Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

সাক্ষাৎকার

সুষ্ঠু নির্বাচন হলে বিদেশি হস্তক্ষেপ কমে যাবে: আসিফ নজরুল

Icon

খালিদ বিন আনিস

প্রকাশ: ০১ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

সুষ্ঠু নির্বাচন হলে বিদেশি হস্তক্ষেপ কমে যাবে: আসিফ নজরুল

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক আসিফ নজরুল একাধারে একজন কলাম লেখক, ঔপন্যাসিক ও রাজনীতি বিশ্লেষক। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যলয়ের আইন বিভাগ থেকে ১৯৮৬ সালে স্নাতক এবং ১৯৮৭ সালে স্লাতকোত্তর সম্পন্ন করেন। ১৯৯৯ সালে সোয়াস ইউনিভার্সিটি অফ লন্ডন থেকে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন। এরপর জার্মানির বন শহরের এনভায়রনমেন্টাল ল’ সেন্টার থেকে পোস্ট ডক্টরেট ফেলোশিপ অর্জন করেন। শিক্ষকতা পেশায় যোগদানের আগে তিনি কিছুকাল সাপ্তাহিক বিচিত্রায় কাজ করেছেন।

সাক্ষাৎকার নিয়েছেন খালিদ বিন আনিস

যুগান্তর : এদেশের রাজনীতিতে অতীতে বিভিন্ন সময় বিদেশি হস্তক্ষেপ দেখা গেছে। এবারের প্রেক্ষাপটে আপনি বিদেশি কূটনীতিকদের এ ধরনের তৎপরতাকে কতটা তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে করছেন?

আসিফ নজরুল : আমি মনে করি এবারেরটা অনেক বেশি তাৎপর্যপূর্ণ। কারণ, এর আগে যখন বিদেশি হস্তক্ষেপ হতো, তখন কিন্তু সবাই মিলে এক পক্ষে হস্তক্ষেপ করত। ভারত, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র-এদের মধ্যে কোনো কনফ্লিক্ট থাকত না। তারা হয়তো বলেছে, কেএম হাসানকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারপ্রধান করলে হবে না, বা ইলেকশনের পদ্ধতিটা এমন হলে হবে না, মানে তাদের মধ্যে মতভেদ ছিল না। কিন্তু এবার আমরা প্রথম দেখতে পাচ্ছি, অত্যন্ত শক্তিশালী দুটি পক্ষ আছে। এক পক্ষে আছে যুক্তরাষ্ট্র আর ইউরোপীয় দেশগুলো, আরেক পক্ষে আছে চীন ও রাশিয়া। চীন ও রাশিয়ার সঙ্গে ভারত কতটুকু আছে সেটা আমরা বুঝতে পারছি না; কিন্তু চীন ও রাশিয়া অন্য একটা পক্ষ। বাংলাদেশ কখনোই বিদেশি হস্তক্ষেপের ক্ষেত্রে কোনো রাজনৈতিক প্রসঙ্গে এ রকম তিনটি পরাশক্তির মাঝখানে পড়ে যায়নি। কাজেই এটা আমি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ মনে করি এবং এটা শুধু নির্বাচনের মধ্যেই থেমে থাকবে না, এটা এ অঞ্চলে কূটনৈতিক, সামরিক ও অর্থনৈতিক যে আধিপত্য পরাশক্তিগুলোর, সেগুলোর মীমাংসা শুরু হওয়ার একটা নির্বাচনও হয়ে দাঁড়িয়েছে। আগের যে কোনো সময়ের চেয়ে বর্তমানে বিদেশি হস্তক্ষেপ, বিদেশি কূটনৈতিক তৎপরতা অনেক বেশি তাৎপর্যপূর্ণ।

যুগান্তর : আমাদের দেশের বর্তমান রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে বিদেশিদের এ ধরনের তৎপরতা কতটা সুফল বয়ে আনবে কিংবা কতটা কুফল বয়ে আনতে পারে বলে আপনি আশঙ্কা করছেন?

আসিফ নজরুল : বিজ্ঞাপনের ভাষা উদ্ধৃত করে বলছি, দাগ থেকে যদি ভালো কিছু হয়, তাহলে খারাপ কী? ২০১৪ ও ২০১৮ সালে যে নির্বাচন দেখেছি, সেগুলো ছিল জঘন্য নির্বাচন। নির্বাচনের নামে পুরো জাতির সঙ্গে নিষ্ঠুর প্রতারণা ও প্রহসন, তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করা হয়েছে। এখন এ অবস্থা থেকে বের হয়ে আসার ক্ষমতা তো এককভাবে বিরোধী দলগুলো দেখাতে পারছে না বা তাদের দেখাতে দেওয়া হচ্ছে না। এরকম ক্ষেত্রে যদি পজিটিভ অর্থে সুষ্ঠু, অবাধ নির্বাচন করার জন্য বিদেশি হস্তক্ষেপ ঘটে এবং এটার পেছনে যদি বাংলাদেশবিরোধী কোনো এজেন্ডা না থাকে, এটা যদি মূলত হয় অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন, তাহলে তো অবশ্যই এটা সুফল বয়ে আনতে পারে। মানুষের ভোটাধিকার তাতে ফেরত আসবে, অন্তত একটা জনমতের প্রতিফলন ঘটবে, একটা জনগণের সরকার প্রতিষ্ঠিত হবে। কিন্তু অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন, এটা যদি প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর সমঝোতার মাধ্যমে বা বিরোধী দলের আন্দোলনের মুখে হয়, তাহলে তা বাংলাদেশের জন্য তুলনামূলক ভালো হবে বলে আমি মনে করি।

যুগান্তর : আগামী নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু, গ্রহণযোগ্য ও অংশগ্রহণমূলক করতে বিদেশিদের এই যে আগ্রহ, তা কি শুধুই এদেশের গণতান্ত্রিক যাত্রা অব্যাহত রাখার লক্ষ্যে, নাকি অন্য স্বার্থও রয়েছে?

আসিফ নজরুল : আজ যুক্তরাষ্ট্রের ট্রাম্প প্রশাসন যদি অবাধ নির্বাচনের কথা বলতো, আমরা অবাক হতাম। কিন্তু যেহেতু বাইডেনের ঘোষিত নীতিই এটা এবং আমরা জানি যে ডেমোক্রেটরা সাধারণত অন্য দেশে সুষ্ঠু নির্বাচনের ব্যাপারে বেশি আগ্রহী থাকে রিপাবলিকানদের তুলনায়, কাজেই অবশ্যই তাদের কিছুটা ইচ্ছা তো এখানে আছেই অবাধ, সুষ্ঠু, গ্রহণযোগ্য ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন করার। কিন্তু এটি শুধু গণতান্ত্রিক যাত্রা অব্যাহত রাখার লক্ষ্যে, এমনটি অসম্ভব। এটা মূলত হচ্ছে এ কারণে যে, বঙ্গোপসাগরের কৌশলগত গুরুত্ব অনেক; কারণ আপনি জানেন সাউথ-চায়না সি এখান থেকে খুব বেশি দূরে নয়, ভারত মহাসাগরও এর সঙ্গে লাগানো, আবার মিয়ানমারও পাশে। ফলে এ জায়গার নিয়ন্ত্রণটা, বিশেষ করে মেরিন অঞ্চলে, খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আজ চীনের সঙ্গে ভারত, চীনের সঙ্গে আমেরিকার যে লড়াই শুরু হয়েছে কূটনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামরিক ক্ষেত্রে, এখানে এই বঙ্গোপসাগর-ভারত মহাসাগর, এ জায়গার কৌশলগত নিয়ন্ত্রণ রক্ষা করাটা অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়িয়েছে আমেরিকার কাছে। মিয়ানমারের ওপর যে আইনটা করল তারা; বা এখানে তাদের যে কৌশলগত ও সামরিক স্ট্র্যাটেজি, আকসা প্রস্তাব যদি আমরা দেখি, বুঝতে পারি, এ এলাকার গুরুত্ব আমিরকানদের কাছে বেড়েছে চীনের উত্থানের কারণে, মিয়ানমারের এখনকার ভূমিকার কারণে, ইউক্রেন যুদ্ধের পর রাশিয়ার সঙ্গে আমেরিকার প্রচণ্ড প্রতিযোগিতামূলক সম্পর্কের কারণে, রাশিয়ার সঙ্গে হঠাৎ করে চীনের সম্পর্ক উন্নত হয়ে যাওয়ার কারণেও এ অঞ্চলের ভূ-রাজনৈতিক ও ভূ-অর্থনৈতিক গুরুত্ব বেড়ে গেছে। ভূ-রাজনীতি ও ভূ-অর্থনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য এখানে একটা প্রতিযোগিতা চলছে আমেরিকার সঙ্গে অন্যদের। শুধু সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্যই সরকারের ওপর আমেরিকা চাপ দিচ্ছে, এটা মনে হয় না।

যুগান্তর : ব্রিকসে যোগ দেওয়ার সিদ্ধান্ত কি আমাদের দেশের রাজনীতিতে যুক্তরাষ্ট্রের হস্তক্ষেপের অন্যতম একটি কারণ বলে মনে করেন?

আসিফ নজরুল : বাংলাদেশ আসলে ব্রিকসে যোগ দিতে পারছে না ভারতের আপত্তির কারণে। এখন এর দুটি ব্যাখ্যা থাকতে পারে-ভারত কেন আপত্তি জানাল? একটা হতে পারে ভারত বাংলাদেশকে সমান মর্যাদার দেশ হিসাবে দেখে না। বাংলাদেশের বর্তমান সরকারও হয়তো সমান মর্যাদা চায় না, তারা ক্ষমতায় থাকলেই খুশি। ফলে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কটা হয়ে গেছে অনেকটা ‘ক্লায়েন্ট স্টেট’ টাইপের। এখন বাংলাদেশ ব্রিকসের সদস্য হলে তো এমন সম্পর্ক বজায় রাখতে সমস্যা হবে ভারতের অথবা হয়তো ব্রিকসের সদস্য হলে বাংলাদেশ যদি চীনের আরও খুব ঘনিষ্ঠ হয়ে যায়, তাহলে ভারতের জন্য তা খুব থ্রেটফুল হয়ে যেতে পারে। কারণ বর্তমান সরকারকে তো আসলে বিদেশিরা খুব বেশি বিশ্বাস করে না। বর্তমান সরকার ভারতের সঙ্গে খুব ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক থাকা অবস্থায়ও চীনের সাবমেরিন এখানে ঢুকতে দিয়েছে। এরকম অনেক ঘটনা আছে, যে কারণে এ সরকারকে আসলে ভারতও ঠিক আগের মতো বিশ্বাস করে না। ফলে এ আশঙ্কা হয়তো কাজ করেছে ভারতের যে, কোনো দিন যদি বাংলাদেশ চীনের দিকে সরে যায়, তাহলে সেটা তাদের জন্য সমস্যা হবে। আবার হয়তো এমনও হতে পারে, ভারত ব্রিকসে থাকা সত্ত্বেও আমেরিকার সঙ্গে খুব ভালো সম্পর্ক মেইনটেইন করে। হয়তো আমেরিকা ভারতকে চাপ দিয়েছে যে, বাংলাদেশ নিষেধাজ্ঞায় পড়তে পারে, এ অবস্থায় ব্রিকসে যেন না নেওয়া হয়।

আপনি প্রশ্ন করেছেন, ব্রিকসে যোগ দেওয়ার সিদ্ধান্ত আমাদের রাজনীতিতে হস্তক্ষেপের অন্যতম কারণ কিনা। এটি শুধু ব্রিকসের কারণে নয়। বাংলাদেশ সরকারের যে চীনমুখী নীতি, রাশিয়াপ্রীতি, আমেরিকার প্রতি তুচ্ছতাচ্ছিল্য ভাব-সবকিছু মিলে এগুলো হচ্ছে। এর মধ্যে মানবাধিকার আর গণতন্ত্রের এজেন্ডা তো অবশ্যই আছে, যেহেতু বাইডেনের ঘোষিত নীতিই এটি।

যুগান্তর : যদি দেশে বিদেশিদের ঐকান্তিক চেষ্টার ফলে তত্ত্বাবধায়ক কিংবা ঐকমত্যের সরকারের অধীনে একটি নির্বাচন হয়েই যায়, তারপরও দেশে সুশাসনের যে অভাব রয়েছে বলে অভিযোগ আছে, অর্থনৈতিক দুরবস্থা ও দুর্নীতি বিরাজ করছে, তা থেকে উত্তরণ ঘটবে?

আসিফ নজরুল : তত্ত্বাবধায়ক সরকার বা ঐকমত্যের সরকারের অধীনে নির্বাচন হলে এ সমস্যা দূর হয়ে যাবে, এটা ভাবা অতিরিক্ত আশাবাদ। তবে আমরা মনে করি, এতে দেশের কুশাসন কমবে, অর্থনৈতিক দুরবস্থা ও দুর্নীতি অনেকাংশে দূর হবে। আপনি একটু খেয়াল করে দেখেন, ১৯৯১ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত দুটি করে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির সরকার ছিল। তখন এত বেশি অনাচার ছিল না, এত বেশি কুশাসন ছিল না। এত ব্যাপক মাত্রায় অর্থনৈতিক দুর্নীতি, দুরবস্থা হয়নি, যা আজকে বাংলাদেশে দেখা যাচ্ছে। আমরা আগে ইতিহাসে পড়তাম, সুলতান মাহমুদ সতেরো বার ভারত আক্রমণ করেছিল লুটপাট করার জন্য। আর এখন যেন প্রায় সতেরো বছর ক্ষমতায় থাকা হয়েছে একইভাবে বাংলাদেশকে লুটপাট করার জন্য, লুটের টাকা বিদেশে পাচার করার জন্য। এ পরিমাণ দুর্নীতি আর অনাচার এখন কেন হচ্ছে? কারণ এ সরকারের কোনো জবাবদিহিতা নেই, তারা তো জনগণের ভোটে নির্বাচিত নয়। তারা জনগণের প্রতি জবাবদিহিতা অনুভব করে না। লুটেরা, খারাপ লোকজন, অসৎ ব্যবসায়ী, শক্তির তাণ্ডব দেখানো বিভিন্ন বাহিনী-এদের ওপর ভর দিয়ে ক্ষমতায় টিকে আছে এ সরকার। তাই তাদের পৃষ্ঠপোষকতা করছে। ফলে এ মাত্রায় কুশাসন, দুর্নীতি ও দুরবস্থা চলছে। এটা থাকবে না জনগণের ভোটে নির্বাচিত সরকারে এলে, যখন একটা কার্যকর বিরোধী দল থাকবে, সভা-সমাবেশ, বাক-স্বাধীনতা আগের চেয়ে বৃদ্ধি পাবে, জবাবদিহিতা ও জনগণের প্রতি দায়বদ্ধতা থাকবে, তখন এখনকার চেয়ে অবস্থার অবশ্যই উন্নতি হবে।

যুগান্তর : শুধু একটি অবাধ-নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠান সম্পন্ন করতে পারলেই কি বিদেশিরা সন্তুষ্ট হবে, তাদের তৎপরতা বন্ধ হবে?

আসিফ নজরুল : বিদেশি তৎপরতা তখন কমে আসবে। একটা দেশে যখন সুশাসন থাকে, মোটামুটি জাতীয় ঐক্য থাকে, যখন সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার পরিবর্তন হয়, তখন সেই দেশে বিদেশি তৎপরতা কম থাকে। এটা কোনো রকেট সায়েন্স নয়। এখানে সমস্যা না থাকলে বিদেশিরা হস্তক্ষেপ করবে কীভাবে? সমস্যা যখন কম হবে, হস্তক্ষেপ কম হবে। সমস্যা বেশি হলে হস্তক্ষেপ বেশি হবে।

যুগান্তর : রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রীর আসন্ন সফরকে কী চোখে দেখছেন এবং যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা বিশ্ব, ভারত ও চীন এটিকে কীভাবে নেবে বলে আপনার ধারণা?

আসিফ নজরুল : এটা খুবই অ্যাম্বিশাস একটা পদক্ষেপ নিয়েছে বাংলাদেশ সরকার। মনে হচ্ছে যেন তারা আমেরিকা-ইউরোপের সঙ্গে লড়ার জন্য প্রস্তুত হয়ে আছে। এটার একটা চেষ্টা হচ্ছে রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে সফরে এনে। এর আগে প্রতিরক্ষা সচিবও এসেছিলেন। আমার মনে হয়, এটা বাংলাদেশ সরকারের জন্য খুব ভালো পদক্ষেপ হবে না, কারণ আন্তর্জাতিক আধিপত্য বিস্তারের ক্ষেত্রে রাশিয়া আমেরিকার ধারেকাছেও নেই। আমেরিকা সন্দেহ করে, বাংলাদেশের বর্তমান সরকার যে কোনো মূল্যে ক্ষমতায় থাকতে চায়, দরকার হলে পুতিনের মডেলে সরকার প্রতিষ্ঠা করে, উত্তর কোরিয়ার মডেলে বা মিয়ানমারের মডেলে সরকার প্রতিষ্ঠা করে। এ সন্দেহগুলো, সেই সংশয়গুলো আরও জোরদার হবে এবং ইউরোপ বা আমেরিকা হস্তক্ষেপ করার আরও বেশি যৌক্তিকতা খুঁজে পাবে এসব সফরকে কেন্দ্র করে।

যুগান্তর : বিদেশিদের এ ধরনের তৎপরতা আমাদের দেশের ভবিষ্যৎ রাজনীতি ও সমাজব্যবস্থায় কী ধরনের পরিবর্তন আনতে পারে?

আসিফ নজরুল : পরিবর্তন দুধরনের হতে পারে। আমেরিকা যদি কোনো দেশে ইনভল্ভড হয়, সেক্ষেত্রে এর ভালো উদাহরণও আছে, যেমন কাতারের মতো একটা ছোট দেশ, আমেরিকার বন্ধু হওয়ার পর বিশাল প্রভাবশালী রাষ্ট্র হয়ে গেছে। আবার দক্ষিণ কোরিয়ার মতো একটা রাষ্ট্র আমেরিকার সঙ্গে বন্ধুত্ব হওয়ার পর, আমেরিকার আনুকূল্য পাওয়ার পর তারা অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে উত্তর কোরিয়ার চেয়ে অনেক বড় দেশ হয়ে গেছে। আবার আমেরিকা খারাপভাবে ইনভল্ভড হয়েছে যেসব দেশে, সেখানে ভয়াবহ খারাপ অবস্থা নেমে এসেছে, যেমন আফগানিস্তান বা ইরাক এর উদাহরণ। ফলে অবস্থা কোনদিকে যাবে সেটা নির্ভর করে আমাদের অভ্যন্তরীণ শক্তির ওপর। আমরা বিদেশি হস্তক্ষেপকে আমাদের অনুকূলে কাজে লাগাতে পারছি কিনা, সেটার ওপর। আরও আমাদের সচেতনতাটা আছে কিনা, আমরা সক্ষম কিনা, আমাদের জাতীয় ঐক্য আছে কিনা, আমাদের দেশপ্রেম আছে কিনা এবং আমাদের দক্ষতা আছে কিনা, আমাদের পরিস্থিতি বোঝার ক্ষমতা আছে কিনা, আমাদের সেই লিডারশিপ আছে কিনা। তো সেগুলো যদি থাকে, তাহলে বিদেশি হস্তক্ষেপ হয়তো আমাদের জন্য ইতিবাচক হতে পারে।

যুগান্তর : বাংলাদেশের নির্বাচন প্রশ্নে আমেরিকা ও ভারতের স্বার্থ কি সাংঘর্ষিক হবে?

আসিফ নজরুল : আমার মনে হয় না সে রকম সাংঘর্ষিক হবে। আমরা যেটা বুঝতে পারি, ভারতের দুশ্চিন্তা হচ্ছে এখানে মৌলবাদী শক্তি বা জামায়াত যেন প্রেফারেন্স না পায়, আগামী নির্বাচনের মধ্য দিয়ে তারা যেন শক্তিশালী না হয়ে ওঠে। তো আমার মনে হয় না আগামী নির্বাচনে যদি বিএনপি বিজয়ীও হয়, তারা জামায়াতকে সে রকম শক্তি অর্জন করতে দেবে বা এটা করতে দিয়ে ভারতের চক্ষুশূল হওয়ার ঝুঁকি নেবে, তাদের তো অনেক শিক্ষা হয়েছে। আমি নিজেও মনে করি, দুটি দলের আলাদাভাবে নিজেদের মতো রাজনীতি করা উচিত। কারণ আমি বিশ্বাস করি না বিএনপি ও জামায়াতের রাজনীতি এক। ভারতের দুই নম্বর কনসার্ন হচ্ছে, যদি বিএনপি নির্বাচনে জিতে আসে, তাহলে তারা বাংলাদেশের মাটিতে ভারতের বিচ্ছিন্নতাবাদী তৎপরতা করার সুযোগ দেবে কিনা। আমি বিশ্বাস করি, বিএনপির তো অনেক শিক্ষা হওয়া উচিত এতদিনে। বিএনপি যদি কখনো ক্ষমতায় আসে বা যে কোনো দলই ক্ষমতায় আসুক না কেন, বাংলাদেশের মাটিকে কখনোই ভারতবিরোধী বিচ্ছিন্নতাবাদী তৎপরতার জন্য ব্যবহার করতে দেওয়া উচিত নয়।

শুধু রাজনৈতিক বা নিরাপত্তার কারণে নয়, আমাদের নৈতিকতার কারণেও। একটা দেশ আমাদের দেশকে স্বাধীন হতে সাহায্য করেছে, এখন সেই দেশকে আমি টুকরো করার জন্য অন্যদের সাহায্য কেন করব? এটা কোনোভাবেই নৈতিক দিক থেকে গ্রহণযোগ্য নয়। বাংলাদেশে যে সরকারই ক্ষমতায় আসুক, ভারতের সঙ্গে একটা উইন-উইন সম্পর্ক রেখে একটা সম্মানজনক, মর্যাদাপূর্ণ, ভারসাম্যপূর্ণ বন্ধুত্ব রাখা উচিত। কাজেই এ ধরনের নিশ্চয়তা যদি ভারত পায় যে, এ রকম একটা সরকার আসতে চলেছে, যে উগ্রপন্থিদের উসকে দেবে না বা এখানে ভারতের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের আশ্রয় দেবে না, আমার ধারণা, ভারত এটুকুতেই কনভিন্সড হলেই খুশি থাকবে। এ দুটি মিনিমাম চাওয়া আমার ধারণা আমেরিকাও মেনে নেবে। ফলে ভারত আর আমেরিকার স্বার্থ ওরকম সাংঘর্ষিক হবে বলে আমি মনে করি না। তারা যদি আমাদের ভালো বন্ধু হয়, এদেশে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য তাদের আমাদের সাহায্য করা উচিত।

যুগান্তর : আপনাকে ধন্যবাদ।

আসিফ নজরুল : ধন্যবাদ।

আসিফ নজরুল সাক্ষাৎকার

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম