মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়ার একটা অর্থপূর্ণ লক্ষ্য ছিল

 এম এ মান্নান 
২০ নভেম্বর ২০২৩, ১২:০০ এএম  |  প্রিন্ট সংস্করণ

আমাদের প্রাণাধিক প্রিয় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আজীবন জনগণের জন্য জেল-জুলুম সহ্য করে, আন্দোলন-সংগ্রাম করে অতীব সাহস ও ধৈর্যের সঙ্গে এদেশের মানুষকে অনুপ্রেরণা দিয়ে বাংলাদেশ স্বাধীন করার প্রশ্নে অকপট সহযোগিতা জুগিয়ে গেছেন। ফলে আমরা ৯ মাস অবিরাম মুক্তিযুদ্ধ করে বহু শহিদের রক্তের বিনিময়ে বাংলাদেশ স্বাধীন করতে পেরেছি। যার ফলে স্বাধীন দেশের জাতির পিতা করে আমরা তাকে অমরত্বের আসনে অধিষ্ঠিত করেছি। বঙ্গবন্ধুকে যেভাবেই শ্রদ্ধা-ভালোবাসায় কিংবা দোষ-ত্রুটির বিচারে মূল্যায়ন করা হোক না কেন, তার মূল্যবোধ চিরদিন অটুটই থাকবে। যতদিন বাংলাদেশ টিকে থাকবে, ততদিন তার নাম কেউই মুছে ফেলতে পারবে না। তার জীবনব্যাপী ইতিহাসের মূল্যায়নে জাতির পিতার স্মৃতি ও ঐতিহ্য নিয়ে বেঁচে থাকবেন। বঙ্গবন্ধুকে হারিয়ে বহু দুঃখ-কষ্টের বিনিময়ে আমরা তার সুযোগ্য কন্যা শেখ হাসিনাকে পিতার জায়গায় ধরে রাখতে চেয়েছি। শত দুঃখ-কষ্টের মাঝেও আমরা শেখ হাসিনাকে রাজসিংহাসনে বসাতে একান্তভাবে ইচ্ছা প্রকাশ করেছি। বঙ্গবন্ধুকন্যা হিসাবে শেখ হাসিনাকে অনেক ধৈর্য ও মহত্ত্বের পরিচয় ধরে রাখতে হবে। তার কাছ থেকে আমরা আত্মত্যাগ ও সুআচরণ আশা করি। কিন্তু তিনি মর্যাদাপূর্ণ আসনে বসে মাঝেমাঝে যেভাবে অযৌক্তিক ভাষায় মনের দুঃখ-কষ্ট প্রকাশ করেন, তা তাকে মোটেই মানায় না। তাই আমার ছোট বুদ্ধি ও কিছু অভিব্যক্তি তার সমীপে পেশ করতে চাই। আশা করব তিনি আমার এ অভিব্যক্তিকে খোলা মনে গ্রহণ করবেন।

১. মহান আল্লাহর এ বিশাল জগতে আমরা অতীব ক্ষুদ্র ক্ষণস্থায়ী জীব। মানুষের জীবনের এক মিনিটেরও ভরসা নেই। যে কোনো সময় এ রাজসিংহাসন ছেড়ে অজানা এক অন্ধকার পথে চলে যেতে হবে। তাই সময় থাকতে আপনাকে সুবিবেচনাবোধের পরিচয় দিতে হবে ।

২. আপনি জীবনে যেমন বহু দুঃখ-কষ্টের আঘাতে ছিন্নভিন্ন অবস্থার মুখোমুখি হয়েছেন, তেমনি আপনি অনেক সুখ ভোগও করেছেন। আপনি বিশ্বের অধিকাংশ দেশই সফর করে ঘুরেফিরে জীবনের স্বাদ উপভোগ করেছেন। আপনার আর কোনো চাওয়া-পাওয়ার ওজর আপত্তি নেই। বহু তুখোড় রাজনীতিবিদ পণ্ডিত বুদ্ধিজীবীদের সংস্পর্শে এসেছেন। আরও পাঁচ বছর ক্ষমতায় থাকলে এসব সুযোগ-সুবিধাই ভোগ করবেন। আল্লাহ যাকে ইচ্ছা সম্মান-মর্যাদা দান করেন, আবার যাকে ইচ্ছা লাঞ্ছিত-অমর্যাদাও করেন। ক্ষমতা চিরদিন এক হাতে থাকে না। এটা প্রতিনিয়ত পরিবর্তনশীল।

৩. আপনি ঐতিহ্যবাহী রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের সভাপতি। শহর থেকে তৃণমূল পর্যায় পর্যন্ত গ্রামেগঞ্জে এ দলের কর্মীর বিস্তৃতি রয়েছে। আমরা চাই এ দলটির সুনাম চিরদিন অক্ষুণ্ন থাক। আপনার অভিব্যক্তির দিকে তাকিয়ে সারাক্ষণ তীর্থের কাকের মতো নেতাকর্মীরা ২-১টি ভালো কথা, খুশির কথা শোনার জন্য অপেক্ষা করে থাকে।

৪. দেশের ও জনগণের প্রয়োজনে যদি আপনি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করেন, তবে মনে রাখবেন আল্লাহ চান তো ক্ষমতা আপনার হাতেই ফিরে আসবে। যদি ক্ষমতা ফিরে না আসে, তবে কমপক্ষে আপনি বড় বিরোধী দলের ভূমিকায় থাকবেন। এতে আপনার মহত্ত্বের এক বিরাট পরিচয় ঘটবে। দেশের জনগণের কাছে আপনার গ্রহণযোগ্যতা আরও অনেক গুণ বেড়ে যাবে বলে সুশীলসমাজের ধারণা। অবশ্য এখন আর সেসময় নেই।

একটি দেশের সংসদীয় নির্বাচন দেশের গণতন্ত্র, উন্নয়ন, শান্তি ও শৃঙ্খলা রক্ষার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। দেশের গণতন্ত্র ও সার্বিক উন্নয়নের জন্য সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন শুধু আমাদের জন্যই নয়, বিশ্বের প্রতিটি দেশের জন্যই অপরিহার্য ও মঙ্গলজনক। বর্তমানে আমাদের দেশে গণতন্ত্র ও শান্তিশৃঙ্খলা আছে কি না, তা আমরা মনেপ্রাণে বুঝতেই পারি না। গণতন্ত্র এমন একটা জিনিস যা ধরা যায় না, ছোঁয়া যায় না, চোখে দেখাও যায় না। অথচ একটা দেশে গণতন্ত্র না থাকলে সেটা মনে হয় যেন কোনো অসভ্য জঙ্গলের দেশ, সেখানে মানুষের পারস্পরিক ভালোবাসার কোনো মূল্য থাকে না। দেশের সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নকল্পে দেশের মানুষের মনের ভাবকে একত্র করে সম্মিলিত হয়ে ঐক্যবদ্ধভাবে কোনো কাজের সমন্বয়ের সমষ্টিকেই গণতন্ত্রের প্রকৃত বিকাশ বলে ধরে নেওয়া হয়। গণতন্ত্র না থাকলে মানুষের কোনো বাকস্বাধীনতাও থাকে না। আমরা বাকস্বাধীনতা ও সম্পদের সুষম বণ্টনের জন্য, পারস্পরিক ভালোবাসা ও সৌহার্দ বিনিময়ের মাধ্যমে ৯ মাস অবিরাম যুদ্ধ করে অসংখ্য অগণিত জীবনের তাজা রক্তের বিনিময়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জন করেছি। আমি একজন মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক। মুজিবনগর সরকারের মহামান্য অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম সাহেব আমাকে কিশোরগঞ্জ জেলার ভাটি এলাকা ছাড়া মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত গঠনের জন্য সংগঠকের দায়িত্ব প্রদান করলে আমি প্রথমেই বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টি, ন্যাপ ইত্যাদি দলের সমন্বয়ে কটিয়াদী থানার সর্বদলীয় অ্যাকশন কমিটি গঠন করি এবং আওয়ামী লীগের পক্ষে অ্যাকশন কমিটির সভাপতি নির্বাচিত হই। আমার বাড়িতে নিজ খরচে একটি অস্থায়ী মুক্তিযুদ্ধ ক্যাম্প প্রতিষ্ঠা করি, যেখানে ট্রেনিংপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধারা এবং নিপীড়িত নির্যাতিত হিন্দু-মুসলিমরা গোপনে আশ্রয় নিত। আমি বহু যুবককে মুক্তিযুদ্ধে ট্রেনিংয়ে পাঠাই। অবশেষে কয়েকশ যুবক নিয়ে ভারতের পুরাখাসিয়ায় মুক্তিযুদ্ধ ট্রেনিং গ্রহণ করি।

১৯৬৬ সালে বঙ্গবন্ধুর ৬ দফা দাবির মর্মার্থ বুঝে আওয়ামী লীগকে সমর্থন করা শুরু করি। বঙ্গবন্ধুর আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ মিছিল, মিটিং ও আন্দোলন করি। এভাবে আমার আওয়ামী লীগ করার বর্তমান বয়স প্রায় ৫৫-৫৬ বছর। এ পর্যন্ত আমি রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা থেকে বহুভাবে বঞ্চিত হয়ে এখন নীরবে অবহেলিত হয়ে নোংরা রাজনৈতিক পরিবেশ থেকে অনেকটা দূরে থাকতে চেষ্টা করছি। আমি শৈশব থেকে নিঃস্ব হতদরিদ্রদের সেবা করে আসছি, তাই সমাজসেবা ও জনসেবা করে বাকি জীবন অতিবাহিত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। মুক্তিযুদ্ধ করতে গিয়ে জীবনে অনেক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছি। বঙ্গবন্ধুকন্যা মাননীয় প্রধান মন্ত্রী শেখ হাসিনা আমাকে নবম সংসদ নির্বাচনে এমপির নমিনেশন দিলেও মাননীয় নেত্রীর অনুরোধে সেক্রিফাইস করতে হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের একপর্যায়ে মারাত্মকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়লে প্রথমে মাননীয় সাবেক ধর্মমন্ত্রী প্রিন্সিপাল মতিউর রহমান সাহেব আমাকে ভারতের ঢালু হাসপাতালে ভর্তি করান। সেখানেও বিশেষ কোনো উন্নতি না হলে এমন সময় আল্লাহর রহমতে মহামান্য অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি মরহুম সৈয়দ নজরুল ইসলাম সাহেব আমাকে তুরা হাসপাতালে খুঁজে বের করে আমার চিকিৎসার যাবতীয় দায়িত্ব নিলে আমি আস্তে আস্তে সুস্থ হয়ে উঠি। দোয়া করি আমার অতীব শ্রদ্ধেয় স্যার মরহুম সৈয়দ নজরুল ইসলাম সাহেবকে আল্লাহ যেন জান্নাতুল ফেরদাউস দান করেন।

দেশে বর্তমানে যে সংঘাত পরিস্থিতি বিরাজ করছে, তা অত্যন্ত জটিল আকার ধারণ করছে। এই সংঘাত দেশকে কোন দিকে নিয়ে যাবে তার কোনো ঠিক নেই। দেশের নিরীহ মানুষ মরছে, গাড়ি-বাড়ি-সম্পদ ধ্বংস হচ্ছে। আপনার আমার জীবনের যেমন মূল্য, আশা-আকাঙ্ক্ষা আছে, ঠিক তেমনি এক নিংস্ব হতদরিদ্র গরিব মানুষেরও জীবনের মূল্য আছে। সংঘাতময় পরিস্থিতি কারও জন্য কোনো মঙ্গল বয়ে আনে না। দিনে দিনে শুধু অকল্যাণ-অমঙ্গলই টেনে আনে। বঙ্গবন্ধুকে জাতির পিতার স্বীকৃতিতে ভূষিত করা হলেও দেশের ১৭-১৮ কোটি মানুষের সবার মনে স্থান করে নিতে পারেননি তিনি। আমাদের চেষ্টা করতে হবে কীভাবে পুরো জাতির জন্য তার স্বীকৃতি উদ্ধার করা যায়। না হয় এসব অমর কীর্তি দিনে দিনে অবমূল্যায়িত হতে থাকবে। বিএনপিও বাংলাদেশে একটি বৃহৎ দল। আমরা না মানলেই যে এই দলের অস্তিত্ব নষ্ট বা বিলীন হয়ে যাবে, এমন চিন্তা করার কোনো সুযোগ নেই। তাছাড়া দেশে সব সময় সংঘাত মারামারি, ঝগড়াঝাঁটি লেগে থাকলে উন্নয়নমূলক কার্যাদি সম্পন্ন করা খুবই দুরূহ। এভাবে দেশের অবনতি ঘটতে থাকবে। আমাদের সামনের দিকে এগিয়ে যেতে হবে। জাতিসংঘসহ বিশ্বের অনেক বড় দেশ আমাদের দেশের সংঘাত নিয়ে কঠিনভাবে বিচার-বিশ্লেষণ করতে শুরু করেছে। আমাদের যেন কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি না হতে হয়, সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে আমাদের সবাইকে অত্যন্ত জোরালোভাবে চিন্তাভাবনা করা একান্ত জরুরি।

জোরজবরদস্তির নির্বাচন করে দেশে শান্তি আনা যাবে না। দেশের মানুষের মন সুস্থ না থাকলে পরিবেশ ভালো না হলে দেশের কোনো উন্নতি হবে না বা হলে ধরে রাখা যাবে না। কোনো অঘটন মানুষের মনে রেখাপাত করলে তা সহজে দূর হয় না। ফলে দেশে উন্নত সুস্থ পরিবেশ গড়ে উঠবে না। দেশের বহু মানুষ মুখ ফুটে কিছু বলে না। দেশকে গভীর সংঘাতে ফেলা কোনোভাবেই উচিত হবে না। আমরা এজন্য মুক্তিযুদ্ধ করিনি।

ইঞ্জিনিয়ার এম এ মান্নান : বীর মুক্তিযোদ্ধা

যুগান্তর ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন