Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

কপ-২৮ জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব কতটা কমাবে?

Icon

ড. মো. জামাল উদ্দিন

প্রকাশ: ০৭ ডিসেম্বর ২০২৩, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

কপ-২৮ জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব কতটা কমাবে?

আমিরাতের দুবাইয়ে চলছে জাতিসংঘের সর্ববৃহৎ আন্তর্জাতিক জলবায়ু সম্মেলন (কপ-২৮)। এ শীর্ষ সম্মেলনকে কেন্দ্র করে সারা বিশ্বের মানুষ অধীর অপেক্ষায় আছে জলবায়ুর অভিঘাত থেকে পরিত্রাণ পেতে কী বার্তা আসে সেখান থেকে! সম্মেলনের প্রথম দিনেই ‘জলবায়ু বিপর্যয় তহবিল’ গঠন করেছেন প্রতিনিধিরা। এটি ইতিবাচক দিক! দরিদ্র দেশগুলোর জন্য জলবায়ু বিপর্যয় তহবিল গঠন করাকে একটি উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ হিসাবে দেখছেন তারা। ৩০ নভেম্বর থেকে শুরু হওয়া জাতিসংঘের জলবায়ুবিষয়ক এ শীর্ষ সম্মেলন চলবে ১২ ডিসেম্বর পর্যন্ত। এবারের শীর্ষ সম্মেলনে মূলত চারটি ‘বিশেষ পরিবর্তন’-এর ওপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করা হবে বলে সংবাদ সূত্রে জানা যায়; তা হলো-জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে বেরিয়ে আসার কার্যক্রম আরও ত্বরান্বিত করা; জলবায়ু অর্থ ব্যবস্থার রূপান্তর; জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় জনগণ এবং প্রকৃতির ভূমিকা এবং নারী, আদিবাসী, স্থানীয় সম্প্রদায়, তরুণদের শীর্ষ সম্মেলনে অন্তর্ভুক্তি নিশ্চিত করা। তবে কীভাবে এ লক্ষ্যগুলো অর্জিত হবে, সেটা দেখার অপেক্ষায় থাকতে হবে।

জলবায়ু বিপর্যয় তহবিলে কোন দেশ কী পরিমাণ অনুদান দেবে, তা নির্দিষ্ট করে বলা না হলেও বেশকিছু দেশ অনুদানের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। তাদের মধ্যে কপ-২৮ সম্মেলনের আয়োজক দেশ সংযুক্ত আরব আমিরাত এক হাজার লাখ ডলার, জার্মানি এক হাজার লাখ ডলার, ব্রিটেন কমপক্ষে ৫১০ লাখ ডলার, যুক্তরাষ্ট্র ১৭৫ লাখ ডলার এবং জাপান ১০০ লাখ ডলার অনুদান দেওয়ার প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করেছে। তবে ভবিষ্যতে এ তহবিলে কীভাবে অর্থায়ন করা হবে তা এখনো পরিষ্কার নয়। ক্লাইমেট অ্যাকশন নেটওয়ার্ক ইন্টারন্যাশনালের বিশ্বব্যাপী রাজনৈতিক কৌশলের প্রধান হারজিত সিং বলেন, জলবায়ু সংকট তৈরি করেছে ধনী দেশগুলো; তাই আর্থিক সাহায্য করার দায়িত্বও তাদের।

১৭৬০ সালের ইউরোপের শিল্পবিপ্লবের পর থেকেই মূলত পৃথিবীতে কার্বন নিঃসরণ শুরু হয়, যা বাতাসের উষ্ণতা ও বায়ুদূষণের প্রধান কারণ হয়ে দাঁড়ায়। শুধু গত এক শতকেই পৃথিবীর তাপমাত্রা প্রায় ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস বৃদ্ধি পেয়েছে। বিজ্ঞানীদের ধারণা, জলবায়ুর এ পরিবর্তনের প্রভাবে ২১০০ সাল নাগাদ সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা ১ মিটার বেড়ে যাবে। আশঙ্কা করা হচ্ছে, এ ধারা অব্যাহত থাকলে একবিংশ শতাব্দী শেষে বিশ্ব থেকে অন্তত ৪৩টি দেশ সমুদ্রপৃষ্ঠে হারিয়ে যাবে! বাংলাদেশেরও একটা উল্লেখযোগ্য অংশ ডুবে যাবে। অথচ যেসব দেশ এজন্য দায়ী, তারা এখনো নির্বিকার। পরিসংখ্যানে জানা যায়, যুক্তরাষ্ট্র, চীন, ভারত ও রাশিয়া পৃথিবীব্যাপী ৫৫ শতাংশেরও বেশি কার্বন নিঃসরণ করছে। অন্যদিকে অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলোর দায় একেবারেই নগণ্য। বাংলাদেশের দায় তো এক্ষেত্রে মাত্র ০.৪৭ ভাগেরও কম।

১৯৯২ সালে জাতিসংঘে প্রস্তাব পাশের পর ১৯৯৫ সালে জার্মানিতে প্রথম সম্মেলনের মাধ্যমে জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ে আলোচনা শুরু হয়। এটিই বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলন বা কপ (কনফারেন্স অব পার্টিস) নামে পরিচিত। চলতি সম্মেলনের শুরুতেই জাতিসংঘ প্রধান সতর্ক করে বলেছেন, ২০২৩ সাল হচ্ছে বিশ্বের উষ্ণতম বছর! এভাবে চলতে থাকলে বৈশ্বিক উষ্ণতা ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখার লক্ষ্য পূরণ হবে না। কপ-২৮ সম্মেলনের সভাপতি আরব আমিরাতের সুলতান আল জাবের বলেছেন, ‘এখন আসল কাজ শুরু হবে। আমি নিজেই এ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সাহায্য করব এবং বাস্তব ও কার্যকর ফলাফলে ভূমিকা রাখব।’ সংযুক্ত আরব আমিরাতের জাতীয় তেল সংস্থা অ্যাডনকের প্রধান জাবেরও বলেছেন, ‘জীবাশ্ম জ্বালানির ভূমিকা’ অবশ্যই জাতিসংঘের জলবায়ুু আলোচনায় অন্তর্ভুক্ত করা উচিত।

জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিকর প্রভাব ইতোমধ্যেই বৈশ্বিক অর্থনীতিকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে নিু ও মধ্যম আয়ের দেশগুলো গত ৩০ বছরে মোট ২১ ট্রিলিয়ন ডলারের মূলধন এবং জিডিপির সম্মিলিত ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে, যা উন্নয়নশীল বিশ্বের মোট ২০২৩ জিডিপির প্রায় অর্ধেক। মিসরে গত বছরের কপ-২৭ সম্মেলনের লস অ্যান্ড ড্যামেজ-এর বিষয়টি এবার সবার মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দুতে থাকবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। বিশেষ করে এ সংক্রান্ত তহবিলের অগ্রগতি কী, উন্নয়নশীল দেশগুলো তা জানতে চাইবে। কারণ জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সৃষ্ট অপরিবর্তনীয় ক্ষতি মোকাবিলায় উন্নয়নশীল দেশগুলোকে সহায়তার জন্য উন্নত দেশগুলো এ অর্থ প্রদানের প্রতিশ্রুতি দেয়। এখনো যেহেতু এ সময়সীমা বাকি আছে, তাই এটি এবারের আলোচনায় মুখ্য সূচিতে নাও থাকতে পারে। তবে সুশীলসমাজ এবং উন্নয়নশীল দেশগুলো এ তহবিল প্রতিষ্ঠার অগ্রগতি যে আশাব্যঞ্জক নয় এবং এটি জরুরি ভিত্তিতে বাস্তবায়ন করা প্রয়োজন, তা নিয়ে জোর চাপ সৃষ্টি করতে পারে বলে অনেকেই মনে করেন।

কপ-২৮ আয়োজনকারী দেশ সংযুক্ত আরব আমিরাত যেহেতু নিজেই জীবাশ্ম জ্বালানি উৎপাদনকারী দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম। এবং আগের তুলনায় এ সম্মেলনে ধনিক ব্যবসায়িক প্রতিনিধি বেশি, তাই সমালোচকদের মতে, সম্মেলনের ফল কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় না হওয়ার আশঙ্কা থাকে। কেননা বৈশ্বিক উষ্ণতা ১.৫ সে-এর মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখতে হলে জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার রোধ করার বিকল্প নেই। আর এ জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার ধনী দেশগুলোতেই বেশি। সংবাদ সূত্রে জানা যায়, সম্মেলনের সভাপতি ও আরব আমিরাতের সুলতান আল জাবের নিজেকে এমন একজন ব্যক্তিত্ব হিসাবে তুলে ধরছেন, যিনি জীবাশ্ম জ্বালানি সংস্থাগুলোকে তেল এবং গ্যাসের ব্যবহারে ‘ফেজ ডাউন’ নিয়ে আলোচনার টেবিলে রাখতে পারেন বলে দাবি করছেন।

কপ-২৮ থেকে ভারত এবং দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশগুলোর প্রত্যাশার বিষয়টিও আলোচনার দাবি রাখে। ভারত এবং দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশের পাশাপাশি বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশগুলোও কপ-২৮-এ প্রধানত একটি জিনিসের দিকে তাকিয়ে থাকবে। সেটি হলো-প্রচুর পরিমাণে জলবায়ু তহবিল বৃদ্ধি। জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য সবচেয়ে বেশি দায়ী বিশ্বের উন্নত দেশগুলোর কাছ থেকে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর আর্থিক সহায়তার দাবি বহুদিনের। অথচ প্রায় দুই দশক ধরেই বিশ্বের উন্নত দেশগুলোকে এ দাবির পক্ষে তেমন জোরালোভাবে সাড়া দিতে দেখা যাচ্ছে না। উন্নয়নশীল দেশগুলো ২০০৯ সালে করা জলবায়ুসংক্রান্ত কর্মকাণ্ডকে সমর্থন করার জন্য প্রতিবছর ১০০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার প্রদানের যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, তা পূরণ করতে তারা ধারাবাহিকভাবে ব্যর্থ হয়েছে বলে বিশ্লেষকদের ধারণা!

এবারের সম্মেলনে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে স্বল্পোন্নত, অত্যন্ত বিপন্ন ও ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর পক্ষে কার্যকর ভূমিকা রাখতে চায় বাংলাদেশ। আর এ লক্ষ্যে পাঁচটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিষ্পত্তিতে সমন্বিতভাবে কাজ করার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। সংবাদ সূত্রে জানা যায়, পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তনমন্ত্রী মো. শাহাব উদ্দিন সংবাদমাধ্যমকে জানান, ‘বাংলাদেশের প্রতিনিধিদলটি কপ সম্মেলনে বিভিন্ন ইস্যুভিত্তিক আলোচনায়, স্বল্পোন্নত দেশ এবং জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে অত্যন্ত বিপন্ন ও ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর পক্ষে কার্যকর ভূমিকা পালন করবে। এজন্য পাঁচটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিষ্পত্তির লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। লক্ষ্যগুলো হলো-গ্লোবাল স্টক টেক নির্ধারণ, ১.৫০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রার লক্ষ্যের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ কার্যক্রমের অগ্রগতি মূল্যায়ন, ভবিষ্যৎ উচ্চাকাঙ্ক্ষা, মাইলফলক নির্ধারণ এবং স্পষ্ট পদক্ষেপ গ্রহণ। অধিক বিপদাপন্ন উন্নয়নশীল দেশগুলোর লোকসান ও ক্ষতি (লস অ্যান্ড ড্যামেজ) আমলে নেওয়ার লক্ষ্যে কপ-২৮ সম্মেলনে ‘লস অ্যান্ড ড্যামেজ ফান্ড’ কার্যকর করা এবং এর বিস্তারিত কর্মপরিধি ঠিক করা; অভিযোজনসংক্রান্ত বৈশ্বিক লক্ষ্য ‘গ্লোবাল গোল অন অ্যাডাপ্টেশন’-এর কাঠামো তৈরি বা প্রণয়ন করা, সদস্য দেশগুলোকে অবশ্যই ১.৫০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রার লক্ষ্যের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ করার জন্য তাদের এনডিসিতে বর্ণিত ২০৩০ প্রশমন লক্ষ্যমাত্রাকে শক্তিশালী করা এবং এনডিসি বাস্তবায়নের জন্য এলডিসি দেশগুলোর অর্থায়ন বাড়ানো। উন্নত দেশগুলোকে ২০২৫ সাল পর্যন্ত, প্রতিবছর উন্নয়নশীল দেশগুলোয় জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় ১০ হাজার কোটি ডলার দেওয়া নিশ্চিত করা ও জলবায়ু অর্থায়নের সংজ্ঞা চূড়ান্ত করা।

অভিযোজন অর্থায়ন দ্বিগুণ করা, জাতীয় অভিযোজন পরিকল্পনা বাস্তবায়ন এবং ২০২৫-পরবর্তী সময়ে জলবায়ু অর্থায়নের জন্য ‘নিউ কালেক্টিভ কোয়ান্টিফাইড গোল অন ক্লাইমেট ফিন্যান্স’ আলোচনায় উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জন করাও আলোচনার ইস্যুতে রয়েছে বলে জানা যায়। বাংলাদেশের পরিবেশমন্ত্রী গণমাধ্যমকে বলেছেন, ‘কপ সম্মেলনে বাংলাদেশের অবস্থান যথাযথভাবে তুলে ধরার লক্ষ্যে, ইতোমধ্যে দেশের বিশিষ্ট জলবায়ু বিশেষজ্ঞ, সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও সংস্থার মতামত নিয়ে একটি অবস্থান পত্র প্রণীত হয়েছে।’ আশা করা যায়, এ অবস্থান পত্র এ সম্মেলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।

জার্মান ওয়াচের তথ্যমতে, বাংলাদেশ বিশ্বের সপ্তম জলবায়ু ঝুঁকিপূর্ণ দেশ। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ক্রমাগত তাপমাত্রা বৃদ্ধি, অনিয়মিত বৃষ্টি, বন্যার প্রকোপ, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, সাইক্লোনের মাত্রা ও তীব্রতা বৃদ্ধি, অকাল খরা, উপকূলীয় মাটি ও ভূগর্ভস্থ পানিতে অতিরিক্ত লবণাক্ততা। সেই সঙ্গে সুপেয় পানির অভাব, খাদ্য উৎপাদনে ঘাটতি, মানুষের বাস্তুচ্যুতি, কাজের অভাব ইত্যাদি আরও প্রকট হচ্ছে। এসব সমস্যা সমাধানে জলবায়ু তহবিল বৃদ্ধি ও সচেতনতা বাড়ানোর কোনো বিকল্প নেই। আশা করা যায়, বাংলাদেশসহ উন্নয়নশীল দেশের জলবায়ু পরিবর্তনের বদনাম ঘুচাতে কপ-২৮ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।

ড. মো. জামাল উদ্দিন : প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, বারি; সাবেক ন্যাশনাল কনসালটেন্ট, এফএও

 

আমিরাত দুবাই জাতিসংঘ

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম