চেতনায় বুদ্বুদ
এ কী কথা শুনি আজ মথুরার মুখে!
বদিউর রহমান
প্রকাশ: ১২ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
নির্বাচন ঘনিয়ে আসছে। অতএব ক্ষমতাপ্রত্যাশী রাজনৈতিক দলগুলোর এখন বড় বেশি ব্যস্ততা। কেউ এককভাবে, আবার কেউ জোটবদ্ধভাবে-যারা যেভাবে পারে প্রতিদ্বন্দ্বী পক্ষকে হেনস্তা করতে মহাব্যস্ত। জনগণের মধ্যে ভোটের প্রতি আগ্রহ সৃষ্টির থেকেও নিজেদের কর্মকাণ্ডের ঢোল বাজাতে অথবা বিরোধী পক্ষের অপকীর্তির প্রচারেই এখন সবাই ব্যস্ত। সাম্প্রতিক সময়ের রাজনৈতিক বক্তব্যগুলো বলা চলে, অতীব বিরক্তিকর এবং ঘ্যানর-ঘ্যানর মার্কা। সুস্থ-সুন্দর নির্বাচনের জন্য জনগণকে স্বস্তিদায়ক কোনো কথা কোনো পক্ষই বলছে না। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ব্যস্ত বিএনপির অতীত ব্যর্থতা, জন্মের অপকর্ম এবং তাদের জ্বালাও-পোড়াওয়ের কাসুন্দি নিয়ে। আর বিএনপি ব্যস্ত আওয়ামী লীগের স্বৈরাচার, কর্তৃত্বপরায়ণতা এবং গণতন্ত্রের তথা নির্বাচনের সংস্কৃতির বিনাশ নিয়ে। মির্জা ফখরুল ভদ্রজন, মার্জিত বক্তব্য নিয়েই বেশি আবির্ভূত হন। রিজভীর মধ্যে লাগামছাড়া ভাব আছে। অন্যদিকে শেখ হাসিনার ধারালো আক্রমণ বিএনপির আঁতে ঘা দেয়। কিন্তু ওবায়দুল কাদেরের মধ্যে বেশ লাগামছড়া ভাব লক্ষণীয়। রাজনীতিতে মেঠো বক্তৃতায় এমন হতেই পারে, কিন্তু তারও একটা সীমা-পরিসীমা থাকা আবশ্যক এবং কাম্য তো বটেই। অথচ আমরা কোনো পক্ষ থেকেই তেমন সুস্থতা, ধীর স্থিরতা, সহিষ্ণুতা এবং জনতুষ্টির বক্তব্য পাচ্ছি না। হালে সবচেয়ে বড় বেফাঁস বক্তব্য দিয়ে দিলেন ওবায়দুল কাদের। আমরা যারপরনাই অবাক হলাম।
২৬ আগস্ট, ২০২৩ মিরপুর-১-এর দারুসসালাম বালুর মাঠে আওয়ামী লীগের এক আলোচনাসভা ও দুস্থ ব্যক্তিদের মধ্যে খাদ্য বিতরণ অনুষ্ঠানে ওবায়দুল কাদের বলেন, বিএনপি ক্ষমতায় এলে এক রাতেই আওয়ামী লীগকে শেষ করে দেবে। ক্ষমতায় এলে আওয়ামী লীগের ওপর কোনো প্রতিশোধ নেওয়া হবে না, বিএনপি নেতাদের এমন বক্তব্যের জবাবে ওবায়দুল কাদের বলেন, বিএনপির মুখে মধু, অন্তরে বিষ। তারা আওয়ামী লীগকে নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছে, আবার ক্ষমতায় এলে এক রাতের মধ্যে বাকিটা শেষ করে দেবে (যুগান্তর, প্রথম আলো, ২৭ আগস্ট)। বিএনপির বিরুদ্ধে কাদের আরও বিষোদ্গার করেছেন। তার এমন বলায় এখন আমরা অভ্যস্ত। বিএনপিও আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করে। এ দুদল একে অপরকে সামান্যতম সহ্য করতে পারে কি না বোঝা মুশকিল। আওয়ামী লীগের ক্ষোভ অবশ্যই ঐতিহাসিক। ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট সপরিবারে বঙ্গবন্ধু হত্যা, ২১ আগস্ট ২০০৪-এর গ্রেনেড হামলায় শেখ হাসিনাকে হত্যার চেষ্টা, ১৯৭৫-এর জেলহত্যা-সবই তো আওয়ামী লীগকে ধ্বংস করার জন্যই। আওয়ামী লীগকে নেতৃত্বশূন্য করার জন্যই তো ৭৫-এর নভেম্বরের জেলহত্যা। এমনকি চট্টগ্রামের লালদীঘি ময়দানের জনসভায় গুলিও তো হাসিনাকে হত্যার উদ্দেশ্যেই, হোক না তাতে পুলিশের সংশ্লিষ্টতা প্রমাণিত হয়েছে। এসব প্রচেষ্টার পেছনে বিএনপির সংশ্লিষ্টতা কি উড়িয়ে দেওয়া যায়? হ্যাঁ, বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করেই তো জিয়া ক্ষমতাসীন হয়েছে, নাকি? খুনিদের ইনডেমনিটি তো জিয়াই দিয়েছেন, নাকি? ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার সঙ্গে বিএনপি নেতাদের সংশ্লিষ্টতা কি এখন আর অস্বীকার করা যাবে? জজ মিয়া নাটক তো বিএনপি সরকারই করেছে, নাকি? আগের এসব ঘটনা থেকেই বোধকরি ওবায়দুল কাদেরের বক্তব্যের প্রথম অংশের আংশিক সত্যতা মেলে-অর্থাৎ বিএনপি আওয়ামী লীগকে কিছুটা হলেও নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছে। আংশিক সত্য বলি এজন্য যে, বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যাও, আওয়ামী নেতাদের হত্যা করে আওয়ামী লীগের যথেষ্ট ক্ষতি করা হয়েছে। কিন্তু আমরা এ কথা বিশ্বাস করি না যে, বিএনপি আওয়ামী লীগকে নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছে। হ্যাঁ, আওয়ামী লীগকে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার সর্বাত্মক চেষ্টা হয়তো বিএনপির ছিল, কিন্তু নিশ্চিহ্ন করে দিতে পারেনি। বঙ্গবন্ধু হত্যায় আওয়ামী-বিশ্বাসঘাতকতাও তো অস্বীকার করা যাবে না। খন্দকার মোশতাক কি আওয়ামী লীগের নেতা ছিলেন না? অন্য আওয়ামী নেতারা কি মোশতাককে তখন সমর্থন দেননি?
আওয়ামী লীগ উপমহাদেশের অন্যতম প্রাচীন রাজনৈতিক দল। মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে দলটি গঠিত হয়ে আওয়ামী মুসলিম লীগ থেকে পরে শুধু আওয়ামী লীগ হয়ে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে পূর্ণতা লাভ করে, দেশ স্বাধীন করে। বঙ্গবন্ধু জাতির পিতা হলেন। কিন্তু স্বাধীন বাংলাদেশে আওয়ামী শাসন খোদ বঙ্গবন্ধুর আমলেই হোঁচট খায়। কিন্তু আওয়ামী লীগ তো নিশ্চিহ্ন হয়নি। আওয়ামী লীগকে নিশ্চিহ্ন করার চেষ্টা আর আওয়ামী লীগ নিশ্চিহ্ন হওয়া এক কথা নয়। এ দুটোর মাঝে আকাশ-পাতাল তফাত। এই ওবায়দুল কাদেরই এক অনুষ্ঠানে একবার বলেছিলেন, ’৭১ পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুকে স্বীকার করতে অসুবিধা কোথায়? তার মানে কি ’৭১-পরবর্তী বঙ্গবন্ধুর শাসন প্রশ্নসাপেক্ষ ছিল, এমন বোঝায় না? আওয়ামী লীগ নিশ্চিহ্নের প্রশ্ন উঠত যদি বঙ্গবন্ধুকে হত্যা না করে আওয়ামী দুঃশাসনে দলটির পতন হতো। কিন্তু খুনিরা নিশ্চিত জানত যে, বঙ্গবন্ধু পরিবারের একজনও জীবিত থাকলেও আওয়ামী লীগকে নিশ্চিহ্ন করা কল্পনাতীত। এ জন্যই ওই পরিবারের কাউকে জীবিত রাখতে চায়নি। কপালগুণে বিদেশে থেকে জানে বেঁচে গিয়ে শেখ হাসিনা তো আবার আওয়ামী লীগকে তুলে আনলেন। তাহলে বিএনপি আওয়ামী লীগকে নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছে বক্তব্যটি সত্য নয়। বলা যেতে পারে, নিশ্চিহ্ন করার চেষ্টা করেছে, তবে ব্যর্থ হয়েছে। এ প্রসঙ্গে এটাও বলা যায়, জিয়া খুন না হলে হয়তো আওয়ামী লীগকে নিশ্চিহ্নের আরও চেষ্টা চলত। সঙ্গে সঙ্গে এটা বলা অবশ্যই সংগত হবে যে, শেখ হাসিনা আওয়ামী লীগের দায়িত্ব না নিলেও আওয়ামী লীগকে নিশ্চিহ্ন করার চেষ্টা হয়তো আরও জোরদার করতে পারত বিএনপি। তিন উদ্দিনের সরকারের আমলেও শেখ হাসিনাকে বাদ দিয়ে আওয়ামী লীগকে নিশ্চিহ্ন করার অরেক চেষ্টা নেওয়া হয়েছিল, সে চেষ্টা আওয়ামী নেতাদের দিয়েই করার ছক ছিল কিন্তু। তাহলে আমরা পরিষ্কার বুঝলাম যে, আওয়ামী লীগকে নিশ্চিহ্ন করতে হলে আওয়ামী লীগ নেতাদের মাধ্যমেই করতে হবে, অন্যভাবে নয়। অন্যেরা চেষ্টা করতে পারে, কিন্তু তা কখনো সম্ভব হবে না, যদি আওয়ামী-গাদ্দাররা তাদের সঙ্গে একাত্ম না হয়, যেমনটি ঘটেছে মোশতাকের সময় এবং তিন উদ্দিনের সময়।
এবার আসা যাক ওবায়দুল কাদেরের বক্তব্যের দ্বিতীয় অংশে তথা মূল অংশে। তিনি বললেন, বিএনপি ক্ষমতায় এলে এক রাতেই আওয়ামী লীগকে শেষ করে দেবে। অর্থাৎ আগে যেটুকু করেছে তা তো করেছেই, বাকিটুকুও শেষ করে দেবে। এমন অর্বাচীন বক্তব্যের নানাবিধ ব্যাখ্যা থাকতে পারে। এক রাতেই যদি আওয়ামী লীগকে বিএনপি শেষ করে দিতে পারত, তাহলে জিয়া এবং খালেদা জিয়া, এমনকি সাত্তারও তো বিএনপিকে ক্ষমতায় থাকাকালীন নেতৃত্ব দিয়েছেন, কিন্তু অওয়ামী লীগকে এক রাতে কেন, দীর্ঘ মোয়াদেও তো শেষ করতে পারেননি। এমন ইতিহাস থাকা সত্ত্বেও ওবায়দুল কাদের এমন একটা বাজে আশঙ্কা কেন প্রকাশ করলেন? আমরা তা একটু পর্যালোচনা করে দেখতে চাই। এক. নির্বাচন খুব কাছে বিধায় দলের সাধারণ সম্পাদক হিসাবে কাদের