দুর্নীতি বন্ধ করতে না পারলে বিপর্যয় ঠেকানো যাবে না
মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া
প্রকাশ: ১৭ নভেম্বর ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
গত ৬ নভেম্বর বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আবদুর রউফ তালুকদার ইকোনমিক রিপোর্টার্স ফোরামের নেতাদের সঙ্গে দেশের সার্বিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে একটি মতবিনিময় সভা করেন। ওই সভায় তিনি যেসব কথা বলেছেন, তা কয়েকটি সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়েছে। সোশ্যাল মিডিয়ায় তার বক্তব্য নিয়ে নানা আলোচনা হচ্ছে। গভর্নর বলেছেন, ‘আমাদের অর্থনীতি বর্তমানে একটি চ্যালেঞ্জিং সময় অতিক্রম করছে। আমার ৩৬ বছরের চাকরিজীবনে আমি কখনোই এমন অর্থনৈতিক সংকট প্রত্যক্ষ করিনি।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমরা সব সময় জোড়া ঘাটতি নিয়ে আলোচনা করেছি-চলতি হিসাবের ঘাটতি এবং রাজস্ব ঘাটতি। গত অর্থবছরে চলতি হিসাবের ঘাটতি এবং আর্থিক হিসাবের ঘাটতি উভয়ই দেখা গেছে, যা ১৪/১৫ বছরে ঘটেনি। আর্থিক হিসাবে আগের অর্থবছরের ১৫ বিলিয়ন ডলারের থেকে উদ্বৃত্ত থেকে চলতি অর্থবছরে ২ বিলিয়ন ডলারের ঘাটতিতে পড়েছে। অর্থাৎ ১৭ বিলিয়ন ডলারের একটি ব্যবধান।’ গভর্নর মনে করেন, অর্থনৈতিক পরিস্থিতি একেবারে তলানিতে নেমে এসেছে। আর খারাপ হওয়ার সুযোগ নেই। এখন অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়ানোর সময়। চলতি অর্থবছরেই দেশের অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াবে বলে তিনি মনে করেন।
সাংবাদিক নেতাদের সঙ্গে আলোচনা প্রসঙ্গে তিনি অর্থনীতির আরও নানা চ্যালেঞ্জের বিষয় উল্লেখ করেছেন এবং এসব মোকাবিলায় গৃহীত নানা ব্যবস্থার কথা বলেছেন। যেমন: রেমিট্যান্সের নিম্নগতি, টাকার অবমূল্যায়ন, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, রপ্তানি আয় কমে যাওয়া, খেলাপি ঋণ বেড়ে যাওয়া, অর্থ পাচার, হুন্ডি ব্যবসা বৃদ্ধি, বৈদেশিক সহায়তার অর্থছাড়ে ধীরগতি ইত্যাদি। অবশ্য এসব চ্যালেঞ্জের বিপরীতে বাংলাদেশ ব্যাংক কী কী ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে, সংবাদপত্রে তার বিস্তারিত উল্লেখ নেই। অর্থব্যবস্থার একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানের কর্তাব্যক্তির মুখ থেকে এরূপ স্বীকারোক্তি এর আগে বোধকরি শোনা যায়নি।
দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি কি সত্যিই খুব খারাপ? আত্মসমালোচনা ভালো, যদি এর মাধ্যমে আমাদের সমস্যা ও দুর্বলতাগুলো চিহ্নিত করে প্রতিকার ও প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণে তৎপর হই, যদি আমাদের সিদ্ধান্তগুলো পক্ষপাতদুষ্ট না হয়ে জনকল্যাণমুখী হয়।
দেশের সার্বিক পরিস্থিতি বর্তমান অবস্থায় উপনীত হওয়ার প্রক্রিয়াটি বেশ কবছর আগেই শুরু হয়েছে। ২০২০ সালের মার্চে করোনা মহামারির প্রাদুর্ভাব এবং তা প্রায় দুবছর স্থায়ী হওয়া, ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ শুরু হওয়া এবং তা এখনো চলমান থাকায় সারা বিশ্ব এক অস্থির সময় কাটাচ্ছে। দেশে দেশে মূল্যস্ফীতি, উৎপাদন ও সরবরাহ চেইনে বিপর্যয়, জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি, অর্থনীতিতে মন্দাভাব ইত্যাদির প্রভাব অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও পড়েছে। তবে আমাদের সমস্যা যে শুধু বৈশ্বিক কারণেই হয়েছে, তা নয়। অভ্যন্তরীণ দুর্বলতা, অনিয়ম, দুর্বল করপোরেট শাসন, অনৈতিক ব্যবসা, দুর্নীতি ইত্যাদি কারণে দেশের অর্থনীতিতে সংকট দেখা দিয়েছে। উচ্চমূল্যস্ফীতি, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ক্ষয়, টাকার অবমূল্যায়ন, খেলাপি ঋণ, বিদেশে অর্থ পাচার, আমদানি-রপ্তানিতে অস্থিরতা, উৎপাদন ও সরবরাহে বিপর্যয় ইত্যাদি যেসব সমস্যা ও সংকট অর্থনীতিতে সৃষ্টি হয়েছে, এগুলো একটির সঙ্গে অন্যটি সম্পর্কিত; সহজ কথায় একটি দ্বারা অন্যটি সৃষ্ট। তবে আমার বিবেচনায় সব সমস্যা ও সংকটের মূলে রয়েছে দুর্নীতি।
২০১৮ সালের নির্বাচনি ইশতেহারে আওয়ামী লীগ দুর্নীতির বিরুদ্ধে ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি গ্রহণের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। দুর্নীতি প্রতিরোধে প্রধানমন্ত্রীর অনুশাসন থাকা সত্ত্বেও দুর্নীতি কমেনি, বরং কোনো কোনো ক্ষেত্রে বেড়েছে। ২০১৪ সাল থেকে আজ অবধি দক্ষিণ এশিয়ায় আফগানিস্তানের পর বাংলাদেশ সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত দেশের তকমা পেয়ে আসছে। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের ২০২২ সালের র্যাংকিংয়ে বিশ্বের সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত দেশের তালিকায় ১২ নম্বরে অবস্থান বাংলাদেশের। এমন কোনো সেক্টর নেই, যেখানে দুর্নীতি বাসা বাঁধেনি।
ব্যাংকিং সেক্টরের খেলাপি ঋণ, পুঁজি পাচার, প্রভাবশালীদের ঋণ পুনঃতফশিলীকরণের নামে সুদ মওকুফ ও অনৈতিক সুযোগ প্রদান, ভুয়া জামানতের বিপরীতে নামে-বেনামে ঋণ নিয়ে আত্মসাৎ ইত্যাদি সবই সর্বব্যাপী দুর্নীতির প্রকৃষ্ট উদাহরণ। পুঁজি স্থানান্তরের কারণে নামিদামি ব্যাংকও দুর্বল, সমস্যাজর্জরিত ব্যাংকের তালিকাভুক্ত হয়েছে। কোনো কোনো ব্যাংকের তথাকথিত মালিক, পরিচালক এসব পাচারের সঙ্গে জড়িত। ব্যাংকসংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের মতে, গত ৫ বছরে ব্যাংকিং সেক্টরে সবচেয়ে বেশি অনিয়ম ও দুর্নীতি হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবমতে, এ বছরের জুন শেষে খেলাপি ঋণ ছিল ১ লাখ ৫৬ হাজার ৩৯ কোটি টাকা, যা ছিল মোট বিতরণকৃত ঋণের ১০.১১ শতাংশ। প্রকৃত খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৪ লাখ কোটি টাকা, অর্থাৎ বিতরণকৃত ঋণের ২৫ শতাংশে পৌঁছেছে বলে বিশেষজ্ঞদের ধারণা। বিগত কয়েক বছরে অর্থ মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ ব্যাংক খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিলীকরণের জন্য অনেক সুবিধা দিয়েছে; কিন্তু খেলাপি ঋণ আদায় তো হয়ইনি, বরং দিন দিন বাড়ছে। বাংলাদেশ ব্যাংক ও সরকার কেন ঋণখেলাপিদের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নিচ্ছে না বা নিতে পারছে না, সে প্রশ্ন অর্থনীতি বিশ্লেষক ও দেশপ্রেমিক নাগরিকদের।
খেলাপি ঋণের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ হচ্ছে অর্থ পাচার। এ দুটি বিষয়ে অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড. মইনুল ইসলামের প্রচুর গবেষণা পেপার প্রকাশিত হয়েছে। আমিও কয়েকটি লেখায় দেশি-বিদেশি উৎস থেকে তথ্যাদি নিয়ে অর্থ পাচারের ব্যাপকতা তুলে ধরেছি। হুন্ডি, আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের আড়ালে ওভার ইনভয়েসিং এবং আন্ডার ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে অর্থ পাচার, রপ্তানি আয় বিদেশে রেখে দেওয়া ইত্যাদি কারণে দেশ প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। এক হিসাবমতে, বছরে বাংলাদেশ থেকে কমপক্ষে ১৫-১৬ বিলিয়ন ডলার পাচার হয়ে যাচ্ছে। গত বছর বিপুল জনশক্তি রপ্তানির পরও সেপ্টেম্বরে রেমিট্যান্স এসেছে মাত্র ১৩৪ কোটি ডলার, যা গত ৪১ মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন। এর প্রধান কারণ হুন্ডির মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রা পাচার। অক্টোবরে রেমিট্যান্স এসেছে ১৯৭ দশমিক ৭৫ কোটি ডলার। তা সত্ত্বেও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের পতন ঠেকানো সম্ভব হয়নি। ২০২৩ সালের নভেম্বরে বাংলাদেশের গ্রস বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ (আইএমএফের হিসাবমতে) ১৯ দশমিক ৪৫ বিলিয়ন ডলার, যার ফলে নিট রিজার্ভের পরিমাণ ১৭ বিলিয়ন ডলারেরও নিচে নেমে গেছে।
বলতে দ্বিধা নেই, অর্থ পাচার তথা হুন্ডির মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রা পাচারের ফলে বাংলাদেশ ব্যাংকের ডলার রিজার্ভ প্রতিনিয়ত ক্ষয়প্রাপ্ত হচ্ছে। অর্থমন্ত্রী বলেছেন, দেশে যে পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা আসার কথা, তার অর্ধেকই হুন্ডির মাধ্যমে পাচার হয়ে যায়। সে হিসাবে প্রতিমাসে গড়ে আমরা যে ২০০ কোটি ডলার রেমিট্যান্স পাই, সে পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা হুন্ডি ব্যবসার কারণে হারাচ্ছি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, আমাদের বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের প্রধান উৎস রপ্তানি আয়। রপ্তানি খাত থেকে আসে মোট বৈদেশিক মুদ্রার ৭০ শতাংশ, আর রেমিট্যান্স থেকে আসে ২৮ শতাংশ। গত জুনে রপ্তানি আয় ছিল ৫০০ কোটি ডলারের উপরে। জুলাইয়ে ৪৫৯ কোটি, আগস্টে ৪৭৮ কোটি এবং সেপ্টেম্বরে ৪৩১ কোটি ডলার; অর্থাৎ রপ্তানি আয় গত জুনের তুলনায় কমতির দিকে। অন্যদিকে দেশের মুদ্রাবাজারে ডলারের চাহিদা বেশি থাকায় তা মেটানোর জন্য প্রায় প্রতি মাসেই বাংলাদেশ ব্যাংক ১ বিলিয়ন ডলার বাজারে ছাড়ছে। এছাড়া রয়েছে আমদানি ব্যয় মেটানো ও বৈদেশিক ঋণ পরিশোধ। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর অর্থ পাচারের ব্যাপকতা বোঝাতে উল্লেখ করেছেন, দুবাইয়ে ১৩ হাজার বাংলাদেশি মালিকানাধীন কোম্পানি রয়েছে। প্রতিটি কোম্পানি খুলতে গড়ে কমপক্ষে ৫ কোটি টাকা খরচ হলে শুধু কোম্পানি প্রতিষ্ঠার জন্যই খরচ হয়েছে ৬৫ হাজার কোটি টাকা। পর্তুগালে গত দুই বছরে আড়াই হাজার বাংলাদেশি বাড়ি ক্রয় করে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান গড়ে নাগরিকত্ব পেয়েছেন। তাদের প্রত্যেকে কমপক্ষে ৫ লাখ ইউরো বিনিয়োগ করেছেন। সে হিসাবে ওই দেশে পাচার হয়েছে কমপক্ষে ১২৫০ মিলিয়ন ইউরো। যেহেতু এখনো প্রতিমাসে যে হারে রিজার্ভ কমছে, সেই হারে পুনর্ভরন হচ্ছে না, সেহেতু রিজার্ভ তলানিতে পৌঁছাতে আরও সময় বাকি রয়েছে বলে মনে হয়। যে কোনো মূল্যে দুর্নীতি, পুঁজি লুণ্ঠন ও বৈদেশিক মুদ্রা পাচার বন্ধ করতে না পারলে বিপর্যয় ঠেকানো সম্ভব হবে না। বিদেশে যেসব বাংলাদেশি বাড়ি ক্রয় করে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলে কিংবা বিনিয়োগের বিনিময়ে পর্তুগাল, মালয়েশিয়া বা অন্য কোনো দেশের নাগরিকত্ব গ্রহণ করে, তাদের চিহ্নিত করা খুব কঠিন কাজ নয়। এদের মধ্যে কারা বৈধ উপায়ে এবং কারা অবৈধভাবে বৈদেশিক মুদ্রা নিয়ে গেছে তা বের করা প্রয়োজন। জনস্বার্থে এসব পাচারকারী-লুটেরার বিরুদ্ধে সরকারকে ব্যবস্থা নিতে হবে অথবা এসব অপকর্মের দায় কর্তৃপক্ষকেও নিতে হবে।
ঋণখেলাপিদের রাষ্ট্রীয় পুরস্কার দেওয়া হবে না মর্মে গভর্নর বলেছেন। এদের সঠিক তালিকা প্রস্তুত করে সংবাদপত্রে প্রকাশে বাধা কোথায়? এ প্রসঙ্গে অর্থনীতিবিদ ড. মইনুল ইসলামের একটি মন্তব্য এখানে উদ্ধৃত করা যায়। তিনি বলেছেন, ‘বাংলাদেশের অনেক বড় গ্রুপের বিরুদ্ধে পুঁজি পাচারের অভিযোগ আছে। কিন্তু সেগুলোর কখনোই যথাযথ তদন্ত হয়নি। হাজার হাজার ব্যাংক ঋণ লুটেরা, দুর্নীতিবাজ আমলা, প্রকৌশলী, গার্মেন্টস মালিক ও রাজনীতিক এখনো দেশ থেকে পুঁজি পাচার করছে। এসব পুঁজি পাচারকারী জাতির এক নম্বর দুশমন। তারা যদি ব্যাপক হারে বিদেশে পুঁজি পাচার না করত, তাহলে অর্থনীতি বর্তমান সংকটে পড়ত না।’
মূল্যস্ফীতির লাগাম টানতে সরকারনির্ধারিত ৯-৬ সুদের হার তুলে দেওয়ার জন্য অর্থনীতিবিদদের চিৎকার শোনা এবং তা কার্যকর করায় বাংলাদেশ ব্যাংক অনেক বিলম্ব করেছে। আর্থিক হিসাবের ঘাটতির কারণে সরকারি ব্যয় চালু রাখার স্বার্থে বাংলাদেশ ব্যাংক টাকা ছাপিয়েছে। এতেও মূল্যস্ফীতি বেড়েছে। পরবর্তীকালে এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বৈদেশিক মুদ্রা সংকটে আমদানি নিয়ন্ত্রণ। ফলে কতিপয় চিহ্নিত ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান নিত্যপণ্যের সিন্ডিকেট গড়ে তুলেছে। আগস্ট, সেপ্টেম্বর, অক্টোবর-এ তিন মাস ধরেই খাদ্য মূল্যস্ফীতি ১২ শতাংশের উপরে। বিশ্ববাজারে যখন অধিকাংশ খাদ্যপণ্যের দাম নিম্নমুখী, সেসময় আমাদের দেশের অধিকাংশ নিত্যপণ্যের দাম কেন ঊর্ধ্বমুখী-এ প্রশ্ন করার অধিকার জনগণের রয়েছে। সম্প্রতি বাজারে চালের দামও কেজিতে ২ থেকে ৪ টাকা, অর্থাৎ বস্তাপ্রতি ৩০০ টাকা বেড়েছে বলে খবরে প্রকাশ। পেঁয়াজ, আলু, ডিম, মাছ, ব্রয়লার মুরগি-এসবের দাম আগে থেকেই চড়া। নিম্ন-আয়ের মানুষই মূল্যস্ফীতির বড় ভুক্তভোগী। তাদের স্বস্তি দিতে হলে সিন্ডিকেট ভাঙতে হবে, বাজার মনিটরিং বাড়াতে হবে, বাজারে প্রতিযোগিতা সৃষ্টি করতে হবে, অবৈধ চাঁদাবাজিসহ অতি মুনাফাখোরি শক্ত হাতে দমন করতে হবে। ডলার সংকট এবং টাকার মানের অবমূল্যায়ন মুদ্রাস্ফীতি পরিস্থিতি আরও খারাপ করতে পারে। সেজন্য সরকারকে অবশ্যই মুদ্রানীতি, রাজস্বনীতি ও বাজার ব্যবস্থাপনার মধ্যে সমন্বয় করে পদক্ষেপ নিতে হবে।
আমাদের দেশীয় মুদ্রা ইতোমধ্যে ২৭ শতাংশ অবমূল্যায়িত হয়েছে। টাকার মান ধরে রাখার জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি করছে। কিন্তু এতে কোনো ফল পাওয়া যাচ্ছে না। ডলারের দাম বাড়ছে, টাকার মান কমছে। বৈদেশিক মুদ্রামান নির্ধারণের ক্ষমতা কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাংলাদেশ ফরেন এক্সচেঞ্জ ডিলারস অ্যাসোসিয়েশনের (বাফেদা) কাছে ছেড়ে দিয়েছে। ফলে একশ্রেণির ব্যাংক ও মুদ্রা ব্যবসায়ী কার্ব মার্কেটের সঙ্গে যোগসাজশ করে মুদ্রামান ওঠানামা করিয়ে ব্যবসা করছে বলে শোনা যায়। শ্রীলংকার ইনস্টিটিউট অব পলিসি স্টাডিজের নির্বাহী পরিচালক অর্থনীতিবিদ দুশনি বীরাকুন সম্প্রতি ঢাকায় সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘মুদ্রার মান ধরে রাখতে রিজার্ভ থেকে খরচের কোনো মানে হয় না।’ বৈদেশিক মুদ্রার চাহিদা কিংবা চাপের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে দেশীয় মুদ্রার বিনিময় হারের সামঞ্জস্য করতে হবে। একবার সেটি করা হলে বৈদেশিক মুদ্রা নিয়ে কারচুপি বন্ধ হবে, রেমিট্যান্স আগমন বাড়বে এবং রপ্তানি আয়ও বাড়বে। ব্যালেন্স অব পেমেন্ট সংকট কাটিয়ে ওঠার জন্য এ উপায়ে রিজার্ভ সঞ্চিতির কোনো বিকল্প নেই।
দক্ষিণ এশিয়ারই দেশ শ্রীলংকা ২০১০ সালে মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হয়েছে। তাদের মাথাপিছু জিডিপি ৪ হাজার ডলার ছাড়িয়ে গিয়েছিল, কিন্তু রাজস্ব ও বৈদেশিক মুদ্রা ব্যবস্থাপনার কিছু ত্রুটির কারণে সেদেশের অর্থনীতি চরম বিপর্যয়ের মুখে পড়েছিল। পরবর্তীকালে সঠিক অর্থনৈতিক নীতিপদ্ধতি অবলম্বনের ফলে শ্রীলংকার বিপর্যয় অনেকটা কাটিয়ে ওঠার পথে। বৈদেশিক মুদ্রার জন্য হাহাকার কমে গিয়েছে এবং মূল্যস্ফীতি ২ শতাংশের নিচে নামিয়ে আনা সম্ভব হয়েছে। শ্রীলংকার তুলনায় আমাদের দেশ এখনো অনেক ভালো। বাংলাদেশের বৈদেশিক ঋণ সহনীয় পর্যায়ে রয়েছে, আমরা বহুজাতিক উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা এবং দ্বিপাক্ষিক উন্নয়নসহযোগী দেশগুলোর আস্থা হারাইনি। উৎপাদন, রপ্তানি, কর্মসংস্থান, দ্রব্যের প্রাপ্যতা ইত্যাদি সামান্য কমলেও স্থিতিশীল অবস্থায় রয়েছে। অর্থনীতির মৌলভিত্তি এখনো ভেঙে পড়েনি। এ অবস্থায় সঠিক অর্থনৈতিক নীতি বাস্তবায়নের মাধ্যমে দুর্নীতি, অর্থ পাচার, খেলাপি ঋণ, মূল্যস্ফীতি ইত্যাদি কমিয়ে আনা হলে অর্থনীতি বর্তমান সংকট কাটিয়ে আবার ঘুরে দাঁড়াবে।
মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া : সাবেক সিনিয়র সচিব ও এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান, বর্তমানে জার্মানিতে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত