একজন শিক্ষকের দৃষ্টিতে রাষ্ট্র ও রাজনীতি

 ড. হাসনান আহমেদ 
০৫ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ১২:০০ এএম  |  প্রিন্ট সংস্করণ
একজন শিক্ষকের দৃষ্টিতে রাষ্ট্র ও রাজনীতি
একজন শিক্ষকের দৃষ্টিতে রাষ্ট্র ও রাজনীতি

এদেশেরই এক জনপ্রিয় প্রয়াত শিল্পীর একটি গান এরকম : ‘আমি ছন্দহারা এক নদীর মতো ছুটে যাই, আমার চলার শেষ কোন সাগরে তার ঠিকানা তো জানা নাই।’ গানের আরেকটা লাইনও না বলে পারছি না, ‘সীমাহারা দূর দিগন্ত পারে, জানি না কোথা ভেসে যায় কোন সে অভিসারে, যারে খুঁজে ফিরি আমি তারে যে...।’ এবার একটা গল্প বলি। বেশ আগের কথা।

তখন দেশে লেখাপড়া শিখতে হতো, কেউ পাশ করিয়ে দিত না, শিখে পাশ করতে হতো। রাজনৈতিক মস্তানরাও কথায় কথায় রামদা, কিরিচ হাতে করে হেডমাস্টারের পিণ্ডি চটকাতে আসত না। শিক্ষকদের, বিশেষ করে হেডমাস্টারদের মেরুদণ্ড বেশ শক্ত ছিল। কোনো রাজনৈতিক পক্ষপাতিত্ব সমাজে চলত না। মানুষের জিব ঘুরাতে হলে জাগ্রত বিবেকের একটা দংশন ছিল।

সমাজে জনপ্রতিনিধিদের কথায় সাধারণ মানুষের আস্থা ছিল। সমাজে নীতিবোধের প্রাধান্য ছিল। এক হেডমাস্টার স্কুলের বারান্দায় বসে অজু করছেন। এক ছাত্র মাথা চুলকাতে চুলকাতে সামনে এসে দাঁড়াল। হেডমাস্টার ছেলেটাকে দেখে চিনে ফেলেছেন। ছেলেটা ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষার আগে টেস্ট-পরীক্ষায় ‘ডিজ্যালাউড’ হয়েছে। ছাত্রটা এসে শিক্ষককে ভদ্রতার সঙ্গে জিজ্ঞেস করল, ‘স্যার, আমি টেস্টে আনএলাউ হলাম কেন?’ হেডমাস্টার কোনো কথা না বাড়িয়ে সরাসরি উত্তর দিলেন, ‘ওই জন্যই, যাও।’ ছেলেটা হেডমাস্টারের উত্তরটা বুঝতে না পেরে আবার একই প্রশ্ন করল। হেডমাস্টারও একই উত্তর দিয়ে নামাজের উদ্দেশে অফিস রুমে ঢুকে পড়লেন।

হবে হবে করে বায়ান্নটা বছর পার করে ফেললাম। এদেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় এবং গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ও ন্যায়নীতি প্রতিষ্ঠায় বারবার ‘আনএলাউ’ হচ্ছি কেন? সারাদিন যত কাজই করি না কেন, মাথা থেকে ভাবনাটা যায় না। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় চৌদ্দ-পনেরো বছরের কিশোর ছিলাম। তেমন বেশি কিছু বুঝতাম না। স্লোগানে অংশ নিয়ে স্লোগান হাঁকতে পারতাম। বর্তমানে যে কোনো সময় জীবনসূর্য অস্ত যাবে। মাঝখানে পেশায় মাস্টারসাহেব হয়েছি। এখন নিজের জীবনে কী পেলাম, কী পেলাম না-তা ভাবি কম।

ভাবি, আমাদের সন্তান ও ছাত্রছাত্রীদের জন্য আমরা কেমন বাংলাদেশ রেখে যাচ্ছি! তারা কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে? তারা যা দেখে, তা-ই শেখে। সর্বৈব মিথ্যাচার, শঠতা, ঠগবাজি, প্রকাশ্য চাটুকারিতা, ব্যক্তি ও গোষ্ঠী স্বার্থান্ধতা ছাড়া শেখার আর কী আছে! এদেশে সামাজিক শিক্ষা বলতেও কি কিছু আছে? স্বাধীন-সার্বভৌম এ ভূখণ্ডটা মানুষের মতো মানুষদের জন্য স্বর্গ, নাকি নরকতুল্য? আরও কত কিছু দুর্ভাবনা মাথার মধ্যে অবিরাম ঘুরপাক খায়। নিজেকে স্থির রাখতে পারি না বলেই হয়তো এসব কথা প্রকাশ করি। আমরাও তো এদেশের নাগরিক। দেশটা তো আমাদের সবার। কেউ দেখি দুচোখ দিয়ে, কেউবা এক চোখে।

স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র ঘাঁটলে কয়েকটি কথা আজও চোখে ভাসে : বাংলাদেশের জনগণের জন্য সাম্য, মানবিক মর্যাদা, সামাজিক ন্যায়বিচার এবং সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্র। মাঝেমধ্যেই রাতে বালিশে মাথা রেখে আকাশপাতাল চারণ করি। বায়ান্নটা বছরেও আমরা এগুলোর একটাও অর্জন করতে পেরেছি কি? কাউকে জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছা হয়, আমাদের ঠিকানা কোথায়? আমরা এভাবে ‘আনএলাউ’ হলাম কেন? এসব ভেবেই হয়তো কেউ কেউ অবৈধভাবে টাকা লুটপাট করে সুখের আশায় অন্য দেশে টাকা পাচার করছে।

কেউবা যোগ্যতা অর্জন করতে না পেরে অবৈধভাবে বিদেশ যেতে সাগর পাড়ি দিতে গিয়ে ভূমধ্যসাগরে ডুবে মরাকেও শ্রেয় মনে করছে। দেশটা কি এতই খারাপ! আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের সেই স্বদেশি মূল্যবোধ, আত্মজিজ্ঞাসা, ত্যাগের মহিমা কোথায় হারাল? আমাদের মানবতাবোধ বলতে কি কিছুই আর অবশিষ্ট আছে? একজন ব্যক্তি যতক্ষণ পর্যন্ত আমার অন্যায় কাজে সমর্থন দেয়, ততক্ষণ সে ধোয়া তুলসীপাতা। যেই-না আমার অন্যায় কাজের বিরোধিতা করে, তখনই তার মতো খারাপ লোক আর এ পৃথিবীতে একটিও নেই। এ আবার কেমন বিবেকবোধ? আমরা মনুষ্যত্ববোধের কোন অবনতির দিকে ধেয়ে চলেছি! কেন চলেছি?

শিক্ষক হয়েছি বলে সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ, হাইস্কুলের অসংখ্য সহকর্মীর সঙ্গে আমার সখ্য। শিক্ষামানের যে শোচনীয় অবস্থার কথা আমি জানি, তাদের কাছে আরও বেশি শুনি। এদেশের শিক্ষার মান যে কোনো পর্যায়ে নেমে গেছে, সংশ্লিষ্ট মহল ছাড়া কাউকে বলে বোঝানো যাবে না। একজন কলেজ শিক্ষক বললেন, ‘ভাই, এইচএসসি পরীক্ষার মাত্র দশ-পনেরোটা খাতার লেখা স্যাম্পল হিসাবে দেখলেই বুঝবেন এদেশে লেখাপড়া বলতে কিছু হয় না। তবু চাকরি টিকিয়ে রাখতে আমরা নম্বর দিই, পাশ করাই।

বাস্তব কথাটা কোথাও বলতে পারি না, দোষ নিজের গায়ে এসে পড়ে।’ আমিও বুঝি, সম্মিলিত প্রচেষ্টা ছাড়া কোনো একক ব্যক্তির চেষ্টা এক্ষেত্রে বৃথা। সম্মিলিত প্রচেষ্টা যারা দেখাবেন, তারা রাজনীতি নিয়ে মহাব্যস্ত। শিক্ষার উন্নয়নে হাজার হাজার কোটি টাকার প্রজেক্ট নিচ্ছি। বাস্তব শিক্ষামানের উন্নতি না দেখা পর্যন্ত বিশ্বাস করি না। কত সহকর্মীর কাছেই তো একই কথা শুনছি, স্বচক্ষে দেখছি। কী করতে পারছি! একটা দেশের শিক্ষা ধ্বংস হয়ে গেলে জাতি ধ্বংস হতে আর কী বাকি থাকে? অথচ মনে মনে তা হয়ে চলেছে।

আরেকটা হলো দুর্নীতির অবস্থা। একটা জাতির ধ্বংসের জন্য এ দুটো উপাদানের পতনই যথেষ্ট। তাহলে আমরা কিসের এত বড়াই করি? একটা স্বাধীন ভূখণ্ডের অস্তিত্ব ছাড়া আমাদের আর অস্তিত্ব কোথায়? আমরা মানুষ, না মানুষ নামের কলঙ্ক? পত্রিকা খুললেই দুর্নীতি, পুকুর চুরি, নদী চুরি, এমনকি সাগর চুরিও চোখে পড়ছে। চুরি-দুর্নীতি, ব্যাংক ডাকাতি, খুনাখুনি সাধারণ সহনশীলতার পর্যায়ে চলে এসেছে।

কাকে বলব? কে শোনে কার কথা? আইনের শাসন কই? পরিবেশ-পরিস্থিতি ক্রমেই নিুগামী হচ্ছে। কারণ আমরা মনুষ্যত্বের বৈশিষ্ট্য হারিয়েছি, নীতিবান মানুষ যে দেশে হারিকেন ধরিয়ে খুঁজতে হয়। প্রতিটি সেক্টরে, প্রতিটি কাজে দুর্নীতি ‘ওপেন সিক্রেট’ ব্যাপার হয়ে গেছে; কেউ এর প্রতিবিধান নিয়ে কোনো কথাও আর বলে না। ভালো মানুষ কিছু থাকলে তারা আর ধর্তব্যের মধ্যে পড়ে না। মূল্যবোধসম্পন্ন মানুষ তো হঠাৎ করে এক রাতে তৈরি হবে না! এমনটি হলে সেদেশ কেমন চলা উচিত?

শিক্ষা মানুষের মনুষ্যত্ববোধ জাগিয়ে তোলে। মনুষ্যত্ববোধ-জাগানিয়া শিক্ষা কোথায়? চিন্তাভাবনা, কথা ও আচার-আচরণের মধ্যে তো মানুষের মনুষ্যত্ব থাকতে হবে, তারপর কর্মে তা প্রকাশ পাবে। আমরা মনুষ্যত্ববোধের জাগরণ না শিখিয়ে বাহ্যিক লৌকিকতা ও লোকদেখানো সৌজন্য শেখাতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছি। তাই ‘আনএলাউ’ হয়ে গেছি।

দেশের রাজনীতিতে পুরো বিপরীতমুখী দুটি ধারার জেদাজেদি শুরু হয়ে গেছে। যে যা-ই করুক, চরম ভোগান্তিটা সাধারণ মানুষের জন্য। বিরোধী পক্ষেরও জেল-জুলুম-নির্যাতন কম নয়। প্রত্যেক ভাত-খাওয়া মানুষের কোনটা সত্য, কোনটা মিথ্যা, যৌক্তিক-অযৌক্তিক এ বোধটুকু অন্তত আছে। আমরা নিকট অতীতে নিজেই মানুষের আস্থা নষ্ট করেছি, তাই যত ভালো নির্বাচনের প্রতিশ্রুতিই দিই না কেন, আমাদের কথায় কেউ আস্থা রাখতে পারছে না। এ দোষের দায় অন্যের ওপর চাপাই কী করে? কয়েক মাস আগে তুরস্কে জাতীয় নির্বাচন হয়ে গেল। সেখানে সরকারি দলে থেকে এরদোয়ান ৪৯.৪৯ শতাংশ ভোট পেলেও ৫০ শতাংশের বেশি পাওয়ার জন্য পুননির্বাচন দিতে হলো।

এ থেকে আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোর অনেক শিক্ষণীয় ছিল। আমরা ভালো কিছু শিখতেও চাই না, আবার চর্চাও করি না। শুধু জোর করে নিজেদের কুকর্ম সাধারণ মানুষের ওপর চাপিয়ে দিই; আর বলি, ‘আমি যা করি তা তোমরা করো না, আমি যা বলি তা তোমরা শোনো।’ আমাদের স্বভাব ও কর্মের পরিবর্তন না হলে শুধু মুখ দিয়ে ঠেলে দেশকে বেশিদূর নিয়ে যাওয়া যাবে না। আমরা বিভিন্ন যুক্তি দেখিয়ে যত চাতুর্যপূর্ণ বয়ানই করি না কেন, সাধারণ মানুষ সবই বোঝে; আমরা ঠিকানা ভুলে যাচ্ছি।

আমাদের দলীয় রাজনীতির ঊর্ধ্বে উঠে দেশের স্বার্থকে প্রাধান্য দিতে হবে। এদেশের কোনো বড় দল বুকে হাত দিয়ে বলতে পারবে না যে, তারা অতীত থেকে আজ পর্যন্ত নিজেরা নিজেদের সমস্যার সমাধান করেছে। বড় দলের সবাই বারবার বিদেশিদের কাছে আমাদের একই অভ্যন্তরীণ সমস্যাকে মেটানোর জন্য সত্য-মিথ্যা মিলিয়ে দেশের বিরুদ্ধে বলেছে। আমরা কেউই ধোয়া তুলসীপাতা মূলত নই।

রাষ্ট্রের মালিক যদি জনগণই হয়ে থাকে, আবার জনগণের মতামতকেই যদি প্রাধান্য দিই, তাহলে জাতীয় নির্বাচনে ‘দলনিরপেক্ষ’ বা ‘নির্দলীয়’ সরকারব্যবস্থা সম্পর্কে মতামত জানার জন্য নির্দলীয় কারও অধীনে আমরা একটা গণভোটেরও তো আয়োজন করতে পারি। তবে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য দুই-তিন মাসের নির্দলীয় সরকারব্যবস্থার আয়োজন যতই করি না কেন, পাঁচ বছর পর একই সমস্যা যে আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠবে না, তার নিশ্চয়তা কোথায়? এজন্যই বলি, গণভোট যদি করতেই হয়, সংবিধান পরিবর্তনের জন্যও গণভোটের কাজ একবারে চুকিয়ে ফেলা দরকার।

অতঃপর নির্দলীয় সরকার আইন, বিচার ও প্রশাসন বিভাগে যত পরিবর্তন আনা প্রয়োজন, তা যথাযথ ও সুষ্ঠু-নিরপেক্ষভাবে প্রয়োগ করে দেশটাকে পথে আনবে, আইনের শাসন নিশ্চিত করবে। তারপর জাতীয় নির্বাচনের মাধ্যমে আবার রাজনীতিকদের হাতে তুলে দেবে। আমাদের রাজনীতিকদের কথা বিশ্বাস করা কষ্টকর। আমাদের রাজনৈতিক ব্যবস্থার পরিবর্তন অপরিহার্য হয়ে দাঁড়িয়েছে।

বর্তমার ব্যবস্থায় দেশ ভালোভাবে চলার ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার কোনো আশার আলো দেখি না। এদেশের রাজনীতির প্রতিটি অঙ্গে যে পচন ধরেছে, তাতে সহজ টোটকা চিকিৎসায় রোগ নিরাময় হওয়ার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। এ জনগোষ্ঠীকে সামাজিক ও প্রাতিষ্ঠানিক সুশিক্ষা দিয়ে সুশিক্ষিত বানানো এবং দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা না করা পর্যন্ত জাতির সামনে কোনো ভবিষ্যৎ নেই।

কোনো পক্ষ, দল বা নাগরিক সমাজ যদি পারে বিপরীতমুখী দুটো পক্ষকে যেভাবেই হোক আলোচনার টেবিলে বসতে বাধ্য করুক। তাদেরই সমাধানে আসতে হবে। এর কোনো বিকল্প দেখি না। উভয়পক্ষ একে অন্যের প্রতি যতই কাদা ছোড়াছুড়ি করে আসর মাতানোর চেষ্টা করুক, এবারের নির্বাচন বিগত নির্বাচনের মতো জোড়াতালি দিয়ে হবে না।

দেশের অর্থনৈতিক অবস্থাও ভালো নয়। পশ্চিমা গণতান্ত্রিক শক্তি ও পার্শ্ববর্তী ভারতীয় শক্তি যতই সাহস জোগাক না কেন, শেষ দায়টা এদেশকেই বহন করতে হবে। এভাবে চললে সামাজিক বিশৃঙ্খলা, সাধারণ মানুষের ভোগান্তি কোনোক্রমেই কমবে না। উভয়েরই এই শুভবুদ্ধির উদয় যত তাড়াতাড়ি হবে, ততই সাধারণ মানুষের মুক্তি, দেশেরও মঙ্গল।

যুবক বয়সে সিনেমা দেখতে যেতাম। একটা সিনেমায় সব কয়েদিকে কয়েদিদের পোশাক পরে বৃত্তাকারে বসে থালা বাজিয়ে গান গাইতে দেখেছিলাম, ‘এই জেলখানাকে নেব আপন করে, ও বন্ধু রে, এখানে সবাই কয়েদি।’ যদি কেউ প্রশ্ন করে, “স্যার, আমি ‘আনএলাউ’ হলাম কেন?” উত্তরটা, ‘ওই জন্যই’।

ড. হাসনান আহমেদ : অধ্যাপক, ইউআইইউ; গবেষক ও শিক্ষাবিদ; প্রেসিডেন্ট, জাতীয় শিক্ষা-সেবা পরিষদ

 

যুগান্তর ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন