Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

জন্মশতবার্ষিকী

তিনি ছিলেন মুক্তমনা মানুষ

Icon

রাশেদ খান মেনন

প্রকাশ: ০৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

তিনি ছিলেন মুক্তমনা মানুষ

বাংলাদেশের প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক আন্দোলনের ইতিহাসে যে কজন ব্যক্তিত্ব বিশিষ্ট স্থান অধিকার করে আছেন, আহমদুল কবির তাদের একজন। আমার ছাত্ররাজনীতির জীবনে তার সঙ্গে পরিচয় চৌষট্টির সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সময়।

সেসময় তিনি তার তোপখানার ব্যবসায়িক অফিসকে ওই সাম্প্রদায়িকতা প্রতিরোধ আন্দোলনের কেন্দ্র হিসাবে ব্যবহার করতে দিয়েছিলেন। ইতোমধ্যে তার পরিচয় জেনেছিলাম মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানীর একজন বিশ্বস্ত ব্যক্তি হিসাবে। পরবর্তী সময়ে তিনি মওলানা ভাসানী গঠিত পূর্ব পাকিস্তান কৃষক সমিতির কোষাধ্যক্ষ হয়েছিলেন।

ঘোড়াশালের বনেদি পরিবারের সন্তানের কৃষক আন্দোলন তথা প্রগতিশীল আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণ আমাদের সেসময় বিশেষ আকর্ষণ করেছিল। পরবর্তী সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররাজনীতিতে তার সদম্ভ পদচারণার কথা জেনেছি। এই ছাত্ররাজনীতির সময় থেকেই তিনি যে অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হন, সেই ধারাতেই তিনি অটল ছিলেন জীবনের শেষদিন পর্যন্ত।

রাজনীতির অভিধানে উদার গণতন্ত্রী বলে যাদের অভিহিত করা হয়, সেই সংজ্ঞায় তাকে সহজেই ফেলা যায়। রাজনীতি ও ব্যক্তিজীবন উভয় ক্ষেত্রে ছিলেন তিনি মুক্তমনা। রাজনীতি ও আদর্শের প্রতি অনুরক্ত হলেও তার বন্ধনে তিনি আবদ্ধ হননি। আর ওই রাজনীতি এগিয়ে নেওয়ার কাজে সর্বত সাহায্য করেছেন।

কবির ভাইয়ের বৈশিষ্ট্য ছিল তার মতো; সেটা অন্যের যতই অপছন্দনীয় হোক, মুখের ওপর সোজাসাপটা বলা। তার যুক্তিও ছিল সরাসরি। কোনো ভন্ডামির ধার ধারতেন না। ফলে তার কথা যদি কেউ গ্রহণও না করত, তারপরও তাকে সহজে বোঝানোর ফলে তার সম্পর্কে বিরূপ ধারণা পোষণ করতে পারত না।

বাংলাদেশের রাজনীতি সম্পর্কে তার ধারণা ছিল স্পষ্ট। এ সম্পর্কে সুস্পষ্ট মতামতও ছিল, যার পরিচয় আমরা পাই দেশের দ্বিতীয় সংসদের সদস্য হিসাবে বাজেটের ওপর তার আলোচনায়। ওই আলোচনায় তিনি পার্লামেন্টারি বাকচাতুরতার আশ্রয় নিতেন না। বস্তুনিষ্ঠ বিশ্লেষণের মাধ্যমে বাজেট ও দেশের রাজনীতি সম্পর্কে তার মতামত তুলে ধরতেন।

‘সংবাদ’-এর সম্পাদকের দায়িত্ব নেওয়ার পর পত্রিকার ব্যবস্থাপনা ও সম্পাদনার ক্ষেত্রেও মুনশিয়ানার পরিচয় দিয়েছেন তিনি। বস্তুত তার হাতে ‘সংবাদ’ এক নতুন মাত্রা পেয়েছিল। অবশ্য ব্যবসায়িক ও রাজনৈতিক ব্যস্ততার কারণে তিনি সেখানে বেশি সময় দিতে পারেননি বলে মনে হয়। তবে ‘সংবাদে’ আধুনিকতার ছোঁয়ার জন্য তাকে কৃতিত্ব দেওয়া যায়।

জীবনের শেষভাগে এসে রাজনীতির সঙ্গেই বিশেষভাবে জড়িয়ে পড়েন তিনি। আগে দেশের প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক আন্দোলনে কিছুটা পেছনে থেকে তার নীতি ও কৌশল নির্ধারণে ভূমিকা পালন করতেন। পরবর্তী সময়ে ‘গণতন্ত্রী পার্টি’র সভাপতির দায়িত্ব গ্রহণ করেন।

এ পর্যায়ে এসে দেশের জাতীয় সম্পদ গ্যাস ও তেল ক্ষেত্রগুলো বিদেশের হাতে তুলে দেওয়া, জাতীয় স্বার্থবিরোধী ও অসম চুক্তি স্বাক্ষর, গ্যাস রপ্তানি প্রভৃতি ক্ষেত্রে উপর্যুপরি সরকারগুলো যেসব পদক্ষেপ গ্রহণ করে, তার বিরুদ্ধে আন্দোলনের প্ল্যাটফরম গড়ে তোলার ক্ষেত্রে তিনি সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন।

গ্যাস-তেল সম্পদ রক্ষার জন্য যে জাতীয় কমিটি পরবর্তী সময়ে ওই আন্দোলন পরিচালনা করে, তার গঠনে বিশেষ ভূমিকা ছিল তার। শাসকগোষ্ঠীর ত্রিদলীয় ধারার বিপরীতে বিকল্প গড়ে তোলার ধারণায় ১১ দলের যে প্ল্যাটফরম গঠিত হয় সেক্ষেত্রেও তার ভূমিকা ছিল অগ্রণী।

বস্তুত তার বাসায় বসেই ১১ দলের যাত্রা শুরু এবং এটা ঠিক হয়েছিল যে, তিনি চিকিৎসা করে ফেরার পর ১১ দলকে আরও সামনে এগিয়ে নিতে তার সঙ্গে বসে আলোচনা ও সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। কিন্তু সেটা আর হতে পারেনি। ১১ দল ২০০১ সালে যে নির্বাচনি মেনিফেস্টো তৈরি করে, সেটা রচনার ক্ষেত্রেও তিনি বিশেষ উদ্যোগী ছিলেন এবং প্রচুর সময় দেন।

এ লেখার শুরুতেই তার সম্পর্কে যে কথা বলা হয়েছে, অর্থাৎ একজন মুক্তমনা অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক ব্যক্তিত্বের সন্ধান পাই আহমদুল কবিরের মধ্যে। তার মৃত্যু যদি কোনো ক্ষেত্রে অশেষ ক্ষতিসাধন করে থাকে তা এই ক্ষেত্রে।

কেবল বিশ্বাস হিসাবে নয়, ব্যাবহারিক ক্ষেত্রেও তিনি তার অসাম্প্রদায়িকতার প্রকাশ দেখিয়েছেন তার নিজের এলাকায় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সুরক্ষা নিশ্চিত করার মধ্য দিয়ে। তার এলাকার সংখ্যালঘু সম্প্রদায় তাকে সত্যিকার অর্থেই অভিভাবক মনে করত। আর রাজনীতি ও সাম্প্রদায়িক ক্ষেত্রে এ অসাম্প্রদায়িক ধারণার ব্যাপারে তিনি ছিলেন আপসহীন।

কবির ভাই চলে গেছেন। তার বয়স হিসাবে এর মধ্যে অস্বাভাবিকতা নেই। তারপরও তার বুদ্ধিবৃত্তিক পরিপক্বতা এদেশের রাজনীতি ও সমাজে যে অবদান রাখতে পারত, তার থেকে দেশের মানুষ নিঃসন্দেহে বঞ্চিত হয়েছে।

কবির ভাইয়ের ‘সংবাদ’-এর সঙ্গে এদেশের প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক আন্দোলনের অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক রয়েছে। ‘সংবাদ’ অঙ্গীকার করেছে, তারা সেই ধারাকে অক্ষুণ্ন রাখবে। দেশের মানুষও আশা রাখে জহুর হোসেন চৌধুরী-আহমদুল কবিররা ‘সংবাদ’-এর জন্য যে পথ রচনা করে গেছেন, তারা সেই পথ অনুসরণ করেই এদেশের মানুষকে তাদের স্বপ্ন পূরণ করতে সাহায্য করবে।

কবির ভাই চলে গেলেও তার ভাবনার প্রতিফলন দেখা যাবে ‘সংবাদ’-এর পাতায়। আর রাজনীতির ক্ষেত্রে তার সহযোদ্ধা হিসাবে আমরা যারা রয়ে গেলাম, তারা যদি বাংলাদেশ ও তার রাজনীতিকে একটি অসাম্প্রদায়িক ধারায় ফিরিয়ে আনতে পারি, একটি গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠা করতে পারি, তাহলে আমাদের পক্ষ থেকে সেটাই হবে তার প্রতি শ্রেষ্ঠ শ্রদ্ধা নিবেদন। (‘আহমদুল কবির স্মারকগ্রন্থ’ থেকে সংকলিত)

রাশেদ খান মেনন : সভাপতি, বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি

তিনি ছিলেন মুক্তমনা মানুষ

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম