এসব কীসের আলামত?
এক-এগারো থেকে শুরু করে পদ্মা সেতু নির্মাণসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে চিহ্নিত কুশীলবদের নানামুখী অপতৎপরতা দেশের জনগণ দুঃখের সঙ্গে প্রত্যক্ষ করেছে।
নিজেদের কুকীর্তি আড়ালের উদ্দেশ্যে দেশ ও বিশ্ববাসীকে বিভ্রান্ত করার নানামুখী তৎপরতা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত পন্থায় দেশকে অস্থিতিশীল করার হীন চক্রান্ত কি না, তা ভেবে দেখা প্রয়োজন।
শিক্ষা-উচ্চশিক্ষা, সরকারি ও বেসরকারি সংস্থার ঊর্ধ্বতন প্রশাসনে প্রতারক-জালিয়াত-দুর্নীতিবাজ ও জঙ্গিবাদের আশ্রয়-প্রশ্রয়ে বর্ণচোরারা পরিস্থিতিকে আরও ঘোলাটে করে কাদের কী এজেন্ডা বাস্তবায়ন করার অপপ্রয়াসে লিপ্ত, এর বস্তুনিষ্ঠ ও নিবিড় তদন্ত আবশ্যক।
মহান বিজয় দিবস-২০২২ উপলক্ষ্যে জাতির উদ্দেশে প্রদত্ত ভাষণে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রাষ্ট্রবিরোধী চক্রান্ত সম্পর্কে জনগণকে সতর্ক করে বলেছিলেন, ‘এখনো এ দেশে একাত্তরের ‘শকুনি’ এবং পঁচাত্তরের হায়েনাদের বংশধররা সক্রিয় আছে। সুযোগ পেলেই তারা দন্ত-নখর বসিয়ে দেশটাকে ক্ষতবিক্ষত করে ফেলে। সাধারণ মানুষ ভালো আছে দেখলে এদের গায়ে জ্বালা ধরে। দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রকারীরা সক্রিয় হয়ে উঠে। জনগণ বয়কট করার পর অগণতান্ত্রিক পন্থায় তারা এখন ক্ষমতায় আসার ষড়যন্ত্র করছে। ২০০৯ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত গণতান্ত্রিক ধারা অব্যাহত আছে। জনগণের ভোটের অধিকার নিশ্চিত রয়েছে। সে কারণেই আজ বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা পেয়েছে।
বিএনপি-জামায়াত জোট ক্ষমতায় থাকলে কোনোদিনই বাংলাদেশ এত উন্নতি করতে পারত না। দেশের মানুষের ওপর আস্থা হারিয়ে বিএনপি-জামায়াত এখন বিদেশিদের কাছে দেশের বদনাম করার জন্য কিছু ভাড়াটিয়া লোক নিয়োগ করেছে। পাচারকৃত অর্থ ব্যবহার করছে আর দেশের বদনাম করে বেড়াচ্ছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘স্বাধীনতার পর থেকে এ দেশে স্বাধীনতাবিরোধী সাম্প্রদায়িক অপশক্তি চক্রান্ত এবং ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। এখনো যুদ্ধাপরাধী, পরাজিত শক্তি এবং ১৫ আগস্টের খুনি, ফাঁসি যাদের হয়েছে তাদের ছেলেপেলে, যুদ্ধাপরাধীদের দোসর এবং বংশধর-তারা কিন্তু বাংলাদেশের বিরুদ্ধে চক্রান্ত, ষড়যন্ত্র চালিয়ে যাচ্ছে। যে আন্তর্জাতিক শক্তি আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে বিরোধিতা করেছিল, তাদের কিছু কিছু এদের মদদ দিয়ে থাকে। কাজেই এ ব্যাপারে জাতিকে সতর্ক থাকতে হবে। পরাজিত শক্তি সবসময়ই এক্ষেত্রে সক্রিয় ছিল।’
ইতোমধ্যে দেশে সংঘটিত বিস্ফোরণ-অগ্নিকাণ্ড, হত্যা, রাস্তা অবরোধসহ বিস্তর অপরাধের সংবাদে দেশবাসী চরমভাবে হতাশাগ্রস্ত। সীতাকুণ্ডসহ দেশের আতঙ্কিত জনপদ হিসাবে খ্যাত বিভিন্ন অঞ্চল, বিশেষ করে শিল্পাঞ্চলে অবকাঠামো নির্মাণ, ফায়ার সার্ভিস-পরিবেশ সুরক্ষা-দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা, জন-অধ্যুষিত এলাকায় কলকারখানা স্থাপনে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের যথাযথ অনুমতি, পর্যাপ্ত পর্যবেক্ষণ কতটুকু কার্যকরভাবে পরিচালিত হচ্ছে, তার নৈর্ব্যক্তিক বিশ্লেষণ, পদক্ষেপ গ্রহণ অধিকতর গুরুত্ব বহন করে। ৪ মার্চ চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড উপজেলার সীমা অক্সিজেন কারখানায় ভয়াবহ বিস্ফোরণে এখন পর্যন্ত অন্তত ৭ জনের মৃত্যু হয়েছে এবং গুরুতর আহত হয়েছে ২৪ জন। বিস্ফোরণে কারখানার আশপাশের অন্তত এক বর্গকিলোমিটার এলাকা প্রচণ্ড কেঁপে ওঠে। প্রায় এক কিলোমিটার পর্যন্ত উড়ে যায় লোহার পাত। গত ৫ মার্চ রাজধানীর সায়েন্সল্যাব এলাকায় একটি বাণিজ্যিক ভবনে বিস্ফোরণে একই প্রতিষ্ঠানের তিনজন কর্মী নিহত হন। এ ঘটনার পরপরই গুলিস্তানের সিদ্দিকবাজারে এক ভবনে বিস্ফোরণে ৮ মার্চ পর্যন্ত ২০ জনের মৃত্যু হয়। আহত হয়েছেন প্রায় ১২০ জন। ৯ মার্চ গণমাধ্যমে প্রকাশিত ফায়ার সার্ভিসের পরিসংখ্যান অনুসারে, ২০২০ থেকে ২০২২ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত ৩৩৪টি এবং ২০২৩ সালের জানুয়ারি থেকে ৮ মার্চ পর্যন্ত ১০টিসহ সারা দেশে সর্বমোট ৩৪৪টি বিস্ফোরণের ঘটনায় ১৩৬ জনের প্রাণহানি হয়েছে। সহস্রাধিক আহতের মধ্যে অনেকেই পঙ্গুত্ব বরণ করেছেন। গত তিন বছরে ঘটা বিস্ফোরণের মধ্যে সবচেয়ে ভয়ানক হচ্ছে ২০১৯ সালে চুড়িহাট্টার বিস্ফোরণে ৭১ জনের, ২০২০ সালের ৪ সেপ্টেম্বর রাতে নারায়ণগঞ্জের বাইতুস সালাম জামে মসজিদে বিস্ফোরণে ইমামসহ ৩৪ জনের, ২০২১ সালের ২৭ জুন রাজধানীর মগবাজারে ১২ জনের এবং ২০২২ সালের ৪ জুন চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের বিএম ডিপোতে ৫১ জনের হৃদয়বিদারক মৃত্যুর ঘটনা।
বিস্ফোরণের পাশাপাশি প্রায় প্রতিদিনই সারা দেশে সংঘটিত অগ্নিকাণ্ডের সংবাদ অবলোকনে দেশের প্রত্যেক নাগরিক নিদারুণ আতঙ্কিত-শঙ্কিত। ৬ জুন ২০২২ সংবাদপত্রে প্রকাশিত ঢাকা মেডিকেলের বার্ন ইউনিটের তথ্য-উপাত্ত পর্যালোচনায় দেখা যায়, সারা দেশে বছরে আনুমানিক ৬ লাখ মানুষ আগুনে পুড়ে হতাহত হয়। আগুনে পুড়ে গড়ে প্রতিদিন বার্ন ইউনিটে চিকিৎসা নিতে আসে ২০ থেকে ২৫ জন। ফায়ার সার্ভিসের তথ্য অনুযায়ী, বিগত ৬ বছরে সারা দেশে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে ৮৮ হাজারের মতো। এতে ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে ২৯ হাজার কোটি টাকারও বেশি। প্রাণহানি হয়েছে ১ হাজার ৪০০ জনের এবং আহত হয়েছেন প্রায় ৫ হাজার মানুষ। বিভিন্ন সময়ে দেশে ঘটা অগ্নিদুর্ঘটনা নিয়ে বার্তা সংস্থা রয়টার্স প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে প্রায়ই নিরাপত্তার নিয়ম লঙ্ঘন করা হয়। বিশেষ করে শিল্প খাতে। ২০০৫ সালের পর থেকে বাংলাদেশে কারখানা ও বিভিন্ন ভবনে অগ্নিকাণ্ডের ফলে শত শত মানুষ প্রাণ হারিয়েছে। ওই প্রতিবেদন মতে, ২০২১ সালের মার্চ মাসে কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্পের অগ্নিকাণ্ডে ১৫ জন নিহতের পাশাপাশি ৫৫০ জন আহত, জুলাই মাসে নারায়ণগঞ্জের জুস কারাখানার ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে ৫২ জন নিহত ও ২০ জন আহত এবং ডিসেম্বর মাসে সুগন্ধা নদীতে বরগুনাগামী একটি লঞ্চে আগুন লেগে অন্তত ৩৮ জনের মৃত্যু হয়। এছাড়াও পূর্ববর্তী বছরগুলোর আলোচিত অনেক অগ্নিকাণ্ডে হতাহতের পরিসংখ্যানও প্রতিবেদনে সন্নিবেশিত হয়েছে।
অত্যধিক প্রকাশ পাওয়া এসব ঘটনা ছাড়াও প্রতিনিয়ত ছোটখাটো অনেক বিস্ফোরণ-অগ্নিকাণ্ডে হতাহতের সংখ্যা দীর্ঘায়িত এবং ভুক্তভোগীদের শরীরের অঙ্গহানি হয়ে মানবেতর জীবনযাপনের অসহনীয় দৃশ্যপট তৈরি করছে। বিশেষজ্ঞদের অভিযোগ, এত মৃত্যু সত্ত্বেও কারখানার নিরাপত্তা নিশ্চিতে মালিকপক্ষের গাফিলতি দৃশ্যমান। কর্তৃপক্ষের সচেতনতা নিয়েও আছে নানা প্রশ্ন। সীতাকুণ্ডের বিস্ফোরণের ঘটনা তদন্তে গঠিত কমিটির বিশেষজ্ঞ সদস্য গণমাধ্যমে বলেছেন, ‘যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে সীতাকুণ্ডের বিস্ফোরণটি অনিবার্য ছিল। ওই দিন দুর্ঘটনা না ঘটলেও দুই দিন আগে-পরে হতোই। অক্সিজেন প্ল্যান্টটিতে অতিরিক্ত গ্যাসের চাপ নিয়ন্ত্রণের সেফটি ভাল্ব দীর্ঘদিন ধরেই কাজ করছিল না। কিন্তু প্ল্যান্টটিতে দায়িত্বরত ব্যক্তিরা বিষয়টি বুঝতে পারেনি বিধায় এ বিস্ফোরণ ঘটেছে।’ তদন্তে আরও জানা যায়, কারখানাটির যন্ত্রাংশের মেইনটেন্যান্সও দীর্ঘদিন ধরে হয়নি। এ বিস্ফোরণের পর সরকারি সংস্থাগুলোর তদারকির ঘাটতি থাকার বিষয়টি আবারও জনসম্মুখে প্রকাশ পেয়েছে। কারখানাটির বিস্ফোরক লাইসেন্স হালনাগাদ রয়েছে কি না, তা ২৪ ঘণ্টা অতিবাহিত হলেও জানতে পারেনি বিস্ফোরক অধিদপ্তর।
অতীতে সংঘটিত বহু দুর্ঘটনার তদন্ত প্রক্রিয়া এখনো শেষ হয়নি। যেসব ঘটনার তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশ পেয়েছে, তাতে বিস্ফোরণের জন্য মূলত ভবন বা প্রতিষ্ঠানের মালিককে দায়ী করা হয়েছে। তদন্তে শিল্পকারখানার বিস্ফোরণ ছাড়া অন্যান্য দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে জমে থাকা গ্যাস বিস্ফোরণের কারণ হিসাবে প্রতীয়মান। এছাড়াও তদন্তে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের অবহেলার বিষয়টি প্রকাশ্যে এলেও তাদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক কোনো ব্যবস্থা নেওয়ার নজির নেই। সরকারের পক্ষ থেকে দুর্ঘটনায় মৃত ও ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের আর্থিক সুবিধা, হাসপাতাল সুবিধা এবং বিভিন্ন প্রণোদনামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হলেও আগে থেকেই দুর্ঘটনা কবলিত অঞ্চলের সার্বিক নিরাপত্তার বিষয়টি অবশ্যই সুনিশ্চিত করতে হবে।
সংঘটিত প্রতিটি ঘটনার পর ফায়ার সার্ভিস কর্তৃক স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে দাখিল করা তদন্ত প্রতিবেদনের সুপারিশ এবং মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা অনুসরণে তেমন কোনো কার্যকর পদক্ষেপ দৃষ্টিগোচর নয়। নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লায় মসজিদের বিস্ফোরণের কারণ উদ্ঘাটন করে তদন্ত সংস্থা সিআইডি জানিয়েছিল, মসজিদের নিচ দিয়ে নেওয়া অবৈধ গ্যাস লাইনের লিকেজ দিয়ে বের হওয়া গ্যাসের ওপর বিদ্যুতের স্পার্ক পড়তেই বিস্ফোরণ ঘটেছে। ঢাকার সাইন্সল্যাবের ঘটনায়ও পুলিশের বোমা নিষ্ক্রিয়কারী দল ভবনটি পরিদর্শন করে জমে থাকা গ্যাসের সম্পৃক্ততা পেয়েছে। এ ঘটনার সঙ্গে মিল রয়েছে মগবাজারের বিস্ফোরণেরও। দেশের খ্যাতিমান প্রকৌশলীদের মতে, এ দুর্ঘটনাগুলোর জন্য ভবন মালিকের চেয়ে সরকারি সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোই বেশি দায়ী। একটা বিল্ডিং নির্মিত হওয়ার পর পাঁচ বছর অন্তর সবকিছু ঠিকঠাক আছে কিনা তা পরিদর্শন করে যে প্রতিবেদন তৈরি করতে হয়, সেটি হচ্ছে না। উপরন্তু রাজউক-সিডিএ-সংশ্লিষ্ট সংস্থা বা ফায়ার সার্ভিস-বিদ্যুৎ-গ্যাস ইত্যাদির ক্ষেত্রেও বিল্ডিং নির্মাণের সময় পরিদর্শন ছাড়াই অনৈতিক লেনদেনে লাইসেন্স দেওয়ার বিপুল অভিযোগ রয়েছে। ঢাকা শহরের ৬ লাখ বিল্ডিংয়ের অধিকাংশ এভাবেই তৈরি। যতদিন না সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো এ অবস্থা থেকে বের না হবে, ততদিন পরিস্থিতির উন্নতির আশা করা উচিত হবে না।
সাম্প্রতিক ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো পর্যবেক্ষণে জনমনে গভীর সংশয়-সন্দেহের ডালপালা বিস্তার করছে। এ ধরনের ঘটনার সঙ্গে নাশকতা, অগ্নিসন্ত্রাস, জঙ্গিবাদ, বিকৃত মানসিকতার ফলস্বরূপ দেশকে অস্থিতিশীল করার পরিকল্পনা বাস্তবায়নে মহড়া প্রদর্শনের যোগসূত্র রয়েছে কিনা, তারও নিবিড় অনুসন্ধান জরুরি। সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে সমাধানে দ্রুততর কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণে ব্যর্থ হলে অপরাধীদের হীন অপচেষ্টা-অপকৌশল দেশকে পর্যুদস্ত করার সমূহ আশঙ্কা রয়েছে।
ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী : শিক্ষাবিদ; সাবেক উপাচার্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
সম্পাদক : সাইফুল আলম, প্রকাশক : সালমা ইসলাম
প্রকাশক কর্তৃক ক-২৪৪ প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড), বারিধারা, ঢাকা-১২২৯ থেকে প্রকাশিত এবং যমুনা প্রিন্টিং এন্ড পাবলিশিং লিঃ থেকে মুদ্রিত।
পিএবিএক্স : ৯৮২৪০৫৪-৬১, রিপোর্টিং : ৯৮২৩০৭৩, বিজ্ঞাপন : ৯৮২৪০৬২, ফ্যাক্স : ৯৮২৪০৬৩, সার্কুলেশন : ৯৮২৪০৭২। ফ্যাক্স : ৯৮২৪০৬৬
E-mail: jugantor.mail@gmail.com
© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত
এসব কীসের আলামত?
এক-এগারো থেকে শুরু করে পদ্মা সেতু নির্মাণসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে চিহ্নিত কুশীলবদের নানামুখী অপতৎপরতা দেশের জনগণ দুঃখের সঙ্গে প্রত্যক্ষ করেছে।
নিজেদের কুকীর্তি আড়ালের উদ্দেশ্যে দেশ ও বিশ্ববাসীকে বিভ্রান্ত করার নানামুখী তৎপরতা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত পন্থায় দেশকে অস্থিতিশীল করার হীন চক্রান্ত কি না, তা ভেবে দেখা প্রয়োজন।
শিক্ষা-উচ্চশিক্ষা, সরকারি ও বেসরকারি সংস্থার ঊর্ধ্বতন প্রশাসনে প্রতারক-জালিয়াত-দুর্নীতিবাজ ও জঙ্গিবাদের আশ্রয়-প্রশ্রয়ে বর্ণচোরারা পরিস্থিতিকে আরও ঘোলাটে করে কাদের কী এজেন্ডা বাস্তবায়ন করার অপপ্রয়াসে লিপ্ত, এর বস্তুনিষ্ঠ ও নিবিড় তদন্ত আবশ্যক।
মহান বিজয় দিবস-২০২২ উপলক্ষ্যে জাতির উদ্দেশে প্রদত্ত ভাষণে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রাষ্ট্রবিরোধী চক্রান্ত সম্পর্কে জনগণকে সতর্ক করে বলেছিলেন, ‘এখনো এ দেশে একাত্তরের ‘শকুনি’ এবং পঁচাত্তরের হায়েনাদের বংশধররা সক্রিয় আছে। সুযোগ পেলেই তারা দন্ত-নখর বসিয়ে দেশটাকে ক্ষতবিক্ষত করে ফেলে। সাধারণ মানুষ ভালো আছে দেখলে এদের গায়ে জ্বালা ধরে। দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রকারীরা সক্রিয় হয়ে উঠে। জনগণ বয়কট করার পর অগণতান্ত্রিক পন্থায় তারা এখন ক্ষমতায় আসার ষড়যন্ত্র করছে। ২০০৯ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত গণতান্ত্রিক ধারা অব্যাহত আছে। জনগণের ভোটের অধিকার নিশ্চিত রয়েছে। সে কারণেই আজ বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা পেয়েছে।
বিএনপি-জামায়াত জোট ক্ষমতায় থাকলে কোনোদিনই বাংলাদেশ এত উন্নতি করতে পারত না। দেশের মানুষের ওপর আস্থা হারিয়ে বিএনপি-জামায়াত এখন বিদেশিদের কাছে দেশের বদনাম করার জন্য কিছু ভাড়াটিয়া লোক নিয়োগ করেছে। পাচারকৃত অর্থ ব্যবহার করছে আর দেশের বদনাম করে বেড়াচ্ছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘স্বাধীনতার পর থেকে এ দেশে স্বাধীনতাবিরোধী সাম্প্রদায়িক অপশক্তি চক্রান্ত এবং ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। এখনো যুদ্ধাপরাধী, পরাজিত শক্তি এবং ১৫ আগস্টের খুনি, ফাঁসি যাদের হয়েছে তাদের ছেলেপেলে, যুদ্ধাপরাধীদের দোসর এবং বংশধর-তারা কিন্তু বাংলাদেশের বিরুদ্ধে চক্রান্ত, ষড়যন্ত্র চালিয়ে যাচ্ছে। যে আন্তর্জাতিক শক্তি আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে বিরোধিতা করেছিল, তাদের কিছু কিছু এদের মদদ দিয়ে থাকে। কাজেই এ ব্যাপারে জাতিকে সতর্ক থাকতে হবে। পরাজিত শক্তি সবসময়ই এক্ষেত্রে সক্রিয় ছিল।’
ইতোমধ্যে দেশে সংঘটিত বিস্ফোরণ-অগ্নিকাণ্ড, হত্যা, রাস্তা অবরোধসহ বিস্তর অপরাধের সংবাদে দেশবাসী চরমভাবে হতাশাগ্রস্ত। সীতাকুণ্ডসহ দেশের আতঙ্কিত জনপদ হিসাবে খ্যাত বিভিন্ন অঞ্চল, বিশেষ করে শিল্পাঞ্চলে অবকাঠামো নির্মাণ, ফায়ার সার্ভিস-পরিবেশ সুরক্ষা-দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা, জন-অধ্যুষিত এলাকায় কলকারখানা স্থাপনে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের যথাযথ অনুমতি, পর্যাপ্ত পর্যবেক্ষণ কতটুকু কার্যকরভাবে পরিচালিত হচ্ছে, তার নৈর্ব্যক্তিক বিশ্লেষণ, পদক্ষেপ গ্রহণ অধিকতর গুরুত্ব বহন করে। ৪ মার্চ চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড উপজেলার সীমা অক্সিজেন কারখানায় ভয়াবহ বিস্ফোরণে এখন পর্যন্ত অন্তত ৭ জনের মৃত্যু হয়েছে এবং গুরুতর আহত হয়েছে ২৪ জন। বিস্ফোরণে কারখানার আশপাশের অন্তত এক বর্গকিলোমিটার এলাকা প্রচণ্ড কেঁপে ওঠে। প্রায় এক কিলোমিটার পর্যন্ত উড়ে যায় লোহার পাত। গত ৫ মার্চ রাজধানীর সায়েন্সল্যাব এলাকায় একটি বাণিজ্যিক ভবনে বিস্ফোরণে একই প্রতিষ্ঠানের তিনজন কর্মী নিহত হন। এ ঘটনার পরপরই গুলিস্তানের সিদ্দিকবাজারে এক ভবনে বিস্ফোরণে ৮ মার্চ পর্যন্ত ২০ জনের মৃত্যু হয়। আহত হয়েছেন প্রায় ১২০ জন। ৯ মার্চ গণমাধ্যমে প্রকাশিত ফায়ার সার্ভিসের পরিসংখ্যান অনুসারে, ২০২০ থেকে ২০২২ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত ৩৩৪টি এবং ২০২৩ সালের জানুয়ারি থেকে ৮ মার্চ পর্যন্ত ১০টিসহ সারা দেশে সর্বমোট ৩৪৪টি বিস্ফোরণের ঘটনায় ১৩৬ জনের প্রাণহানি হয়েছে। সহস্রাধিক আহতের মধ্যে অনেকেই পঙ্গুত্ব বরণ করেছেন। গত তিন বছরে ঘটা বিস্ফোরণের মধ্যে সবচেয়ে ভয়ানক হচ্ছে ২০১৯ সালে চুড়িহাট্টার বিস্ফোরণে ৭১ জনের, ২০২০ সালের ৪ সেপ্টেম্বর রাতে নারায়ণগঞ্জের বাইতুস সালাম জামে মসজিদে বিস্ফোরণে ইমামসহ ৩৪ জনের, ২০২১ সালের ২৭ জুন রাজধানীর মগবাজারে ১২ জনের এবং ২০২২ সালের ৪ জুন চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের বিএম ডিপোতে ৫১ জনের হৃদয়বিদারক মৃত্যুর ঘটনা।
বিস্ফোরণের পাশাপাশি প্রায় প্রতিদিনই সারা দেশে সংঘটিত অগ্নিকাণ্ডের সংবাদ অবলোকনে দেশের প্রত্যেক নাগরিক নিদারুণ আতঙ্কিত-শঙ্কিত। ৬ জুন ২০২২ সংবাদপত্রে প্রকাশিত ঢাকা মেডিকেলের বার্ন ইউনিটের তথ্য-উপাত্ত পর্যালোচনায় দেখা যায়, সারা দেশে বছরে আনুমানিক ৬ লাখ মানুষ আগুনে পুড়ে হতাহত হয়। আগুনে পুড়ে গড়ে প্রতিদিন বার্ন ইউনিটে চিকিৎসা নিতে আসে ২০ থেকে ২৫ জন। ফায়ার সার্ভিসের তথ্য অনুযায়ী, বিগত ৬ বছরে সারা দেশে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে ৮৮ হাজারের মতো। এতে ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে ২৯ হাজার কোটি টাকারও বেশি। প্রাণহানি হয়েছে ১ হাজার ৪০০ জনের এবং আহত হয়েছেন প্রায় ৫ হাজার মানুষ। বিভিন্ন সময়ে দেশে ঘটা অগ্নিদুর্ঘটনা নিয়ে বার্তা সংস্থা রয়টার্স প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে প্রায়ই নিরাপত্তার নিয়ম লঙ্ঘন করা হয়। বিশেষ করে শিল্প খাতে। ২০০৫ সালের পর থেকে বাংলাদেশে কারখানা ও বিভিন্ন ভবনে অগ্নিকাণ্ডের ফলে শত শত মানুষ প্রাণ হারিয়েছে। ওই প্রতিবেদন মতে, ২০২১ সালের মার্চ মাসে কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্পের অগ্নিকাণ্ডে ১৫ জন নিহতের পাশাপাশি ৫৫০ জন আহত, জুলাই মাসে নারায়ণগঞ্জের জুস কারাখানার ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে ৫২ জন নিহত ও ২০ জন আহত এবং ডিসেম্বর মাসে সুগন্ধা নদীতে বরগুনাগামী একটি লঞ্চে আগুন লেগে অন্তত ৩৮ জনের মৃত্যু হয়। এছাড়াও পূর্ববর্তী বছরগুলোর আলোচিত অনেক অগ্নিকাণ্ডে হতাহতের পরিসংখ্যানও প্রতিবেদনে সন্নিবেশিত হয়েছে।
অত্যধিক প্রকাশ পাওয়া এসব ঘটনা ছাড়াও প্রতিনিয়ত ছোটখাটো অনেক বিস্ফোরণ-অগ্নিকাণ্ডে হতাহতের সংখ্যা দীর্ঘায়িত এবং ভুক্তভোগীদের শরীরের অঙ্গহানি হয়ে মানবেতর জীবনযাপনের অসহনীয় দৃশ্যপট তৈরি করছে। বিশেষজ্ঞদের অভিযোগ, এত মৃত্যু সত্ত্বেও কারখানার নিরাপত্তা নিশ্চিতে মালিকপক্ষের গাফিলতি দৃশ্যমান। কর্তৃপক্ষের সচেতনতা নিয়েও আছে নানা প্রশ্ন। সীতাকুণ্ডের বিস্ফোরণের ঘটনা তদন্তে গঠিত কমিটির বিশেষজ্ঞ সদস্য গণমাধ্যমে বলেছেন, ‘যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে সীতাকুণ্ডের বিস্ফোরণটি অনিবার্য ছিল। ওই দিন দুর্ঘটনা না ঘটলেও দুই দিন আগে-পরে হতোই। অক্সিজেন প্ল্যান্টটিতে অতিরিক্ত গ্যাসের চাপ নিয়ন্ত্রণের সেফটি ভাল্ব দীর্ঘদিন ধরেই কাজ করছিল না। কিন্তু প্ল্যান্টটিতে দায়িত্বরত ব্যক্তিরা বিষয়টি বুঝতে পারেনি বিধায় এ বিস্ফোরণ ঘটেছে।’ তদন্তে আরও জানা যায়, কারখানাটির যন্ত্রাংশের মেইনটেন্যান্সও দীর্ঘদিন ধরে হয়নি। এ বিস্ফোরণের পর সরকারি সংস্থাগুলোর তদারকির ঘাটতি থাকার বিষয়টি আবারও জনসম্মুখে প্রকাশ পেয়েছে। কারখানাটির বিস্ফোরক লাইসেন্স হালনাগাদ রয়েছে কি না, তা ২৪ ঘণ্টা অতিবাহিত হলেও জানতে পারেনি বিস্ফোরক অধিদপ্তর।
অতীতে সংঘটিত বহু দুর্ঘটনার তদন্ত প্রক্রিয়া এখনো শেষ হয়নি। যেসব ঘটনার তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশ পেয়েছে, তাতে বিস্ফোরণের জন্য মূলত ভবন বা প্রতিষ্ঠানের মালিককে দায়ী করা হয়েছে। তদন্তে শিল্পকারখানার বিস্ফোরণ ছাড়া অন্যান্য দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে জমে থাকা গ্যাস বিস্ফোরণের কারণ হিসাবে প্রতীয়মান। এছাড়াও তদন্তে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের অবহেলার বিষয়টি প্রকাশ্যে এলেও তাদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক কোনো ব্যবস্থা নেওয়ার নজির নেই। সরকারের পক্ষ থেকে দুর্ঘটনায় মৃত ও ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের আর্থিক সুবিধা, হাসপাতাল সুবিধা এবং বিভিন্ন প্রণোদনামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হলেও আগে থেকেই দুর্ঘটনা কবলিত অঞ্চলের সার্বিক নিরাপত্তার বিষয়টি অবশ্যই সুনিশ্চিত করতে হবে।
সংঘটিত প্রতিটি ঘটনার পর ফায়ার সার্ভিস কর্তৃক স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে দাখিল করা তদন্ত প্রতিবেদনের সুপারিশ এবং মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা অনুসরণে তেমন কোনো কার্যকর পদক্ষেপ দৃষ্টিগোচর নয়। নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লায় মসজিদের বিস্ফোরণের কারণ উদ্ঘাটন করে তদন্ত সংস্থা সিআইডি জানিয়েছিল, মসজিদের নিচ দিয়ে নেওয়া অবৈধ গ্যাস লাইনের লিকেজ দিয়ে বের হওয়া গ্যাসের ওপর বিদ্যুতের স্পার্ক পড়তেই বিস্ফোরণ ঘটেছে। ঢাকার সাইন্সল্যাবের ঘটনায়ও পুলিশের বোমা নিষ্ক্রিয়কারী দল ভবনটি পরিদর্শন করে জমে থাকা গ্যাসের সম্পৃক্ততা পেয়েছে। এ ঘটনার সঙ্গে মিল রয়েছে মগবাজারের বিস্ফোরণেরও। দেশের খ্যাতিমান প্রকৌশলীদের মতে, এ দুর্ঘটনাগুলোর জন্য ভবন মালিকের চেয়ে সরকারি সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোই বেশি দায়ী। একটা বিল্ডিং নির্মিত হওয়ার পর পাঁচ বছর অন্তর সবকিছু ঠিকঠাক আছে কিনা তা পরিদর্শন করে যে প্রতিবেদন তৈরি করতে হয়, সেটি হচ্ছে না। উপরন্তু রাজউক-সিডিএ-সংশ্লিষ্ট সংস্থা বা ফায়ার সার্ভিস-বিদ্যুৎ-গ্যাস ইত্যাদির ক্ষেত্রেও বিল্ডিং নির্মাণের সময় পরিদর্শন ছাড়াই অনৈতিক লেনদেনে লাইসেন্স দেওয়ার বিপুল অভিযোগ রয়েছে। ঢাকা শহরের ৬ লাখ বিল্ডিংয়ের অধিকাংশ এভাবেই তৈরি। যতদিন না সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো এ অবস্থা থেকে বের না হবে, ততদিন পরিস্থিতির উন্নতির আশা করা উচিত হবে না।
সাম্প্রতিক ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো পর্যবেক্ষণে জনমনে গভীর সংশয়-সন্দেহের ডালপালা বিস্তার করছে। এ ধরনের ঘটনার সঙ্গে নাশকতা, অগ্নিসন্ত্রাস, জঙ্গিবাদ, বিকৃত মানসিকতার ফলস্বরূপ দেশকে অস্থিতিশীল করার পরিকল্পনা বাস্তবায়নে মহড়া প্রদর্শনের যোগসূত্র রয়েছে কিনা, তারও নিবিড় অনুসন্ধান জরুরি। সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে সমাধানে দ্রুততর কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণে ব্যর্থ হলে অপরাধীদের হীন অপচেষ্টা-অপকৌশল দেশকে পর্যুদস্ত করার সমূহ আশঙ্কা রয়েছে।
ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী : শিক্ষাবিদ; সাবেক উপাচার্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়