Logo
Logo
×

দৃষ্টিপাত

শক্তিশালী বন্ড মার্কেট তৈরি করতে হবে

Icon

মো. মামুনুর রশিদ

প্রকাশ: ০৪ ফেব্রুয়ারি ২০২০, ০৬:০০ পিএম

প্রিন্ট সংস্করণ

শক্তিশালী বন্ড মার্কেট তৈরি করতে হবে

আমরা কমবেশি সবাই বন্ড সম্পর্কে ধারণা রাখি। বন্ড হচ্ছে এক ধরনের ঋণচুক্তিপত্র; যার মাধ্যমে কোনো কোম্পানি মূলধন ঘাটতি পূরণে অন্যপক্ষের কাছ থেকে ঋণ নিয়ে থাকে।

বাংলাদেশের বন্ড মার্কেট খুবই ছোট বা নেই বললেই চলে। বাংলাদেশের জিডিপিতে এর অবদান মাত্র ০.০৬ ভাগ। সুনির্দিষ্ট নীতিমালার অভাবে দেশে এখনও সচল হয়নি বন্ড মার্কেট।

কোম্পানিগুলো মূলধন সংগ্রহে ব্যাংক ঋণের ওপর বেশি নির্ভর করায় এই বাজার গভীরতা পায়নি। টাকার অঙ্কে বন্ডের ইউনিট ছোট ও পুঁজিবাজারে লেনদেনযোগ্য হলে বিপুল অর্থের বিনিয়োগ আসবে বন্ড মার্কেটে।

উন্নত বিশ্বে পুঁজিবাজারের পাশাপাশি রয়েছে বন্ড মার্কেটের শক্ত অবস্থান। বড় প্রকল্পে অর্থায়নের অনেক দেশের সরকারও বন্ড ছাড়ে। আর বন্ডে নির্ধারিত হারে সুদ পাওয়া যায় বলে সাধারণ শেয়ারের তুলনায় এতে বিনিয়োগ ঝুঁকি কম। বাংলাদেশে ব্যাংক ঋণের ওপর অতিরিক্ত নির্ভরশীলতার কারণে দীর্ঘদিনেও গতিশীল বন্ড মার্কেট তৈরি হয়নি।

পুঁজিবাজার বিকাশের স্বার্থে বন্ড মার্কেটের উন্নয়ন জরুরি। বন্ড বাজার উন্নয়নের পাশাপাশি সুনির্দিষ্ট নীতিমালা প্রণয়ন করতে হবে। পুঁজিবাজার এবং ব্যাংক খাতের মতো যাতে এরকম নাজুক অবস্থা না হয়, সেদিকে নীতিনির্ধারকদের লক্ষ রাখতে হবে।

বাংলাদেশে ১৯৮৮ থেকে ২০১৩ সালের মধ্যে মাত্র ৩টি বন্ড এবং ১৪টি ডিবেঞ্চার জনসাধারণের কাছে ইস্যু করা হয়েছে। সবচেয়ে বড় বন্ডটি ইস্যু করা হয়েছিল ২০০৭ সালে।

এটির নাম ছিল, ‘আইবিবিএল মুদারাবা পারপিচুয়াল বন্ড’; যার পরিমাণ ছিল ৩০০ কোটি টাকা (প্রায় ৪ কোটি ডলার)। এটি ছিল একটি ইসলামিক বন্ড। এই বন্ডে শুধু মুনাফা দেয়া হতো এবং নীতি অনুযায়ী কোনো ধরনের সুদের হার ছিল না।

আমাদের দেশে বর্তমানে ৫ ধরনের ট্রেজারি বন্ড আছে (২, ৫, ১০, ১৫ এবং ২০ বছর মেয়াদি)। একেকটির অভিহিত মূল্য বা ফেসভ্যালু ১ লাখ টাকা। এটিকে সংস্কার করতে হবে।

বন্ডকে যদি ফেমাস করতে হয়, বন্ডকে যদি জনপ্রিয় করতে হয়, বন্ডকে যদি নতুন পণ্য হিসেবে দেখতে চাই; তবে সেটা পাঁচ হাজার টাকার বেশি ইউনিট হওয়া উচিত নয়। আর সাধারণ মানুষকে বন্ড কেনার সুযোগ দেয়া উচিত। একজন সাধারণ মানুষ ১ লাখ টাকায় বন্ড ক্রয় করতে পারবে না। ফেসভ্যালু কমিয়ে আনতে হবে; যাতে করে সাধারণ মানুষের কাছে এটি জনপ্রিয় হয়।

দেশের অর্থনীতির কথা বলতে গেলে ব্যাংক খাত ও পুঁজিবাজারের কথাই বলতে হয়। অর্থাৎ মুদ্রাবাজার এবং পুঁজিবাজার। পাশাপাশি আরেকটা কথা বলে রাখা যায়, অন্যান্য দেশের পুঁজিবাজারের তুলনায় আমাদের দেশের পুঁজিবাজারও ততটা বৃহৎ নয়।

মোট জিডিপিতে এর অবদান মাত্র ২৫ থেকে ৩০ ভাগ (আনুমানিক); যেখানে হংকংয়ে ১০৯০ ভাগ, মালয়েশিয়াতে ১৬৯ ভাগ, থাইল্যান্ডে ৯৮ ভাগ, ভারতে ৮০ ভাগ এবং ফিলিপাইনে ৯১ ভাগ জিডিপিতে অবদান রাখে। আমাদের অর্থনীতিকে বিকশিত করার জন্য এই দুটি বাজারই যথেষ্ট নয়।

জরুরি ভিত্তিতে বন্ড বাজারের উন্নয়ন করতে হবে। বন্ড বাজারের উন্নতি হলে পুঁজিবাজার এবং ব্যাংক খাতের উপর নির্ভরতা কমে যাবে। দীর্ঘমেয়াদে তহবিল সংগ্রহে বৈচিত্র্য আনতে হবে।

বাংলাদেশের শিল্প, বাণিজ্য এবং ব্যবসায় সম্প্রসারণের জন্য শক্তিশালী বন্ড বাজারের বিকল্প নেই। বিভিন্ন ধরনের কোম্পানি, শিল্প এবং ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান তাদের দীর্ঘমেয়াদি অর্থের জন্য পুঁজিবাজারের দ্বারস্থ হচ্ছে। পুঁজিবাজারে আইপিও বা বুক বিল্ডিং পদ্ধতির মাধ্যমে দীর্ঘমেয়াদি অর্থ সরবরাহ করতে অনেক জটিলতা পোহাতে হয়।

বিভিন্ন ধরনের শর্তাদি বা কাগজপত্র প্রেরণ করতে হয় এবং অনেক আনুষ্ঠানিকতা পালন করতে হয়; খরচও গুনতে হয়। পুঁজিবাজার থেকে অর্থ সংগ্রহ করার জন্য যে পরিমাণ আনুষ্ঠানিকতা পালন করতে হয়, বন্ড বাজার থেকে দীর্ঘমেয়াদে অর্থ সংগ্রহ করতে এতটা আনুষ্ঠানিকতা পালন করতে হয় না।

খরচের পরিমাণও পুঁজিবাজার থেকে তুলনামূলকভাবে কম। বন্ডে ঝুঁকিও কম। তাছাড়া পুঁজিবাজার উন্নয়নেও শক্তিশালী বন্ড মার্কেট দরকার।

কারণ পুঁজিবাজারে দরকার পুঁজি বা অর্থ। ব্যাংক খাত সেটা পূরণে ব্যর্থ হচ্ছে। বন্ড বাজার থেকে অর্থ সংগ্রহ করে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করা যেতে পারে। আমাদের জিডিপি যে ৮ শতাংশ হারে

বাড়ছে, আমরা যদি বন্ড মার্কেট উন্নয়ন করতে না পারি তাহলে আমাদের এই জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার থাকবে না।

সাম্প্রতিক সময়ে নতুন একটি বন্ড লন্ডন স্টক একচেঞ্জে তালিকাভুক্ত হয়েছে; যেটির নাম দেয়া হয়েছে ‘বাংলা বন্ড’। বাংলা বন্ড হচ্ছে বিশ্বের প্রথম বাংলাদেশি টাকা ডিনমিনেটেড বন্ড।

দেশের বেসরকারি খাতকে বিনিয়োগে উৎসাহ দিতে বিশ্বব্যাংক গ্রুপের সহযোগী সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল ফিন্যান্স কর্পোরেশনের (আইএফসি) সহায়তায় ১১ নভেম্বর, ২০১৯ তারিখে এ বন্ড চালু হয়। লন্ডন স্টক এক্সচেঞ্জে (এলইসি) এটি ওইদিনই আনুষ্ঠানিকভাবে তালিকাভুক্ত হয়।

আইএফসি আগামী এক বছরে ১০০ কোটি ডলার মূল্যমানের বন্ড ছাড়ার প্রতিশ্র“তি দিয়েছে। টাকা লেনদেন হবে লন্ডন স্টক মার্কেটে। যে কেউ এই বন্ড কিনতে পারবে। ডলার দিয়ে এই বন্ড কিনতে হবে। সেই ডলার টাকায় কনভার্ট হয়ে তা বিনিয়োগ করা হবে।

আন্তর্জাতিক অর্থবাজারে বাংলাদেশি মুদ্রায় বন্ড ছাড়ার ঘটনা এটাই প্রথম। এই বন্ডের মাধ্যমে সংস্থাটি ইতিমধ্যে প্রায় ১ কোটি ৯০ লাখ মার্কিন ডলারের সমপরিমাণ অর্থ সংগ্রহ করেছে বলে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে।

বাংলা বন্ডের মাধ্যমে আইএফসির সংগৃহীত অর্থ ঋণ পাবে বাংলাদেশের বেসরকারি খাতের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান। যেমন, প্রথম ধাপে ৮০ কোটি টাকা ঋণ পাচ্ছে প্রাণ গ্রুপ।

আমাদের বেসরকারি খাতে বিপুল বিনিয়োগ প্রয়োজন; বিশেষত অবকাঠামো, ম্যানুফ্যাকচারিং, নির্মাণ, আবাসন ও নানা রকমের আধুনিক সেবা খাতে বিনিয়োগ বাড়ানোর জন্য যে অর্থায়ন প্রয়োজন, তা দুর্লভ। বন্ডের মাধ্যমে সংগৃহীত অর্থ থেকে আমরা উক্ত বেসরকারি খাতের উন্নয়ন করতে পারি।

আমাদের দেশের প্রেক্ষিতে অর্থনীতির বিকাশ, বেসরকারি খাতের উন্নয়ন, পুঁজিবাজারের অর্থাভাব দূর এবং ব্যাংক খাতের ওপর নির্ভরশীলতা কমাতে শক্তিশালী বন্ড মার্কেটের বিকল্প নেই।

শিক্ষার্থী, ফিন্যান্স অ্যান্ড ব্যাংকিং বিভাগ

ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া

বন্ড

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম