Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

জাতীয় তামাক নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচি প্রণয়ন জরুরি

Icon

ড. অরূপরতন চৌধুরী

প্রকাশ: ৩১ মে ২০২৩, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

জাতীয় তামাক নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচি প্রণয়ন জরুরি

আজ বিশ্ব তামাকমুক্ত দিবস। ১৯৮৭ সাল থেকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে দিবসটি পালন করা হচ্ছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এ বছর বিশ্ব তামাকমুক্ত দিবসের প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করেছে-‘We need food: not tobacco’ বাংলায় যার ভাবানুবাদ হচ্ছে-‘আমাদের খাদ্য দরকার, তামাক নয়’। ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা, জলবায়ু পরিবর্তন, দ্রুত নগরায়ণ, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধসহ বিভিন্ন কারণে এ বছরের প্রতিপাদ্যটি যথার্থ।

কারণ, ‘খাদ্যদ্রব্য’ যে কোনো সময়ে জীবন বাঁচাতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ; কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে তা যেন দুষ্প্র্রাপ্য হতে চলেছে। একসময় টাকা, ডলার কিংবা পাউন্ড পকেটে নিয়ে ঘুরলেও খাদ্য মিলবে না! হতে পারে এমন দিন আসন্ন।

বর্তমানে দেশে প্রায় ১ লাখ ৮ হাজার হেক্টর কৃষিজমিতে তামাক চাষ হচ্ছে, যা দেশের খাদ্য উৎপাদনে ব্যাঘাত ঘটাচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে আগামী দিনে খাদ্য সংকট দেখা দিতে পারে। তামাক চাষ মাটির উর্ব্বরতা শক্তি হ্রাস করে, এটি সর্বজন স্বীকৃত। এমনকি কৃষকও তা জানে। তামাক চাষের কারণে খাদ্যশস্য চাষের জমি কমে যাচ্ছে। দেখা যায়, দেশের যেসব জেলায় তামাক চাষ হয়, সেখানে পুষ্টিকর খাদ্যের সংকট রয়েছে।

পরিবেশ, প্রাণিকুলেও তামাক চাষের বিরূপ প্রভাব দেখা যাচ্ছে। তামাক পাতা পোড়ানোর ফলে বাংলাদেশে ৩০ শতাংশ বন উজাড় হচ্ছে। উপরন্তু, তামাক চাষে ব্যবহৃত কীটনাশক ও রাসায়নিক দ্রব্য-জীববৈচিত্র্য ও প্রাণীচক্রের ক্ষতি করছে। তামাক চাষপ্রবণ এলাকায় মানুষের মধ্যে বিশেষত গর্ভবতী নারীদের নানাবিধ স্বাস্থ্যগত সমস্যা দেখা দেয়, প্রতিবন্ধী, বিকলাঙ্গ সন্তান জন্ম দেয়। ওইসব এলাকায় প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠী বেশি হয়ে থাকে। কারণ, তামাক চাষ ও প্রক্রিয়াজাতকরণে নারী-শিশুরা জড়িত থাকে।

বৈশ্বিক বিশ্লেষণে দেখা গেছে, তামাক চাষ সারা পৃথিবীর ২-৪ শতাংশ বন উজাড়ের জন্য দায়ী। ২০১৩ সালে ইন্টারন্যাশনাল কোস্টাল ক্লিন-আপ বাংলাদেশসহ ৯২টি দেশের সাগর থেকে যে বর্জ্য সংগ্রহ করে, তার মধ্যে ১ম স্থানেই রয়েছে সিগারেট ফিল্টার। তামাক চাষের পরিমাণ বাড়াতে জমি তৈরির জন্য প্রচুর বনাঞ্চল ধ্বংস করা হয়।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্যমতে, ১৯৭০ সাল থেকে তামাকের কারণে বিশ্বব্যাপী (গ্রীষ্মমণ্ডলীয় অঞ্চলে) আনুমানিক ১ দশমিক ৫ বিলিয়ন হেক্টর বন বিলুপ্ত হয়ে গেছে; যা ২০ শতাংশ বার্ষিক গ্রিনহাউজ গ্যাস বৃদ্ধির প্রধান কারণ!

এত ভয়াবহতার পরও তামাক চাষ লাভজনক এবং তামাককে অর্থকরী ফসল হিসাবে জাহির করার প্রবণতা সব সময় লক্ষ করা যায়। কিন্তু আদতে তামাক চাষ, তামাক কোম্পানির জন্য লাভজনক; কৃষকের জন্য নয়। যদি কৃষকের জন্য তামাক চাষ লাভজনকই হতো, তাহলে বৃহত্তর রংপুর অঞ্চল, কুষ্টিয়া, বান্দরবানসহ তামাক চাষপ্রবণ এলাকাগুলোয় দরিদ্র মানুষ থাকত না। এসব জেলা অনুন্নত থাকত না। তামাক কোম্পানিগুলো কৃষকদের ‘লোভের ফাঁদে’ ফেলে তামাক চাষে উদ্বুদ্ধ করছে।

কারণ, ‘তামাক’ তাদের ব্যবসার প্রধান কাঁচামাল। যে কোনো উপায়ে ব্যবসার কাঁচামালের জোগান নিশ্চিত করতে চাইবে বহুজাতিক তামাক কোম্পানিগুলো। আমার, আপনার কিংবা রাষ্ট্রের কী ক্ষতি-সেটি তাদের মাথাব্যথার কারণ নয়। তাই কৃষকদের পণ্যের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত এবং বিকল্প ফসল উৎপাদনে উৎসাহিত করার মাধ্যমে তামাক চাষ থেকে ফিরিয়ে আনতে আশু পদক্ষেপ নিতে হবে। তামাক চাষ নিয়ন্ত্রণে ইতোমধ্যে আপিল বিভাগ থেকে নির্দেশনা রয়েছে, সেটি অনুসরণ জরুরি।

তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনের ধারা-১২তে তামাক উৎপাদন নিয়ন্ত্রণে, বিশেষত তামাক চাষ নিরুৎসাহিত করতে একটি নীতি প্রণয়নের নির্দেশনা রয়েছে। যতদূর জানা যায়, স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে তামাক চাষ নিয়ন্ত্রণে একটি খসড়া নীতিমালা তৈরি করা হয়েছে। সময়ের প্রয়োজনে নীতিটি চূড়ান্ত করে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে দেশে তামাক চাষ নির্মূল অপরিহার্য হয়ে পড়েছে। কারণ, আমাদের খাদ্য সংকট প্রতিরোধ এবং তামাকের করাল গ্রাস থেকে জনস্বাস্থ্য, পরিবেশ ও অর্থনৈতিক সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে। তামাকমুক্ত করতে হবে দেশ।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ২০১৬ সালে ‘সাউথ এশিয়ান স্পিকার্স সামিটে’ ঘোষণায় বলেন, ‘আমরা ২০৪০ সালের মধ্যে বাংলাদেশ থেকে তামাকের ব্যবহার সম্পূর্ণভাবে নির্মূল করতে চাই।’ তার এ ঘোষণা বাস্তবায়নে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়, দপ্তর, বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো কাজ করে যাচ্ছে। আমরা দেখি, প্রধানমন্ত্রী কোনো ঘোষণা, অঙ্গীকার কিংবা প্রত্যয় ব্যক্ত করলে সেটার বাস্তবায়নে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও সহযোগী দপ্তর, বিভাগ সবাই দ্রুত পদক্ষেপ নেয়।

কিন্তু তামাক ও মাদকের মতো জাতীয় সমস্যার ক্ষেত্রে একধরনের অনীহা কিংবা দায়িত্ব এড়িয়ে চলার প্রবণতা দেখা যায়, যা অনাকাঙ্ক্ষিত। তামাক নিয়ন্ত্রণ শুধু এককভাবে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কাজ নয়, এক্ষেত্রে সবাইকে নিজ নিজ অবস্থান থেকে কাজ করতে হবে। তবেই এ সমন্বিত কাজগুলো ফলপ্রসূ হতে পারে। এ লক্ষ্যে কিছু বিষয়ে আশু পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়োজন। যেমন-দেশে বিদ্যমান ‘ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার (নিয়ন্ত্রণ) আইন’ যুগোপযোগী করা প্রয়োজন।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ‘এফসিটিসি’র আলোকে আইন সংশোধনে ইতোমধ্যেই নির্দেশনা দিয়েছেন। আইনের দুর্বলতা এবং আইন বাস্তবায়নে প্রতিবন্ধকতাগুলো দূরীকরণে এই সংশোধনীগুলো উল্লেখযোগ্য-১. আইনে উল্লিখিত পাবলিক প্লেস, পরিবহণের আওতা বৃদ্ধি ও সব তামাকজাত দ্রব্য সেবন নিষিদ্ধের পাশাপাশি আইন অমান্যে জরিমানা বৃদ্ধি এবং এসব স্থানে আলাদাভাবে ‘ধূমপানের স্থান’ না রাখা। ২. তামাক কোম্পানির ‘সিএসআর’ কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ করা। ৩. চতুর ও কৌশলী প্রচারণা বন্ধ করতে বিক্রয় স্থলে সব ধরনের তামাকজাত দ্রব্য দৃষ্টির আড়ালে রাখা। ৪. খোলা ও খুচরা এবং ভ্রাম্যমাণ তামাক বিক্রয় নিষিদ্ধ করা।

৫. শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ১০০ মিটারের মধ্যে তামাকজাত দ্রব্যের দোকান না রাখা। ৬. তামাকজাত দ্রব্য বিক্রয়ে লাইসেন্স গ্রহণ বাধ্যতামূলক এবং খোলা ও খুচরা বিক্রয় নিষিদ্ধ করা। ৭. তামাকজাত দ্রব্যের মোড়কে সচিত্র স্বাস্থ্য সতর্কবাণী ৯০ শতাংশ করা এবং স্ট্যান্ডার্ড প্যাকেজিং চালু করা। ৮. ই-সিগারেট বা ভেপিংয়ের আমদানি, উৎপাদন, বিক্রয়, বিপণন ও ব্যবহার নিষিদ্ধ করা উল্লেখযোগ্য।

আইনটি শক্তিশালী করা হলে দেশের মধ্যবয়সি এবং তরুণদের মধ্যে তামাক ব্যবহার বহুলাংশে কমে আসবে। এর ফলে তামাকজনিত রোগ ও অকালমৃত্যু হ্রাস পাবে। কিন্তু তামাক কোম্পানিগুলো সরকারের জনস্বাস্থ্য রক্ষার উদ্দেশ্য ব্যাহত করতে নানা অপপ্রচার চালাচ্ছে, যা প্রতিহত করতে হবে।

বর্তমানে ‘ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো’তে সরকার ও সরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের প্রায় ১০ শতাংশ শেয়ার রয়েছে। সরকারের উচ্চপদস্থ একাধিক কর্মকর্তা বিএটি’র পরিচালনা পর্ষদে প্রতিনিধিত্ব করছেন। জনস্বাস্থ্য, পরিবেশবিধ্বংসী পণ্যের ব্যবসায়ীদের সঙ্গে সরকারের অংশীদারত্বের বিষয়টি অনেক মহলেই দ্বৈতনীতি হিসাবে দেখা হচ্ছে এবং সরকারের তামাক নিয়ন্ত্রণ প্রচেষ্টাকে জনগণের কাছে প্রশ্নবিদ্ধ করছে। তাই তামাক কোম্পানি থেকে শেয়ার প্রত্যাহার করার জন্য সরকারকে অতি দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে।

আমাদের অনেক পুরোনো আইন ‘এসেনসিয়াল কমিউডিটি অ্যাক্ট-১৯৫৬’তে তামাক জরুরি পণ্য হিসাবে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। ‘কৃষি বিপণন আইন-২০১৮’তে তামাক অর্থকরী ফসলের মধ্যে অন্যতম হিসাবে রাখা হয়েছে। এরকম কিছু কিছু বিষয় তামাক কোম্পানিকে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে নানা সুযোগ-সুবিধা দিচ্ছে। পুরোনো যেসব আইন, নীতি ও অধ্যাদেশ তামাক নিয়ন্ত্রণের জন্য সমস্যা সৃষ্টি করে বা এমন বিষয় সন্নিবেশিত রয়েছে, সেগুলো সংস্কারের মাধ্যমে যুগোপযোগী করতে হবে। ‘এফসিটিসির আর্টিকেল ৫.৩’ অনুসারে তামাক কোম্পানির প্রভাব বন্ধে ‘গাইডলাইন’ প্রণয়নও অত্যন্ত জরুরি।

২০১৪-১৫ অর্থবছর থেকে তামাকজাত দ্রব্যে ১ শতাংশ হারে ‘স্বাস্থ্য উন্নয়ন সারচার্জ’ আরোপ ও ২০১৭ সালে এ সংক্রান্ত নীতি প্রণয়ন করা হয়। কিন্তু দেশে ‘জাতীয় তামাক নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচি’ প্রণয়ন করা হয়নি। প্রধানমন্ত্রীর তামাকমুক্ত বাংলাদেশ ঘোষণা বাস্তবায়নে ‘রোডম্যাপ’ প্রণয়ন এবং তামাক নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচি অধিকতর গতিশীল ও সর্বস্তরে ছড়িয়ে দিতে ‘জাতীয় তামাক নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচি’ প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন এখন সময়ের দাবি। তাছাড়া কর ফাঁকি ও জটিল তামাক কর আহরণ প্রক্রিয়ায় বরাবরই লাভবান হচ্ছে তামাক কোম্পানি। এদিকটায় নজর দেওয়ার সময় এসেছে। সর্বোপরি, নীতি গ্রহণ ও বাস্তবায়ন প্রক্রিয়ায় তামাক কোম্পানির নগ্ন হস্তক্ষেপ বন্ধ করা অতীব জরুরি। কারণ, তা না হলে আমাদের কাঙ্ক্ষিত ফল অর্জন সম্ভব নয়।

জলবায়ু পরিবর্তন এবং নানা কারণে বাংলাদেশ খাদ্য উৎপাদনে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থানে রয়েছে। পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ, দূষণ নিয়ন্ত্রণ, জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত মোকাবিলা বর্তমান সময়ের চ্যালেঞ্জ। এছাড়া দ্রুতবর্ধনশীল জনগণের জন্য আগামী দিনের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে তামাক ও মাদকের ছোবল থেকে রক্ষার মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ‘সোনার বাংলা’ গড়ে তুলতে তামাক চাষ নিয়ন্ত্রণের বিকল্প নেই। সেই সঙ্গে খাদ্যশস্য উৎপাদনে কৃষকদের উৎসাহিত এবং সার্বিক সহযোগিতা প্রদান একান্ত জরুরি। সরকার এ বিষয়ে আশু পদক্ষেপ নেবে-আজকের দিবসে এটাই প্রত্যাশা।

ড. অরূপরতন চৌধুরী : প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি, মাদকদ্রব্য ও নেশা নিরোধ সংস্থা (মানস); সদস্য, জাতীয় মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ উপদেষ্টা কমিটি এবং জাতীয় তামাক নিয়ন্ত্রণ টাস্কফোর্স কমিটি

prof.arupratanchoudhury@yahoo.com

 

তামাক

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম