Logo
Logo
×

দৃষ্টিপাত

জৈবিক পলিমার ও পলিথিনের ব্যবহার এখন সময়ের দাবি

Icon

জান্নাতুল মাওয়া

প্রকাশ: ০৩ মার্চ ২০২০, ০৬:০০ পিএম

প্রিন্ট সংস্করণ

জৈবিক পলিমার ও পলিথিনের ব্যবহার এখন সময়ের দাবি

‘পলিমার’ নামটি সর্বসাধারণের কাছে সুপরিচিত না হলেও ভিন্ন যে নামটিতে এটি পরিচিত, তা সবার কাছে বহুল পরিচিত। যদি বলি প্লাস্টিক তাহলে যে কেউ খুব সহজেই চিনবে।

কারণ এ নামটি আমাদের দৈনন্দিন জীবনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে। এ পলিমার তৈরি হয় অ্যালকাইন ও অন্যান্য প্রতিস্থাপিত অ্যালকিনগুলো উচ্চচাপ, উচ্চতাপ ও অনুঘটকের উপস্থিতিতে এক অণু অপর অণুর সঙ্গে পরপর যুক্ত হয়ে। সস্তা, বহনযোগ্য ও সহজলভ্য হওয়ায় এর বহুরূপী ব্যবহার দেখা যায়।

ক্যারি ব্যাগ থেকে ওষুধের বোতল, খাদ্য পরিবেশনের পাত্র থেকে ফুলের টব- বিভিন্ন ক্ষেত্রে চটের ব্যাগ হোক কিংবা কাঁচের শিশি অথবা চিনামাটির থালা কিংবা মাটির টব; সবকিছুর বিকল্প হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে পলিমার। উল্লেখযোগ্য দুটি পলিমার হলো প্লাস্টিক ও পলিথিন।

১৯০৭ সালে প্লাস্টিকের বৈপ্লবিক উদ্ভাবন বেশ সাড়া জাগিয়েছিল বিশ্বজুড়ে। ৫০ থেকে ৭০-এর দশকে সীমিত পরিমাণ প্লাস্টিক উৎপাদিত হওয়ার দরুন নেতিবাচক প্রভাব নিয়ে চিন্তাধারা তখন ছিল ভাবনার বাইরে। কিন্তু ৯০-এর দশকে প্লাস্টিকের উৎপাদন এবং এর দ্বারা সৃষ্ট বর্জ্যরে পরিমাণ তিন গুণেরও বেশি বেড়ে যায় এবং ২০০০ সালের পর থেকে এ দূষণ পুরোপুরি ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে যায়।

অপরদিকে, মনুষ্য কর্তৃক উদ্ভাবনী আবিষ্কার ‘পলিথিন’, যেটাও এক ধরনের পলিমার এবং একই সঙ্গে অত্যন্ত পরিচিত প্লাস্টিক। উচ্চচাপ (১০০০-১২০০ ধঃস) ও তাপমাত্রায় (২০০ ০প) সামান্য অক্সিজেনের উপস্থিতিতে তরলিভূত হয়ে অসংখ্য ইথিলিনের অণু (৬০০-১০০০, মতান্তরে ৪০০-২০০০ অণু) পলিমারাইজেশন প্রক্রিয়ায় সংযুক্ত হয়ে পলিথিন উৎপন্ন করে। পলিথিন সাদা, অস্বচ্ছ ও নমনীয় পদার্থ।

কোনো কিছুর নিয়ন্ত্রিত ব্যবহার জীবনকে সহজ করলেও ঠিক বিপরীতটা ঘটবে এর উল্টোদিকে অর্থাৎ দৈনন্দিন কাজে প্লাস্টিক ও পলিথিনের ব্যবহার আমাদের কাজকে অবশ্যই সহজ করেছে, এতে কোনো সন্দেহ নেই। তবে এর পরিমাণ অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পাওয়ায় এ আবিষ্কার আমাদের জন্যই অভিশাপ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

প্লাস্টিক ও পলিথিন প্রকৃতিতে দীর্ঘদিন অবিকৃত থাকে, পচে না; এমনকি প্রকৃতিতে বিরাজমান ব্যাকটেরিয়া এবং ফাংগাস দ্বারা বিয়োজিত হয় না। মূলত, সচেতনতার অভাবে ব্যবহারের অযোগ্য হয়ে গেলে ব্যবহারকারীরা এসব সামগ্রীকে বর্জ্য পদার্থ হিসেবে যত্রতত্র ফেলে দেয়। নর্দমাগুলো এসব সামগ্রী দিয়ে ভরে যাওয়ার দরুন নোংরা পানি এবং বস্তুগুলো নিষ্কাশিত হতে পারে না।

পরিণামে আশপাশের এলাকাগুলো নোংরা পানিতে প্লাবিত হচ্ছে, যা পানীয় জলের উৎসগুলোয় মিশে গিয়ে পানিদূষণ ঘটাচ্ছে। এ ছাড়া নিত্যপ্রয়োজনীয় ব্যবহৃত দ্রব্যের মোড়কে প্লাস্টিক ও পলিথিন ব্যবহার করায় তা হতে বিষফেনোল নামক বিষ নির্গত হচ্ছে, যা খাদ্যদ্রব্যের সঙ্গে মিশে যায়। এর ফলে খাদ্য গুণাগুণ যেমন নষ্ট হচ্ছে; তেমনি জটিল স্বাস্থ্যঝুঁকির মুখে পড়তে হচ্ছে।

পৃথিবী আজ যখন প্লাস্টিক ও পলিথিন দূষণের চরমসীমায় এসে উপনীত হয়েছে, ঠিক তখনই ‘এর সমতুল্য, কিন্তু ক্ষতিকারক নয়; এমন কিছু আবিষ্কার করলে ক্ষতির মোকাবেলা করা সম্ভব হবে’- এ ধারণা মাথায় রেখে আবিষ্কার হল জৈবিক পলিমার।

চলুন জেনে নেয়া যাক, জৈবিক পলিমার কী? বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যায়, জৈবিক পলিমার হল এমন এক ধরনের পলিমার, যা মূলত জৈব উপাদান থেকে তৈরি। জৈবিক পলিমারের দুটি উল্লেখযোগ্য রূপ হল জৈবিক প্লাস্টিক ও পলিথিন। প্রথমে জেনে নেয়া যাক, জৈবিক প্লাস্টিক সম্পর্কে।

বাজারে যেসব পলিমার তথা প্লাস্টিক পাওয়া যায়, তার কাঁচামাল হিসেবে মূলত ব্যবহৃত হয় পেট্রোলিয়াম জাতীয় হাইড্রোকার্বন অর্থাৎ এটি মূলত খনিজ তেলনির্ভর। তবে বর্তমানে বিজ্ঞানীরা যে জৈব প্লাস্টিক শিল্পের ধারণা প্রদান করেছেন, তার কাঁচামাল মূলত কৃষি বা উদ্ভিদ জাতীয় বস্তু; যা পরিবেশে দ্রুত বিয়োজিত হয়ে যাবে। ফলে এটিকে পরিবেশবান্ধব বলে আখ্যা দিয়েছেন বিজ্ঞানীরা।

যেহেতু উদ্ভিদ বায়ু থেকে কার্বন ডাই অক্সাইড গ্রহণ করে বৃদ্ধি পায়; সেহেতু জৈব প্লাস্টিকের দহনে উৎপন্ন কার্বন ডাই-অক্সাইড পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট করবে না। তাই বিজ্ঞানীরা আগামীর সবুজ পৃথিবীর জন্য বেছে নিচ্ছেন জৈবিক পলিমার তথা জৈবিক প্লাস্টিককে। জৈবিক প্লাস্টিক হল নতুন প্রজন্মের প্লাস্টিক, যা তৈরি করতে মূলত ব্যবহৃত হয় সেলুলোজ, আখ, ভুট্টা, ট্যাপিওকা, আলু, সয়াপ্রোটিন, ল্যাকটিক এসিড ইত্যাদি। এ ছাড়া বিভিন্ন গবেষণা এবং পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে বলা হচ্ছে, এভোক্যাডো, সিউইডস, ক্যাকটাস, আঙুর, মাশরুমসহ বিভিন্ন পোকামাকড় হতে জৈব প্লাস্টিক উৎপন্ন করা সম্ভবপর হবে।

জৈবিক এ প্লাস্টিককে অনেক উন্নত দেশেই প্রাধান্য দেয়া হচ্ছে। উদ্ভিদ ও উদ্ভিদজাত বস্তু থেকে যেমন বাঁশতন্তু, দানাশস্যের তুস, আঠা প্রভৃতিকে বিশেষ প্রযুক্তি ব্যবহার করে এমন বায়োপ্লাস্টিকের পরিবর্তিত রূপ দেয়ার চেষ্টা চলছে, যা হবে সুলভ এবং ব্যবহারিক প্রয়োজনীয়তাযুক্ত।

সমগ্র বিশ্বে জাপানের টয়োটা মোটর কর্পোরেশন প্রথম জৈব প্লাস্টিক ব্যবহারের কৃতিত্বের দাবিদার। তাদের ‘রম’ নামক মডেলের গাড়ির চাকা হিসেবে যে জৈব প্লাস্টিক ব্যবহৃত হয়েছে, তা মূলত আলু এবং আখ হতে প্রস্তুত। জাপানের মিৎসুবিশি কোম্পানি উচ্চ তাপমাত্রা সহনশীল এবং বেশি কাঠিন্য যুক্ত জৈব প্লাস্টিক উৎপাদন করছে, যা সনি কর্পোরেশন তাদের কিছু ওয়াকম্যান তৈরিতে ব্যবহার করছে।

আশা করা যায়, এ ক্ষেত্রে বিজ্ঞানীদের নিরলস গবেষণা ও আধুনিক প্রযুক্তি অধিগ্রহণের ফলে জৈব প্লাস্টিকের ব্যবহার ক্রমশ বৃদ্ধি পাবে আর আমরা অতি দ্রুত এগিয়ে যেতে পারব সবুজ পৃথিবী গড়ার লক্ষ্যে।

সময়ের আরও একটি উদ্ভাবনী আবিষ্কার, জৈবিক পলিথিনের ব্যাপারে আলোচনা করি এবার। সোনালি ব্যাগ হল পাট থেকে উদ্ভাবিত এমন এক ধরনের জৈবিক পলিথিন ব্যাগ এবং আমাদের জন্য অতি গর্বের বিষয় যে, প্রক্রিয়াটি আবিষ্কার করেছেন বাংলাদেশি বিজ্ঞানী মোবারক আহমদ খান। পাট থেকে সেলুলোজ সিটের মাধ্যমে পলিথিন ব্যাগ তৈরি করা হয়। পাটের তৈরি এ সোনালি ব্যাগ সহজেই মাটির সঙ্গে মিশে যায় এবং মাটির উর্বরতা বৃদ্ধিতে সহায়তা করে।

সম্প্রতি এমন আরও এক পলিথিন ব্যাগ প্রস্তুত করা হয়েছে, যা পানিতে দ্রবীভূত হয়ে যাবে। তাছাড়া মিশে যাওয়ার পরও তা কোনো বিষাক্ত পদার্থের সৃষ্টি করবে না কিংবা কোনো বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখাবে না। যুগান্তকারী এ প্লাস্টিক ব্যাগের নাম হল ‘সল্যুব্যাগ’। পরিবেশ দূষণ প্রতিহত করার তাগিদে চিলির রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক রাজধানী সান্তিয়াগোর দু’জন গবেষক এ সল্যুব্যাগ তৈরি করেন।

এরা হলেন রবার্টো অ্যাস্তেত এবং ক্রিশ্চিয়ান অলিভারস। দীর্ঘ চার বছরের গবেষণার পর তারা এ ব্যাগ আবিষ্কারে সক্ষম হয়েছেন। বিভিন্ন জৈব উপাদানের মাধ্যমে প্রস্তুত করা হচ্ছে বলে এ ব্যাগ পরিবেশবান্ধব। এ মূল উপাদানটির নাম হল পলিভিনাইল অ্যালকোহল (পিভিএ)। এ পলিভিনাইল অ্যালকোহল পরিবেশ এবং প্রাণীর স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর না হওয়ার কারণ হল এটি দ্রবীভূত হওয়ার পর শুধু কার্বন থাকে, যা কোনো ধরনের নেতিবাচক প্রভাব ফেলে না।

পরিবেশের প্রতিটি উপাদানের সুসমন্বিত রূপই হল সুস্থ পরিবেশ। এ সুসমন্বিত রূপের ব্যত্যয় ঘটলে পরিবেশ দূষণ হয় এবং পরিবেশের স্বাভাবিক মাত্রার অবক্ষয় দেখা দেয়।

ক্ষতিকর এসব প্লাস্টিক ও পলিথিনের বিকল্প হিসেবে জৈবিক পলিমার এবং পলিথিনের ব্যবহার এখন সময়ের চাহিদা। গণমাধ্যম এগিয়ে এলেই কেবল বিপুলসংখ্যক মানুষের কাছে এর গুরুত্ব বোঝানো সম্ভব হবে বলে আমি মনে করি।

শিক্ষার্থী, এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়, ত্রিশাল, ময়মনসিংহ

 

পলিমার

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম