কবে টেস্ট ম্যাচ জেতা শিখবে বাংলাদেশ?
মুহা. ইকবাল আজাদ
প্রকাশ: ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২০, ০৬:০০ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
বাংলাদেশের টেস্টে অভিষেক হয়েছে প্রায় দু’দশক। লম্বা সময়ের পথচলায় টেস্টে কতটা উন্নতি করেছে বাংলাদেশ? ২০০০ সালে ভারতের সঙ্গে টেস্টে অভিষেক বাংলার টাইগারদের।
গত দু’দশকে বাংলাদেশ টেস্ট খেলেছে ১১৮টি; যার মধ্যে জয় মাত্র ১৩টি। ড্র করেছে ১৬টি এবং এর সিংহভাগই দেশের মাটিতে। বিপরীতে ম্যাচ হেরেছে ঠিক ৮৯টি; অর্থাৎ মোট ম্যাচের ৭৫ শতাংশই হেরেছেন বাংলার বাঘেরা। হেরে যাওয়া ম্যাচের প্রায় অর্ধেকটা (৪৩) আবার ইনিংস পরাজয়। পরিসংখ্যানই বলে দিচ্ছে, টেস্ট ম্যাচ জিততে কতটা কাঁচা টিম বাংলাদেশ।
একটা দলের ভালো করার পেছনে সবচেয়ে বড় অবদান ঘরোয়া লীগের। বিশ্বের যত নামিদামি খেলোয়াড়, তাদের ঘরোয়া লীগের পরিসংখ্যান বলে দেয়, তারা কেন এত প্রতিষ্ঠিত; অথচ বাংলাদেশের ঘরোয়া লীগের মান নিয়ে আছে নানা প্রশ্ন।
ক্রিকেটের উচ্চ গদিতে যিনিই বসেছেন, তিনিই বলেছেন- ঘরোয়া লীগ তাদের চিন্তায় আছে; ঘরোয়ার উন্নতি হচ্ছে। এত উন্নতির ফলাফল পাওয়া যাবে কবে? উন্নতির জোয়ারেই কী তবে জাতীয় দলের এই আকাল!
বাংলাদেশের ১১৮টি টেস্ট ম্যাচে অভিষেক হয়েছে ৯৬ জনের। এদের কেউ কেউ খেলা থেকে বিদায় নিয়েছেন। কেউবা দুই-এক ম্যাচ সুযোগ পেয়ে দলছাড়া হয়েছেন।
যারা দলছাড়া হয়েছেন, তারা অনুপযুক্ত হলে কেনই বা দলে সুযোগ পেলেন? দলছাড়া হওয়ার পর কতটাই বা পরিচর্যা করেছে বিসিবি- এ প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে। টেস্টের পরিসংখ্যানে ১২ দেশের বাংলাদেশের অবস্থান ৯। বাংলাদেশের নিচে থাকা জিম্বাবুয়ের ক্রিকেট প্রায় বিলুপ্তির পথে এবং আফগানিস্তান, আয়ারল্যান্ড নবীন সদস্য।
নবাগত টিম আফগানের সঙ্গেও কিছুদিন আগে দেশের মাটিতে হেরেছে বাংলাদেশ। পূর্ণশক্তি নিয়েও ন্যূনতম প্রতিরোধ গড়তে পারেনি পুরো দল। বাংলাদেশ টেস্টের প্রথম জয় পায় ২০০৫ সালে জিম্বাবুয়ের সঙ্গে। শেষবার জিম্বাবুয়ের সঙ্গে টেস্ট সিরিজেও সিলেটের মাঠে লজ্জার দাগ এঁকেছে বাংলাদেশ।
ক্রিকেটে হার-জিত থাকবেই, তাই বলে নিয়মিত হারতে থাকবে; কিংবা হারতে থাকা দলটি কি কোনোদিন জিততে শিখবে না?
ক্রীড়া জগতে হ্যাট্রিক শব্দটি অসাধারণ কিছুর জানান দেয়। উপমাসূচক সদ্য পাকিস্তানের নাসিম শাহের সবচেয়ে কম বয়সে হ্যাট্রিক পাকিস্তান ক্রিকেটের জন্য গর্বের বিষয়।
কিন্তু টানা তিন ম্যাচ ইনিংস পরাজয়ের বেদনা কি অসাধারণ কিছুর জানান দেবে? হয়তো অসাধারণ হারের গল্প বলবে। বিদেশের মাটিতে বাংলাদেশের পরাজয়ের গল্পগুলো প্রতিপক্ষের জন্য অসাধারণ জয়-ই বটে! ভিনদেশের মাটিতে এ পর্যন্ত ৫৬টি ম্যাচ খেলে জয় মাত্র ৪টি; ড্র মাত্র তিনটি। অবাক করা বিষয় হল, বিদেশের মাটিতে বাংলাদেশ সর্বশেষ ম্যাচ ড্র করেছিল ২০১৩ সালে।
সর্বশেষ জিতেছিল ২০১৭ সালের মার্চ মাসে শ্রীলংকার সঙ্গে। তারপর থেকে বিদেশের মাটিতে যেন হারের বৃত্তে নিয়মিত বাংলাদেশ। যাবে, খেলবে, হেরে আসবে। কখনও আবার ইনিংস ব্যবধানে হারবে।
বিদেশের মাটিতে সর্বশেষ টানা পাঁচ ম্যাচের ইনিংস পরাজয় তার প্রামাণ্য চিত্র। ম্যাচ শেষে প্রেস কনফারেন্সে প্রতিনিধিরা এসে বলবে- এখান থেকে শিক্ষা নেবে পুরো দল। বাস্তবতা হল, ইদানীং শিক্ষাগুলো যেন অশিক্ষায় পরিণত হয়েছে।
মুমিনুলকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল- অনুর্ধ্ব ১৯ বিশ্বকাপের এমন জয়ের পেছনে সবচেয়ে বড় ভূমিকা কী? উত্তর ছিল- জয়ের ক্ষুধা। বিসিবি বসও বলেছিলেন, জয়ের বাসনা থেকে যুবাদের বিশ্বজয়।
অথচ জাতীয় দলের টেস্ট টিমে এই জয়ের ক্ষুধা কি আদৌও আছে? উত্তরের ঝুড়িতে ইতিবাচক থেকে নেতিবাচকের পরিমাণ বেশি হলে অবাক হওয়ার কিছুই থাকবে না। টেস্ট ম্যাচ জিততে হলে অসাধারণ ব্যাটিং, ২০ উইকেট তুলতে পারা বোলারদের পাশাপাশি দরকার অ্যাগ্রিসিভ ফিল্ডিং।
বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানরা যাচ্ছেতাই। কখনো সফল, কখনও বা পরাস্ত। কিন্তু প্রতিপক্ষের ২০ উইকেট তোলার বোলার কোথায়? সদ্য শেষ হওয়া পাকিস্তানের বিপক্ষে প্রথম টেস্টে ক’জনই অ্যাগ্রিসিভ ফিল্ডিং করেছেন? কয়টা হাফ চান্সকে ফুল চান্স বানিয়েছেন? বরং ক্যাচ ছেড়ে বাবর আজমকে সেঞ্চুরি দিয়েছেন।
উইকেটের পেছনে ক্যাচ ধরেও ব্যাটসম্যানকে বারবার জীবন দিয়েছেন। খেলোয়াড়দের আগ্রাসন দেখে মনে হয়েছে, জীবনে প্রথম খেলতে নেমেছেন। তাতে নিজেদের সাধারণ বিলাসিতায় অসাধারণ করে ম্যাচ হারাটাই অনুমেয়।
দুই দশকে ১১৮টি টেস্ট ম্যাচ খেলা দেশের সঙ্গে ‘শিশু’ তকমা অনেকটা বেমানান। শ-খানেক ম্যাচ অতিক্রম করা টেস্ট খেলুড়ে দলের মাত্র ১৩টি জয় আরও বেশি জঘন্য। টেস্ট ম্যাচ একজন ক্রিকেটার গড়ার মূল কারিগর। টেস্টের শীর্ষস্থানের বিরাট কোহলি ওয়ানডেরও এক নম্বর ব্যাটসম্যান।
টেস্টের ধারাবাহিক বাবর আজম টি-টোয়েন্টির সেরা ব্যাটসম্যান। গত কয়েক বছরে টেস্টে ধারাবাহিক মুশফিক বাংলাদেশের সবচেয়ে নির্ভরশীলতার প্রতীক। ওয়ানডে, টি-টোয়েন্টির পাশাপাশি টেস্টকেও সর্বোচ্চ প্রাধান্য দিন। ঘরোয়া মাঠে ঘাসের মাঠের পাশাপাশি পিচের প্রতিও নজর দিন।
খেলোয়াড়দের ম্যাচ ফি বাড়ানোর পাশাপাশি তাদের খাদ্যাভ্যাস, খাদ্যের গুণগত মানের প্রতি নজর দিন। টেস্ট দলে দ্রুত অভিষেক না করিয়ে যথেষ্ট পরখ করুন। দুই-এক ম্যাচ পরে ছুড়ে না ফেলে সময় নিয়ে দেখুন। বাজে ফর্মের জন্য বাদ দিলেও তার পরিচর্যা করুন। তাতে একজন সাইফুদ্দিন উঠে আসতে পারে।
ব্যাটসম্যানের পাশাপাশি টেস্টের বিশেষ বোলার বের করার চেষ্টা করুন। প্রয়োজনে ‘পেসার হান্ট’ প্রতিযোগিতার ব্যবস্থা করুন। বোলারদের ২০ উইকেট নেয়ার সামর্থ্য না থাকলে কোনো দলই টেস্ট ম্যাচ জিতবে না। শুরু থেকেই খেলোয়াড়দের ফিটনেস নিয়ে কাজ করুন; যাতে ফিল্ডিং অন্যদের ছাড়িয়ে যায়।
সামান্য রানআউট কিংবা অসাধারণ ক্যাচ একটি ম্যাচের মোড় ঘুরিয়ে দিতে পারে। খেলোয়াড়দের অভয় দিন। ম্যাচ জেতার আত্মবিশ্বাস তৈরি করুন।
প্রেস কনফারেন্সে এসে বারংবার এখান থেকে শিখব- এ কথা না বলে বাস্তবিক অর্থেই শিখুন কিংবা শিখান। ঘরোয়া লীগের ক্রিকেটীয় দুর্নীতি দমন করে দেশের ক্রিকেটের উন্নতির প্রাণান্তকর চেষ্টা করুন। তাতে ক্রিকেটের প্রতি খেলোয়াড়দের আগ্রহ বাড়াবে। দলের ক্রিকেটারদের পাইপলাইন বৃদ্ধি পাবে। দেশের ক্রিকেটের উন্নতি হবে। আশা করা যায়, এতে টেস্ট ম্যাচ জয়ের শিশু বাংলাদেশ একসময় যুবক, বয়স্কতে পরিণত হতে পারবে।
শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
