ইসি কি নিজের দায়িত্বটা ঠিকমতো বোঝে?
এরশাদুল আলম প্রিন্স
প্রকাশ: ০১ ডিসেম্বর ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ঘোষিত তফশিল অনুযায়ী সরকার ও সরকারপন্থি রাজনৈতিক দলগুলো এখন নির্বাচনমুখী। এদিকে নির্বাচন বিবাদ নিয়ে এ মুহূর্তে সংলাপের কোনো উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না। আওয়ামী লীগ বলছে, সংবিধান অনুযায়ী নির্ধারিত সময়ের মধ্যে নির্বাচন করতে হবে। সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচন হচ্ছে কিনা সরকারের কাছে সেটিই বিবেচ্য। সরকারের দায়িত্ব সংবিধান রক্ষা করা, আর নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব নির্বাচনের তফশিল দেওয়া। কিন্তু রাজনৈতিক সমঝোতা না করে সংবিধান ও কমিশনের তফশিল অনুযায়ী যদি নির্বাচন হয়, তবে নিশ্চিতভাবেই আমরা আবারও একটি একতরফা নির্বাচনের দিকে যাচ্ছি। সরকার জেনে-বুঝেই আবারও এমন একটি একতরফা নির্বাচনের ঝুঁকি নিয়েছে। একতরফা সুবিধা নিতে হলে একতরফা ঝুঁকিও নিতে হয়।
কমিশনের কাজ শুধু তফশিল ঘোষণা করা নয়। তফশিল ঘোষণার পরও কমিশনের অনেক কাজ থাকে। সব দায়িত্ব সংবিধানে লেখা থাকে না। সংবিধান অনুযায়ী স্বাধীনভাবে (অনুচ্ছেদ-১১৮) নির্বাচন পরিচালনা করা (অনুচ্ছেদ-১১৯) কমিশনের দায়িত্ব। এ দায়িত্ব পালনের জন্য যা যা করা দরকার কমিশন তা করবে। কিন্তু বর্তমান আউয়াল কমিশন কি তা করছে? এ কমিশন কি জনগণকে একটি সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন উপহার দিতে পারবে?
জাতীয় নির্বাচনের সবচেয়ে বড় অংশীদার হচ্ছে রাজনৈতিক দল। নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর সম্পর্ক বা পারস্পরিক দায়িত্বের বিষয়গুলো সংবিধানে বা আইনে লেখা নেই। আইনে না থাকলেও রাজনৈতিক দল, বিশেষ করে কার্যত বিরোধী দলের (De facto Opposition) অংশগ্রহণ ছাড়া কোনো নির্বাচন গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। নির্বাচন তো শুধু পুলিশি প্রহরায় ভোটাভুটি নয়। নির্বাচনে কতটি দল অংশগ্রহণ করল, তার চেয়ে বড় বিষয় হলো কারা অংশগ্রহণ করল। গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো মূল রাজনৈতিক দল বিশেষ করে সরকার ও বিরোধী দলের অংশগ্রহণ। ১৫ ফেব্রুয়ারির নির্বাচনটি প্রশ্নবিদ্ধ কারণ, সে নির্বাচনে প্রধান বিরোধী দল আওয়ামী লীগ অংশগ্রহণ করেনি। ঠিক একই যুক্তিতে আজও প্রধান বিরোধী দল যদি নির্বাচনে না আসে তবে সে নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধই থেকে যাবে। ১৫ ফেব্রুয়ারির নির্বাচন যে কারণে প্রশ্নবিদ্ধ, ঠিক একই কারণে ২০১৪ সালের নির্বাচনও প্রশ্নবিদ্ধ।
রাজনৈতিক দলের পাশাপাশি দেশের ভোটাররা নির্বাচনে স্বতঃস্ফূর্তভাবে ভোট দিতে পারল কিনা সেটিও সমান গুরুত্বপূর্ণ। ভোটের দিন খুব সুষ্ঠু পরিবেশ, ভোটারদের দীর্ঘ লাইন-কিন্তু ভোটাররা ভোট দিতে পারল না-একে কি সুষ্ঠু নির্বাচন বলা যায়? এমন নির্বাচনের নজিরও কি আমাদের নেই?
কাজেই, গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের পূর্বশর্ত হলো অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন। যেখানে প্রধান রাজনৈতিক দল ও জনগণ অংশগ্রহণ করতে পারে। একটি নির্বাচনে যদি সরকারি দল অথবা প্রধান বিরোধী দলের বদলে আরও ডজনখানেক রাজনৈতিক দলও অংশগ্রহণ করে, তাতে সে নির্বাচন গ্রহণযোগ্যতা পায় না। সে কারণেই ইইউ বাংলাদেশে একটি অংশগ্রহণমূলক বা অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচনের কথা বলছে। আর সরকার সেটি অনুধাবন না করে তৃণমূল বিএনপি বা এ জাতীয় আরও নামসর্বস্ব দলকে অন্তর্ভুক্ত করে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের দিকে এগোচ্ছে।
কিন্তু তৃণমূলজাতীয় বিএনপি বা কল্যাণ পার্টি কার্যত বিরোধী দল বিএনপির বিকল্প হিসাবে কাজে দেবে না। ভবিষ্যতে বিএনপিও যদি কোনো একতরফা নির্বাচনের লক্ষ্যে এ রকম ডজনখানেক কল্যাণ পার্টি নিয়ে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের দাবি করে, সেটিও আওয়ামী লীগের বিকল্প হিসাবে কাজে দেবে না। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, এ দুটি দল যতবারই একতরফা নির্বাচনের পথে হেঁটেছে, পথিমধ্যে তারা এ রকম সাইনবোর্ডসর্বস্ব দলকে সঙ্গে নিয়ে নির্বাচনি বৈতরণী পার হতে চেয়েছে। আর দু-চারটি আসনের জন্য ক্যারিয়ার কূটনীতিকের ভোজবাজি বা চৌকশ সৈনিকের ডিগবাজি আমাদের রাজনীতিতে নতুন কিছু নয়। কিন্তু এসব করে আজ পর্যন্ত কোনো দলই একতরফা নির্বাচনের দায় এড়াতে পারেনি।
অতীতে একাধিক ক্ষমতাসীন সরকার এভাবে দল সৃষ্টি করেছে এবং দুঃখজনক হলেও সত্য-কংস রাজার বদ ফরমাশ পালনে কোনো কোনো নির্বাচন কমিশনও সহযোগী হিসাবে কাজ করেছে। দলের নিবন্ধন, মনোনয়নপত্র বৈধকরণ ও জামাই আদর করে নির্বাচনে নিতে সেসব কমিশন খুবই করিৎকর্মা ছিল। কিন্তু এভাবে প্রকৃত অংশগ্রহণমূলক বা দোতরফা নির্বাচনের ফলাফল কী হতে পারে সেটি জানার জন্য ভোট পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয় না। সরকার ও কমিশন তা ভোটের আগেই উপলব্ধি করতে পারে। তাই, একতরফা নির্বাচনের চেষ্টাটাও তারা আগে থেকেই করে।
একটি প্রকৃত অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনে যে উৎসাহ-উদ্দীপনাপূর্ণ পরিবেশ থাকে তা এখন নেই। তবে, একেবারেই যে নেই তাও নয়। সরকারি দলের একতরফা আনন্দ ও উৎসাহের কমতি নেই। এবার নির্বাচন কমিশন সে একতরফা উদ্যাপনে শরিক হলো। মনোনয়ন ফরম বিক্রি নিয়ে ক্ষমতাসীন দলের যে শোডাউন গণমাধ্যমে প্রকাশ পেল, কমিশন সে ব্যাপারে কোনো প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেনি। আচরণবিধি লঙ্ঘন করে বিশাল মিছিল নিয়ে রাস্তা বন্ধ করে মনোনয়ন কেনাবেচার হিড়িক কমিশনের নজরে পড়েনি। তফশিল দেওয়া যেমন তাদের সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা, এগুলো দেখাও যে তাদের আইনগত বাধ্যবাধকতা।
তফশিলের আগে সরকার কেন্দ্রীয় ও স্থানীয় প্রশাসনে ব্যাপক রদবদল করেছে। কমিশন তাদের ব্যাপারে এখনো কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। উপরন্তু কমিশন বলছে, পুলিশ-প্রশাসনে এখন রদবদল করলে বিশৃঙ্খলা দেখা দেবে। সংবিধানের ১২০ অনুচ্ছেদ বলছে, নির্বাচন কমিশনের ওপর ন্যস্ত দায়িত্ব পালনের জন্য যেরূপ কর্মচারীর প্রয়োজন হইবে, নির্বাচন কমিশন অনুরোধ করিলে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন কমিশনকে সেইরূপ কর্মচারী প্রদানের ব্যবস্থা করিবেন। কমিশন যেহেতু এখনো কোনো অনুরোধ করেনি, তাই তারা বর্তমানে যে যে দায়িত্বে আছেন, বিশৃঙ্খলার ভয়ে সেসব কর্মচারী নিয়েই নির্বাচন সম্পন্ন করবেন। কমিশন এদের দিয়েই সুষ্ঠু নির্বাচন হবে বলে মনে করে। অথচ, তিনি আইনগত ক্ষমতাবলে কাউকে রদবদল করবেন এবং সে রদবদলের ফলে যদি কেউ বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করবে বলে তিনি মনে করেন, তবে তার রদবদল করাটাই তার নৈতিক দায়িত্ব। কারণ, কমিশনের কাজ সুষ্ঠু নির্বাচন করা। গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের স্বার্থেই বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারীদের সরাতে হবে। কিন্তু আউয়াল কমিশন তো ঝামেলা পছন্দ করেন না। প্রশাসনে রদবদল করলে কারও কারও জন্য সৃষ্ট সমতল মাঠ নষ্ট হয়ে যেতে পারে। কমিশন সে ঝামেলায় কেনই বা যাবে? কিন্তু কমিশনের দায়িত্ব যে সবার জন্যই সমতল মাঠের ব্যবস্থা করা সেটাও তার মনে রাখতে হবে।
সংবিধানের ১১৯ অনুচ্ছেদ কমিশনের দায়িত্ব নিয়ে কথা বলেছে। এ দায়িত্বের ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে হাইকোর্ট বিভাগ বলেছেন, ‘From a close reading of Article 119 of the Constitution, it appears that the Election Commission has been given a plenary power of superintendence, direction and control of the preparation of the electoral rolls for election and therefore whatever power is necessary for the purpose must be presumed to be there unless there is an ouster by express provision’ (রিট পিটিশন নং ২৫৬১/২০০৫; আব্দুল মোমেন চৌধুরী গং অন্যান বনাম বাংলাদেশ)
কাজেই সুষ্ঠু, অংশগ্রহণমূলক ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য কমিশন সংবিধান অনুযায়ী স্বাধীন এবং আইনানুযায়ীও তার রয়েছে ব্যাপক ক্ষমতা ও ভূমিকা। কাজেই, সংবিধানের দোহাই দিয়ে শুধু তফশিল ঘোষণা করে দায়সারা গোছের ভোটাভুটির ব্যবস্থা করলে আউয়াল কমিশন আখেরে দায় এড়াতে পারবে না।
এরশাদুল আলম প্রিন্স : আইনজীবী, প্রাবন্ধিক
