Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

চেতনায় বুদ্বুদ

ব্যক্তির স্বাধীনতা দলীয় অধীনতাকে ছাড়িয়ে যেতে পারে না

Icon

বদিউর রহমান

প্রকাশ: ২৩ মে ২০২৩, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

ব্যক্তির স্বাধীনতা দলীয় অধীনতাকে ছাড়িয়ে যেতে পারে না

রাজনীতি করতে হলে জনগণের প্রয়োজন হয়, জনগণ ছাড়া রাজনীতি করা যায় না। কারণ রাজনীতি জনগণের জন্যই করা হয়, করতে হয়। জনগণের সুখ-দুঃখ, কল্যাণ-অকল্যাণ, উন্নতি-অবনতি-সবকিছু হালের রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় রাজনীতির সঙ্গে এমনভাবে জড়িয়ে গেছে যে, কেউ নিজে একা একা আর টিকে থাকতে পারেন না। প্রত্যক্ষভাবে রাজনীতি করেন না, কোনো দলেও নেই, নিজের জমিজমা, চাকরি-বাকরি একটা কিছু নিয়ে নিজে নিজে আলাদা চলবেন-সে পথও নেই। বাজারে যাবেন-দেখবেন রাজনীতির প্রভাব রয়েছে, সরকার তো রাজনীতির মাধ্যমে ক্ষমতায়। অতএব, ওই সরকারের রাজনৈতিক নীতিতে অনুসরণীয় অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে আপনি আটকা পড়ে গেছেন। স্কুল-মাদ্রাসায় বাচ্চা ভর্তি করাবেন-সেখানেও রাজনীতির জালে আটকাবেন, কমিটিতে কারা আছেন, তাদের রাজনৈতিক নীতি-প্রভাব থেকে আপনি মুক্তি পাবেন না। হালে দেখবেন, আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক প্রভাবে কট্টর আওয়ামীবিরোধী মাদ্রাসায়ও বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন সাড়ম্বরে পালিত হচ্ছে, কোনো অফিসের আঙিনায় দেখবেন রাষ্ট্রীয়ভাবে পালিত শেখ রাসেলের জন্মদিনের ব্যানার-পোস্টার এখনো সম্মানে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে, বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকীর ছবিগুলো তো অনেক স্থানেই রয়েছে, এমনকি পত্রিকার বিজ্ঞাপনেও এখনো বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকীর লোগো চালানো হচ্ছে। জাতির পিতার সম্মানার্থে এসব কতখানি হচ্ছে আর আওয়ামী-প্রভাব-দখলদারি বজায়ের জন্য কতখানি, এর পার্থক্য করা এখন খুব কঠিন হবে। এটা নিরূপিত হবে আওয়ামী লীগ সরকারে/ ক্ষমতায় না থাকলে। বিএনপি আমলে আমরা ৭ নভেম্বর সরকারি ছুটিতে থাকতাম, বলা হতো সিপাহি-জনতার বিপ্লব বা জাতীয় সংহতি দিবস, না কী একটি যেন। গত এক যুগে জন্মগ্রহণকারী কোনো বালক-বালিকা তো ৭ নভেম্বরের নামগন্ধও হয়তো পায় না। আবার ক্ষমতার বাইরে ২১ বছরে আওয়ামী লীগ তো, বিশেষত বিএনপির আমলে এমন কোণঠাসা ছিল যে, লোকে বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউ চিনত না, চিনত বি বি অ্যাভিনিউ, তখন জিয়ার খালকাটা থেকে শুরু করে তার গুণগানই কেবল বাজানো হতো। আমাদের বিটিভি তো যখন যার তখন তার রেকর্ড বাজাতেই সৃষ্ট, এর সরকারি রূপ ছাড়া নিজস্ব কোনো অবয়ব কখনো ছিল না। থাকার আশাও করা যায় না। এখন বিটিভির খবর মানুষ যদি বিটিভিতে না দেখে, তবে অন্য চ্যানেলে হলেও তাকে জোর করে দেখানো হবে। কেন এ নষ্টামি, কেন এ ভ্রষ্টামি যে বিটিভির সংবাদ অন্য চ্যানেলে প্রচার করতেই হবে? এটাই হলো নষ্ট রাজনীতির কুপ্রভাব, সব নিজেদের দখলে আনার এক জোর-জুলুম। নির্বাচনে রাজনৈতিক প্রভাব এত প্রবল যে, তখন কারও রাজনৈতিক স্বাধীনতা তার দলীয় অধীনতাকে ডিঙাতে পারে না। যেহেতু রাজনীতি করতে হলে জনগণ প্রয়োজন, জনগণ পেতে হলে দল অত্যাবশ্যক। অতএব, দল করতে হলে দলীয় অধীনতা মানতেই হবে, তাতে দলের অধীনতা ছাড়া রাজনৈতিক স্বাধীনতা ভাবা যাবে না।

নির্বাচন দলীয় মার্কায় হওয়ার রেওয়াজ অনেক পুরোনো, বিশেষত ক্ষমতায় আসার জন্য দলীয় মনোনয়ন পেলে দলীয় মার্কা প্রতীক হিসাবে স্বীকৃত হয়। দলীয় প্রতীকের বেলায় ব্যক্তি গণ্য হলেও মার্কাই বেশি গণ্য, বিবেচ্য; ব্যক্তি গণ্য হলেও তখন নগণ্য। বলা হয়ে থাকে, ১৯৭০-এর নির্বাচনে কলাগাছকে নৌকা মার্কা দিলে কলাগাছই নির্বাচিত হতো। এখনো তা-ই হচ্ছে। আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচনে দলীয় অধীনতা ছিল না, আওয়ামী লীগ সব দলীয় করতে গিয়ে পৌর মেয়র থেকে ইউনিয়নের চেয়ারম্যানও দলীয় অধীনতায় নিয়ে আসে, শুরু হয় এক মহাল্যাটা। স্থানীয়ভাবে জনপ্রিয় ব্যক্তিও এখন আর দলের মার্কা না পেলে নির্বাচিত হতে ওষ্ঠাগতপ্রাণ হয়ে যান। ব্যতিক্রমী কেউ কেউ এসে যান, যদি দলীয় শাসনে-প্রশাসনে তার অনেক সময় ভিক্ষার দরকার নেই, কুত্তা সামলানোর অবস্থায় পড়তে হয়। তার তখন রাজনৈতিক স্বাধীনতা আর থাকে না, দলের স্বাধীনতাই তার স্বাধীনতা, দলের অধীনতাই তার স্বাধীনতা। আওয়ামী সরকার নিজস্ব একক প্রভাব-প্রতিপত্তি সর্বত্র ছড়িয়ে দিতে এই যে একটা কালাকানুন করল, এর থেকে আমরা কবে মুক্তি পাব, নাকি এর আরও সম্প্রসারণ হবে, তা আগামী দিনে দেখা যাবে। এতে সমাজ তার নিজস্বতা হারাচ্ছে, এ অবস্থা চলতে থাকলে ভবিষ্যতে বিয়েশাদিও দলীয় ভিত্তিতে চলে আসে কি না, আল্লাহ মালুম। তবে অনেক চালাক পরিবারের সদস্যরা সব দরজা খোলা রাখার জন্য একেকজন একেক দলে যাবেন, যাতে তারা ক্ষমতা থেকে ছিটকে না পড়েন।

রাজনৈতিক স্বাধীনতা বলতে আমরা কী বুঝে থাকি? আমরা বুঝি, প্রত্যেকের নিজস্ব ধ্যানধারণায়, বিশ্বাসে, চিন্তায়, কর্মে, সংবিধানের খেলাপ না করে, যে কোনো ধারার রাজনীতি করার স্বাধীনতা থাকবে। এবার কারও যদি কোনো দলের আদর্শের সঙ্গে তার মিলে যায়, তখন তিনি ওই দলের রাজনীতি করবেন। এখানে তার স্বাধীনতায় কেউ বাধা সৃষ্টি করে না। কিন্তু একবার তিনি কোনো দলে দীক্ষিত হলে তাকে এবার ওই দলের সংবিধান, নীতি-আদর্শও মেনে চলতে হবে। তিনি নির্বাচনের জন্য কোনো পদে যতই নিজেকে যোগ্য ভাবুন না কেন, দল যদি তাকে উপযুক্ত না ভাবে, তাহলে তাকে মনোনয়ন দেবে না, তিনি দলীয় মনোনয়নের অনুপযুক্ত। এক্ষেত্রে তিনি তার দলীয় অধীনতায় থাকতে বাধ্য, এখন আর তার রাজনৈতিক স্বাধীনতা নেই। তাকে রাজনৈতিক স্বাধীনতায় যেতে হলে হয় দল ত্যাগ করতে হবে, নয় বিদ্রোহী হতে হবে। এবারও তার রক্ষে নেই-দল ত্যাগ করলে তিনি ইমেজ হারাবেন, ভিন্ন দলে গিয়ে সুবিধা নাও করতে পারেন; আবার বিদ্রোহী হলে তিন বহিষ্কার হবেন, এতেও তার ইমেজ ক্ষুণ্ন হবে। কজন বিদ্রোহী হয়ে দলের প্রচ্ছন্ন বা নীরব সমর্থন ছাড়া নির্বাচনে উতরে আসতে পারেন? অতএব, দল করতে হলে প্রথমে রাজনৈতিক স্বাধীনতায় দলে যোগদান করলেও পরে দলীয় অধীনতার ভিত্তিতে তাকে তার রাজনৈতিক স্বাধীনতাকে সমর্থন করে চলতে হবে। আমরা বলতে চাই, দল করতে হলে দলকে মানতে হবে, দল মনোনয়ন না দিলে তা মেনে নিয়েই দলের জন্য কাজ করতে হবে। আমাদের দেশে নির্বাচনে দলীয় স্বাধীনতাই ওই দলের ব্যক্তির স্বাধীনতা, দলীয় স্বাধীনতাই তার রাজনৈতিক স্বাধীনতা। দল তাকে লালনপালন করে, দল তাকে মনোনয়ন দেয়, দল তাকে পদ দেয়, দল তাকে রাষ্ট্রীয় পদেও নিয়ে আসে। অতএব, দল তার সর্বস্ব, দল হবে তার জাগরণ, দল হবে তার আহার-নিদ্রা সর্বক্ষণ।

সচরাচর কোনো ব্যক্তি দলীয় সমর্থন ছাড়া একা নির্বাচনে তেমন সুবিধা করে উঠতে পারে না, যারা বিদ্রোহী হয়ে কখনো-সখনো পেরেছ, তাও দলের প্রচ্ছন্ন বা নীরব সমর্থনে, অথবা দলীয় কোন্দলের সুযোগে, কিংবা পূর্বে দলীয় মনোনয়নে জিতে যাওয়ার ফলস্বরূপ জনপ্রিয় হয়ে ওঠায়। কিন্তু দল ত্যাগ করার পর ওদের আর তেমন পাত্তা থাকে না। বাংলাদেশে দল ত্যাগ করে যারাই নতুন দল করতে গেছে, কিংবা নতুন দলে গেছে তাদের প্রায় সবাই রাজনীতিতে শুধু দলচ্যুতই হননি, অনেকটা রাজনীতিচ্যুতও হয়ে গেছেন। আওয়ামী লীগ ত্যাগ করে ড. কামাল এখন চালচুলোহীন এক শ্যাওলা ধরা রাজনীতিক, তার গণফোরাম কয়বার যে ভাঙল! মিজানুর রহমান চৌধুরী ও কাজী জাফর এরশাদের পদতলে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী হলেন বটে, কিন্তু পরে হারিয়ে গেলেন। কোরবান আলী এরশাদে নিজেকে কোরবান করে দিলেন, পরে আর কেউ তাকে চেনে না। মান্না এখন এমন পর্যায়ে গেলেন যে, মান্নার কান্না নহে হীরা নহে পান্না। রব সাময়িক উপকৃত হয়ে এরশাদের গৃহপালিত বিরোধীদলীয় নেতা হলেন বটে, এখন তিনি মৃতপ্রায়। কর্নেল অলি এখন পস্তাচ্ছেন কি না কে জানে। ড. রেজা কিবরিয়া এখন দিশেহারা, নতুন এক ছেলেমানুষের সঙ্গে কী যে করেন-আমরা বুঝে উঠতে পারছি না। কাদের সিদ্দিকী কি বোনের পদতলে এসে যাচ্ছেন? গামছা নিয়ে বোধহয় আর সব লজ্জা নিবারণ করে উঠতে পারছেন না। নৌকা মার্কা নিয়ে অন্য দলের যারা নির্বাচন করেছেন বা ভবিষ্যতে করবেন, তাদের তো উদ্দেশ্যই একটু ক্ষমতা পাওয়া, তাদের আবার নিজ দলের হিসাবে কে ভোট দেয়? আমি আগেও একবার লিখেছি-যারা দল ত্যাগ করে চলে গেছে, তাদের যেন আবার দলে ঠাঁই দেওয়া না হয়। যারা বিদ্রোহী হয়েছে, তাদেরও যেন আর ক্ষমা করা না হয়।

সম্প্রতি গাজীপুরে আমরা অ্যাডভোকেট জাহাঙ্গীরকে দেখলাম বিদ্রোহী হতে। হাইকোর্টেও হেরে গিয়ে এখন মাকে নিয়ে মাঠে আছেন তিনি। গাজীপুরের মেয়র নির্বাচনে এটা একটা বিষয় বটে। আমাদের দেখতে হবে এখানে ব্যক্তি জাহাঙ্গীর বেশি জনপ্রিয়, না আওয়ামী লীগ। অবশ্যই আওয়ামী লীগের বদৌলতেই জাহাঙ্গীর জাতে উঠেছিলেন, এখন তিনি সেই আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে ভোটে নেমেছেন। তাহলে আমরা কী উপসংহারে পৌঁছতে পারি? আমরা কি বলতে পারি, জাহাঙ্গীরের দলীয় আনুগত্য বা অধীনতা কৃত্রিম ছিল, অকৃত্রিম ছিল না। মায়ের জন্য লড়ে তিনি মাকে কতটুকু বিজয়ী করতে পারবেন, তা বিরাট প্রশ্ন। সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ; কিন্তু নিজের পায়ে তিনি কেন যে কুড়াল মারলেন আমরা বুঝে উঠতে পারছি না। তার ভবিষ্যৎ তিনি নিজেই কি ক্ষতবিক্ষত করলেন না? যারা দলীয় রাজনীতি করেন, তারা দলের প্রতি কেন যে অকৃতজ্ঞ হয়ে যান, তারা কেন যে ক্ষমতার জন্য এত অন্ধ হয়ে পড়েন-আমি এখনো বুঝি না। বোধকরি দলীয় রাজনীতি করি না বলেই আমি এসব অকৃতজ্ঞতার হেতু বুঝে উঠতে পারি না।

বদিউর রহমান : সাবেক সচিব, এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান

রাজনীতি

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম