দেশপ্রেমের চশমা
ভালো নির্বাচন করার সম্ভাব্য উপায়
মুহাম্মদ ইয়াহ্ইয়া আখতার
প্রকাশ: ১৩ অক্টোবর ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
বহুলপ্রতীক্ষিত দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন দ্বারপ্রান্তে। দু-তিন সপ্তাহ পর নির্বাচন কমিশন নির্বাচনি শিডিউল ঘোষণা করবে। এজন্য সরকারি দল এবং সরকারে সম্পৃক্ত দলগুলো নির্বাচনি প্রস্তুতি শুরু করেছে বলে দাবি করছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবিতে আন্দোলন করা দলগুলো এ ব্যাপারে নীরব। তারা কিছুতেই দলীয় সরকারের অধীনে প্রধানমন্ত্রীকে ক্ষমতায় রেখে সংসদ না ভেঙে নির্বাচনে অংশগ্রহণের কথা ভাবছে না। এ ব্যাপারে দলগুলো অনড় ভূমিকা পালন করে নির্দলীয় সরকারাধীনে সংসদ নির্বাচনের দাবিতে অহিংস আন্দোলন অব্যাহত রেখেছে। নির্বাচন কমিশন শিডিউল ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে এ দলগুলো এদের আন্দোলনকে অহিংস রাখতে পারবে কি না, তা নিয়ে জনমনে সন্দেহ আছে। অন্যদিকে সরকার থেকে বলা হচ্ছে, কোনোরকম সহিংসতা হলে তারা তার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। কাজেই নির্বাচনি ব্যবস্থা নিয়ে এমন একটি জটিল পরিস্থিতির মধ্যে কমিশন সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার কথা বলে নির্বাচন করতে মরিয়া হলে শিডিউল ঘোষণা করার পর রাজপথে নিশ্চিত রক্তপাতের আশঙ্কা দেখা দেবে।
আশ্চর্যের বিষয়, দেশের সুশীল সমাজ এমন অবস্থায় নীরব ভূমিকা পালন করছে। অতীতের নির্বাচনগুলোর আগে সুশীল সমাজ ও দেশের সর্বজনশ্রদ্ধেয় ব্যক্তিত্বদের অনেকে সুষ্ঠু নির্বাচনের স্বার্থে সরকারকে পথ বাতলে দিয়েছেন। আমার ভুল না হলে দশম সংসদ নির্বাচনের প্রাক্কালে ড. আকবর আলি খান একাই সুষ্ঠু নির্বাচনের লক্ষ্যে ৪টি ফর্মুলা প্রদান করেছিলেন। সেগুলো গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছিল। নিষ্ক্রিয় এবং সুবিধাবাদী হলেও এখনো দেশে সুশীল সমাজ রয়েছে। রয়েছেন অনেক দেশপ্রেমিক ব্যক্তিত্ব। তাদের তো দেশের মঙ্গল চাওয়ার কথা। এমন সংকটকালে তারা নীবর ভূমিকা পালন করছেন কেন? এর নানা কারণ থাকতে পারে। একটি কারণ এমন হতে পারে, তারা ভাবছেন, সরকার যদি কোনোভাবে আবারও একটি ফন্দি-ফিকিরের নির্বাচন করে ক্ষমতায় থাকতে পারে, তাহলে তারা এখন সরকারি ইচ্ছার বিরুদ্ধে সোচ্চার হলে পরে তাদের ওপর সরকারের রক্তচক্ষু প্রতিহিংসার দৃষ্টি দেবে। তখন আর সরকারের কাছ থেকে তারা কোনো সুবিধা নিতে পারবেন না। দেশ ও জনস্বার্থ ভুলে এমন স্বার্থপর চিন্তা থেকে বেরিয়ে এসে তাদের বলা উচিত, দলীয় সরকারাধীনে নির্বাচন হলে ভালো নির্বাচন হতে পারে কি না। এ ব্যাপারে তাদের স্বাধীন মতামত দেওয়া উচিত। আরও বলা উচিত, কেমন ব্যবস্থায় বা কী উপায়ে নির্বাচনকে স্বচ্ছ করা যায়। তারা চাইলে নতুন কোনো ব্যবস্থার উদ্ভাবন করে তা জাতির সামনে তুলে ধরতে পারেন। কিন্তু এমন দেশপ্রেমিক সুশীল সমাজের সদস্য খুঁজতে হলে এখন শক্তিশালী দুরবিন প্রয়োজন। বেশির ভাগ সুশীল সমাজ সদস্যই সুবিধাভোগী ও সুবিধাবাদী চরিত্রধারী। তবে বিরল ব্যতিক্রম যে নেই তা বলা যায় না। এদের সামনে এখন রক্তপাত এড়ানোর স্বার্থে ভূমিকা পালনের দায়িত্ব পড়েছে। এ দায়িত্ব পালন না করলে এসব সুশীল সদস্যদের ইতিহাসের কাছে জবাবদিহি করতে হবে।
বাংলাদেশি নির্বাচনি সংকট নিয়ে আমি সামান্য লেখালেখি করেছি। কীভাবে এ সংকটের সমাধান করা যায়, সে সম্পর্কে লিখেছি। বিভিন্ন টকশোতে সুযোগ পেলে কথা বলেছি। বিভিন্ন সময় আমি বিভিন্ন জাতীয় সমস্যা নিয়ে আমার নির্বাচিত কলাম ‘দেশপ্রেমের চশমা’-য় পরামর্শমূলক কলাম লিখেছি। সরকার আমার পরামর্শ যে কোনো সময় আমলে নেয়নি এমনটা বলব না। দু-একটি সমস্যার ওপর আমার লেখা প্রকাশিত হওয়ার পর সরকার যে দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে, তা আমি সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্ত ঘোষণার মধ্য দিয়ে জানতে পেরেছি। তবে দেশের অন্যতম প্রধান সমস্যা নির্বাচনি সংকট নিয়ে আমি অনেক বছর অব্যাহতভাবে লিখছি। এ বিষয়ে সরকার আমার পরামর্শ আমলে নেয়নি। আমার পরামর্শে প্রভাবিত হয়ে কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেনি। বছর দেড়েক হলো আমি আমার বিভিন্ন লেখায় এবং বক্তব্যে বলে আসছি যে বিরাজিত প্রতিহিংসামূলক রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে দলীয় সরকারাধীনে ভালো নির্বাচন হতে পারে না। গত বছর মার্চে নির্বাচন কমিশন আহূত শিক্ষাবিদদের সঙ্গে অনুষ্ঠিত সংলাপে আমন্ত্রিত হয়ে আমি একই কথা বলেছি। পাঠক-শ্রোতারা এ বক্তব্যকে অনুসরণীয় বিবেচনা করলেও সরকারের তরফ থেকে এ বক্তব্যে সাড়া দিয়ে ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। পরিবর্তে, সরকারদলীয় মন্ত্রী ও নেতারা সংবিধানের অজুহাত দিয়ে সংসদ না ভেঙে দলীয় সরকারাধীনে নির্বাচন করার পুরোনো গীত গেয়েছেন। কারণ, সরকার চায় নিজেদের অধীনে অনুগত প্রশাসন ও নতজানু নির্বাচন কমিশনের তত্ত্বাবধানে নির্বাচন করিয়ে ক্ষমতা দীর্ঘায়িত করতে। সেজন্য এ ব্যবস্থায় নির্বাচনে সুনিশ্চিতভাবে পরাজিত হওয়ার সম্ভাবনা নিয়ে বিরোধী দলগুলো নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে চাইছে না। এ কারণে বিরোধীদলীয় নেতাকর্মীরা নির্দলীয় সরকারাধীনে সংসদ নির্বাচনের দাবি আদায় এবং জনগণের ভোটের অধিকার সুনিশ্চিত করতে অহিংস আন্দোলন অব্যাহত রেখেছেন। কিন্তু সরকার সে আন্দোলনের উত্তাপ গায়ে মাখছে না। একপর্যায়ে শিডিউল ঘোষণার পর এ আন্দোলন অহিংস না থাকলে দেশ অভূতপূর্ব অরাজকতার মধ্যে পড়বে। সমঝোতা না করে একতরফাভাবে প্রশাসন ও পোশাকধারী বাহিনী ব্যবহার করে সরকার নির্বাচনি বৈতরণি পার হতে চাইলে সংঘাত এড়ানো যাবে না। রক্তপাত এড়িয়ে যুগপৎ দেশে ও গণতান্ত্রিক বিশ্বে গ্রহণযোগ্য শান্তিপূর্ণ সংসদ নির্বাচন করতে হলে আমার বিবেচনায় সরকারের সামনে যে পথগুলো রয়েছে তা নিচে উল্লেখ করছি।
১. আগামীকালই সরকারপ্রধান এ মর্মে একটি ঘোষণা দেবেন যে, সরকার আন্দোলনরত রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে ২-৩ দিনের মধ্যে আলোচনায় বসবে। সবার পরামর্শ নিয়ে এ মাসে জাতীয় সংসদের শেষ অধিবেশনে একটি ‘নির্দলীয় নির্বাচনকালীন সরকার বিল’ পাস করতে হবে। তারপর সংসদ ভেঙে দিলে নবগঠিত নির্দলীয় সরকারাধীনে জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এমন ঘোষণায় যাবতীয় বিরোধীদলীয় আন্দোলন কর্মসূচি বন্ধ হয়ে যাবে। দেশে নির্বাচনের সুবাতাস প্রবাহিত হবে। দলগুলো প্রার্থী নির্বাচন এবং মিছিল-মিটিংসহ নির্বাচনি কাজে ব্যস্ত সময় কাটাবে। নির্দলীয় সরকারাধীনে নির্বাচন দেওয়ায় ভোটারদের মধ্যে সরকারি দলের গ্রহণযোগ্যতা বাড়বে এবং উৎসবীয় আমেজে সব দলের অংশগ্রহণে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।
২. এমন বিল পাশ করলে ওই নির্দলীয় সরকারের নাম ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকার’, ‘নির্বাচনকালীন সরকার’, ‘তদারকি সরকার’ বা অন্য যে কোনো নাম দেওয়া যেতে পারে। তবে ওই সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হওয়ার ক্ষেত্রে আগের মতো কেবল সুপ্রিমকোর্টের সর্বশেষ অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতির নাম রাখা সমীচীন হবে না। এ নির্বাচনের প্রাক্কালে সুপ্রিমকোর্টের সর্বশেষ অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি কে হবেন, তা নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে অঙ্ক কষাকষি এড়াতে এবং বিচার বিভাগের পদোন্নতি প্রক্রিয়ায় যাতে নিয়মতান্ত্রিক ভারসাম্য বিনষ্ট না হয়, সেজন্য প্রধান উপদেষ্টার পদে সুপ্রিমকোর্টের সর্বশেষ অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতির সঙ্গে সর্বজনশ্রদ্ধেয় ন্যাপরায়ণ অবসরপ্রাপ্ত আমলা, সুশীল সমাজ ব্যক্তিত্ব, বা অন্য অরাজনৈতিক পেশাজীবীর নামও উল্লেখ করে রাজনৈতিক নেতাদের বিচারপতিদের নিয়ে মাতামাতি রোধ করতে হবে।
৩. সরকার বিরোধীদলীয় দাবির প্রতি কর্ণপাত না করে একতরফাভাবে প্রশাসন ও পোশাকধারী বাহিনী ব্যবহার করে নিজেরা ক্ষমতায় থেকে সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের চেষ্টা করতে পারে। এ প্রক্রিয়ায় নির্বাচন করার চেষ্টা বাধার সম্মুখীন হবে। এমন নির্বাচনে বড় বিরোধী দলগুলো অংশগ্রহণ করবে না। এ রকম নির্বাচন করা সম্ভব হলে নিশ্চিতভাবে সরকারি দল সব আসনে জয়লাভ করবে। তবে তারা লোক দেখানোর জন্য কিছু আসন নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী ছোট ছোট দলকে ছেড়ে দেবে। গত দুটি সংসদ নির্বাচনের মতো এমন নির্বাচনও দেশে এবং বিদেশে গ্রহণযোগ্যতা পাবে না। নির্বাচন শিডিউল ঘোষণার আগে ও পরে অভূতপূর্ব অরাজক পরিস্থিতি তৈরি হবে। গণতান্ত্রিক বিশ্বেও দেশের ভাবমূর্তি আরও ধসে পড়বে। দেশ আন্তর্জাতিক বিশ্বে অধিকতর কোণঠাসা হয়ে পড়বে। বিশ্বায়নের পৃথিবীতে একা চলতে গিয়ে দেশ অর্থনৈতিক বিপর্যয়ে পড়বে। তখন হয়তো আরও কঠোরভাবে ভিসানীতি প্রয়োগ করা হবে। এমনকি দেশ অর্থনৈতিক অবরোধের মুখে পড়লেও জনগণ অবাক হবে না।
৪. সরকার মহামান্য রাষ্ট্রপতিকে দিয়ে নির্বাচনি সংকট এড়াতে সব দলকে আহ্বান জানিয়ে নির্বাচনকালীন সরকারের এজেন্ডা দিয়ে সংলাপের মাধ্যমে একটি নির্বাচনকালীন জাতীয় সরকার গঠনের চেষ্টা করতে পারে। সে সরকারে বিভিন্ন দল থেকে সদস্য নেওয়া হবে। অবশ্যই ক্ষমতাসীন দলীয় প্রধান, তথা প্রধানমন্ত্রী ওই সরকারে থাকবেন না। উনি পদত্যাগ করবেন এবং সংসদ ভেঙে দেওয়া হবে। বাম জোট এবং দলগুলো থেকে দু-একজন প্রতিনিধি নিয়ে এমন সরকারে সরকারি ও প্রধান বিরোধী দলগুলো থেকে সমান বা সামান্য কমবেশিসংখ্যক সদস্য অন্তর্ভুক্ত করা হবে। দলগুলো নির্বাচিত বা অনির্বাচিত উভয় ধরনের সদস্যের নাম এমন সরকারের সদস্য হিসাবে অন্তর্ভুক্ত করতে জমা দিতে পারবেন। ইসির পুনর্গঠন লাগবে কি না, তা ওই সরকার পদাসীন হয়ে ঠিক করবেন।
কোন পন্থায় নির্বাচন হলে নির্বাচন ভালো হবে, তা ভোটাররা অবগত। তবে সরকার ক্ষমতা দীর্ঘায়িত করার সংকীর্ণ স্বার্থে সরকারপ্রধানকে ক্ষমতায় রেখে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন করতে মরিয়া। এর আগেও দু-দুবার (২০১৪ ও ২০১৮) দলীয় সরকারাধীনে স্বচ্ছ নির্বাচন করতে চেয়ে সরকার চরমভাবে ব্যর্থ হয়েছে। তারপরও যদি সরকার জনগণ ও অধিকাংশ রাজনৈতিক দলের ইচ্ছার বিরুদ্ধে দলীয় সরকারাধীনে নির্বাচন করতে চায়, তাহলে আমি সরকারকে একটি পরামর্শ দেব। সরকার দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন দলীয় না নির্দলীয় সরকারাধীনে হবে, সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার আগে এ বিষয়ের ওপর একটি গণভোটের আয়োজন করুক। সে গণভোটটি যেন আবার দলীয় সরকারাধীনে সামরিক শাসনামলের গণভোটের মতো না হয়। এমন গণভোট অবশ্যই জাতিসংঘ বা কোনো নির্দলীয় তত্ত্বাবধানকারী কর্তৃপক্ষের অধীনে অনুষ্ঠিত হতে হবে। গণভোটে যদি অধিকাংশ ভোটার দলীয় সরকারের অধীনে সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের পক্ষে রায় দেন, তাহলে সরকারদলীয় সরকারাধীনে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের আয়োজন করতে পারবে। আর যদি অধিকাংশ ভোটার নির্দলীয় সরকারাধীনে সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের পক্ষে রায় দেন, তাহলে সরকারের একগুঁয়েমি না করে গণরায়ের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়ে নির্দলীয় সরকারাধীনে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত হবে।
ড. মুহাম্মদ ইয়াহ্ইয়া আখতার : অধ্যাপক, রাজনীতিবিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
akhtermy@gmail.com
