এইচএসসি পরীক্ষার্থীদের যুক্তিবিদ্যা প্রথমপত্র
আবদুল কুদ্দুস
প্রকাশ: ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০২০, ০৬:০০ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
প্রভাষক, ঢাকা রেসিডেন্সিয়াল মডেল কলেজ, ঢাকা
যুক্তিবিদ্যা পরিচিতি
প্রশ্ন : রবিন দর্শন বিভাগের ছাত্র। বিভাগীয় লাইব্রেরি কক্ষে সাজানো কিছু ছবির প্রতি তার দৃষ্টি আকৃষ্ট হয়েছে। যেমন একটি সারিতে প্লেটো ও এরিস্টটলের ছবি, আরেকটিতে আল ফারাবি, ইবনে সিনা, ডান্স স্কটাসের ছবি, অন্য আরেকটিতে লাইবনিজ, জে.এস.মিল হেগেলের ছবি এবং শেষ সারিতে আছে জর্জ বুল, ফ্রেগে ও বার্ট্রান্ড রাসেলের ছবি। তার বন্ধু সামি কপির লেখা Introduction to
Logic গ্রন্থটি তার হাতে দিয়ে বলল, এই বইটিতে যুক্তিবিদ্যার পরিচয় প্রকৃতি আলোচ্য বিষয়সহ বিভিন্ন বিষয় সুন্দরভাবে আলোচিত হয়েছে। এটা পড়ে সে উপকৃত হয়েছে।
ক. যোসেফ যুক্তিবিদ্যার সঙ্গায় কী বলেন?
খ. যুক্তিবিদ্যাকে আদর্শনিষ্ঠ বিজ্ঞান বলা হয় কেন? ব্যাখ্যা কর।
গ. সামি নির্দেশিত বইটির লেখকের আলোকে যুক্তিবিদ্যার পরিচয় দাও।
ঘ. রবিনের দেখা ছবিগুলোতে যুক্তিবিদ্যার ক্রমবিকাশের কয়টি স্তরের ইঙ্গিত পাওয়া যায়? আলোচনা কর।
উত্তর-ক : যোসেফ বলেন, যুক্তিবিদ্যা হচ্ছে চিন্তার বিজ্ঞান।
উত্তর-খ : যুক্তিবিদ্যাকে আদর্শনিষ্ঠ বিজ্ঞান বলা হয়। যে বিজ্ঞান কোনো আদর্শের আলোকে একটি বিষয় বা ঘটনা কেমন হওয়া উচিত তা নিয়ে আলোচনা করে তাকে আদর্শনিষ্ঠ বিজ্ঞান বলা হয়। এ বিজ্ঞান কোনো বিষয়ের স্বরূপ বা প্রকৃতি কেমন তা নির্ণয় করে না বরং বিশেষ আদর্শের সঙ্গে ওই বিষয়টি কীভাবে সঙ্গতিপূর্ণ তা ব্যাখ্যা করে। এ অর্থে যুক্তিবিদ্যা, নীতিবিদ্যা ও নন্দনত্ত্ব আদর্শনিষ্ঠ বিজ্ঞান। যুক্তিবিদ্যা একটি সুশৃংখল বিজ্ঞান। এটি মিথ্যাকে বর্জন ও সত্যকে গ্রহণ করার সঠিক চিন্তা পদ্ধতির নির্দেশ করে। অর্থাৎ সত্যের সন্ধান ও ভ্রান্তি পরিহারের উদ্দেশ্যে যুক্তিপদ্ধতি ও তার সহায়ক প্রক্রিয়া যেমন সংজ্ঞা, বিভাগ, ব্যাখ্যা, শ্রেণিকরণ ইত্যাদি নিয়ে আলোচনা করে। এর মূল আদর্শ সত্যতা। তাই এটিকে আদর্শনিষ্ঠ বিজ্ঞান বলা হয়।
উত্তর-গ : উদ্দীপকের সামি নির্দেশিত বইটি হচ্ছে I.M. Copi এর Introduction to Logic. কপি এই গ্রন্থে যুক্তিবিদ্যা সম্পর্কে যে ধারণা দেন তা নিচে আলোচনা করা হল।
যুক্তিবিদ্যা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, যুক্তিবিদ্যা হচ্ছে বৈধ যুক্তি থেকে অবৈধ যুক্তির পার্থক্য নির্দেশ করার জন্য ব্যবহৃত পদ্ধতি ও নীতিসমূহের একটি বিশিষ্ট বিদ্যা (The study of logic is the study of the methods and principles used in distinguishing correct from incorrect argument.) অর্থাৎ তার মতে যুক্তিবিদ্যা পাঠের উদ্দেশ্য হচ্ছে বৈধ ও অবৈধ যুক্তি চেনা।
সংজ্ঞাটিতে প্রথমত যুক্তিবিদ্যাকে একটি শাস্ত্র বলা হয়েছে যেখানে কিছু সুনির্দিষ্ট নিয়মনীতি রয়েছে। প্রতিটি বিজ্ঞানেরই কিছু নির্দিষ্ট ও সুশৃংখল নিয়ম-পদ্ধতি থাকে। যুক্তিবিদ্যারও সে ধরনের কিছু নিয়মনীতি রয়েছে। দ্বিতীয়ত সে নীতিগুলো যদি চর্চা করা হয় তাহলে বৈধ ও অবৈধ যুক্তির পার্থক্য করা সম্ভব হবে। অর্থাৎ এখানে তিনি যুক্তিবিদ্যার ব্যবহারিক দিকটির ইঙ্গিত করেছেন। কেউ যুক্তিবিদ্যার নিয়মনীতি অনুসরণ করলে সঠিক যুক্তি প্রয়োগে কথা বলতে বা সঠিক ভাষা প্রয়োগ করতে পারবেন এবং ভুল যুক্তি চিহ্নিত করে তা বর্জন করতে পারবেন। প্রকৃতপক্ষে যুক্তিবিদ্যার কাজই হল এমন নিয়মনীতি সরবরাহ করা যার অনুসরণে ভাষার যৌক্তিক প্রয়োগ সম্ভব হয়।
যুক্তিবিদ কপির আলোচনায় আমরা এভাবে যুক্তিবিদ্যা সম্পর্কে একটি স্পষ্ট ধারণা অর্জন করতে পারি।
উত্তর -ঘ : উদ্দীপকে রবিনের দেখা ছবিগুলোতে যুক্তিবিদ্যার ক্রমবিকাশের চারটি স্তরের ইঙ্গিত রয়েছে। তা হল প্রাচীন যুগ, মধ্যযুগ, আধুনিক যুগ ও সাম্প্রতিক যুগ। নিচে এ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হল। প্রথম সারিতে রয়েছে প্লেটো ও এরিস্টটলের ছবি। যুক্তিবিদ্যার প্রাচীন যুগ তাদের মাধ্যমে রচিত হয়েছে। প্লেটো যদিও সরাসরি যুক্তিবিদ্যার আলোচনা করেননি, কিন্তু তার ছাত্র এরিস্টটল প্লেটোর মাধ্যমেই যুক্তিবিদ্যার মূল নির্দেশনা পেয়েছেন। প্লেটোর প্রস্তাবিত শিক্ষাব্যবস্থায় যুক্তিবিদ্যা ছিল অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ পাঠ্যবিষয়। আর এরিস্টটল সেই যুক্তিবিদ্যারই বাস্তব রূপদান করেন। এ জন্য এরিস্টটলকে যুক্তিবিদ্যার জনক বলা হয়। তার ‘অর্গানন’ গ্রন্থসমগ্রের ‘ক্যাটিগোরিস’ পুস্তকে যুক্তিবিদ্যার বিভিন্ন ধারণার ব্যাখ্যা এসেছে।
দ্বিতীয় সারিতে রয়েছে আল ফারাবি, ইবনে সিনা ও ডান্স স্কাটাসের ছবি যা যুক্তিবিদ্যার মধ্যযুগকে নির্দেশ করছে। এসময় যুক্তিবিদ্যার বিভিন্ন বিষয়বস্তুর ব্যাপক বিকাশ ঘটে। তবে এরিস্টটলের প্রভাব সবকিছুতে স্পষ্টভাবে লক্ষ করা যায়। আল ফারাবি (৮৭০-৯৫০) এরিস্টটলের যুক্তিবিদ্যাকে আরবি ভাষায় অনুবাদ করেন। ইবনে সিনা (৯৮০-১০৩৭) এরিস্টটলের সহানুমান ও অবরোহী যুক্তিবিদ্যার সমালোচনা করেন। তার মতে আরোহী যুক্তিবিদ্যা কার্যকারণ নির্ণয়ে অধিকতর সহায়ক। ডান্স স্কটাসও ছিলেন এ সময়ের বিখ্যাত যুক্তিবিদ। তার মতে যুক্তিবিদ্যা সব বিজ্ঞানের সেরা বিজ্ঞান ও সব কলার সেরা কলা।
তৃতীয় সারিতে ছিল লাইবনিজ, জে.এস.মিল ও হেগেলের ছবি। এরা আধুনিক যুক্তিবিদ্যার পরিচিত নাম। আধুনিক যুক্তিবিদ্যার সূচনা হয় ফ্রান্সিস বেকনের (১৫৬১-১৬২৬) মাধ্যমে। তিনি এরিস্টটলের কঠোর সমালোচনা করে আরোহী যুক্তিবিদ্যার পক্ষে যুক্তি দেন। লাইবনিজ গণিতের অনন্ত ক্ষুদ্র ক্যালকুলাস আবিষ্কার করেন যা পরবর্তীতে প্রতীকী যুক্তিবিদ্যার বিকাশে ভূমিকা রাখে। জে.এস.মিল (১৮০৬-১৮৭৩) কার্যকারণ প্রমাণ পদ্ধতি, আরোহের শ্রেণিকরণ প্রভৃতি ক্ষেত্রে নতুন নতুন আলোচনা উপস্থাপন করেন। হেগেল আবিষ্কার করেন দ্বান্দ্বিক যুক্তিবিদ্যা।
চতুর্থ বা শেষ সারিতে জর্জ বুল, ফ্রেগে ও বার্ট্রান্ড রাসেলের ছবি ছিল। এরা ছিলেন আধুনিক যুক্তিবিদ্যার সাম্প্রতিক সংস্করণ গাণিতিক ও প্রতীকী যুক্তিবিদ্যার প্রতষ্ঠার সঙ্গে জড়িত। জর্জ বুল ছিলেন এদের অগ্রনায়ক। ফ্রেগে ও রাসেলের অবদান এ ক্ষেত্রে অনস্বীকার্য। একটি জটিল যুক্তিপ্রক্রিয়াকে প্রতীক ও সংকেতের মাধ্যমে গাণিতিক পদ্ধতিতে উপস্থাপনের কাজ এসময় শুরু হয়। রাসেল ও হোয়াইটহেডের সমন্বয়ে লেখা Principia Mathematica গ্রন্থটি গাণিতিক যুক্তিবিদ্যার এক প্রামাণ্য গ্রন্থ।
উদ্দীপকের চার ধরনের চিত্রে যুক্তিবিদ্যার উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশের ইতিহাসের যে ইঙ্গিত করা হয়েছে তা এতক্ষণের আলোচনায় স্পষ্ট করার চেষ্টা করা হয়েছে।
