প্রয়োজন সতর্কতা ও দায়িত্বশীলতা
এ কে এম শাহনাওয়াজ
প্রকাশ: ৩১ জুলাই ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
আমাদের দুর্ভাগ্য, সুস্থ ধারার রাজনীতির সংকটে ভুগছে এ দেশ। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের দল আওয়ামী লীগ প্রায় দেড় দশক রাষ্ট্রক্ষমতায় আসীন। আমরা যারা মুক্তিযুদ্ধ দেখেছি, সহায়সম্পদ, স্বজন হারিয়েছি, জীবন নিয়ে পরিবার নিয়ে পালিয়ে বেড়িয়েছি গ্রাম থেকে গ্রামে। আত্মত্যাগ করে যারা মুক্তিযুদ্ধ করেছেন, আর যারা জীবনবাজি রেখে মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতা করেছেন, তারা সব আমাদেরই স্বজন ছিলেন। স্বাধীনতার উষালগ্নে নারায়ণগঞ্জের বন্দরের বাড়িতে এসে আমার কিশোর দেহ-মন মুষড়ে পড়েছিল। তিন পুরুষের সম্পদে গড়া বিশাল সাজানো বাড়ি ছাইয়ের গাদায় মুখ থুবড়ে পড়ে কঙ্কাল হয়ে গিয়েছিল। জামায়াতে ইসলামী ও বিহারিদের সহযোগিতায় পাকিস্তানি বর্বর সেনারা সব জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে ছারখার করে দিয়েছিল। তবুও হতাশ হতে দেখিনি অভিভাবকদের। মেনে নিয়েছিলেন। ভেবেছেন, মুক্তিযুদ্ধে এটুকু ত্যাগ স্বীকার করতেই হয়।
বিধ্বস্ত দেশে ফিরেছিলেন বঙ্গবন্ধু। দৃঢ়তার সঙ্গে হাল ধরেছিলেন। কিন্তু সুযোগসন্ধানীরা সেই কঠিন বাস্তবতা বিবেচনায় না এনে বঙ্গবন্ধুকে ব্যর্থ বানানোর চেষ্টা করেছে বারবার। ঘোলাটে অবস্থা সৃষ্টি করে হত্যা করেছে বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারের সদস্যদের। আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব সেই সময়ের বাস্তবতায় ঘুরে দাঁড়াতে পারেননি। আর এর সুযোগ নিয়েছিল অপশক্তি। এ সুযোগে সুবিধাভোগী হয়ে ক্ষমতার মসনদে এলেন জিয়াউর রহমান। আমি বিশ্বাস করি, এ প্রজন্মের মানুষ, বিশেষ করে শিক্ষার্থীরা সেসব অতীতের খোঁজ রাখেন। দুর্ভাগ্য এই, রাজনীতিতে বিভিন্ন পক্ষকেই দেশপ্রেমের বদলে ক্ষমতাপ্রেমেই মত্ত থাকতে দেখেছি আমরা ।
পনেরো বছরের শাসনকালে আওয়ামী লীগ সরকারের সাফল্য অনেক; দেশকে অনেকটা উচ্চতায় নিয়ে গেছেন তারা। কিন্তু মানুষের মনে স্বস্তি দিতে পেরেছেন কি? দলটি যেখানে জনসমর্থনের সূচক অনেক উপরে নিতে পারত, সেখানে দিনে দিনে নিুগামী হচ্ছে। নানা অস্বস্তিকর পরিস্থিতির ভেতর দিয়ে যাচ্ছি আমরা। এরই মধ্যে শিক্ষার্থীরা সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের যৌক্তিক দাবি নিয়ে মাঠে নামল। আমাদের মনে হয়েছে, এটা খুব সরল দাবির একটি আন্দোলন। প্রায় দুই সপ্তাহ কেটে গেলেও সরকারপক্ষ কোনো দলীয় ব্যানার ছাড়া একটি সংগঠিত ছাত্র আন্দেলনকে পাত্তাই দিল না। ১০ জুলাই কোটা আন্দোলনসংক্রান্ত আমার একটি কলাম যুগান্তরের সম্পাদকীয় পাতায় ছাপা হয়েছে। এখন আমার মনে হচ্ছে, অভিজাত নেতারা এ অভাজনদের বিশ্লেষণের প্রতি যদি সামান্য মনোযোগ দিতেন, তবুও কিছু লাভ হতো। আন্দোলন দাবানলের মতো দেশব্যাপী ছড়িয়ে পড়ার পর আমাদের ধারণা ছিল, মাঠের রাজনীতিতে অভিজ্ঞ আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব আন্দোলনকারীদের সঙ্গে বসে সহজেই সমস্যাটি মিটিয়ে ফেলবেন। কিন্তু তেমন কোনো উদ্যোগ দেখা যায়নি তখন। অনেকের মনে হয়েছে, এর পেছনে দুটো কারণ থাকতে পারে। প্রথমত, বিরোধীদলীয় চ্যালেঞ্জ না থাকায় অনেকদিন থেকেই আওয়ামী লীগ নেতাদের আচরণে-কথায় হামবড়া ভাব প্রকাশ পাচ্ছিল। দ্বিতীয়ত, ছাত্র আন্দোলন দীর্ঘায়িত করা সরকারেরই ইচ্ছা ছিল কি না, এটাও অনেকের প্রশ্ন। কারণ সরকারের ছত্রছায়ার অনেক বড় বড় রাঘববোয়াল পাহাড়সমান দুর্নীতি করে ধরা পড়ছিল। এতে সরকারের ভাবমূর্তির বেশ ক্ষতি হচ্ছিল। তাই হয়তো প্রয়োজন ছিল মানুষের দৃষ্টি অন্যদিকে ফেরানো। যাই হোক, কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের দাবি এবং সরকারের পদক্ষেপের মধ্যে দূরত্ব বিশেষ ছিল না। শুধু দায়িত্বশীলদের সিদ্ধান্ত নেওয়ায় ধীরগতি হঠাৎ সবকিছু অগ্নিগর্ভ করে দিল। আদালত সরকারকে সমস্যা সমাধানের সুযোগ দিয়েছিলেন। সে সুযোগ গ্রহণ করে সরকারপক্ষ সংকটের ইতি টানতে পারত। কিন্তু সরকার অযথা পানি ঘোলা করে অবশেষে সুপ্রিমকোর্টের রায়ের মাধ্যমে কোটা সংস্কারের দাবি বাস্তবায়নের পক্ষে পরিপত্র জারি করল। অবশ্য এ প্রাপ্তির জন্য অনেক দুঃখজনক ঘটনা দেখতে হয়েছে। অনেকের রক্ত ঝরেছে। অনেক নির্যাতন সহ্য করতে হয়েছে। সবকিছুর পরও দাবি বাস্তবায়িত হওয়ায় আমি আন্দোলনকারী সব শিক্ষার্থীকে ধন্যবাদ জানাই।
পাশাপাশি আন্দোলনকারী শিক্ষার্থী ও তাদের সমন্বয়কদের সতর্ক থাকতে পরামর্শ দেব, দায়িত্বশীল আচরণ করার জন্যও আহ্বান জানাব। কারণ কার দায় কতটা, এ হিসাব দেশের বড় সংকটে করতে নেই। প্রয়োজন আগে সংকট থেকে দেশকে রক্ষা করা। ইতোমধ্যে অনেক মূল্যবান জীবন ঝরে গেছে। অনেকে হাসপাতালে জীবন নিয়ে যুদ্ধ করছে। দেশের হাজার হাজার কোটি টাকার ক্ষতি হয়ে গেল। এ সন্ত্রাসের দায় শিক্ষার্থীদের ওপর কোনো পক্ষই চাপাচ্ছে না। সরকারপক্ষ বলছে, আন্দোলনের উত্তাল পরিস্থিতির সুযোগ জামায়াত, বিএনপি ও জঙ্গিরা নিয়েছে। তবে আমরা সব প্রমাণ পাওয়ার পর এ ব্যাপারে নিশ্চিত হব। অবশ্য ধ্বংসযজ্ঞের নমুনা দেখে ২০১৩-১৪ এবং ২০২৩-এর ২৮ অক্টোবরের অরাজকতার কথা মনে পড়ে যায়। যেখানে একইভাবে অগ্নিসন্ত্রাস করেছিল বিএনপি-জামায়াত।
কোটা সংস্কারের দাবি বাস্তবায়িত হলেও এখনো অস্বস্তি রয়ে গেছে শিক্ষার্থীদের মধ্যে। এটিও ঠিক, আন্দোলনের সূত্রেই কিছু অনভিপ্রেত ঘটনা ঘটেছে। এর ফল হিসাবেই শিক্ষার্থীরা পরবর্তী সময় আট দফা দাবি উত্থাপন করেছে। এসব দাবি যে যৌক্তিক নয়, তা বলছি না। কিন্তু নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনের সূত্রমতো এসব দাবি চলমান আন্দোলনে জুড়ে দেওয়া ঠিক নয়। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে স্বাভাবিক অবস্থায় আগে ফিরতে হবে। অতঃপর দাবি পূরণ না হলে আন্দোলন করার সুযোগ তো আছেই।
আমার আশঙ্কা অন্য জায়গায়। যেসব অপশক্তি আন্দোলনকে ব্যবহার করে নিজ লক্ষ্য অর্জনের জন্য এত বড় ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছে, তারা এত তাড়াতাড়ি ফিরে যেতে চাইবে না। শিক্ষার্থীরা আন্দোলন থেকে সরে গেলেও সেসব দুরাচার কখন যে কোন ছদ্মাবরণে শিক্ষার্থীদের ওপর ভর করবে, তা বলা কঠিন। তাই আমি মনে করি, এ সময় সতর্কতার সঙ্গে শিক্ষার্থীদের চলা প্রয়োজন।
আমি আশঙ্কা করছি কখন কোন সংকটে শিক্ষার্থীরা বিপদগ্রস্ত হবে, তা নিয়ে। আমার দুটি অভিজ্ঞতার কথা মনে পড়ছে। ২০০১ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের শেষদিকে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ব্যাপক ছাত্র আন্দোলন হয়েছিল। একজন মন্ত্রী আসবেন ক্যাম্পাসে। শিক্ষার্থীরা তাকে ঢুকতে দেবে না। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটকের সামনে প্রচুর ছাত্রছাত্রী জমায়েত হয়েছিল। মন্ত্রী কাছাকাছি চলে এসেছেন। হঠাৎ পুলিশি অ্যাকশন শুরু হয়ে গেল। লাঠিচার্জ, কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপ। ছত্রভঙ্গ ছাত্ররা। হঠাৎ দেখি গার্ড শেডে লুকিয়েছে কয়েকজন ছাত্রী। ওদিকে তেড়ে আসছে পুলিশ। আমি ছুটে গিয়ে দরজা আগলে দাঁড়ালাম। পুলিশের কয়েক ঘা পড়ল আমার পিঠে। পুলিশ সরে গেলে আমরা কেন্দ্রীয় খেলার মাঠ দিয়ে ছুটলাম। আমার সামনে ফাটল টিয়ার গ্যাসের শেল। আমি আক্রান্ত হয়ে পড়ে গেলাম। কয়েকজন ছাত্র আমাকে আগলে নিয়ে গেল ক্যাফেটেরিয়ার কাছে। তারা পানি দিয়ে চোখ-মুখ মুছে সুস্থ করে তুলেছিল।
দ্বিতীয় ঘটনা ২০১৩ সালের। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্যবিরোধী ছাত্র-শিক্ষক আন্দোলন তখন তুঙ্গে। উপাচার্যের ক্যাডার বাহিনী হিসাবে ছাত্রলীগ চড়াও হচ্ছে আন্দোলনকারীদের ওপর। একপর্যায়ে সাংস্কৃতিক সংগঠনের ছেলেমেয়েরা উপচার্যের বাংলোর কাছে অনশন ধর্মঘট করছিল। সন্ধ্যা নেমে গেছে। ছাত্রলীগ মারমুখী হয়ে তেড়ে আসছে। আমরা শিক্ষকরা মানবঢাল হয়ে ছাত্রছাত্রীদের আগলে রাখছি। হঠাৎ ছাত্রলীগের ছেলেদের ছোড়া একটি সুচালো ইট আমার ওপর পড়ল। কপালগুণে ইটখণ্ডটি কাঁধের কাছে আমার শার্ট ছিঁড়ে নিচে পড়ে গেল।
এসব অভিজ্ঞতার পর আমার আশঙ্কা থাকে সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে। সরকারি বাহিনী এবং সরকারি ছাত্রসংগঠন সবসময় সরকার বা প্রশাসনবিরোধী আন্দোলনরত সাধারণ ছাত্রছাত্রীর বিপক্ষে থাকে। সাধারণ ছাত্রছাত্রীর পাশে সরকারি দায়িত্বশীলরা কখনো দাঁড়ান না। ছাত্রলীগ ক্যাম্পাসে দিনের পর দিন সাধারণ শিক্ষার্থীদের ওপর কতটা নির্যাতন করেছে যে, এর প্রতিক্রিয়া হিসাবে বিস্ফোরণ দেখতে হলো এবার! ছাত্রলীগের ছেলেমেয়েগুলো তো আমাদেরই সন্তান। ওদের লাঠিয়াল বানিয়ে উচ্ছন্নে পাঠিয়েছে তো সুবিধাবাদী নেতারাই। কিন্তু নিদানে ছাত্রলীগ-আওয়ামী লীগ কী কাজে লাগল এবার? নেতা-নেত্রীরা কি তা বুঝতে চাইবেন? সাধারণ মানুষ কতজন পথে নামল সরকারের পক্ষে?
আমরা চাইব, ছাত্রলীগ প্রভু না হয়ে বন্ধু হয়ে ফিরে আসুক ক্যাম্পাসে। আর তা সম্ভব সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের সতর্ক দৃষ্টির সংঘশক্তি যদি বজায় থাকে। সাধারণ শিক্ষার্থীরা অসংগঠিত বলে ওদের দুর্বল ভেবে সরকারি ছাত্রসংগঠনের ছেলেমেয়েরা চড়াও হয়। প্রশাসনের সহযোগিতার হাত ওদের মাথাতেই থাকে। ছাত্রলীগে নাম লেখানো ছাত্রছাত্রীদেরও বলব, নিজেদের অস্তিত্ব বিসর্জন দিয়ে কারও পেটোয়া বাহিনী হওয়া সম্মানের নয়।
শিক্ষার্থীদের আবার সতর্ক থাকতে বলব, কোনো অপশক্তি যাতে কোনো ধরনের সুযোগ নিতে না পারে। আমরা সবাই যেন ভালো থাকার চেষ্টা করি। দেশের সম্মান ফিরে আসুক। নিহত সবার জন্য প্রার্থনা করি। প্রতিবাদ তো থাকবেই। আর আহতদের পাশে দাঁড়াই।
এ কে এম শাহনাওয়াজ : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
shahnawaz7b@gmail.com
