প্রাকৃতিক দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় বাংলাদেশ কতটা প্রস্তুত
মো. আরাফাত রহমান
প্রকাশ: ২২ ডিসেম্বর ২০২০, ০৬:০০ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে আবহমানকাল ধরে বাংলাদেশ বিভিন্ন সময়ে প্রাকৃতিক দুর্যোগে আক্রান্ত হচ্ছে। এসব দুর্যোগের মধ্যে রয়েছে বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস, কালবৈশাখী ঝড়, টর্নেডো, নদীভাঙন, উপকূলভাঙন, খরা, শৈত্যপ্রবাহ ইত্যাদি।
এছাড়া সিসমিক জোন অর্থাৎ ইউরেশিয়ান প্লেট, ইন্ডিয়ান প্লেট ও বার্মা প্লেটের মাঝামাঝি অবস্থানে থাকার কারণে বাংলাদেশ ভূমিকম্প ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। বৈশ্বিক উষ্ণায়নের কারণে বাংলাদেশের অবস্থান অত্যন্ত নাজুক।
জলবায়ু পরিবর্তনের বাস্তবতায় প্রাকৃতিক দুর্যোগের মাত্রা ও তীব্রতা দিন দিন বেড়েই চলেছে। জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষেত্রে আমাদের ভূমিকা অত্যন্ত নগণ্য হলেও এর মারাত্মক বিরূপ প্রভাবের শিকার হচ্ছে বাংলাদেশ। দারিদ্র্য ও ঘনবসতির কারণে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বাংলাদেশের উপকূলীয় ও নদীতীরবর্তী এলাকার জনসাধারণের জীবন ও জীবিকা ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
জলবায়ু পরিবর্তনে আক্রান্ত দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম এবং দারিদ্র্য ও ঘনবসতির দরুন জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব বাংলাদেশের জন্য অনেক বেশি ভয়াবহ। ‘ওয়ার্ল্ড রিস্ক রিপোর্ট-২০১১’ অনুযায়ী, দুর্যোগের ঝুঁকি ও বিপদাপন্নতার দিক থেকে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান যথাক্রমে ৬ষ্ঠ ও ১৫তম। জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব, অপরিকল্পিত নগরায়ণ, প্রকৃতিতে মানুষের অপরিকল্পিত হস্তক্ষেপ, নদীশাসন ইত্যাদির প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ নানা প্রভাবজনিত কারণে দুর্যোগে বাংলাদেশের বিপদের আশঙ্কা কয়েকগুণ বেড়েছে। বিভিন্ন সময়ে প্রাকৃতিক দুর্যোগগুলোয় একদিকে যেমন জানমালের ক্ষতি হয়েছে, অন্যদিকে তেমনি অর্থনৈতিক ক্ষতির পরিমাণও অনেক বেড়ে গেছে। এ অবস্থা নিঃসন্দেহে বাংলাদেশকে তার উন্নয়ন অগ্রযাত্রা থেকে পিছিয়ে দিচ্ছে।
দুর্যোগের ঝুঁকি ও ক্ষয়ক্ষতি মানুষের জীবন ও সম্মানজনক জীবিকা অর্জনের পথে এক বিশাল অন্তরায়। বিশেষ করে দরিদ্র সম্প্রদায়ের জন্য, যারা অত্যন্ত কষ্টে জীবিকা নির্বাহ করে থাকে।
দুর্যোগের ফলে কেবল দুর্যোগকবলিত দেশ বা জাতি ক্ষতিগ্রস্ত হয় এমন নয়; বরং এর ফলে বিশ্বব্যাপী ব্যাপক বিরূপ প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। পরিবর্তিত প্রযুক্তি, আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপট, অপরিকল্পিত নগরায়ন, পরিবেশ ও ভৌগলিক বিপর্যয়, জলবায়ুর পরিবর্তন, এইচআইভি-এইডসের প্রকোপ, ভূতাত্ত্বিক বিপর্যয় ও ক্রমবর্ধমান হারে জনসংখ্যা বৃদ্ধি বিশ্বব্যাপী দুর্যোগের ঝুঁকি তীব্রতর করে তুলেছে। পরিবর্তনের এ অব্যাহত ধারা বিশ্ব অর্থনীতি ও উন্নয়নশীল দেশগুলোর টেকসই উন্নয়নের পথে বিরাট বাধাস্বরূপ।
দুর্যোগে প্রত্যেক মানুষেরই সমান সুযোগ ও সহযোগিতা পাওয়ার অধিকার আমাদের সংবিধান কর্তৃক স্বীকৃত। বাংলাদেশের সংবিধানে সব পর্যায়ে সব মানুষের সমান অধিকার পাওয়ার কথা বলা হয়েছে। যেহেতু দুর্যোগে অপেক্ষাকৃত দরিদ্র জনগোষ্ঠী সম্পদ হারায়, সেহেতু বাংলাদেশের সংবিধান অনুসারে আক্রান্ত জনগোষ্ঠী তাদের জীবনধারণের মৌলিক উপকরণ ফিরে পাওয়ার অধিকার রাখে।
জনগণের সার্বিক দুর্যোগ লাঘব করা, দুর্দশাগ্রস্ত জনগোষ্ঠীর জন্য জরুরি মানবিক সহায়তা, পুনরুদ্ধার ও পুনর্বাসন কর্মসূচি অধিকতর দক্ষতার সঙ্গে পরিচালনা করার লক্ষ্যে ‘দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা আইন, ২০১২’ প্রণীত হয়েছে। এছাড়াও বাংলাদেশে বিদ্যমান বিভিন্ন আইনে দুর্যোগ ঝুঁকি হ্রাস এবং দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিষয়ের সংশ্লিষ্টতা রয়েছে।
২০১০ সালে প্রণীত বাংলাদেশ সরকারের প্রেক্ষিত পরিকল্পনা ২০১০-২০২১-এ মোট দশটি উন্নয়ন অগ্রাধিকারের মধ্যে অন্যতম হল পরিবেশ রক্ষা, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সৃষ্ট সমস্যা কার্যকরভাবে মোকাবেলা করা এবং পরিবেশ দূষণ করে এমন সব বিষয়ে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা। এতে আরও বলা হয়, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত বিধায় জলবায়ু পরিবর্তনজনিত দুর্যোগ ঝুঁকি হ্রাসে একটি সমন্বিত দুর্যোগ প্রশমন, প্রস্তুতি, সাড়াদান, পুনরুদ্ধার ও পুনর্বাসন কার্যক্রম বাস্তবায়ন করা প্রয়োজন।
১৯৮৮ ও ১৯৯৮ সালের ব্যাপক বন্যা এবং ১৯৯১ সালের ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের পর সরকার দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় সনাতনী ধারণার পরিবর্তে দুর্যোগ ঝুঁকি হ্রাসমূলক ধারণার প্রয়োগ ঘটানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে আপদ ও ঝুঁকি শনাক্তকরণ, জনগণের প্রস্তুতি এবং সার্বিকভাবে দুর্যোগ মোকাবেলার জন্য উদ্যোগ গ্রহণকে সমান গুরুত্ব প্রদান করা। পূর্বের ত্রাণ ও পুনর্বাসন ধারণার পরিবর্তে জনগণের অংশগ্রহণে ঝুঁকি ব্যবস্থাপনার একটি কাঠামোগত রূপরেখা প্রণীত হয়েছে।
সার্বিক ঝুঁকি ব্যবস্থাপনার এ কাঠামোর কেন্দ্র মূলে রয়েছে ঝুঁকিকবলিত জনগোষ্ঠীর ঝুঁকি মোকাবেলার সামর্থ্য বৃদ্ধি এবং সুনির্দিষ্ট ঝুঁকির মধ্যে তাদের বিপদের আশঙ্কা হ্রাস করা। বস্তুত ত্রাণ ও পুনর্বাসন কৌশলের পরিবর্তে একটি সার্বিক দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কাঠামো গড়ে তোলার জন্য সরকার দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে নানামুখী সংস্কারের উদ্যোগ নিয়েছে, যা প্রশসংনীয়।
সহকারি কর্মকর্তা, ক্যারিয়ার অ্যান্ড প্রফেশনাল ডেভেলপমেন্ট সার্ভিসেস বিভাগ, সাউথইস্ট বিশ্ববিদ্যালয়
arafat.bcpr@seu.edu.bd
