Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

নীতি দুর্নীতি অর্থনীতি

রাজনৈতিক অস্থিরতায় সাধারণ মানুষের কষ্ট বাড়ছে

Icon

ড. আর এম দেবনাথ

প্রকাশ: ১৮ নভেম্বর ২০২৩, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

রাজনৈতিক অস্থিরতায় সাধারণ মানুষের কষ্ট বাড়ছে

বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি কয়েকদিন আগে বলেছেন, তার অঞ্চলের মেয়েরা দিনে তিনবার লিপস্টিক ব্যবহার করে। এ কথা কীভাবে তিনি বললেন তা আমি জানি না। তবে যা গত পরশুদিন জেনেছি তার কথা বলছি। উত্তরাঞ্চলের এক রিকশাওয়ালা দৌড়ের ওপর আছেন। তার ‘কিস্তি’ দেওয়ার সময় হয়েছে। মেয়ের বিয়ে, স্ত্রীর অপারেশন ইত্যাদির জন্য তিনি স্থানীয় এক ‘এনজিও’ থেকে ‘লোন’ নিয়েছেন। প্রতি মাসে এর কিস্তি দিতে হয়। নভেম্বরের কিস্তি বাকি পড়ে গেছে। তিনি এখন গলদঘর্ম। রিকশায় এখন যাত্রী কম। হরতাল-অবরোধ। অস্থিরতা চারদিকে। স্কুল বন্ধ। ছেলেমেয়েরা অভিভাবকসহ স্কুলে যায় না। মানুষের চলাচল কম। অতএব যাত্রী কম। তাই অবশ্যম্ভাবীভাবে ভাড়াও কম। কম ভাড়ায় তিনি বেশি বেশি ‘খ্যাপ’ মারেন যাতে আয় বাড়ে। তবু তিনি কুলিয়ে উঠতে পারছেন না। কয়েকদিনের মধ্যে তাকে বাড়িতে ২০ হাজার টাকা পাঠাতে হবে-খোরাকি, কিস্তির খরচ বাবদ। মন্ত্রী সাহেবের কথার সঙ্গে তো রিকশাওয়ালার কথা মিলল না। ‘লিপস্টিক’ ব্যবহার করা যদি সচ্ছলতার খবর হয়, তাহলে কিস্তির খবরটা কী?

উত্তরবঙ্গের রিকশাওয়ালাদের একটা অংশ বরাবরই ঋণী-দায়গ্রস্ত। তারা কিস্তির টাকা দেওয়ার জন্য ঢাকায় আসেন। কাজ করেন এক-দুই মাস। বাড়ি যান কিছু টাকা হলে। ইদানীং এ ধরনের রিকশাওয়ালার সংখ্যা বাড়ছে। এমনিতেই মানুষ দেনার ভারে ভুগছে। টানা হরতাল-অবরোধ, অস্থিরতার কারণে মানুষের ভোগান্তি বেড়েছে। রোজগার নেই। বাকিতে খাওয়া, দেনা করা, সহায়-সম্পদ-গরু-ছাগল বিক্রি করা-এসব দিন দিন বাড়ছে। নির্বাচন-পূর্ববতী সময়ে যদি এ ধরনের অবরোধ-হরতাল দিনের পর দিন চলতে থাকে, তাহলে মানুষের ভোগান্তির শেষ থাকবে না। এ সময়ে অবশ্য একটা ভালো খবর আছে। আর সেটা হচ্ছে আমনের খবর। কাগজে দেখলাম দেশের কোথাও কোথাও ইতোমধ্যে আমন ধান উঠতে শুরু করেছে। ফসলের পূর্বাভাসও ভালো। কিন্তু ফসল তোলার কাজে শ্রমের ব্যবহার এখন কম। যন্ত্রেই হয় সবকিছু। অতএব, গ্রামেই কৃষি মজুরদের কাজ আমন মৌসুমে বাড়বে এর কোনো কারণ দেখি না।

হরতাল-অবরোধে দেশের সাপ্লাই চেইন যে পুরোপুরি ভেঙে গেছে, তা ১৪ নভেম্বরের এক সভায় এফবিসিসিআই নেতারা বলেছেন। তারা অবিলম্বে এ আত্মবিধ্বংসী কাজ থেকে সবাইকে বিরত থাকতে অনুরোধ করেছেন। দেশবাসীকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন টানা হরতাল-অবরোধের কুফল সম্পর্কে। একটি কুফলের কথা কাগজে দেখলাম। সেটি হচ্ছে পাইকারি বাজারের খবর। স্থান বগুড়ার মহাস্থান বাজার। সেখানে অবরোধের কারণে পরিবহণ বিঘ্নিত হওয়ায় চাহিদা কমে গেছে। এ কারণে এক সপ্তাহের ব্যবধানে পাইকারি বাজারে সবজির দাম প্রায় অর্ধেকে হ্রাস পেয়েছে। খবরে দেখা যাচ্ছে, কৃষক এক মন ফুলকপি আগে যেখানে বিক্রি করেছেন ১৮০০ টাকায়, তার দাম এখন মোটামুটি ১০০০ টাকা। এদিকে অবরোধের কারণে ট্রাকভাড়া বেড়ে গেছে। বগুড়া থেকে ঢাকায় ট্রাকভাড়া যেখানে ছিল ২০ হাজার টাকা, এখন তা ৩০ হাজার টাকা। এর ফল ঢাকাবাসী হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে। প্রতিটি পণ্যের, কৃষিপণ্যের জন্য দেড়গুণ-দ্বিগুণ দাম গুনতে হচ্ছে। পণ্যের ভোগ কমাতে হচ্ছে। পরিবহণ ব্যবসা বিঘ্নিত হওয়ায় ভাড়া বেড়েছে ঠিকই, কিন্তু সার্বিকভাবে পরিবহণের চাহিদা কমেছে। পরিবহণের চলাচল সীমিত হয়েছে। মালিকরা ভয়ে তটস্থ। কার গাড়ি কখন আগুনে পোড়ানো হয়-এই ভয়ে তারা গাড়ি রাস্তায় বের করছেন না। ঝুঁকি নিয়ে যারা বের করছেন, তারা ভাড়া নিচ্ছেন বেশি। পণ্যের দাম বাড়ছে।

এদিকে অবরোধের কারণে দূরপাল্লার বাস-ট্রাক পরিবহণ ভীষণভাবে বিঘ্নিত হচ্ছে। অথচ এ পরিবহণ শিল্পের সঙ্গে জড়িত লাখ লাখ শ্রমিক। ট্রাক-বাস শ্রমিকদের রোজগার শুধু বেতনে নয়, তারা ট্রিপে ট্রিপে আলাদা টাকা পান। সেসব বন্ধ। ড্রাইভাররা ঝুঁকি নিয়ে গাড়ি বের করতে সাহস করেন না। ট্রাক, বাস, লঞ্চ, টেম্পো ইত্যাদি ব্যবসায় বিশাল মন্দা নেমে এসেছে। এর সঙ্গে জড়িত আরেকটি শিল্প ধুঁকে ধুঁকে মরছে। আর সেটি হচ্ছে পর্যটনশিল্প। চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, সিলেট, খুলনা, খাগড়াছড়ি ইত্যাদি অঞ্চলের ট্যুরিস্ট স্পটগুলো এখন ফাঁকা। হোটেল-মোটেল ব্যবসা ক্ষতিগ্রস্ত। নগদ লেনদেন নেই। এ শিল্পের সঙ্গে জড়িত লাখ লাখ শ্রমিক-কর্মচারী। জড়িত বিমান পরিবহণ, লাক্সারি বাস। বিমানের যাত্রী নেই বললেই চলে। লাক্সারি বাসের ব্যবসা তলানিতে। অবরোধে মধ্যবিত্ত ঝুঁকি নিয়ে বেড়াতে সাহস পায় না। আর অর্থনৈতিক মন্দার বিষয় তো রয়েছেই।

অবরোধ-হরতাল, সামাজিক অনিশ্চয়তার বড় শিকার হচ্ছে খুচরা ব্যবসা। সারা দেশে লাখ লাখ ছোট ও মাঝারি দোকান। সাপ্লাই চেইনে এরাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। এ খুচরা বিক্রি ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। খুচরা ব্যবসা কীভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, এ সম্পর্কে কাগজে প্রতিদিন খবর প্রকাশিত হচ্ছে। কাগজের খবর থেকে প্রতীয়মান হয়, খুচরা ব্যবসা কমপক্ষে ৫০ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে। বিছানার চাদর, পর্দা, মশারি, কম্বল, শার্ট, প্যান্ট, স্যুট, ব্লেজার, পাঞ্জাবি, কসমেটিকস, জিন্স, টি-শার্ট থেকে শুরু করে সব ধরনের খুচরা বিক্রি হ্রাস পেয়েছে। অগ্রহায়ণের ৩ তারিখ আজ। আবহাওয়ায় শীতের আমেজ। এ সময়ে কম্বলের ব্যবসা হয়, শীতবস্ত্রের ব্যবসা হয়। বুড়িগঙ্গা নদীর ওপারে জিঞ্জিরায় শীতবস্ত্র তৈরির বিশাল ব্যবসা গড়ে উঠেছে। শত শত দর্জি, হেলপার সেখানে কর্মরত। উত্তরবঙ্গের বহু জায়গায় শীতবস্ত্র তৈরির ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে। পোশাকশিল্পের বর্জ্য ‘ঝুট’ভিত্তিক শিল্প গড়ে উঠেছে। পত্রিকার খবরে বোঝা যাচ্ছে হরতাল-অবরোধে এসব শিল্পের কাজকর্মে স্থবিরতা দেখা দিয়েছে। এ মৌসুমে আমন ধান উঠলে তা পরিবহণের প্রয়োজন হয়। কৃষকরা আমন ধান বাজারে নিয়ে আসবেন। মিলাররা তা কিনবেন। পরিবহণ বিঘ্নিত হওয়ায় আমন ধান-চাল পরিবহণে ভীষণ সমস্যা দেখা দেবে। এটা খুবই দুশ্চিন্তার বিষয়। এ সময়ে মানুষ শাকসবজি, মাছ-মাংস, তরিতরকারি, হাঁস-মুরগি ইত্যাদি খেয়ে একটু স্বস্তি পায়। এসবের দাম একটু পড়ে, কারণ এগুলোর সরবরাহ বাড়ে। কিন্তু এবার এ ধরনের আশা অবস্থাদৃষ্টে মনে হয় দুরাশা। মানুষ এমনিতেই তাদের ভোগ বাধ্য হয়ে কমাচ্ছে, তার ওপর পরিবহণ সংকটের কারণে এসবের দাম আরও উপরে উঠলে শাকসবজি, মাছ-মাংসে হাত দেওয়া যাবে না।

এ সময়ে বড় বড় কোম্পানি, ব্যাংক, ধনাঢ্য ব্যক্তিরা শীতার্তদের মধ্যে শীতবস্ত্র বিতরণ করে। কাগজে দেখলাম, ব্যাংকের মালিকরা প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিলে কম্বল দান শুরু করেছেন। এসব কম্বল গরিব ও শীতার্তদের মধ্যে বিতরণ করতে হবে। তা কীভাবে সম্ভব হবে-এটা এখন নতুন দুশ্চিন্তার বিষয়।

ডিসেম্বর আসছে। কদিন পরই শুরু হবে নতুন শিক্ষাবর্ষ। নতুন শিক্ষাবর্ষ মানেই নতুন বই-পুস্তক। কোটি কোটি বই ছাপাতে হবে। কাগজ, কালি, প্যাকেজিংসামগ্রী পরিবহণ করতে হবে। ছাপা পুস্তক স্কুলে স্কুলে পৌঁছাতে হবে। নির্বাচনি সরঞ্জাম ভোটকেন্দ্রে পৌঁছাতে হবে। কীভাবে এসব কাজ সম্পন্ন হবে-যদি হরতাল-অবরোধ অব্যাহত থাকে। অনেক প্রশ্ন।

পরিবহণ যদি অবরোধের শিকার হয়, তাহলে আমদানি-রপ্তানি ব্যবসা যে বিঘ্নিত হবে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। পেশাজীবীদের কথাও বলতে হয়। ঢাকায় বিভিন্ন স্থানে ওস্তাগার, হেলপার, কাঠমিস্ত্রি, তালামিস্ত্রি শ্রেণির শ্রমিক প্রতিদিন কাজের আশায় বসেন। যাদের দরকার তারা সেখান থেকে শ্রমিক, কারিগর জোগাড় করেন। এ বাজারে স্পষ্টতই মন্দা দেখা দিয়েছে। মেরামতির কাজ কম, নির্মাণকাজ কম। এদের পাশাপাশি আছে হরেক রকমের হকার-কেউ বাদাম বিক্রি করে, কেউ ফল বিক্রি করে, কেউ ডাব বিক্রি করে, কেউ আখের রস বিক্রি করে, কেউ পিঠা বিক্রি করে। এদের বেচাকেনা কম, খুবই কম। এমন শত শত ধরনের ছোট ছোট স্বাধীন ব্যবসা হরতাল-অবরোধে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। আরও কিছুদিন এভাবে চললে তাদের সংসার-জীবিকা হুমকির মুখে পড়বে। বহু লোক ইতোমধ্যেই দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে গেছে। পুষ্টির সমস্যা দেখা দিচ্ছে। ঋণের সমস্যা বাড়ছে।

রাজনৈতিক সমস্যা দীর্ঘায়িত হলে অর্থনৈতিক মন্দায় দেশ নিমজ্জিত হবে। এমনিতেই ডলার নেই, রেমিট্যান্স কম, আমদানি বাণিজ্য সংকুচিত, রাজস্ব আশানুরূপ নয়, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমছে। অনেক সমস্যা। এসবের আরেকটি ফল আছে যা মারাত্মক। সেটি হচ্ছে শ্রেণিবিন্যাসিত ঋণ। আমরা যখন মন্দা নিয়ে চিন্তিত, মূল্যস্ফীতি নিয়ে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত, তখন ব্যাংকাররা ভাবছেন শ্রেণিবিন্যাসিত ঋণের পরিমাণ নিয়ে। এমনিতেই এ সমস্যা চূড়ান্ত পর্যায়ে। এ অবস্থায় যদি ব্যবসা-বাণিজ্যে স্থবিরতা নেমে আসে, হরতাল-অবরোধ চলতে থাকে, যদি সাপ্লাই চেইন বিঘ্নিত হয়-তাহলে নিশ্চিতভাবেই বলা যায়, ঋণের টাকা ব্যাংকে ফেরত আসবে না। অনেক ব্যবসায়ী এমনিতেই ঋণের টাকা ফেরত দেন না, তার ওপর যখন হরতাল-অবরোধের মতো ‘অজুহাত’ পাওয়া যাবে, তখন আর কোনো টাকাই ব্যাংকে ফেরত আসবে না। ইতোমধ্যেই ব্যবসায়ীরা তাদের ‘দুঃখের’ কথা বলতে শুরু করেছেন। এ অবস্থায় হরতাল-অবরোধে শ্রেণিবিন্যাসিত ঋণের পরিমাণ যে আরও বাড়বে, তাতে সন্দেহ নেই। আর এটা হবে সর্বনাশা খবর।

ড. আর এম দেবনাথ : অর্থনীতি বিশ্লেষক; সাবেক শিক্ষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম