সাম্প্রতিক সময়ে আমাদের অর্থনীতি যেসব অপঘাতে ক্ষতবিক্ষত, তার মধ্যে অন্যতম হলো অর্থ পাচার। বর্তমান সময়ে আলোচনার শীর্ষবিন্দুতে আছে অর্থ পাচার, কিন্তু ব্যবস্থা গ্রহণের দিক থেকে সবচেয়ে আড়ালে রাখা হয়েছে এ গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুটিকে।
বাংলাদেশের অর্থ পাচার নিয়ে আলোচনা ও উদ্বেগ শুধু বাংলাদেশেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং তা আন্তর্জাতিক পরিধিতে সমভাবে আলোচিত। ওয়াশিংটনভিত্তিক গবেষণা সংস্থা গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটি (জিএফআই) সাধারণত বিশ্বের বিভিন্ন দেশের আর্থিক অনিয়ম নিয়ে কাজ করে। তাদের একটি প্রতিবেদন বলছে, গত ১ দশকে বাংলাদেশ থেকে অর্থ পাচারের পরিমাণ কমপক্ষে ৭ হাজার কোটি ডলার।
সেই হিসাবমতে, বাংলাদেশ থেকে অর্থ পাচারের পরিমাণ প্রতিবছর গড়ে ৭০ হাজার কোটি টাকা। যারা একটু খোঁজখবর রাখেন, তাদের কাছে এটি অনেক পুরোনো তথ্য; কিন্তু এ পুরোনো সমস্যার সমাধানের কোনো নতুন খবর তাদের কাছে নেই। আমাদের প্রবাসী নাগরিকরা মাথার ঘাম পায়ে ফেলে আয় করা রেমিট্যান্স পাঠান বছরে প্রায় ২০ বিলিয়ন ডলার বা ২ লাখ কোটি টাকা। তারপরও তাদের নানাভাবে দেশে অর্থ পাঠানোর জন্য প্রণোদনা-উৎসাহ দেওয়া হয়, জানানো হয় অনুরোধ। অথচ দেশ থেকে অবলীলায় প্রতিবছর পাচার হয়ে যাচ্ছে মোট রেমিট্যান্সের ৩৫ শতাংশের সমপরিমাণ অর্থ। এ কোন শাসনব্যবস্থার মধ্য দিয়ে আমরা চলেছি?
সরকারি মহলকে অর্থ পাচারের বিষয়টিতে ‘নির্মম’ নীরব ভূমিকায় দেখা গেছে। সরকারি মহল থেকে বরাবরই ‘আমাদের কাছে কোনো তথ্য নেই’ কিংবা ‘আপনারা তালিকা দিন’ ধরনের অবজ্ঞার পরিচয় দেওয়া হয়েছে। আমরা সাধারণ মানুষ। অর্থ পাচারের মতো সংবেদনশীল ও গোপনীয় কর্মকাণ্ডের তথ্য সংগ্রহের কোনো উৎস আমাদের থাকার কথা নয়। এর জন্য সরকারের হাতেই বিভিন্ন সংস্থা রয়েছে। সুতরাং, তথ্যপ্রাপ্তির দায় আমাদের ওপর চাপানোর চেষ্টা অভিযোগকে আমলে না নেওয়ারই নামান্তর। আমরা বিভিন্ন গণমাধ্যম ও বেসরকারি গবেষণা সংস্থার কাছ থেকে প্রাপ্ত তথ্যের ওপর ভিত্তি করে উৎকণ্ঠিত হই। তবে এবার খোদ সরকারি দপ্তরের প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। গত মাসে সরকারি শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর জাতীয় রাজস্ব বোর্ডে (এনবিআর) অর্থ পাচারের ওপর একটি প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। সংস্থাটি অর্থ পাচারের ক্ষেত্রে অসাধু ব্যবসায়ীদের সাতটি কৌশলের কথা উল্লেখ করেছে প্রতিবেদনে। প্রতিবেদনে উল্লিখিত শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের সাতটি কৌশল হলো- এক. আমদানি পণ্যের মূল্য বেশি দেখানো (ওভার ইনভয়েসিং); দুই. রপ্তানি পণ্যের মূল্য কম দেখানো (আন্ডার ইনভয়েসিং); তিন. কম ঘোষণায় বেশি পণ্য রপ্তানি; চার. বেশি ঘোষণায় কম পণ্য আমদানি; পাঁচ. কাগজপত্র জালিয়াতির মাধ্যমে রপ্তানি; ছয়. ভুয়া রপ্তানি এবং সাত. শুল্কমুক্ত সুবিধায় আনা পণ্য রপ্তানিতে জালিয়াতি।
শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর সন্ধান পেয়েছে যে, রপ্তানিতে সরকার যে প্রণোদনা দেয় তা হাতিয়ে নিতে জালিয়াতির আশ্রয় নেওয়া হয়ে থাকে। রপ্তানি খাতকে উৎসাহিত করতে বর্তমানে সরকার পণ্যভেদে ১ থেকে ২০ শতাংশ পর্যন্ত নগদ প্রণোদনা দিয়ে থাকে। ওভার ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে পণ্যের মূল্য ও ওজন বাড়তি দেখিয়ে প্রণোদনার অর্থ আত্মসাৎ করা হচ্ছে। প্রতিবেদনে সুস্পষ্ট নাম উল্লেখ করা হয়েছে। যেমন গত বছরের মার্চে সাগর জুট ডাইভারসিফাই ইন্ডাস্ট্রিজ নামে একটি প্রতিষ্ঠান কাস্টমসে ১৮ হাজার পিস (যার ওজন বলা হয়েছে ২ হাজার ৩১২ কেজি) পাটের তৈরি ডোর ম্যাট রপ্তানির ঘোষণা দেয়, যার রপ্তানি মূল্য দেখানো হয় ৮১ লাখ ৩১ হাজার টাকা। কিন্তু কায়িক পরীক্ষায় দেখা যায় ভিন্ন চিত্র। ১৮ হাজার পিসের জায়গায় পাওয়া যায় মাত্র ৬ হাজার ১১৬ পিস (যার ওজন ২৪৪ কেজি) এবং পাটের তৈরি ডোর ম্যাটের পরিবর্তে পাওয়া যায় পাটের তৈরি ন্যাপকিন, যার মূল্য মাত্র ১ লাখ ৫ হাজার টাকা। যদি প্রতিষ্ঠানটি চালানটি রপ্তানি করতে পারত, তাহলে সরকারের কাছে প্রায় ১৬ লাখ টাকা প্রণোদনা দাবি করতে পারত।
আন্ডার ইনভয়েসিংও অর্থ পাচারের একটি কৌশল বলে মনে করে শুল্ক গোয়েন্দা। আন্ডার ইনভয়েসিংটা হয় মূলত রপ্তানি পণ্যের ক্ষেত্রে। আপনি আপনার রপ্তানি পণ্যের মূল্য ঘোষণা করলেন ১০০ ডলার, অথচ এর প্রকৃত মূল্য ১৫০ ডলার। এ বাড়তি ৫০ ডলার আপনার পণ্যের ক্রেতা বিদেশে আপনার অ্যাকাউন্টে জমা করে দেবে। তবে যেসব পণ্যে রপ্তানি প্রণোদনা থাকে না, সাধারণত সেসব পণ্য রপ্তানিতে আন্ডার ইনভয়েসিং করা হয়ে থাকে। শুল্ক গোয়েন্দা এমন তথ্য পেয়েছে। ২ ফেব্রুয়ারি একটি প্রতিষ্ঠান বিদেশে টি-শার্ট রপ্তানির জন্য কাস্টমসে বিল অব এক্সপোর্ট জমা দেয়, যাতে টি-শার্টের মূল্য ১২ টাকা (১২ সেন্ট) ঘোষণা দেওয়া হয়। সাধারণত এত কম মূল্যে টি-শার্ট রপ্তানি হয় না। মূলত অবৈধভাবে অর্থ বিদেশে রেখে দিতেই এ পন্থা অবলম্বন করা হচ্ছে বলে শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর মনে করে।
চতুর্থ কৌশলটি হচ্ছে, কম ঘোষণা দিয়ে বেশি পণ্য রপ্তানি করা। গত বছরের জানুয়ারিতে একটি প্রতিষ্ঠান কাস্টমসে ৬০ হাজার পিস তৈরি পোশাক রপ্তানি করতে বিল অব এক্সপোর্ট জমা দেয়। কিন্তু কায়িক পরীক্ষায় ১ লাখ ২৭ হাজার পিস তৈরি পোশাক পাওয়া যায়। অতিরিক্ত এ ৬৭ হাজার পিস তৈরি পোশাকের মূল্য পাচার হওয়ার ইঙ্গিত দেয়। আবার বেশি ঘোষণা দিয়ে কম পণ্য রপ্তানির ঘটনার প্রমাণও পেয়েছে প্রতিষ্ঠানটি।
নমুনা ঘোষণা আরেকটি কৌশল। প্রতিবেদন বলছে, নমুনা ঘোষণায় পুরো কনটেইনার ভর্তি পণ্য পাঠানো হচ্ছে। এক্ষেত্রে বিভিন্ন নামকরা রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানের ই-এক্সপি জাল করা হচ্ছে। নমুনা পণ্য পাঠানোর ক্ষেত্রে কাস্টমসে মূল্য, এক্সপোর্ট এলসি, কন্ট্রাক্ট ও সেলস অর্ডার উল্লেখ থাকে না। সেক্ষেত্রে কোনো অর্থই দেশে ফিরে না এসে পুরোটাই বিদেশে থেকে যায়। যেমন একটি প্রতিষ্ঠান ৩৭৯ কোটি টাকা, একটি প্রতিষ্ঠান ২৮২ কোটি টাকা এবং একটি প্রতিষ্ঠান ৬২ কোটি টাকার নমুনা পণ্য বিদেশে পাঠিয়েছে; কিন্তু কোনো অর্থই দেশে ফিরে আসেনি।
অর্থ আত্মসাতের সর্বশেষ যে কৌশলটির কথা প্রতিবেদনে উল্লেখিত হয়েছে, তা হলো বিদেশে পণ্য রপ্তানি না করেও শুধু কাগজ জালিয়াতির মাধ্যমে কর্ম উদ্ধার করা। একটি প্রতিষ্ঠান ১১১টি চালান বিদেশে রপ্তানি করে। এ রপ্তানির বিপরীতে ৩১ কোটি ৮১ লাখ টাকা ব্যাংকিং চ্যানেলে বাংলাদেশে আসে। কিন্তু কাস্টমসের তদন্তে উঠে আসে এ প্রতিষ্ঠান কখনো পণ্য রপ্তানি করতে অফডকে বা বন্দরে কনটেইনার পাঠায়নি, এমনকি কোনো কনটেইনার রপ্তানিও হয়নি। শুধু বিল অব এক্সপোর্ট, এলসি, ইনভয়েস ও প্যাকিং লিস্ট জালিয়াতির মাধ্যমে বানিয়ে প্রণোদনার ৬ কোটি ২০ লাখ টাকা আত্মসাৎ করেছে। একই ধরনের একাধিক জালিয়াতির প্রমাণ পেয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। একই কায়দা করে জান্নাত করপোরেশন ১৭৮টি বিল অব এক্সপোর্টের বিপরীতে ৫ কোটি ৮২ লাখ টাকা এবং ফাতিমা করপোরেশন ৬৮টি বিল অব এক্সপোর্টের বিপরীতে ৫ কোটি ৩৪ লাখ টাকার প্রণোদনা হাতিয়ে নিয়েছে।
এভাবেই চলছে রপ্তানির নামে অর্থ পাচার ও আত্মসাৎ এবং তা দিনের পর দিন। জালিয়াতির মাধ্যমে অর্থ পাচার ও সরকারি প্রণোদনা জালিয়াতির মাধ্যমে আত্মসাৎ করার প্রবণতা রোধকল্পে শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর সুস্পষ্ট ছয়টি সুপারিশ করেছে। এগুলো হচ্ছে-রপ্তানি পণ্য চালান পরীক্ষা ও শুল্কায়নের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণ; ঝুঁকিপূর্ণ প্রতিষ্ঠান চিহ্নিত করার মাধ্যমে পণ্যের মূল্য ও সঠিকতা যাচাইয়ের মাধ্যমে রপ্তানির অনুমতি দিতে কাস্টমস হাউজগুলোকে নির্দেশ দেওয়া; রপ্তানি পণ্যের ব্যবহৃত উপকরণের মূল্য, মজুরি, কারখানার ব্যয় ও উৎপাদন খরচ বিবেচনায় ক্যাটাগরিভিত্তিক পণ্যের ন্যূনতম রপ্তানি মূল্য নির্ধারণ করা; পাশাপাশি রপ্তানি পারমিট ইস্যুর আগে বিবরণ ও পরিমাণের ভিত্তিতে পণ্যের প্রকৃত মূল্য প্রদর্শন করা হয়েছে কিনা, তা ব্যাংক বা রপ্তানি পারমিট ইস্যুকারী কর্মকর্তার মাধ্যমে যাচাইয়ের ব্যবস্থা করা।
আমাদের অর্থনৈতিক প্রশাসনের সমস্যা হলো, আমরা অনেক অনিয়ম-দুর্নীতি শনাক্ত করতে অক্ষম, পাশাপাশি কোনো সমস্যা ধরা পড়লে তা প্রতিকারে অপারগ। দেশের শাসনক্ষমতা যেন কোনো অদৃশ্য জায়গা থেকে পরিচালিত হচ্ছে। শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের প্রতিবেদনে যে অনিয়ম প্রকাশিত হয়েছে, তা প্রকৃত আকারের তুলনায় অতি ক্ষুদ্র। তারপরও আমরা চাইব, সরকার প্রতিকারের ব্যবস্থা নেবে। এ প্রসঙ্গে বিশেষজ্ঞের মতামত দিয়েই শেষ করব। শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের সাম্প্রতিক সময়ে প্রকাশিত প্রতিবেদন সম্পর্কে দুর্নীতিবিরোধী সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামানের বক্তব্য হলো, ‘আমদানি-রপ্তানির আড়ালে অর্থ পাচার হচ্ছে, এটি সর্বজনবিদিত। শুল্ক গোয়েন্দা রপ্তানির আড়ালে অর্থ পাচারের পদ্ধতিগুলো শনাক্ত করতে পেরেছে, এজন্য তারা সাধুবাদ পাওয়ার যোগ্য। যারা অর্থ পাচার করছে, তাদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা না নেওয়া গেলে এ প্রবণতা থামানো সম্ভব হবে না। আর শুল্ক গোয়েন্দার প্রতিবেদন সার্থকও হবে না। অসৎ ব্যবসায়ী, কাস্টমস কর্মকর্তা ও ব্যাংক কর্মকর্তা-এ ত্রিপক্ষীয় যোগসাজশ ছাড়া কোনোভাবেই অর্থ পাচার সম্ভব নয়। ইতোমধ্যে অর্থ পাচারের যেসব ঘটনা শনাক্ত হয়েছে, সেসব ঘটনায় জড়িত কাস্টমস ও ব্যাংক কর্মকর্তাদের জবাবদিহিতার আওতায় আনা উচিত।’
মুঈদ রহমান : অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়