ক্রেতাদের দেওয়া সব ভ্যাট কি রাষ্ট্রীয় কোষাগারে যাচ্ছে?
jugantor
ক্রেতাদের দেওয়া সব ভ্যাট কি রাষ্ট্রীয় কোষাগারে যাচ্ছে?

  ড. কুদরাত-ই-খুদা বাবু  

১৮ মার্চ ২০২৩, ০০:০০:০০  |  প্রিন্ট সংস্করণ

সাধারণত বিভিন্ন পণ্যের ওপর যে ট্যাক্স আরোপ করা হয়, তাকে ভ্যাট বা মূল্য সংযোজন কর বলে। মূল্য সংযোজন কর বিংশ শতাব্দীতে উদ্ভাবিত একটি আধুনিক কর, যা যে কোনো ব্যবসায়ের মাধ্যমে সৃষ্ট মূল্য সংযোজনের ওপর আরোপ করা হয়ে থাকে। দেশীয় পণ্য উৎপাদন, বিপণন ও বিক্রয়, বিদেশি পণ্য আমদানি ও রপ্তানি, দেশাভ্যন্তরে সেবা বা পরিষেবার উৎপাদন, বিপণন ও বিক্রয় ইত্যাদি সব ক্ষেত্রে এ কর আরোপযোগ্য।

এ কর উৎপাদন থেকে খুচরা বিক্রয় পর্যন্ত বিভিন্ন স্তরে আরোপ ও আদায় করা হলেও এর দায়ভার চূড়ান্তভাবে কেবল পণ্য বা সেবার ভোক্তাকে বহন করতে হয়। একজন ভ্যাট গ্রাহকের বা ভোক্তার দায়িত্ব হলো, কোনো পণ্য ক্রয় করে বিক্রেতার কাছ থেকে ক্রয় রসিদ সংগ্রহ করা। কারণ, যদি ভোক্তা মূসক চালান গ্রহণ করেন, তবে এটা নিশ্চিত হয় যে ভোক্তার প্রদেয় ভ্যাট সরকারি কোষাগারে জমা হয়েছে।

কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, আমাদের দেশে ক্রেতাদের কাছ থেকে কড়ায়-গন্ডায় ভ্যাট আদায় করা হলেও ওই ভ্যাট সরকারি কোষাগারে জমা না দিয়ে নিজেদের পকেটেই রেখে দিচ্ছেন একশ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী। আর এ ধরনের প্রতারণা বা হোয়াইট কলার ক্রাইমের কারণে সরকার শত শত কোটি টাকার ভ্যাটপ্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। এতে দেশের সার্বিক উন্নয়ন ও অগ্রগতি বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।

মূল্য সংযোজন কর (মূসক) সরকারের কর রাজস্বের অন্যতম প্রধান উৎস। বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ইতঃপূর্বে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) ভ্যাট নিরীক্ষা গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর অভিযান চালিয়ে প্রায় ৮০০ রাজস্ব ফাঁকিবাজ প্রতিষ্ঠানকে চিহ্নিত করে। এসব প্রতিষ্ঠান সাধারণ ক্রেতাদের কাছ থেকে পণ্যের মূল্যের সঙ্গে প্রায় এক হাজার ৬৭ কোটি টাকা ভ্যাট আদায় করেছে; অথচ তা সরকারের কোষাগারে জমা দেয়নি।

প্রতিষ্ঠানগুলোর কোনো কোনোটির ভ্যাট ফাঁকির পরিমাণ ১০০ কোটি টাকার ওপরে, যা রীতিমতো বিস্ময়কর। অন্যদিকে দেখা যায়, দেশের অনেক চালু শপিংমল সারা বছর রমরমা বেচাকেনা করলেও ভ্যাট নিবন্ধনই নেয় না। অথচ, এসব প্রতিষ্ঠান পণ্যের মূল্যের সঙ্গে হিসাব কষে ক্রেতাদের কাছ থেকে ভ্যাট ঠিকই আদায় করে থাকে। এসব ভ্যাট সরকারি কোষাগারে জমা হলে তা দেশের সার্বিক উন্নয়ন ও অগ্রগতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারত।

আইন অনুযায়ী, যদি মূল্য সংযোজন কর আইনের অধীনে কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান বা ওই আইনের অধীনে মূসক উৎসে কর্তনের দায়িত্বপ্রাপ্ত কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান যে কোনো উপায়ে মূল্য সংযোজন কর বা ভ্যাট ফাঁকি দেন, অথবা কর ফাঁকি প্রদানে সহায়তা করেন, অথবা মূল্য সংযোজন কর আইন, ১৯৯১-এর যে কোনো ধারা বা মূল্য সংযোজন কর বিধিমালা, ১৯৯১-এর যে কোনো বিধি বা জাতীয় রাজস্ব বোর্ড প্রণীত অন্য কোনো বিধিমালা বা আদেশ বা অন্য কোনো মূসক দপ্তরের আদেশ লঙ্ঘন বা ভঙ্গ করেন, তবে তা মূল্য সংযোজন কর আইনের অধীনে অপরাধ হিসাবে গণ্য করা হয়।

কোনো ব্যক্তি কর ফাঁকি বা আইনের কোনো ধারা, কোনো বিধি বা কোনো আদেশ ভঙের দায়ে অভিযুক্ত হলে তার বিরুদ্ধে অপরাধের ধরন অনুযায়ী নিুলিখিত এক বা একাধিক শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের বিধান মূল্য সংযোজন কর আইনে রয়েছে; যেমন-১. পণ্য বা সেবা আটক ও বাজেয়াপ্ত; ২. জরিমানা আরোপ; ৩. অপরিশোধিত করের ওপর সুদ আদায়; ৪. সংশ্লিষ্ট ব্যবসায় অঙ্গন তালাবদ্ধকরণ; ৫. মূসক নিবন্ধন বাতিলকরণ; ৬. অবৈধ রেয়াত বাতিল বা সমন্বয়করণ; ৭. গ্রেফতার করা ও কারাদণ্ড প্রদান; ৮. সম্পত্তি অবরুদ্ধকরণ, ক্রোক, বাজেয়াপ্তকরণ প্রভৃতি। উল্লেখ্য, কর ফাঁকির ক্ষেত্রে এসব শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ সত্ত্বেও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে ফাঁকিকৃত কর পরিশোধ করতে হয়।

এনবিআর-এর মূসক নিরীক্ষা ও গোয়েন্দা কর্তৃক অনুসন্ধানে জানা যায়, দেশে বড় মাপের অনেক অসাধু ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানই বেশি ভ্যাট ফাঁকি দিচ্ছে। এসব প্রতিষ্ঠান ক্রেতার কাছ থেকে পণ্যের মূল্যের সঙ্গেই ভ্যাট আদায় করে; অথচ তা সরকারি কোষাগারে জমা না দিয়ে নিজেদের কাছে রেখে দিচ্ছে; যা রীতিমতো অন্যায়, ক্রেতাদের সঙ্গে প্রতারণা ও শাস্তিযোগ্য অপরাধ। এ ক্ষেত্রে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোর বেশির ভাগই ইসিআর মেশিন বা ইলেকট্রনিক ফিসক্যাল ডিভাইস (ইএফডি) মেশিন ব্যবহার করে।

বলা বাহুল্য, কোনো বিক্রির তথ্য এসব মেশিনে না দিলে এর কোনো প্রমাণ থাকে না। ভ্যাট ফাঁকিবাজ প্রতিষ্ঠান বিক্রির তথ্য মেশিনে না দিয়ে তথ্য গোপন করে ভ্যাট ফাঁকি দেয়। ক্রেতা যদি বিক্রেতাকে রসিদ দিতে বাধ্য করে, তবে মেশিনে প্রমাণ থাকবে এবং যা এনবিআর-এর তদন্তে ধরা পড়বে। জনগণের কাছ থেকে ভ্যাট আদায় করেও শেষ পর্যন্ত তা সরকারি কোষাগারে জমা না দিয়ে প্রকারন্তরে ক্রেতাদের আমানতের খেয়ানত করছে এসব অসাধু ব্যবসায়ী। আর এ ধরনের অসাধু ও ফাঁকিবাজ ব্যবসায়ীদের কারণে সরকার হাজার হাজার কোটি টাকার রাজস্বপ্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।

ভ্যাট ফাঁকিবাজ ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানের বেশির ভাগই দুই ধরনের হিসাব রাখে। অনেকে ভ্যাট ফাঁকি দিতে আয়-ব্যয়, বিক্রি ও মুনাফার মিথ্যা তথ্য দিয়ে কম ভ্যাট পরিশোধ করে রিটার্ন জমা দেয়। অনেক সময় এনবিআর কর্মকর্তারা ওইসব প্রতিষ্ঠানে অভিযানে গেলে তারা এসব মিথ্যা হিসাব দেখিয়ে থাকে। একই ব্যবসা প্রতিষ্ঠান নিজেদের সুবিধার জন্য গোপনে প্রকৃত আয়-ব্যয়, বিক্রি মুনাফা ও ভ্যাট পরিশোধের তথ্য সংরক্ষণ করে।

প্রকৃত হিসাবের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের কাঁচামাল আমদানি ও ব্যাংকিং লেনদেনের তথ্যের মিল থাকে। বলা বাহুল্য, সারা দেশে ভ্যাট প্রদানে সক্ষম বিক্রয়কেন্দ্র ৫০ লক্ষাধিক। অথচ এনবিআর-এ ভ্যাট নিবন্ধিত বিক্রয়কেন্দ্রের সংখ্যা ৭ লাখ ৫০ হাজার। এর মধ্যে মাত্র ৩০ থেকে ৩২ হাজার প্রতিষ্ঠান ভ্যাট রিটার্ন দাখিল করে। আর মোট ভ্যাট আদায়ের ৫৬ শতাংশই পরিশোধ করে ১৩০ থেকে ১৫০টি প্রতিষ্ঠান।

এ কথা সত্য, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডে (এনবিআর) লোকবলের অভাব আছে। লোকবলের অভাবে এনবিআর-এর পক্ষে সব প্রতিষ্ঠানের ভ্যাট ফাঁকির তথ্য খতিয়ে দেখা সম্ভব হয় না। এ কারণে সব প্রতিষ্ঠানে গিয়ে ভ্যাটের তথ্য যাচাই করাও সম্ভব হয় না। আবার অনেক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান এনবিআর-এর অসাধু কর্মকর্তাদের অনৈতিক সুবিধা দিয়েও ভ্যাট ফাঁকির তথ্য গোপন করার সুযোগ পেয়ে থাকে, যা বন্ধ করা প্রয়োজন। অসাধু ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও কতিপয় অসাধু এনবিআর কর্মকর্তা-এ দুই ক্ষেত্রেই সরকারের নজরদারি বাড়াতে হবে।

পাশাপাশি ভ্যাট আদায়ের সার্বিক কার্যক্রম সর্বদা সচল ও গতিশীল রাখতে এবং দেশের উন্নয়ন-অগ্রগতির ধারা সক্রিয় রাখতে অবিলম্বে এনবিআর-এ সৎ, দক্ষ ও যোগ্য জনবল নিয়োগ করা প্রয়োজন। আশার কথা, ভ্যাট গোয়েন্দারা ভ্যাট ফাঁকি বন্ধে আগের চেয়ে অভিযান বাড়িয়েছেন এবং সারা দেশেই এ অভিযান চলছে। পাশাপাশি ভ্যাট ফাঁকি বন্ধে এনবিআর ম্যানুয়াল পদ্ধতি বাতিল করে অনলাইনে গেছে। ভ্যাট প্রদানে সক্ষম সব প্রতিষ্ঠানকে অনলাইনে ভ্যাট নিবন্ধন গ্রহণের নির্দেশনা দেওয়া নিঃসন্দেহে প্রশংসার দাবি রাখে। প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়িয়ে ভবিষ্যতে ভ্যাটযোগ্য সব প্রতিষ্ঠানকে নজরদারিতে আনতে হবে। সবাইকে মনে রাখতে হবে, এ দেশ আমার, আপনার, সবার। রাষ্ট্রীয়

আইন প্রতিপালনকল্পে কর প্রদান করা একজন নাগরিকের নৈতিক দায়িত্ব। আর করের অর্থ ছাড়া আমাদের প্রিয় এ দেশটির কোনোভাবেই সার্বিক উন্নয়ন ঘটান সম্ভব নয়।

ড. কুদরাত-ই-খুদা বাবু : অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি

kekbabu@yahoo.com

ক্রেতাদের দেওয়া সব ভ্যাট কি রাষ্ট্রীয় কোষাগারে যাচ্ছে?

 ড. কুদরাত-ই-খুদা বাবু 
১৮ মার্চ ২০২৩, ১২:০০ এএম  |  প্রিন্ট সংস্করণ

সাধারণত বিভিন্ন পণ্যের ওপর যে ট্যাক্স আরোপ করা হয়, তাকে ভ্যাট বা মূল্য সংযোজন কর বলে। মূল্য সংযোজন কর বিংশ শতাব্দীতে উদ্ভাবিত একটি আধুনিক কর, যা যে কোনো ব্যবসায়ের মাধ্যমে সৃষ্ট মূল্য সংযোজনের ওপর আরোপ করা হয়ে থাকে। দেশীয় পণ্য উৎপাদন, বিপণন ও বিক্রয়, বিদেশি পণ্য আমদানি ও রপ্তানি, দেশাভ্যন্তরে সেবা বা পরিষেবার উৎপাদন, বিপণন ও বিক্রয় ইত্যাদি সব ক্ষেত্রে এ কর আরোপযোগ্য।

এ কর উৎপাদন থেকে খুচরা বিক্রয় পর্যন্ত বিভিন্ন স্তরে আরোপ ও আদায় করা হলেও এর দায়ভার চূড়ান্তভাবে কেবল পণ্য বা সেবার ভোক্তাকে বহন করতে হয়। একজন ভ্যাট গ্রাহকের বা ভোক্তার দায়িত্ব হলো, কোনো পণ্য ক্রয় করে বিক্রেতার কাছ থেকে ক্রয় রসিদ সংগ্রহ করা। কারণ, যদি ভোক্তা মূসক চালান গ্রহণ করেন, তবে এটা নিশ্চিত হয় যে ভোক্তার প্রদেয় ভ্যাট সরকারি কোষাগারে জমা হয়েছে।

কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, আমাদের দেশে ক্রেতাদের কাছ থেকে কড়ায়-গন্ডায় ভ্যাট আদায় করা হলেও ওই ভ্যাট সরকারি কোষাগারে জমা না দিয়ে নিজেদের পকেটেই রেখে দিচ্ছেন একশ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী। আর এ ধরনের প্রতারণা বা হোয়াইট কলার ক্রাইমের কারণে সরকার শত শত কোটি টাকার ভ্যাটপ্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। এতে দেশের সার্বিক উন্নয়ন ও অগ্রগতি বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।

মূল্য সংযোজন কর (মূসক) সরকারের কর রাজস্বের অন্যতম প্রধান উৎস। বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ইতঃপূর্বে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) ভ্যাট নিরীক্ষা গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর অভিযান চালিয়ে প্রায় ৮০০ রাজস্ব ফাঁকিবাজ প্রতিষ্ঠানকে চিহ্নিত করে। এসব প্রতিষ্ঠান সাধারণ ক্রেতাদের কাছ থেকে পণ্যের মূল্যের সঙ্গে প্রায় এক হাজার ৬৭ কোটি টাকা ভ্যাট আদায় করেছে; অথচ তা সরকারের কোষাগারে জমা দেয়নি।

প্রতিষ্ঠানগুলোর কোনো কোনোটির ভ্যাট ফাঁকির পরিমাণ ১০০ কোটি টাকার ওপরে, যা রীতিমতো বিস্ময়কর। অন্যদিকে দেখা যায়, দেশের অনেক চালু শপিংমল সারা বছর রমরমা বেচাকেনা করলেও ভ্যাট নিবন্ধনই নেয় না। অথচ, এসব প্রতিষ্ঠান পণ্যের মূল্যের সঙ্গে হিসাব কষে ক্রেতাদের কাছ থেকে ভ্যাট ঠিকই আদায় করে থাকে। এসব ভ্যাট সরকারি কোষাগারে জমা হলে তা দেশের সার্বিক উন্নয়ন ও অগ্রগতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারত।

আইন অনুযায়ী, যদি মূল্য সংযোজন কর আইনের অধীনে কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান বা ওই আইনের অধীনে মূসক উৎসে কর্তনের দায়িত্বপ্রাপ্ত কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান যে কোনো উপায়ে মূল্য সংযোজন কর বা ভ্যাট ফাঁকি দেন, অথবা কর ফাঁকি প্রদানে সহায়তা করেন, অথবা মূল্য সংযোজন কর আইন, ১৯৯১-এর যে কোনো ধারা বা মূল্য সংযোজন কর বিধিমালা, ১৯৯১-এর যে কোনো বিধি বা জাতীয় রাজস্ব বোর্ড প্রণীত অন্য কোনো বিধিমালা বা আদেশ বা অন্য কোনো মূসক দপ্তরের আদেশ লঙ্ঘন বা ভঙ্গ করেন, তবে তা মূল্য সংযোজন কর আইনের অধীনে অপরাধ হিসাবে গণ্য করা হয়।

কোনো ব্যক্তি কর ফাঁকি বা আইনের কোনো ধারা, কোনো বিধি বা কোনো আদেশ ভঙের দায়ে অভিযুক্ত হলে তার বিরুদ্ধে অপরাধের ধরন অনুযায়ী নিুলিখিত এক বা একাধিক শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের বিধান মূল্য সংযোজন কর আইনে রয়েছে; যেমন-১. পণ্য বা সেবা আটক ও বাজেয়াপ্ত; ২. জরিমানা আরোপ; ৩. অপরিশোধিত করের ওপর সুদ আদায়; ৪. সংশ্লিষ্ট ব্যবসায় অঙ্গন তালাবদ্ধকরণ; ৫. মূসক নিবন্ধন বাতিলকরণ; ৬. অবৈধ রেয়াত বাতিল বা সমন্বয়করণ; ৭. গ্রেফতার করা ও কারাদণ্ড প্রদান; ৮. সম্পত্তি অবরুদ্ধকরণ, ক্রোক, বাজেয়াপ্তকরণ প্রভৃতি। উল্লেখ্য, কর ফাঁকির ক্ষেত্রে এসব শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ সত্ত্বেও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে ফাঁকিকৃত কর পরিশোধ করতে হয়।

এনবিআর-এর মূসক নিরীক্ষা ও গোয়েন্দা কর্তৃক অনুসন্ধানে জানা যায়, দেশে বড় মাপের অনেক অসাধু ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানই বেশি ভ্যাট ফাঁকি দিচ্ছে। এসব প্রতিষ্ঠান ক্রেতার কাছ থেকে পণ্যের মূল্যের সঙ্গেই ভ্যাট আদায় করে; অথচ তা সরকারি কোষাগারে জমা না দিয়ে নিজেদের কাছে রেখে দিচ্ছে; যা রীতিমতো অন্যায়, ক্রেতাদের সঙ্গে প্রতারণা ও শাস্তিযোগ্য অপরাধ। এ ক্ষেত্রে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোর বেশির ভাগই ইসিআর মেশিন বা ইলেকট্রনিক ফিসক্যাল ডিভাইস (ইএফডি) মেশিন ব্যবহার করে।

বলা বাহুল্য, কোনো বিক্রির তথ্য এসব মেশিনে না দিলে এর কোনো প্রমাণ থাকে না। ভ্যাট ফাঁকিবাজ প্রতিষ্ঠান বিক্রির তথ্য মেশিনে না দিয়ে তথ্য গোপন করে ভ্যাট ফাঁকি দেয়। ক্রেতা যদি বিক্রেতাকে রসিদ দিতে বাধ্য করে, তবে মেশিনে প্রমাণ থাকবে এবং যা এনবিআর-এর তদন্তে ধরা পড়বে। জনগণের কাছ থেকে ভ্যাট আদায় করেও শেষ পর্যন্ত তা সরকারি কোষাগারে জমা না দিয়ে প্রকারন্তরে ক্রেতাদের আমানতের খেয়ানত করছে এসব অসাধু ব্যবসায়ী। আর এ ধরনের অসাধু ও ফাঁকিবাজ ব্যবসায়ীদের কারণে সরকার হাজার হাজার কোটি টাকার রাজস্বপ্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।

ভ্যাট ফাঁকিবাজ ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানের বেশির ভাগই দুই ধরনের হিসাব রাখে। অনেকে ভ্যাট ফাঁকি দিতে আয়-ব্যয়, বিক্রি ও মুনাফার মিথ্যা তথ্য দিয়ে কম ভ্যাট পরিশোধ করে রিটার্ন জমা দেয়। অনেক সময় এনবিআর কর্মকর্তারা ওইসব প্রতিষ্ঠানে অভিযানে গেলে তারা এসব মিথ্যা হিসাব দেখিয়ে থাকে। একই ব্যবসা প্রতিষ্ঠান নিজেদের সুবিধার জন্য গোপনে প্রকৃত আয়-ব্যয়, বিক্রি মুনাফা ও ভ্যাট পরিশোধের তথ্য সংরক্ষণ করে।

প্রকৃত হিসাবের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের কাঁচামাল আমদানি ও ব্যাংকিং লেনদেনের তথ্যের মিল থাকে। বলা বাহুল্য, সারা দেশে ভ্যাট প্রদানে সক্ষম বিক্রয়কেন্দ্র ৫০ লক্ষাধিক। অথচ এনবিআর-এ ভ্যাট নিবন্ধিত বিক্রয়কেন্দ্রের সংখ্যা ৭ লাখ ৫০ হাজার। এর মধ্যে মাত্র ৩০ থেকে ৩২ হাজার প্রতিষ্ঠান ভ্যাট রিটার্ন দাখিল করে। আর মোট ভ্যাট আদায়ের ৫৬ শতাংশই পরিশোধ করে ১৩০ থেকে ১৫০টি প্রতিষ্ঠান।

এ কথা সত্য, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডে (এনবিআর) লোকবলের অভাব আছে। লোকবলের অভাবে এনবিআর-এর পক্ষে সব প্রতিষ্ঠানের ভ্যাট ফাঁকির তথ্য খতিয়ে দেখা সম্ভব হয় না। এ কারণে সব প্রতিষ্ঠানে গিয়ে ভ্যাটের তথ্য যাচাই করাও সম্ভব হয় না। আবার অনেক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান এনবিআর-এর অসাধু কর্মকর্তাদের অনৈতিক সুবিধা দিয়েও ভ্যাট ফাঁকির তথ্য গোপন করার সুযোগ পেয়ে থাকে, যা বন্ধ করা প্রয়োজন। অসাধু ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও কতিপয় অসাধু এনবিআর কর্মকর্তা-এ দুই ক্ষেত্রেই সরকারের নজরদারি বাড়াতে হবে।

পাশাপাশি ভ্যাট আদায়ের সার্বিক কার্যক্রম সর্বদা সচল ও গতিশীল রাখতে এবং দেশের উন্নয়ন-অগ্রগতির ধারা সক্রিয় রাখতে অবিলম্বে এনবিআর-এ সৎ, দক্ষ ও যোগ্য জনবল নিয়োগ করা প্রয়োজন। আশার কথা, ভ্যাট গোয়েন্দারা ভ্যাট ফাঁকি বন্ধে আগের চেয়ে অভিযান বাড়িয়েছেন এবং সারা দেশেই এ অভিযান চলছে। পাশাপাশি ভ্যাট ফাঁকি বন্ধে এনবিআর ম্যানুয়াল পদ্ধতি বাতিল করে অনলাইনে গেছে। ভ্যাট প্রদানে সক্ষম সব প্রতিষ্ঠানকে অনলাইনে ভ্যাট নিবন্ধন গ্রহণের নির্দেশনা দেওয়া নিঃসন্দেহে প্রশংসার দাবি রাখে। প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়িয়ে ভবিষ্যতে ভ্যাটযোগ্য সব প্রতিষ্ঠানকে নজরদারিতে আনতে হবে। সবাইকে মনে রাখতে হবে, এ দেশ আমার, আপনার, সবার। রাষ্ট্রীয়

আইন প্রতিপালনকল্পে কর প্রদান করা একজন নাগরিকের নৈতিক দায়িত্ব। আর করের অর্থ ছাড়া আমাদের প্রিয় এ দেশটির কোনোভাবেই সার্বিক উন্নয়ন ঘটান সম্ভব নয়।

 

ড. কুদরাত-ই-খুদা বাবু : অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি

kekbabu@yahoo.com

 

যুগান্তর ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন