চেতনায় বুদ্বুদ
আপস, না বিভাজন-কোনটি কাম্য?
বদিউর রহমান
প্রকাশ: ২৬ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
বাংলাদেশের রাজনীতিতে এখন দুটি দলই বিবেচনায়-এক. আওয়ামী লীগ, দুই. বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)। নির্বাচন সামনে রেখে আওয়ামী লীগ-বিএনপির প্রচার-প্রচারণা এখন তুঙ্গে। একদল একটা কর্মসূচি দিলে অপর দলও আরেকটা দেয় এবং একই দিনে। জনসমাবেশ দেখানোই হোক, কিংবা শক্তিমত্তা প্রদর্শনই হোক, কেউ পিছপা হতে নারাজ। বিএনপি গত কয়েক মাসে বেশ তুঙ্গে উঠেছে, রাস্তা গরমের বেশ চেষ্টা ছিল বলা চলে। আওয়ামী লীগও তার শান্তি সমাবেশ নিয়ে পেছনে পেছনে এগিয়েছে বলা চলে। নিত্যদিন পল্টনে যাতায়াতকারী এক বন্ধু বললেন, হরহামেশা সভা-সমাবেশের দুদলের লোকই তার অফিসে যাতায়াত করেন। তাদের আলোচনায় জানা যায় যে, ওসব সভা-সমাবেশে-মিছিলে লোক নিতে নাকি বেশ খাই-খরচা আছে। কোনো দল জনপ্রতি সাতশ-আটশ, কোনো দল পাঁচশ-ছয়শ নাকি দেয়। মাঝেমধ্যে নাকি খাবারের প্যাকেটেরও আয়োজন থাকে। হবে হয়তো, বিনে পয়সায় এখন আর কার এত সময় দেওয়ার মতো আছে? এভাবে ভাড়ায় লোক নেওয়ার জন্য স্বাধীনতার পর পর আমরা ‘বাস্তুহারা কাসেম’ ভাইকে বলতাম, আপনার কত থাকবে? তিনি মাঝেমাঝে রাগ করতেন, ৫০-৬০ টাকায় এখন লোক পাওয়া যায় নাকি। হালে রাস্তায় মিছিলে যেসব ছেলেপুলে দেখি, এরা যে দলীয় রাজনৈতিক কর্মী-সমর্থক নয়, তা চেহারা-সুরতে পরিষ্কার বোঝা যায়। যাকগে, এসব দলের ব্যাপার, আমাদের এসবে কিছুই আসে যায় না। আমরা দলীয় সমাবেশের জমজমাট অবস্থা দেখে আঁচ করার চেষ্টা করি, কোন দলে কত লোক হলো, কারা বেশি বেশি জনসমাগম করতে পারল। কিন্তু গত কয়েকদিনে আমরা যেন নিরামিষ হয়ে পড়ে গেলাম। আওয়ামী লীগ-বিএনপি দুদলই যেন একটু চুপসে গেছে। হবে হয়তো, হয়তো আবার দম নিচ্ছে, শক্তি সঞ্চার করছে, নির্বাচন পর্যন্ত তো চালিয়ে নিতে হবে! বেশি জ্বালা তো বিএনপির, আওয়ামী লীগ তো ক্ষমতায়, তারা তো বিএনপির সভা-সমাবেশ মোকাবিলার জন্য তাদের সভা-সমাবেশ করে থাকে। নামের বাহারও আছে-শান্তি সমাবেশ, ভাবটা যেন অন্যরা অশান্তির সমাবেশ করছে!
আগামী নির্বাচন নিয়ে দুদলে এখনো কড়া বিভাজন রয়েছে। আওয়ামী লীগ বলছে, সংবিধান অনুযায়ী সরকারের অধীনেই যথারীতি নির্বাচন হবে। বিএনপি বলছে, আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় রেখে তাদের অধীনে কোনো নির্বাচন হতে দেওয়া হবে না। সরকারকে পদত্যাগ করতেই হবে। কিন্তু বিএনপি বোধকরি তাদের দাবিতে পেরে উঠছে না। সরকার অনড়, ভদ্রলোকের এককথা। আবার বিএনপিও অনড়, তারাও ভদ্রলোক, অতএব, তাদেরও এককথা। ভদ্রলোকের এককথায় গল্পটা শেয়ার করি। পাত্রপক্ষ পাত্রী দেখতে গিয়ে পাত্রীর বয়স জিজ্ঞেস করলে তারা জানাল যে, পাত্রীর বয়স ১৮। দুবছর পর আবার পাত্রীর বাড়ি গিয়ে আবারও বয়স জিজ্ঞেস করলে আবারও উত্তর-পাত্রীর বয়স ১৮। আরও দুবছর পরও একই বয়সের উত্তর পেয়ে পাত্রপক্ষ জিজ্ঞেস করলেন, আপনাদের পাত্রীর বয়স কি বাড়ে না? সোজা উত্তর-আমরা ভদ্রলোক, ভদ্রলোকের এক জবান, একবার বলেছি তো বয়স ১৮, অতএব, জবানের আর হেরফের হবে না। আমাদের আওয়ামী লীগ-বিএনপির অবস্থাও এখন তা-ই, ভদ্রলোকের এক জবান। এটা কি বিভাজন? আমরা জানি যে, রাজনীতিতে শেষ কথা বলে কিছু নেই। আমরা এ-ও জানি যে, এই যে শেষ কথা বলে কিছু নেই, এটাও বিভাজন, কিন্তু শেষ কথা নয়। রাজনীতি বলে কথা! তাহলে দুদলের এক জবানকে আমরা বিভাজন বলতে পারি না। আমরা বরং এভাবে বলতে পারি, নীতির ক্ষেত্রে আপস নেই। দুদলই যার যার নীতিতে অটল রয়েছে। যদি এমন হতো যে, আপসের ক্ষেত্রে নীতি নেই-তাহলে না হয় আমরা ভাবতে পারতাম, এবার আর বিভাজন থাকবে না, আওয়ামী লীগ-বিএনপির আপস হয়েই যাবে। কিন্তু ঝামেলাটা হচ্ছে, নীতি-বিসর্জন প্রথম কে দেবে? আওয়ামী লীগ যদি এখন প্রথম আপসে এগোয়, তবে তো রৈ রৈ চিৎকার শুরু হবে-তবে কেন নৎ খসালি? এটা যে বড় পরাজয় হয়ে যায়। তাহলে আমরা বুঝলাম, আওয়ামী লীগের পক্ষে আপসে আসা সম্ভব নয়। এবার আসি বিএনপির আপস প্রসঙ্গে। বিএনপি যদি আপস করে দলীয় সরকারের অধীনে ২০১৮-এর মতো নির্বাচনে আসতে রাজি হয়, তাহলেও হইচই হবে, তাহলে একদফা কোথায় গেল? আবারও একই সুর-তবে কেন নৎ খসালি? অতএব, এখানেও সম্ভব নয় আপাতত। তখন কী হবে? আবার কি ২০১৪-তে ফিরে যাবে বাজাদ? কিন্তু তা কি আর সম্ভব? তখন তো আমও যাবে, ছালাও যাবে, নাকি?
এ অবস্থায় পরিণতি কী হবে? দুঅবস্থানে দুদলই থাকল। হাল অবস্থা দেখে আমরা পরিষ্কার আঁচ করছি যে, আওয়ামী লীগ বোধকরি ২০১৪-স্টাইলে হলেও নির্বাচন সেরে নেবে। বিএনপি নির্বাচনে না এলেও এবার ভিন্নতর কৌশল অবলম্বন করবে আওয়ামী লীগ। অন্য কিছু দলকে নিয়ে আসবে। প্রয়োজনে নিজ ঘরানার দলকে আসন ভাগ ভাগ করে দিয়ে নির্বাচন সেরে নিতে পারবে। আওয়ামী লীগের প্রয়োজন যেভাবেই হোক আবার ক্ষমতায় আসা। কয়েকদিন আগে গ্রামের বাড়ি গিয়ে লোকজনের সঙ্গে আলাপে এক জানাজায় গিয়ে বেশ কজনের সঙ্গে আলোচনায় যা টের পেলাম, তাতে পরিষ্কার বুঝলাম, গ্রামেগঞ্জে আওয়ামী লীগের জনপ্রিয়তা এবং প্রভাব এখনো বহাল রয়েছে। যে সমালোচনা আছে তা হচ্ছে আওয়ামী লীগের কিছু মাস্তানি, পান্ডামি-গুন্ডামিতে সাধারণ মানুষ বিরক্ত। তারা আওয়ামী লীগের, তাদের অঙ্গসংগঠনের এসব মাস্তানি-গুন্ডামির অবসান চায়, কিন্তু আওয়ামী লীগকে বাদ দিয়ে বিএনপিকে ক্ষমতায় দেখতে চায় না। আওয়ামী লীগের মাস্তানরা গ্রাম্য সালিশেও পয়সা খায়। দখলদারত্বেও এগিয়ে থাকে। এটা নিয়ে অসন্তোষ থাকলেও ভোট কিন্তু আওয়ামী লীগকেই দেবে, কিন্তু কেন? এমন প্রশ্নের জবাবে এক মুরব্বি বললেন, আওয়ামী লীগ কিছু কাজ তো করছে, বেশ উন্নয়নও তো করছে, একটু গুন্ডামি-পান্ডামি করলেও উন্নয়ন তো হচ্ছে। তার জবাবে দুজন ব্যক্তির দুটি উদাহরণ দেওয়ার লোভ সংবরণ কতে পারছি না। এক. সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব মরহুম মো. মহবুবউজ্জামান, তার অধীনে আমি কাজ করেছি এরশাদের আমলে, একবার কর্মকর্তা পছন্দ-অছন্দ প্রসঙ্গে বলছিলেন যে, করিম খুব সৎ, ঠিক সময়ে অফিসে আসেন, ছুটির সঙ্গে সঙ্গে অফিস ত্যাগও করেন, আজানের সঙ্গে সঙ্গে মসজিদে গিয়ে জামাতে নামাজও আদায় করেন, পারলে একটু বেশি সময় থেকে নফল এবাদতও করেন। কিন্তু অফিস সময়ের একটু পরে কেউ গেলে তার কাজটা ওইদিন সেরে দেন না, পরের দিন আসতে বলেন। তিনি ঘুস খান না, বেতনের বাইরে আলাদা কিছুই গ্রহণ করেন না। আর রহিম ঠিক সময়ে অফিসে আসেন না, সুযোগ পেলেই ফাঁকি দেন, তার সম্পর্কে নামাজ আদায়ে গাফিলতির অভিযোগ রয়েছে, এমনকি ঘুসটুস খাওয়ার বা সেবাপ্রত্যাশী থেকে হোটেলে খাওয়াদাওয়ার বদনামও তার রয়েছে। কিন্তু তিনি কোনো সেবাপ্রত্যাশীকে অফিসের পরে থেকে হলেও কাজটা করে দিয়ে যান, পরের দিন আসতে বলেন না। রহিম এমনও বলেন যে, পরের দিন যাতায়াতে আপনার কত কষ্ট, অর্থ ব্যয় তো আছেই, আমাকে একশ-দুশ টাকা দিয়ে আজই কাজটা সেরে নিলে আপনারই তো লাভ। জনাব মহবুবউজ্জামান বললেন, এ দুজনের মধ্যে আমি কাকে পছন্দ করব? একটু খারাপ শোনালেও আমি রহিমকে নেব। কারণ তিনি কিছু অবৈধ কাজ করলেও সেবাপ্রত্যাশীদের উপকার করে থাকেন। দুই. আইয়ুব খানের বিডি মেম্বার আমলে আমাদের ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মোসলেহ উদ্দীন মোক্তার একজন নামকরা চেয়ারম্যান ছিলেন। তার আমলে আমাদের পাঁচগাছিয়া ইউনিয়নের প্রভূত উন্নয়ন হয়েছিল রাস্তাঘাটে। তিনি বললেন, আমি বড় সাহেবদের হাতে-পায়ে ধরে এক লাখ টাকা মঞ্জুর করিয়ে যদি সবাইকে ভাগ দিয়ে নিজে কিছু নিয়েও তোদের ৭০-৭৫ হাজার টাকায় কাজ করে দেই, সেটা ভালো, না অন্য চেয়ারম্যানদের মতো কোনো টাকা বরাদ্দ করাতে না পেরে কোনো কাজ না করানো ভালো? তার করা উন্নয়ন সবার প্রশংসা কুড়িয়েছে। সেই ৬৮-৬৯ সালে তার করা পাকা পুল এখনো বহাল, যদিও এখন ৩ টনের বেশি ভারী যান চলাচলে ঝুঁকির নোটিশ রয়েছে।
আওয়ামী লীগ-বিএনপির রাজনৈতিক বিভাজন এখন চরমে। এটা স্বাভাবিক যে, বঙ্গবন্ধুকে হত্যায় জিয়ার ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন এবং তৎপরবর্তী ইনডেমনিটি, খুনিদের বিদেশে পদায়ন, জেলহত্যা, ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলা, ইত্যাদিতে বিএনপির ভূমিকার জন্য আওয়ামী লীগ তাদের সঙ্গে আপসে আসতে পারে না। তবে রাজনীতিতে যেহেতু শেষ কথা নেই, আওয়ামী লীগ বিএনপির সঙ্গে নির্বাচনি সমঝোতায় আসতে পারে। এমন সমঝোতার উদ্যোগ শেখ হাসিনা আগেও নিয়েছিলেন, বিএনপি সায় দেয়নি। আগামী নির্বাচনের আগে নির্বাচনি সমঝোতা এমনভাবে হতে পারে, নির্বাচনকালীন সরকারে আওয়ামী লীগের বাইরে অন্য রাজনীতিকরাও অন্তর্ভুক্ত হতে পারেন, তাতে বিএনপির অংশগ্রহণ থাকবে। কিন্তু রাজনৈতিক সরকারের বাইরে কোনো আলাদা তত্ত্বাবধায়কজাতীয় সরকার অবশ্যই নয়। এজন্য প্রয়োজনে সংবিধানে জুতসই সংশোধন করা যেতে পারে। এরশাদের বিরুদ্ধে আন্দোলনে কিন্তু তিন জোটের সমঝোতা হয়েছিল। বিচারপতি সাহাবুদ্দীনকে আনার বিষয়েও সমঝোতা হয়েছিল। ২০১৮-এর নির্বাচনের আগেও কিন্তু সমঝোতা হয়েছিল। আওয়ামী লীগের জন্ম জনমানুষের মাধ্যমে, গণমানুষের মধ্যে; বিএনপির জন্ম সামরিক ছাউনিতে। অতএব, দুদলের আপস আশা করা নিরর্থক। কিন্তু বড় ডাকাতও তো আউলিয়া হয়েছেন, সেটাই বা বিবেচনায় না রাখি কীভাবে? অয়োময় নাটকে কি এক জেলে জমিদারের জমিদারি কিনে ফেলেননি? বাস্তবতা বড় কঠিন। এক রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে আওয়ামী লীগ কি জামায়াতের গোলাম আযমের দোয়াপ্রার্থী হয়নি? তিন জোটের সমঝোতায় কি জামায়াতকেও সঙ্গী করেনি? এক সংশোধনী বিসমিল্লাহ কি এখনো বহাল রাখেনি? অতএব, আপস না হোক, বিভাজনটা অন্তত না থাকুক। তাহলে সমাধান কোথায়? সমাধান সমঝোতায়। যার যার নীতিতে অটল থেকেও সমঝোতায় আসা যায়-তবে কোনো তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পুনর্জন্ম দিয়ে নয়, সাংবিধানিক রাজনৈতিক সরকারের মাধ্যমেই। মনে রাখা দরকার, গণঅভ্যুত্থান বা গণআন্দোলনে আওয়ামী লীগকে হটানো বিএনপির পক্ষে সম্ভব নয়। অতএব, সমঝোতা হলে লাভবান বেশি হবে বিএনপি, সমঝোতা না হলেও আওয়ামী লীগের কিন্তু ক্ষতি হবে না। অস্তিত্ব রক্ষার্থে হলেও বিএনপিকে কিন্তু নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে হবে। আন্দোলনে সরকার উৎখাত করতে না পারলে নির্বাচনের যে আর বিকল্প নেই।
বদিউর রহমান : সাবেক সচিব, এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান
