সাক্ষাৎকার
প্রতিটি হাসপাতালে পর্যবেক্ষণ ওয়ার্ড প্রস্তুত রাখতে হবে: অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম
খালিদ বিন আনিস
প্রকাশ: ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
দেশের অন্যতম শীর্ষ ভাইরোলজিস্ট অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম ২০০৮-০৯ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) উপাচার্য ছিলেন। বিএসএমএমইউ-এর ভাইরোলজি বিভাগের প্রতিষ্ঠাতা বিভাগীয় প্রধান ছিলেন। তিনি করোনাবিষয়ক জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির সদস্য।
১৯৬৪ সালে ঢাকা মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস পাশ করেন তিনি। একই বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমফিল করেন। ১৯৬৭ সালে লন্ডন ইউনিভার্সিটির সেন্ট টমাস হসপিটাল থেকে হেপাটাইটিস ‘বি’ ভাইরাস বিষয়ে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। সারা দেশে ডেঙ্গুর প্রকোপ নিয়ে সম্প্রতি তিনি যুগান্তরের সঙ্গে কথা বলেছেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন খালিদ বিন আনিস
যুগান্তর : আমাদের দেশে বছর বছর ডেঙ্গুরোগের বিস্তার ঘটতে দেখা যাচ্ছে। আক্রান্ত ও মৃত্যুর রেকর্ড সৃষ্টি হচ্ছে। এর পেছনে কী কী কারণ থাকতে পারে বলে আপনি মনে করেন?
ডা. নজরুল ইসলাম : একটা প্রধান কারণ, ডেঙ্গুটা হলো একটা আরবান ডিজিজ, মানে শহুরে রোগ। দেশে প্রথম আমরা ডেঙ্গুর প্রকোপ পেয়েছিলাম ১৯৯৯ সালে। এরপর ২০০০ সালে ডেঙ্গুর প্রকোপ দেখা দিয়েছিল। বেশকিছু লোক মারাও গিয়েছিল। তারপর ডেঙ্গু প্রতিরোধে মশা মারার উদ্যোগ নেওয়া হয় সব মিউনিসিপ্যালিটিতে। এখন চিন্তার বিষয় হচ্ছে, ২০১৯ সালে ডেঙ্গুর প্রকোপ একটু বেশি হয়েছিল, তারপর বর্তমানে, ২০২৩ সালে আবার বেশি হলো। তো আপনি যে প্রশ্নটা করলেন, এর পেছনে একটা কারণ হচ্ছে, আমাদের শহুরে এলাকা বেড়ে যাচ্ছে। এখন থানা শহরেও ছোট ছোট শহুরে এলাকা গড়ে উঠেছে। শহুরে এলাকা গড়ে উঠলে দেখা যায়-এ গলিতে ময়লা, ওখানে গাড়ির টায়ার পড়ে আছে, ডাবের খোসা পড়ে আছে। এমনটা হলে প্রকোপটা বেশি দেখা দেয়।
যুগান্তর : এক্ষেত্রে তাহলে সিটি করপোরেশনেরও দায় আছে?
ডা. নজরুল ইসলাম : নিশ্চয়ই। সিটি করপোরেশন যেগুলো হয়েছে, দেখেন আপনি অধিকাংশ থানা শহরে কোনো করপোরেশন নেই। মিউনিসিপ্যালিটি একটা নামমাত্র আছে। ওখানে মশা মারার কোনো ব্যবস্থা নেই। বাজেট নেই, কিছু নেই। বড় বড় সিটি করপোরেশনে মশা মারার জন্য বাজেট আছে; কিন্তু সব জায়গায় নেই।
যুগান্তর : ডেঙ্গু ভাইরাসের বাহক এডিস মশার বিস্তার রোধে আমাদের ব্যর্থতার জায়গাগুলো কোথায় বলে আপনি মনে করেন? আরেকটু পরিষ্কার করে যদি বলি, সিটি করপোরেশনের দায় তো আছেই, এডিস মশার বিস্তারের ক্ষেত্রে নাগরিক সচেতনতা এক্ষেত্রে কতটুকু কাজে দিচ্ছে?
ডা. নজরুল ইসলাম : আমাদের সবারই এটার দায়িত্ব আছে, কিন্তু আমরা অসচেতন বা আমরা উদাসীন থাকতে খুব পছন্দ করি। করোনার সময় আপনি নিশ্চয়ই দেখেছেন, মানুষকে কত বলা হয়েছে মাস্ক পরো, মাস্ক পরো। অনেকে দোকানে বসে চা খাচ্ছে, আড্ডা দিচ্ছে, মাস্ক নেই তাদের। নজরদারির কেউ এলে পকেট থেকে বার করে মাস্কটা পরছে। মোহাম্মদপুরের কথা যেমন বলতে পারি, এখানে দুটি বাসার মাঝখানে কিছু জায়গা থাকে, আপনি হয়তো দেখেছেন। তো সেখানে ভবনের মানুষ ময়লা ফেলে জায়গাটাকে একটা ডাম্পিং স্টেশনের মতো করে ফেলেন।
যুগান্তর : আমরা দেখতে পাচ্ছি, নগর ছাড়িয়ে ডেঙ্গুর প্রকোপ এখন গ্রামাঞ্চলেও ছড়িয়ে পড়েছে, এর কারণ কী?
ডা. নজরুল ইসলাম : গত ঈদের সময় অনেকেই শহর থেকে গ্রামে গেছে; তাদের মধ্যে ডেঙ্গু ভাইরাস সংক্রমিত মানুষজনও গিয়েছিল। ওখানেও কিন্তু এডিস মশা আছে। এডিস মশার কিছু ক্যারেকটার আছে, যেমন সকালের দিকে এবং সন্ধ্যার কিছু আগে এরা অ্যাকটিভ হয়। তো বাহক গ্রামে যাওয়ার পর সেখানকার এডিস মশাও ইনফেকটেড হয়ে গেছে। এভাবেই এডিস মশার জীবাণু গ্রামে ছড়িয়ে পড়েছে। ডেঙ্গুটা গ্রামে ছড়িয়েছে ঈদের আগে, এটা খেয়াল করে দেখবেন।
যুগান্তর : অন্যান্য দেশের তুলনায় আমাদের দেশে ডেঙ্গুতে মৃত্যুহার বেশি। এর কারণ কী?
ডা. নজরুল ইসলাম : আপনাকে একটা কথা বলি, বিষয়টি বুঝতে সুবিধা হবে। ধরেন, কেউ যদি এনএস ওয়ান (NS1) ইফেকটেড না হয়, তাহলে স্বাভাবিক জ্বর আসবে, যেটাকে আমরা ফ্লু বলে থাকি। তো তার ফ্লু হয়েছে নাকি ডেঙ্গু, তা কীভাবে বুঝব। তিনি চিকিৎসকের কাছে এলে এনএস ওয়ান টেস্ট করতে দিলে দেখা গেল রেজাল্ট পজিটিভ এসেছে। সেক্ষেত্রে আমরা কী করি? আমরা বলছি, আপনি কিন্তু বাসায় থাকবেন। যদি দাঁত দিয়ে রক্ত বের হয় বা পেটব্যথা বেশি হয়, তখন আপনি আবার আসবেন। এ কথাটা বলে বাসায় পাঠিয়ে দিচ্ছি। আমার ব্যক্তিগত মতামত হচ্ছে, যদি কারও এনএস ওয়ান পজিটিভ হয়, সঙ্গে সঙ্গে তাকে আমরা পর্যবেক্ষণ ওয়ার্ডে (অবজারভেশন ওয়ার্ড) রাখব। সেখানে রেখে দেখব সে সুস্থ হচ্ছে কি না। মানে পাঁচ থেকে ছয় দিনের মধ্যেই আমরা রোগীর অবস্থা বুঝতে পারব, যদি অন্যান্য জটিলতা না থাকে। সুস্থ মনে হলে সাধারণ ওয়ার্ডে নিয়ে যাব। সেখানে চিকিৎসা দেব। ভালো হলে ছেড়ে দেব, খারাপ হলে সঙ্গে সঙ্গে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেব। এমনটা হলে জটিলতা তৈরি হতো না। কিন্তু দেখা যায়, রোগীর দাঁত দিয়ে রক্ত বের হলে বা অন্যান্য জটিলতা দেখা দিলে তখন বিভিন্ন হাসপাতালে ছোটাছুটি করি। এরকম করতে করতে রোগীর অবস্থা আরও খারাপ হয়ে যায়। আমরা জেলা পর্যায়ে প্রতিটি হাসপাতালে যদি একটা করে পর্যবেক্ষণ ওয়ার্ড প্রস্তুত রাখতে পারতাম, চিকিৎসার ক্ষেত্রে এমন পরিস্থিতি হতো না। আক্রান্ত ও মৃত্যুর হার এমন হতো না। আবার এসব ওয়ার্ড আমরা করোনাভাইরাসের ক্ষেত্রে, ডেঙ্গুর ক্ষেত্রে, মানে বিভিন্ন সময়ে কাজেও লাগাতে পারি। আর কাজে না লাগলে তখন সেটা বন্ধ করে দিতে পারি।
যুগান্তর : করোনাভাইরাস মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়লে আমাদের দেশে তা মোকাবিলায় বিশেষ উদ্যোগ দেখা গিয়েছিল। ডেঙ্গুর ক্ষেত্রে সে ধরনের উদ্যোগের অভাব কেন?
ডা. নজরুল ইসলাম : আপনি দেখবেন, আমাদের দেশে বক্তৃতা দেওয়ার লোক অনেক আছে, বাস্তবায়ন করার লোক নেই। বক্তৃতা দেওয়া আর প্রশাসন চালানো এক বিষয় নয়। আপনি নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন আমি কী বোঝাতে চাইছি। আপনার হয়তো মনে আছে, সম্ভবত ২০২০ সালে প্রধানমন্ত্রী একটা নির্দেশ দিয়েছিলেন, জেলা পর্যায়ে আইসিইউ করতে হবে। আমি যখন ২০২১ সালের জুনে সংশ্লিষ্টদের প্রশ্ন করলাম, কয়টি জেলায় আইসিইউ হয়েছে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ মোতাবেক? প্রধানমন্ত্রী নির্দেশ দিলে তো সেটা বাস্তবায়ন করতে হবে। তিনি তো সব বিষয় মনিটর করে বেড়াবেন না। এটা সংশ্লিষ্টদের দায়িত্ব। তো প্রশ্নের জবাবে তারা বললেন, প্রতিটি জেলায় অ্যানেসথেসিওলজিস্ট কোথায়, এটা কোথায়, ওটা কোথায়, দুবছর লাগে ট্রেনিং দিতে ইত্যাদি। তো আমি অ্যানেসথেসিয়া ডিপার্টমেন্টে গেলাম, বিএসএমএমইউতে। প্রফেসর আখতারুজ্জামান ছিলেন মনে হয় তখন। তো আমি জিজ্ঞাসা করলাম, আপনার অ্যানেসথেসিয়া ডিপার্টমেন্টের কী খবর?
তিনি বললেন, চারশ অ্যানেসথেটিস্ট বসে আছে, তারা চাকরি পাচ্ছে না। তাহলে বুঝুন, ডিজি অফিস বলছে অ্যানেসথেটিস্ট কোথায় পাব, আর এদিকে চারশ অ্যানেসথেটিস্ট বসে আছেন, চাকরি পাচ্ছেন না। এদিক-সেদিকে তারা চাকরি করেন। এরপর যখন আবার প্রেশার পড়ল, তখন মন্ত্রী বললেন, এসব অ্যানেসথেটিস্টকে যেন রিক্রুট করা হয়। করা হয়েছে বোধহয়, আমি শুনেছিলাম প্রসেস শুরু হয়েছে। তো আইসিইউ কয় জেলায় হয়েছে, এ ব্যাপারে আমি তেমন জানি না। আপনারা খোঁজ নিয়ে দেখবেন কয়টি জেলায় আইসিইউ করা হয়েছে। কারণ, প্রধানমন্ত্রী তো নির্দেশ দিয়েছেন। বাস্তবায়নের কাজ মন্ত্রণালয়ের।
যুগান্তর : ডেঙ্গু ভাইরাস থেকে রোগীকে সুস্থ করতে কার্যকর কোনো প্রতিষেধক এখনো আমরা পাইনি। এ ব্যাপারে আমাদের দেশে বা বিশ্বে কোনো উদ্যোগ কি নেওয়া সম্ভব?
ডা. নজরুল ইসলাম : প্রতিষেধক তো রয়েছেই। চার টাইপের ভাইরাসের ওপরই গবেষণা করে আমরা প্রতিষেধক বের করেছি। সেগুলো নিয়ে কিছু কাজ করতে হবে। কিন্তু সেরকম কিছু হচ্ছে বলে আমি জানি না। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী কিন্তু বলেছিলেন, গোপালগঞ্জে একটা ভ্যাকসিন ইনস্টিটিউট করবেন। আমি তখন বলেছিলাম, ভালো নির্দেশনা। তো সেই ভ্যাকসিন ইনস্টিটিউট কি হয়েছে? আপনারা একটু খবর নিয়ে দেখবেন তো, হয়েছে কি না। আর ফাইনাল প্রতিষেধক আছে। সম্ভবত জাপান কিংবা যুক্তরাষ্ট্র যৌথভাবে ভ্যাকসিন বের করেছে। ওরা ট্রায়ালও দিয়েছে। তো ওটা আমরা ট্রাই করতে পারি। আমাদের আশপাশের দেশেও প্রতিষেধক নিয়ে কাজ হচ্ছে, ভ্যাকসিন ট্রায়াল হচ্ছে।
যুগান্তর : চিকিৎসা ক্ষেত্রে আমরা কতটা সফল? এক্ষেত্রে কী কী করণীয় এখনো বাকি রয়েছে বলে আপনি মনে করেন?
ডা. নজরুল ইসলাম : আমি আপনার কাছে কয়েকটি প্রশ্ন রাখছি, আপনি সুযোগমতো উত্তর খুঁজেন। যখন করোনা হয়, তখন ইমার্জেন্সি কতগুলো ওয়ার্ড করা হলো? তারপরে স্টেশনে ডিউটি দেওয়া হলো ডাক্তারদের। করোনা ওয়ার্ডে ডিউটি করতে গিয়ে সেই সময় অনেক ডাক্তার মারাও গেছেন। তাদের আলাদা করে অ্যালাউন্স দেওয়ার কথা ছিল। ডাক্তারদের সেই অ্যালাউন্সগুলো দেওয়া হয়েছে কি না, আপনারা খবরটা নেবেন তো। এগুলো আমাদের কষ্টের কথা, আপনাদের সঙ্গে বসলে আমরা শেয়ার করতে পারতাম। আমি যখন এইচআইভি-এইডস প্রজেক্টের দায়িত্বে ছিলাম, তখন এমন মিডিয়া সাব-কমিটি করেছিলাম। তো সেরকম একটা মিডিয়া সাব-কমিটি হলে এসব বিষয় আমরা নিয়মিত শেয়ার করতে পারতাম।
যুগান্তর : এখন যে পরিস্থিতি বিরাজ করছে, এ মুহূর্তে আসলে করণীয় কী?
ডা. নজরুল ইসলাম : এখন আমাদের মশা নিধনে সিরিয়াসলি জোর দিতে হবে। ওষুধে মশাগুলো মরল কি না, শুধু মশা নয়, এর লার্ভাগুলো মরল কি না, সেটা পরীক্ষা করতে হবে। ওষুধ যেদিন দেওয়া হয়, এর পরের দিন দেখতে হবে সেগুলো (মশা ও লার্ভা) নড়ছে কি না। তারপর ড্রেন তো পরিষ্কার করা হয় না। সব সময় ড্রেন পরিষ্কার রাখতে হবে। সবচেয়ে বড় কথা, এ ডেঙ্গুর প্রকোপ কাটাতে আমাদের সবার একসঙ্গে বসা উচিত। একটা সমন্বিত প্রচেষ্টা দরকার। এ পক্ষ-ওই পক্ষ হয়ে প্রশ্ন ছোড়াছুড়ি নয় যে, আপনি মারেন না কেন? আপনি কাজ করেন না কেন? আমাদের বলতে হবে, আসুন আমরা সবাই মিলে ডেঙ্গু নিধন করি, ব্যস।
যুগান্তর : আপনাকে ধন্যবাদ।
ডা. নজরুল ইসলাম : ধন্যবাদ।
