Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

স্মার্ট বাংলাদেশের সূচনা হোক প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকেই

Icon

দিপন দেবনাথ

প্রকাশ: ০২ অক্টোবর ২০২৩, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

স্মার্ট বাংলাদেশের সূচনা হোক প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকেই

উন্নয়নের অগ্রযাত্রায় অগ্রগামী বাংলাদেশের পরবর্তী জংশন স্মার্ট বাংলাদেশ। বিশিষ্টজনেরা মনে করেন, আর্থ-সামাজিক বিবেচনার প্রতিটি সূচকে টেকসই উন্নয়নই স্মার্টনেস। ২০৪১ সালের মধ্যে ডিজিটাল বাংলাদেশকে স্মার্ট বাংলাদেশে রূপান্তরের সমন্বিত পরিকল্পনা হলো ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ১২ ডিসেম্বর ২০২২ ডিজিটাল বাংলাদেশ দিবস উদযাপন উপলক্ষ্যে বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে আয়োজিত অনুষ্ঠানে সর্বপ্রথম ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ গড়ার ঘোষণা দেন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমরা আগামী ২০৪১ সালে বাংলাদেশকে উন্নত দেশ হিসাবে গড়ে তুলব এবং বাংলাদেশ হবে ডিজিটাল বাংলাদেশ থেকে স্মার্ট বাংলাদেশ।’ তিনি আরও বলেন, ‘দেশকে ‘স্মার্ট বাংলাদেশে’ পরিণত করার প্রধান হাতিয়ার হবে ডিজিটাল সংযোগ। স্মার্ট নাগরিক, স্মার্ট অর্থনীতি, স্মার্ট সরকার এবং স্মার্ট সমাজের জন্যে ডিজিটাল সংযোগ মূল ভিত্তি হিসাবে কাজ করবে।’ স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার চারটি স্তম্ভের মধ্যে প্রথম যে স্তম্ভটি আলোচনায় আসে, সেটি হলো স্মার্ট নাগরিক। আর যে কোনো মানবশিশুকে পরিবারের বাইরে নাগরিক হিসাবে গড়ে তোলার প্রাতিষ্ঠানিক প্রক্রিয়া শুরু হয় প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে। তাই স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার প্রথম ধাপ স্মার্ট নাগরিক গড়ার সূত্রপাত হওয়া দরকার প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকেই।

বর্তমান সরকারের ডিজিটাল কর্মপরিকল্পনার বড় একটা অংশ জুড়ে ছিল প্রাথমিক শিক্ষা। ইনফো সরকারসহ ইন্টারনেট সংযোগ সম্প্রসারণের বিভিন্ন প্রকল্পের মাধ্যমে ইন্টারনেট সংযোগ পৌঁছে গেছে দেশের প্রতিটি কোষে। প্রায় প্রতিটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ইন্টারনেট সংযোগ নিশ্চিতের পাশাপাশি স্থাপন করা হয়েছে মাল্টিমিডিয়া শ্রেণিকক্ষ। মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম ব্যবহারের মাধ্যমে গতানুগতিক শিক্ষককেন্দ্রিক শিক্ষাকার্যক্রমকে শিক্ষার্থীকেন্দ্রিক আনন্দময় শিক্ষায় রূপান্তর করা হয়েছে। দেশের প্রত্যন্ত গ্রামের শিশুটিও সংযুক্ত হয়েছে বিশ্বের উন্নততম প্রযুক্তির সঙ্গে, ধারণা লাভ করছে বিশ্বের সর্বশেষ উদ্ভাবন সম্পর্কে। প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোর শ্রেণিকক্ষে আধুনিক ডিজিটাল সংযোগ ও ব্যবহার শিখন-শেখানো পদ্ধতিকে করেছে যুগোপযোগী এবং অধিকতর কার্যকর। শিক্ষকদের নিজেদের মধ্যে অভিজ্ঞতা বিনিময়ের (নলেজ শেয়ারিং) জন্য শিক্ষক বাতায়ন নামে যে প্লাটফর্মটি তৈরি হয়েছে তা অভাবনীয়। বিষয়ভিত্তিক ডিজিটাল কনটেন্ট প্রস্তুত, বাতায়নে আপলোড এবং প্রয়োজনে অন্য কনটেন্ট ডাউনলোড করার মাধ্যমে শিক্ষকরা মুক্তপাঠ, শিক্ষক বাতায়নের সহায়তায় ক্লাস পরিচালনা করতে পারছেন। এতে তাদের নিজেদের মানোন্নয়নের পাশাপাশি সমগ্র প্রাথমিক শিক্ষাব্যবস্থা হচ্ছে সমৃদ্ধ। আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর শিখন-শেখানো কার্যক্রম এখন আর ইংরেজি মাধ্যম স্কুল কিংবা কিন্ডারগার্টেনের সীমানার মধ্যে আবদ্ধ নেই, বরং ছড়িয়ে পড়েছে গ্রামীণ বাংলার প্রত্যন্ত অঞ্চলে। প্রকৃতপক্ষেই প্রচলিত ধারণার আমূল পরিবর্তন ঘটে গেছে।

করোনা মহামারিকালে পুরো বিশ্ব যখন স্থবির, তখনো ডিজিটাল মাধ্যম ব্যবহারের মাধ্যমে আমাদের শিশুদের কলকাকলিতে মুখর ছিল অনলাইন শিক্ষাঙ্গন। বাংলাদেশ টেলিভিশনের মাধ্যমে দূরশিক্ষণ পদ্ধতিতে প্রাথমিকশিক্ষা পাঠ ‘ঘরে বসে শিখি’-এর কনটেন্ট সম্প্রচারের মাধ্যমে শিখন কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়েছে। এছাড়াও প্রতিটি উপজেলার ফেসবুক পাতায় ‘উপজেলা অনলাইন স্কুল’-এর মাধ্যমেও শিক্ষার্থীদের পাঠদান করা হয়েছিল। ডিজিটাল সংযোগ এবং তথ্য-প্রযুক্তির সমুন্নত ব্যবহার প্রাথমিক শিক্ষার প্রতিটি পর্যায়কে নিয়ে যাচ্ছে স্মার্ট শিক্ষা ব্যবস্থায়। দেশের সামগ্রিক প্রাথমিক শিক্ষা সংক্রান্ত কার্যক্রম একটি সমন্বিত প্ল্যাটফর্মের আওতায় নিয়ে আসার লক্ষ্যে Primary Education Management Information System (PEMIS) তৈরি করা হয়েছে। সফটওয়্যারটির মাধ্যমে দেশব্যাপী ৬৪ জেলায় ছড়িয়ে থাকা এক লাখ তিরিশ হাজার স্কুল, সাড়ে তিন লাখ শিক্ষক এবং প্রাক-প্রাথমিক থেকে ৫ম শ্রেণি দুই কোটিরও বেশি শিক্ষার্থীর তথ্য সংরক্ষণ এবং সংশ্লিষ্ট কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। স্কুল, শিক্ষক ও শিক্ষার্থী ব্যবস্থাপনা ছাড়াও প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোর বার্ষিক শুমারি এবং বই বিতরণ কার্যক্রম এ সিস্টেমের মাধ্যমে সম্পন্ন করা হচ্ছে। প্রাথমিক পর্যায়ের প্রত্যেক শিক্ষার্থীকে একক পরিচিতি নম্বর (ইউআইডি) প্রদানেরও উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে।

প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় ‘প্রাথমিক শিক্ষার্থীদের জন্য প্রোফাইল প্রণয়ন’ এবং শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীন বাংলাদেশ শিক্ষা তথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরো (ব্যানবেইস)-এর ‘এস্টাবলিশমেন্ট অব ইন্টিগ্রেটেড এডুকেশনাল ইনফরমেশন ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম (আইইআইএমএস)’ শীর্ষক দুটি প্রকল্পের মাধ্যমে ইউনিক আইডি (একক পরিচয়) সংক্রান্ত কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। স্থানীয় সরকার বিভাগের জন্ম-মৃত্যু নিবন্ধন, রেজিস্ট্রার জেনারেলের কার্যালয় ও নির্বাচন কমিশনের জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) অণুবিভাগসহ সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও সরকারি দপ্তরের সহায়তায় এ কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। এতে ৫ বছর থেকে ১৭ বছর বয়সি শিক্ষার্থীদের ইউনিক আইডি দেওয়া হবে আর ১৮ বছর পর ইউনিক আইডি রূপান্তরিত হবে জাতীয় পরিচয়পত্র হিসাবে। প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের অধীন ‘সিভিল রেজিস্ট্রেশন অ্যান্ড ভাইটাল স্ট্যাটিসটিকস’ (সিআরভিএস) প্রকল্পের মাধ্যমে, প্রাথমিক পর্যায়ের সব শিক্ষার্থীকে এ একক পরিচিতি নম্বর (ইউআইডি) প্রদান করা হবে, যার মাধ্যমে শিক্ষা সম্পর্কিত সেবাগুলোর সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করা হবে। এ পরিচিতির মাধ্যমে বার্ষিক বিভিন্ন শিক্ষা সেবা যেমন-পাঠ্যপুস্তক বিতরণ, পরীক্ষার ফল, শিক্ষাবৃত্তি, উপবৃত্তি প্রদান এবং শিক্ষার্থী সম্পর্কিত সেবা যেমন-দৈনিক হাজিরা, অনুপস্থিতি ইত্যাদি তথ্য সংগ্রহ সহজ এবং নির্ভুল হবে। স্কুলে ঝরে পড়া রোধে গ্রহণ করা যাবে কার্যকর পদক্ষেপ।

উন্নত বিশ্বে প্রাথমিক শিক্ষা ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীর শিখন সামগ্রী এবং শিক্ষককে সহায়তার পাশাপাশি জ্ঞানের পরিধি পরিব্যাপ্তির জন্য যে উপাদানগুলো তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা পালন করে; সেগুলোর মধ্যে পাঠ্যপুস্তক, শিখন সহায়ক সামগ্রী, ওয়ার্কবুক, বার্ষিক পাঠ পরিকল্পনা, প্রশ্ন পুস্তিকা, তথ্য পুস্তিকা, শিক্ষক নির্দেশিকা, শিক্ষক সংস্করণ অন্যতম। সরকার এ উপাদানের প্রত্যেকটিকে তথ্যপ্রযুক্তির আওতায় আনার চেষ্টা অব্যাহত রেখেছে। সম্প্রতি এস্পায়ার টু ইনোভেট (এটুআই)-এর কারিগরি সহায়তায় জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) ও প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর শিক্ষক সহায়িকা নামক একটি অ্যাপ তৈরি করেছে। এ অ্যাপ ফিচারে বিদ্যালয়ের নাম, শিক্ষকের আইডি সংযুক্ত করা হয়েছে যেখানে শিক্ষকের পড়ানোর বিষয়টি উল্লেখ রয়েছে। একজন শিক্ষক যে বিষয়ে শিক্ষা দেন তার কর্মপরিকল্পনা এ অ্যাপে যুক্ত করা হয়েছে। প্রতিটি পাঠের ভেতর শিখন পরিকল্পনা দেওয়া আছে অ্যাপটিতে। মূলত শিক্ষক সহায়িকাতে যা আছে; একজন শিক্ষক এর মধ্যেও তা খুঁজে পান। এছাড়া এটি ব্যবহারের মাধ্যমে শিক্ষার্থীর শিখন রেকর্ড সংরক্ষণ করা যায়। শিক্ষকদের পাঠদান ও শিখন কার্যক্রম সহজ হয়েছে। শ্রেণিকক্ষে যত শিক্ষার্থী পড়ে, তারা কি শিখল আর কি শিখতে পারেনি তাও এখানে সংরক্ষণ করা যায়।

পরিশেষে বলা যায়, আধুনিক প্রযুক্তির সংযোজন ও সর্বোত্তম ব্যবহারের মাধ্যমে বাংলাদেশের এখন প্রতিটি প্রাথমিক বিদ্যালয় হয়ে উঠেছে আধুনিক জ্ঞানচর্চার স্মার্ট কেন্দ্র। সর্বশেষ ২৬১৫৯টি স্কুল জাতীয়করণের ফলে স্কুল আওতাবহির্ভূত এলাকা নেই বললেই চলে। মাঠপ্রশাসনে কাজ করার সুবাদে আমার কর্মস্থলের ৯৭টি স্কুলেই আমার যাওয়ার সুযোগ হয়েছে। প্রায় প্রতিটি স্কুলেই এখন রঙিন ভবন, আধুনিক শিক্ষা উপকরণে ভরপুর স্কুল আঙিনা। স্কুল দেওয়ালে আঁকা নানা বর্ণের ছবি, কোমলমতি শিশুদের জানার আগ্রহকে বাড়িয়ে তোলে শতগুণ। একটি স্কুলের প্রতিটি জিনিসই যেন হয় শিক্ষা উপকরণ এমন ভাবনা থেকে তথ্যপ্রযুক্তির মেলবন্ধন ঘটিয়ে কাজ করে যাচ্ছে প্রাথমিক শিক্ষা সংশ্লিষ্ট সবাই এবং আমি মনে করি, এটাই স্মার্টনেস। শ্রেণিকক্ষকে স্মার্ট শ্রেণিকক্ষে রূপান্তর ঘটানোর জন্য প্রায় সব উপকরণই এখন স্কুলে রয়েছে। এখন শুধু দরকার সময়ের ডাক শুনে সব শিক্ষকের নিজেদের সময়োপযোগী করে গড়ে তোলা এবং ডিজিটাল টুলস্গুলোর সঙ্গে অভ্যস্ত হওয়া। আধুনিক প্রযুক্তি জ্ঞানসম্পন্ন মানবসম্পদ তথা স্মার্ট নাগরিক তৈরির স্মার্ট আঁতুড়ঘর হিসাবে আবির্ভূত হবে প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলো-এটাই প্রত্যাশা।

দিপন দেবনাথ : উপজেলা নির্বাহী অফিসার, সিংগাইর, মানিকগঞ্জ

 

স্মার্ট বাংলাদেশ সূচনা প্রাথমিক বিদ্যালয়

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম