মূল্যস্ফীতি কতটা কমানো যাবে?
হাসান মামুন
প্রকাশ: ১০ ডিসেম্বর ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
এ নিবন্ধ লেখার দিন আমাদের পেঁয়াজ আমদানির সহজতম উৎস ভারত থেকে এলো খারাপ খবর। নিজেদের সংকট মোকাবিলায় পেঁয়াজ রপ্তানির ওপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞা তারা বাড়িয়েছে আরও তিন মাস।
৪০ শতাংশ শুল্ক বাড়ানোর পর পেঁয়াজের ন্যূনতম মূল্য বেঁধে দিয়েছিল দেশটি। এর মেয়াদ মার্চ পর্যন্ত বাড়ানো হলো। তাতে পেঁয়াজ আমদানিতে বর্ধিত সময়েও বেশি খরচ হবে আমাদের। ভারত থেকে ওই খবর আসার সঙ্গে সঙ্গেই অবশ্য দেশে পেঁয়াজের দাম বেড়ে গেছে। বৃদ্ধির হার উল্লেখযোগ্য।
এখন ভালো-মন্দ সব খবরই মেলে দ্রুত। বিশেষত নিত্যপণ্যের বাজারে এর প্রভাবও পড়ে মুহূর্তেই। বাজারে যে পেঁয়াজের ঘাটতি আছে, তা কিন্তু নয়। এ অবস্থায় নেতিবাচক খবরজনিত পরিস্থিতিতে একশ্রেণির ব্যবসায়ী ‘বড় দাও’ মেরে থাকে বরাবরই। তাদের ঠেকানো যায় না; ধরাও যায় না।
ভারত থেকে আসা নেতিবাচক খবরে এই যে দেশি-বিদেশি সব উৎসের পেঁয়াজের দাম বেড়ে গেল, তা কমে কতদিনে কোন জায়গায় আসবে বলা কঠিন। এর বাজার এমনিতেই ছিল চড়া। টিসিবির ‘ট্রাক সেলে’ পেঁয়াজও বিতরণ করা হচ্ছিল ভর্তুকি দামে। আরও চড়ে যাওয়া বাজার থেকে সরকারকেও এখন অধিকতর দামে পেঁয়াজ কিনতে হবে। খরচ করতে হবে বেশি। এ খাতে খরচ বেশি হলেও সাধারণত কেউ আপত্তি করে না। কারণ চড়া বাজারে ক্রয়ক্ষমতা হারানো জনসাধারণের জন্যই ন্যায্যমূল্যে বিক্রির এ ব্যবস্থা। অব্যাহত মূল্যস্ফীতিতে নিম্নমধ্যবিত্তের একাংশও এসব বিক্রয় কার্যক্রমের শরণাপন্ন হচ্ছে। এ অবস্থায় পেঁয়াজসহ নিত্যপণ্য বিক্রয় কার্যক্রম আরও জোরদার করতে হবে বৈকি।
দেশের নানা অঞ্চল থেকে ‘আগাম পেঁয়াজ’ উত্তোলনের খবরও আসতে শুরু করেছে। উৎপাদন ব্যয় বেশি পড়লেও চাষীরা উৎসাহভরে পেঁয়াজ ফলিয়েছেন বাজারে পণ্যটির ঘাটতি দেখে। এ অবস্থায় তাদের থাকবে লাভজনক দাম পাওয়ার সম্ভাবনা। তেমন দাম নাকি পাচ্ছেনও। এমন তো হয়েই থাকে-ব্যবসায়ীরা ভালো দাম পেলেও পণ্যটির উৎপাদক তা পান না। গেল মৌসুমে আলুর বেলায় এটি ঘটেছিল। পরে ব্যবসায়ীদের হাতে আলু চলে গেলে এর দাম চড়তে থাকে। চড়তে চড়তে এমন জায়গায় গিয়ে পৌঁছায় যে, আলুর দাম বেঁধে দেয় সরকার। তাতেও সুফল না মেলায় আলু আমদানির মতো সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। অথচ দাবি করে বলা হয়-‘আমরা আলুতে উদ্বৃত্ত’। এবারও নাকি উদ্বৃত্ত ছিলাম। এসব তথ্য-উপাত্ত নিয়ে সরকারের মধ্যেই রয়েছে ভিন্নমত। সঠিক তথ্যের অভাবে আলুর বাজার অশান্ত হয়েছিল বলেও বক্তব্য রয়েছে। আরও আগে আমদানির সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত ছিল বলেও আছে মত। ‘দেরিতে আমদানি’র সুফল এখনো মেলেনি আলুর বাজারে। বিপুল পরিমাণ আমদানি হচ্ছে, সেটাও বলা যাবে না। আর চলমান ডলার সংকটে চাইলেই যা খুশি দ্রুত আমদানি করা যাবে-পরিস্থিতি তেমনও নয়। অথচ আলু, পেঁয়াজ, এমনকি ডিম আমদানি করতে হচ্ছে। মজার ব্যাপার, এর সবগুলোতেই আমরা স্বয়ংসম্পূর্ণ বলে দাবি করা হতো। সব পণ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে হবে, এমন কোনো কথা অবশ্য নেই। কোনো পণ্যে সেটা অর্জিত হলে তা সবসময় ধরে রাখা যাবে, এমন নিশ্চয়তাও নেই। এক্ষেত্রে নির্ভরযোগ্য তথ্য অবশ্য থাকতে হবে এবং তা বিশ্লেষণ করে নিতে পারতে হবে সময়োচিত সিদ্ধান্ত। তাতে ভোক্তাসাধারণের মনেও আসবে আস্থা।
উদ্ভূত পরিস্থিতিতে পেঁয়াজের বাজার শান্ত করে আনার পদক্ষেপ নিতে হবে সরকারকে। একেকটি খাদ্যপণ্য নিয়ে কিছুদিন পরপর যা হচ্ছে, তাতে বোঝা যায় এক্ষেত্রে কিছু অস্বাভাবিকতা রয়েছে। ডিমের বাজার মাঝে এতটা অশান্ত হয়েছিল কেন, তার কারণ খুঁজতে খুঁজতে এর দাম আবার স্বাভাবিক হয়ে এসেছে। খুব বেশি ডিম যে আমদানি হয়েছে, তাও নয়। তবে আমদানির উদ্যোগ গ্রহণের পরই এর দাম নিম্নমুখী হওয়ার প্রবণতা দেখেছেন ভোক্তারা। এর আগে ব্রয়লার মুরগির দাম হঠাৎ বেড়ে গিয়েছিল। এর বহু নিয়মিত ভোক্তা আছেন বলে বড় খবর হয়েছিল সেটা। তখন ডিম ও ব্রয়লারের বাজারে করপোরেট প্রতিষ্ঠানের ‘নিয়ন্ত্রণ’ নিয়ে কিছু কথা উঠেছিল। এমন দু-একটা প্রতিষ্ঠানকে জরিমানার খবরও আসে মিডিয়ায়। তাতে ওই আলাপটাও মনে হয় চাপা পড়ে গেছে। কিন্তু নিত্যপণ্যের বাজারে কোনোভাবে কোনো কারসাজি হয়ে থাকলে তা নিয়ে আলাপ চালু রাখা প্রয়োজন। ডিমের দাম স্বাভাবিক হয়ে আসার পরও তাই ওই আলাপটা চালিয়ে যাওয়া প্রয়োজন যে, এর দাম কেন ওইভাবে বেড়েছিল? ডিম ও ব্রয়লারের দাম দীর্ঘদিন একই জায়গায় আটকে ছিল বলেও অভিযোগ করেন প্রধানত ছোট খামারিরা। তাদের অনেকে নাকি খরচ জুগিয়ে টিকতে না পেরে ব্যবসা ছেড়েছেন। এর কত শতাংশ লোকসান দিয়েছেন, সে হিসাবও থাকা দরকার। তারা অতঃপর কোনো খাতে ঢুকেছেন, নাকি একাংশ কর্মহীন হয়ে পড়েছেন-সেটা জানাও জরুরি। সম্প্রতি শ্রমশক্তি রপ্তানি অনেক বেড়েছে বলে জানা যায়। ব্যর্থ পোলট্রি খামারিরা কি তাদের মধ্যে নেই? আর উল্লেখযোগ্যসংখ্যক ছোট খামার বন্ধ হয়ে যাওয়াতেই কি ডিম ও ব্রয়লার উৎপাদনে সংকটের সৃষ্টি হয়েছিল? মূলত সে কারণেই কি অস্থির হয়ে পড়েছিল বাজার? মহলবিশেষ বাজারকে অস্থির করে তুললেও এর একটা প্রেক্ষাপট নিশ্চয়ই ছিল!
‘পাকিস্তানি জাতের মুরগি’ বলে পরিচিত মুরগিও দেশে কম উৎপাদন হয় না। এর ভোগও অব্যাহতভাবে বাড়ছে। সম্প্রতি এর দাম কমে আসার প্রবণতা লক্ষণীয়। শীতের সময়টায় মুরগির দাম কমে আসার কথা কিন্তু নয়। এ সময়ে সামাজিক অনুষ্ঠানাদি বাড়ে। তবে চলতে থাকা হরতাল-অবরোধে এসব অনুষ্ঠান কম হচ্ছে কিংবা হচ্ছে সীমিত পরিসরে। একই কারণে পোলাওর চালের দাম কমে আসার প্রবণতা আছে কিনা, কে জানে। আমন উত্তোলনের এ সময়টায় সেদ্ধ চালের বাজারও শান্ত হয়ে আসার কথা। এটা আমাদের প্রধান খাদ্যশস্য। সরকার থেকে বলা হচ্ছে, গত ক’মাস চাল আমদানি করতে হয়নি। তার মানে, দেশে চালের ঘাটতি নেই। এ তথ্য সঠিক হলেই খুশি হব। কারণ খাদ্য নিরাপত্তার কেন্দ্রে রয়েছে চাল। বাজারে এর সরবরাহ স্বাভাবিক রাখতে হবে; সরকারের হাতেও সন্তোষজনক মজুত থাকা চাই। হালনাগাদ চাহিদার ভিত্তিতেই চালের বাজারটা স্বাভাবিক রাখতে হবে। আটা-ময়দার ব্যবহার অনেক বেড়ে যাওয়ায় আমাদের গমের চাহিদাও কম নয়। তবে এর উৎপাদন খুব কম। গমের দাম অনেক বেড়েছিল ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে। ওই অঞ্চল থেকে আমরা সারও আমদানি করতাম। সার নিয়ে বড় কোনো সংকটের কথা শোনা যায় না অনেকদিন হলো। তবে সম্প্রতি এর আমদানি ও সরবরাহ নিশ্চিত করা নিয়ে সংকটের খবর মিলল। আসছে উপকরণনির্ভর বোরো মৌসুমে সারের সংকট হতে দেওয়া যাবে না। ‘থ্রি এফ’ অর্থাৎ ফুড, ফুয়েল, ফার্টিলাইজার আমদানিতে যে কোনো নেতিবাচক খবর বড় অস্থিরতা সৃষ্টি করবে।
ফুয়েল বা জ্বালানি পণ্যের বড় দাম বৃদ্ধি আমাদের মূল্যস্ফীতিতে ঘৃতাহুতি দিয়েছিল। পরে ডিজেলসহ এর দাম কমে এলেও এখানে দাম সেভাবে কমানো হয়নি। এ খাতের ‘পুঞ্জীভূত লোকসান’ নাকি মেটানো হবে। সরকার মনে হয় এটাকে তার রাজস্ব আহরণ বৃদ্ধির একটা ক্ষেত্র করেও রাখতে চাইছে। বাজেট অব্যাহতভাবে বাড়তে থাকায় আয় বাড়ানোর কোনো সুযোগই হাতছাড়া করছে না সরকার। ক্রমবর্ধমান ব্যয় নির্বাহে টাকা ছাপানো এবং অকাতরে ঋণ গ্রহণেও কার্পণ্য করছে না। বিদেশি ঋণ হয়ে উঠেছে রেকর্ড পরিমাণ এবং ডলারে তা পরিশোধ করাও এখন সুকঠিন। সরকার পড়ে আছে রিজার্ভ সংকটে। এ মাসে আইএমএফ ঋণের দ্বিতীয় কিস্তি হাতে এলেও ডলার সংকট সহসা কাটবে না। এতে আমদানি ব্যাহত হচ্ছে নজিরবিহীনভাবে। শিল্পের কাঁচামাল, মেশিনারিজ শুধু নয়; খাদ্যপণ্য আমদানিও ব্যাহত হচ্ছে। ডলারের দাম অনেক বেড়ে যাওয়ায় ইতোমধ্যে বিশ্ববাজারে যেসব পণ্যের দাম কমেছে, সেগুলোও আনতে হচ্ছে বেশি দামে। যেমন গম, ভোজ্যতেল। দেশে এসবের দাম উলটো বেড়ে চলেছে। কমছে কেবল দেশে উৎপাদিত পণ্য, যেমন সবজির দাম। হালে গোমাংসের দাম কমেছে হঠাৎ করে। শীতে মাছের সরবরাহ বাড়ায় এর দামও নিম্নমুখী। এসবের প্রভাবেই হয়তো নভেম্বরে মূল্যস্ফীতি কিছুটা কমে আসার প্রবণতা দেখা গেল। তবে আমদানিনির্ভর পণ্যে এটা সহসা কমবে না। ডিসেম্বর থেকে আরএমজি সেক্টরে মজুরি বাড়ছে। নির্বাচনি ব্যয়ের কারণেও বাজারে বাড়বে অর্থ সরবরাহ। তাতেও মূল্যস্ফীতি কমবে না। এদিকে দেরিতে হলেও সুদের হার বাড়িয়ে বাজার থেকে ব্যাংক খাতে অর্থ সরিয়ে নেওয়ার চেষ্টা শুরু হয়েছে। এসবের ঘাত-প্রতিঘাতে মূল্যস্ফীতি কী রূপ নেয়, সেটা দেখার অপেক্ষায় থাকতে হবে। তবে এটা যে বেশি কমবে না, তার স্বীকৃতি রয়েছে চলতি বাজেটে ‘মূল্যস্ফীতির বার্ষিক লক্ষ্যমাত্রা’ বাড়িয়ে দেওয়ার ঘটনায়। ‘বাস্তবতা’ স্বীকার করে নেওয়ার এ প্রবণতা অবশ্য ভালো।
হাসান মামুন : সাংবাদিক, বিশ্লেষক