দলীয় নেতাকর্মীদের আরও বেশি তৎপর করার জন্য এমন ভীতিসঞ্চারক বক্তব্য দিয়ে থাকতে পারেন। তার হয়তো বিশ্বাস জন্মেছে যে, খেলা হবে, খেলা হবে বলে বলে নেতাকর্মীদের যত না চাঙা করা গেছে, বিএনপি ক্ষমতায় এলে এক রাতেই আওয়ামী লীগকে শেষ করে দেবে বললে নেতাকর্মীরা নিজেদের অস্তিত্বের প্রশ্নে, টিকে থাকার প্রশ্নে, নিজেদের ক্ষমতায় থাকাকালীন অর্জিত বৈধ-অবৈধ সম্পত্তি রক্ষার তাগিদে আরও চাঙা হবেন, মারমুখী হবেন, আবার দলের ক্ষমতায় আসার জন্য নিবেদিতপ্রাণ হবেন। মনস্তাত্ত্বিকভাবে মানুষ সাধারণত নিজের অস্তিত্ব এবং সহায়সম্পদ রক্ষার্থে যে কোনো পর্যায়ে যেতে দ্বিধা করে না। কাদেরের বক্তব্য ভীতি প্রদর্শনের মাধ্যমে উদ্বুদ্ধকরণের শামিল বলা যায়। দুই. শেষবার বিএনপি নির্বাচনে জয়ী হওয়ার পর ২০০১ সালে আওয়ামীবিরোধী যে কাণ্ড ঘটিয়েছিল, কাদের হয়তো সেদিকে ইঙ্গিত করে দলীয় নেতাকর্মীদের সাবধান করতে চেয়েছেন। তিন. সাম্প্রতিক বিএনপির সভা-সমাবেশ, মিছিলে বড় রকমের জনসমাগম দেখে কাদেরের মধ্যে নির্বাচনে বিএনপির জয়লাভের একটা অঘোষিত ভীতিও হয়তো কাজ করছে। এমন ভীতি কাদের তার অজান্তেই হয়তো প্রকাশ করে ফেললেন এবং তেমন জয় যেন বিএনপির না হয় তজ্জন্য আগেই সাবধানতা-হুংকার ছাড়লেন। এমন ভীতি প্রকারান্তরে আওয়ামী দুর্বলতারই বহিঃপ্রকাশ। শেখ হাসিনাও যখন বলেন, জনগণ ভোট দিলে আছি, না হলে নেই-তখন বোঝা যায়, এটা শুধু সহি নির্বাচনের প্রচারণাই নয়, এটা হারলেও মুখ রক্ষার আগাম ঘোষণা যেন।
এখন আমাদের প্রশ্ন, টানা তিন মেয়াদ ক্ষমতায় থাকার পরও, দেশের এত এত উন্নয়ন করার পরও, তৃণমূলের একটা অদ্বিতীয় জনপ্রিয় দল হওয়া সত্ত্বেও বিএনপি ক্ষমতায় এলে এক রাতেই আওয়ামী লীগকে শেষ করে দেবে বলে আসলে ওবায়দুল কাদের কী বোঝাতে চেয়েছেন? তিনিও তো তিন মেয়াদের সাধারণ সম্পাদক, শেখ হাসিনা তো চার দশক পার করা সভাপতি, আওয়ামী লীগ তো ইনশাআল্লাহ আবারও ক্ষমতায় আসছে-এরপরও খোদা নাখাস্তা, বিএনপি ক্ষমতায় এসে গেলে এক রাতেই কি আওয়ামী লীগের কোটি কোটি কর্মী-সমর্থক কর্পূরের মতো মিলিয়ে যাবে? তা-ই যদি হয়, তবে তো আমাদের আরেক প্রশ্ন, তারা কি এতকাল ঘোড়ার ঘাস কেটেছেন? আমরা আশা করব, উসকানিমূলক ও ভীতিসঞ্চারক এমন ফালতু কথা তিনি আর বলবেন না। তবে এমন আশঙ্কা রয়েছে, বিএনপি ক্ষমতায় আসতে পারলে কিছু খুনাখুনি তো হবে, তখন অনেক আওয়ামীই অন্য আওয়ামীকেও খুন করবে।
বদিউর রহমান : সাবেক সচিব, এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান