নীতি দুর্নীতি অর্থনীতি
শর্ত যৌক্তিক হলে মানতে বাধা কোথায়?
ড. আর এম দেবনাথ
প্রকাশ: ০৬ মে ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
এ মুহূর্তে অর্থনীতির ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় খবর কী? ডলারের অভাব, মূল্যস্ফীতি, উৎপাদন হ্রাস, বেসরকারি ঋণ প্রবৃদ্ধি হ্রাস, রপ্তানির শ্লথ গতি, রেমিট্যান্সের প্রবাহে বড় ঘাটতি, রাজস্ব আদায়ে ঘাটতি, সয়াবিন তেল ও চিনির মূল্যবৃদ্ধি, মাছের বাজারে আগুন-এসব কি বড় খবর নয়? এখন বৈশাখ মাস। সারা দেশের কৃষক ভাইরা মূল্যবান বোরো ধান ঘরে তুলছেন। ফলন হয়েছে আবারও বাম্পার। এটা কি বড় খবর নয়? নিশ্চয়ই এসব বড় খবর। কেউ তা অস্বীকার করতে পারবে না।
তবে এসব খবর ছাপিয়ে এখন একটি খবর সামনে আসছে, যা আমাদের ‘অর্থনৈতিক স্বাধীনতা’ সম্পর্কিত। স্বাধীনতা মানে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্বাধীনতা উভয়ই। অর্থনীতির ক্ষেত্রে আমাদের স্বাধীনতা বড় জরুরি। স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নেব আমরা। যেমন ভর্তুকি। সারের ওপর থেকে ভর্তুকি তুলতে হবে-এ দাবি ‘আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল’ (আইএমএফ) বহুদিন থেকে করছে। কিন্তু বর্তমান সরকার তাদের দাবি মান্য করেনি এবং এর সুফল আমরা পাচ্ছি। চালে আমরা এখন প্রায় স্বয়ংসম্পূর্ণ।
কিন্তু এ অবস্থা এখন আর নেই। কেন? কারণ আইএমএফ থেকে আমরা সাড়ে চার বিলিয়ন (এক বিলিয়ন সমান শত কোটি) ডলার ঋণ নিতে বাধ্য হয়েছি। বলা যায় স্বস্তির জন্যই। বিদেশে সুনাম রক্ষার জন্য। এর ফল কী? সম্প্রতি সারের ওপর ভর্তুকির পরিমাণ দুবার কমানো হয়েছে এবং তা কৃষিমন্ত্রীর আপত্তি সত্ত্বেও। তার আপত্তি কোনো কাজে আসেনি। কারণ আইএমএফ’র ঋণ, তার সঙ্গে জুড়ে দেওয়া শর্ত। বহু শর্ত। একেক করে সব পালন করতে হবে। একেকটা কিস্তির সময় হবে, আর আইএমএফ কর্তারা আসবেন। তারা দেখবেন শর্ত পালন হচ্ছে কিনা। এর ওপর কিস্তির টাকা পাওয়া নির্ভর করে। কোন শর্ত কে, কখন, কোন মাসে, কীভাবে পালন/বাস্তবায়িত করবে, তা একদম পাই পাই করে নির্ধারিত। নড়াচড়ার কোনো কায়দা নেই।
এমন এক সময় ছিল যখন ১২ বার আইএমএফ থেকে ঋণ নেওয়ার প্রেক্ষাপটে তারা খবরদারি করত সর্বত্র। বাংলাদেশ ব্যাংকেই তাদের অফিস ছিল। শোনা যায়, কী সার্কুলার হবে, সার্কুলারের ভাষা কী হবে তা পর্যন্ত তারা ঠিক করে দিত। ওতে আমরা সই করতাম মাত্র। অনেকদিন এ অবস্থা থেকে আমরা মুক্ত ছিলাম। অর্থনীতি শক্তিশালী হয়। আমদানি ও রপ্তানি বাণিজ্য বাড়ে। রেমিট্যান্স বৃদ্ধি পায়। তৈরি পোশাক রপ্তানি বৃদ্ধি পায়। সামাজিক সূচকে অগ্রগতি হয়। চালে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জিত হয়। ফলমূল, মাছ-মাংস, তরিতরকারি উৎপাদনে আসে অভাবনীয় সাফল্য। জিডিপি বছরে গড়ে ছয়, সাড়ে ছয় শতাংশ হারে বাড়তে থাকে। বেকারত্ব হ্রাস পায়। সাক্ষরতার হার বাড়ে। মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি পায়। এ অবস্থায় আমরা মাথা উঁচু করে দাঁড়াই।
বিদেশি সংস্থাগুলো তাদের ‘ফিট ফর অল’ দাওয়াই দিতে সাহস করেনি। এমনকি আমরা পদ্মা সেতুতে বিশ্বব্যাংকের ঋণ না নিয়ে নিজস্ব সম্পদে তা তৈরি করি, যা অর্থনৈতিক স্বাধীনতার উজ্জ্বল স্বাক্ষর। কিন্তু করোনা মহামারি ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ সারা বিশ্বের মতো আমাদেরও কাহিল করে ফেলে। হঠাৎ সবকিছুর আন্তর্জাতিকভাবে মূল্যবৃদ্ধির ফলে রিজার্ভে টান পড়ে। রিজার্ভ, মানে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমতে থাকে। ডলারের দাম হঠাৎ করে প্রায় ২৫ শতাংশ বেড়ে যায়। আমদানি নিয়ন্ত্রণ করতে হয়। ঋণপত্র মনিটর করতে হয়। সরকারিভাবে ব্যয় সংকোচন করতে হয়। মূল্যস্ফীতি মারাত্মকভাবে বেড়ে যায়, যা এখন ৯ শতাংশের উপরে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমতে থাকলে তখন আন্তর্জাতিক লেনদেনের স্বার্থে আইএমএফ’র শরণাপন্ন হতে হয়। আমরা তাই হয়েছি। ফলে এখন তারা সবকিছুতেই হাত দিয়েছে। সর্বশেষ কোনটিতে হাত দিয়েছে?
৩ মে যুগান্তরের একটি খবরের শিরোনাম : ‘বিদেশের ব্যাংকে ১০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার : সরকারের কাছে ব্যাখ্যা চায় আইএমএফ’। খবরে দেখা যাচ্ছে, আমাদের রপ্তানিকারকরা রপ্তানি করেছেন; কিন্তু ১০ বিলিয়ন ডলার দেশে আসেনি। বিদেশে পড়ে আছে। এর কারণ কী জানতে চায় আইএমএফ। জানতে চাইতেই পারে। তাদের জানতে চাওয়ার ব্যাপার নয়, এটি আমাদের স্বার্থেই জানা দরকার। তারা বলবে কেন? কিন্তু যেহেতু আমরা ‘উদাসীন’, তাই তারা প্রশ্ন করার সাহস পাচ্ছে। এমন আরও অনেক বিষয় আছে, যা আসলে আমাদের উদ্যোগেই করা উচিত। বরং করা উচিত ছিল বহু আগেই। কিন্তু আমরা করিনি।
অজুহাতের শেষ নেই। যেসব কাজ আমরা করিনি, তার কারণ তারা জানতে চাচ্ছে। ফলে তারা যা চায় তা চাপিয়ে দিচ্ছে। যেমন, ব্যাংক কোম্পানি আইন সংশোধন। আমাদের ছিল ব্যাংক কোম্পানিজ অর্ডিন্যান্স ১৯৬২। ১৯৯১ সালে সম্পূর্ণ নতুনভাবে ব্যাংক কোম্পানি অ্যাক্ট করা হয়। পরে বেশ কয়েকবার এর সংশোধন করা হয়। সংশোধন করতে করতে এই আইনকে একটা অকার্যকর আইনে পরিণত করা হয়। আইনটি চলে যায় ঋণখেলাপিদের অনুকূলে। রয়েছে অর্থ ঋণ আইন ১৯৯৪। এ আইনটিও খোঁড়া আইনে পরিণত হয়েছে।
এ অবস্থায় দেশে এসবের কড়া সমালোচনা হয়। আগে একই পরিবারের দুজন পরিচালক ব্যাংক বোর্ডে থাকতে পারত। দুই মেয়াদে তারা ৬ বছর বোর্ডে থাকত। বাজার অর্থনীতির উগ্র সমর্থক একটা গোষ্ঠী এই আইন বদল করে তাদের আরও অনুকূলে নিয়ে নেয়। এখন একই পরিবারের তিনজন পরিচালক থাকতে পারেন এবং এদের মেয়াদ ৯ বছর। এই পরিবর্তনের বিরুদ্ধে সবাই সোচ্চার। কিন্তু কিছুতেই কিছু হয় না। এখন আইএমএফ ধরেছে, এসব বদলাতে হবে। ব্যাংক কোম্পানি আইনে বড় ধরনের সংস্কার আনতে হবে। পরিবার ও পরিচালকদের হাত থেকে ব্যাংকগুলোকে রক্ষা করতে হবে।
খেলাপি ঋণগ্রহীতা কে, তাদের শাস্তি কী, মূলধন পর্যাপ্ততা কী, প্রভিশন রক্ষার ব্যবস্থা ইত্যাদি ক্ষেত্রে তারা এখন হাত দিয়েছে। বলেছে, এসব ঠিক করে সংসদে আইন পাশ করতে হবে অবিলম্বে। মজাই বটে। দেশবাসী যখন বলল, তখন এর কোনো মূল্য নেই। এখন আইএমএফ’র কথায় হচ্ছে সব। তবু হোক। কিন্তু মুশকিল হচ্ছে, বললেই তো হয় না। পেছনের ‘সরকার’, সরকারের ভেতরের ‘সরকার’ বড়ই প্রভাবশালী। তারা অনেক কিছু করতে দিচ্ছে না। শোনা যাচ্ছে ঋণখেলাপির সংজ্ঞা, তাদের শাস্তিসংক্রান্ত আইন, মানে নতুন আইন আরও সহজ করা হচ্ছে। সুশাসন তো অনেক দূরের বিষয়।
আমার মনে আছে, বেশ কিছুদিন আগে আইএমএফ আরেকটি কাজ করিয়েছিল। তাদের পরামর্শে সরকারি সব ব্যাংককে ‘পাবলিক লিমিটেড কোম্পানি’তে রূপান্তরিত করা যায়। উদ্দেশ্য, এগুলো কোম্পানির মতো স্বাধীনভাবে চলবে। সবকিছু চালাবে বোর্ড। সরকার শুধু বোর্ড করে দেবে। এখন পরিস্থিতি কী? এখন সরকারি ব্যাংক কার্যত অর্থ মন্ত্রণালয়ের ‘এপেনডিক্সে’ পরিণত হয়েছে। সব নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে সেখান থেকে।
এর জন্য আওয়ামী লীগ সরকারের প্রথমদিকে যে ব্যবস্থা করা হয়েছিল, তা রদ করে আওয়ামী লীগই নতুন ব্যবস্থা করে। সরকারি ব্যাংকের ‘সুশাসন’ যে তিমিরে ছিল, সেই তিমিরেই রয়ে গেছে। তাদের পরামর্শে বাংলাদেশ শিল্প ব্যাংক ও বাংলাদেশ শিল্প ঋণ সংস্থা-এ দুটি প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে নতুন ব্যাংক বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (বিডিবিএল) তৈরি করা হয়। এর অবস্থা এখন আরও খারাপ। খেলাপি ঋণের বোঝায় জর্জরিত ব্যাংকটি।
অভিজ্ঞতা থেকে বলা যায়, আইএমএফ’র অতীত পদক্ষেপ সব ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছে। ব্যাংকগুলো, আর্থিক প্রতিষ্ঠান, এমনকি বিমা কোম্পানিগুলো পর্যন্ত খেলাপিদের নিয়ন্ত্রণে। কিন্তু এদের ‘খেলাপি’ বলা যাবে না। তারা পুনঃতফসিল, পুনঃগঠন করে ‘সাফ’ থাকছে। চুনোপুঁটিরা হচ্ছে ঋণখেলাপি। বিগ বিজনেস, ঋণখেলাপি, সরকারের মাত্রাতিরিক্ত ‘আদর’ ইত্যাদি মিলে ব্যাংক খাত ধুঁকেধুঁকে মরছে।
খেলাপি ঋণ, পর্যাপ্ত পুঁজি, পর্যাপ্ত সংরক্ষণ ইত্যাদিই বড় সমস্যা। দেখা যাক আইএমএফ এবার কী করতে পারে। আইএমএফ শুধু ব্যাংক খাতের সুশাসন চাচ্ছে না, তারা আরও গুরুত্বপূর্ণ খাতেও হাত দিয়েছে। যেমন, বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভের হিসাবায়ন পদ্ধতির পরিবর্তন চায়। কৃত্রিমভাবে রিজার্ভের পরিমাণ বেশি দেখানো চলবে না-বলে দিয়েছে আইএমএফ। আমরা রিজার্ভ থেকে ৭-৮ বিলিয়ন ডলার নিয়ে একটা-দুটা ফান্ড করে রপ্তানিকারকদের ঋণ দিয়েছি। অথচ ওই পরিমাণ ডলার আবার রিজার্ভেও দেখাচ্ছি। এটা হয় না। এখন তা ‘রিভার্স’ করতে গিয়ে প্রকৃত রিজার্ভ কমে যাচ্ছে।
আইএমএফ বলেছে, সুদের হার বাজারভিত্তিক করতে হবে। বর্তমানে বাংলাদেশ ব্যাংক বাজার অর্থনীতির মৌল নীতির বাইরে গিয়ে আমানত ও ঋণের ওপর সুদের হার নির্ধারণ করে দিচ্ছে। ১৯৯৬ সালের দিকে এই নীতি বাংলাদেশ ব্যাংক তুলে দিয়েছিল। আমানত ও ঋণের ওপর সুদের হারের বিষয়টি ব্যাংকগুলোর হাতে ছেড়ে দিয়েছিল। দীর্ঘদিন তা অব্যাহত রাখার পর হঠাৎ দেশে কী হলো যে সরকার ওই নীতি থেকে বেরিয়ে আসে। এখন আমানত ও ঋণের ওপর সুদ কেন্দ্রীয় ব্যাংক ঠিক করে। কৃত্রিমভাবে তা ঋণের ওপর মাত্র ৯ শতাংশ সুদ নির্ধারণ করে। এটি করতে গিয়ে আমানতের ওপর সুদের হার করা হয় মাত্র ৬ শতাংশ। অথচ মূল্যস্ফীতি ৯ শতাংশ।
আমাদের দেশ আমেরিকা, কানাডা, ইউরোপীয় দেশ নয় যে সঞ্চয় লাগবে না। আমাদের পরিবার আছে, আমরা সঞ্চয়ের ওপর নির্ভর করি, কারণ বিপদে সরকার আমাদের জন্য কিছুই করে না-‘কিল’ দেওয়া ছাড়া। এমন একটা সঞ্চয়ে নির্ভর দেশকে ঋণনির্ভর দেশে পরিণত করার জন্য আমানতকে করা হচ্ছে নিরুৎসাহিত। আইএমএফ বলছে, তা হবে না। সুদের হার বাজারের ওপর ছেড়ে দিতে হবে। এরপর তারা বলছে ডলারের দামের কথা। ডলারের দামও খোলা বাজারি নীতিতে ঠিক করতে হবে।
কৃত্রিমভাবে ডলারের দাম নির্ধারণ করা চলবে না। সরকার মনে হয় ধীরে ধীরে সবই মানছে। গরজ বড় বালাই। একে তো আইএমএফ, যার সঙ্গে রয়েছে বিশ্বব্যাংক, এডিবি এবং এর নিয়ন্ত্রক আমেরিকা-যারা আমাদের রপ্তানি বাজারের বড় অংশ জুড়ে রয়েছে। জুড়ে রয়েছে রেমিট্যান্সে। তাদের শর্ত পূরণে সরকার এখন ব্যস্ত। ভর্তুকি হ্রাস, রাজস্ব বৃদ্ধি ডলারের মূল্য নির্ধারণ ইত্যাদি ইস্যু নিয়েই ব্যস্ত সরকার। দেখা যাক শেষ পর্যন্ত কী হয়?
ড. আর এম দেবনাথ : অর্থনীতি বিশ্লেষক; সাবেক শিক্ষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
