ব্যাংকিং ডিপ্লোমার আধুনিকায়ন জরুরি
কে এম মাসুম বিল্লাহ
প্রকাশ: ০১ নভেম্বর ২০২২, ০৬:০০ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে ব্যাংকিং ব্যবস্থা হয়েছে ডিজিটালাইজড। ম্যানুয়াল ব্যাংকিং বিদায় নিয়েছে, অনলাইন ব্যাংকিং সবার জন্য ব্যাংকিং ব্যবস্থা সহজ করে দিয়েছে। বর্তমান যুগে দেশের সব সরকারি-বেসরকারি ব্যাংকে লেগেছে আধুনিকায়নের ছোঁয়া; কিন্তু ব্যাংকিং ডিপ্লোমা পরীক্ষা থেকে গেছে সেই পুরোনো ধারায়! যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে এটির আধুনিকায়ন অত্যন্ত জরুরি হয়ে পড়েছে; বিশেষ করে তাত্ত্বিক পরীক্ষাগুলো কতটা প্রয়োজনীয়-এ বিষয়ে ভাবার সময় হয়েছে নীতি-নির্ধারকদের। গত কয়েক বছরে আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায়ও বেশ পরিবর্তন এসেছে। বর্তমানে এসএসসি কিংবা এইচএসসি পরীক্ষাগুলো হচ্ছে সৃজনশীল প্রশ্নপত্রে। অর্থাৎ সেখানে সরাসরি বই পড়ে উত্তর লেখার মাধ্যমে নিজের দক্ষতা দিয়ে লেখাকে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। অথচ ব্যাংকাররা সবাই উচ্চশিক্ষার লেভেল পার করে চাকরিতে এলেও তাদের আবার তাত্ত্বিক বিষয়ে ১২টি সাবজেক্টের লিখিত পরীক্ষা দিতে হচ্ছে!
ব্যাংকিং ডিপ্লোমা পরীক্ষা নিয়ে বেশ হতাশা কাজ করে ব্যাংকারদের মধ্যে; বিশেষ করে বেশির ভাগ রাষ্ট্রায়াত্ত ব্যাংকে অনেকাংশেই ব্যাংকিং ডিপ্লোমা পরীক্ষায় পাশের উপরে প্রমোশন নির্ভর করে। আবার ব্যাংকিং ডিপ্লোমার বেশির ভাগ সাবজেক্ট বাণিজ্য বিভাগের হওয়ায় বেশ সমস্যায় পড়তে হয় বিজ্ঞান ও মানবিক বিভাগ থেকে স্নাতক/স্নাতকোত্তর শেষ করা ব্যাংক কর্মকর্তাদের জন্য। এছাড়া খুব ভালো লেখার পরও বারবার ফেল করানোর মতো অভিযোগও আছে ব্যাংকারদের; বিশেষ করে বাণিজ্য বিভাগ থেকে প্রথম শ্রেণিতে অনার্স/মাস্টার্স শেষ করা অনেক ব্যাংকারকেই ডিপ্লোমা পরীক্ষাতে সংশ্লিষ্ট সাবজেক্টে পাশ করতে কয়েকবার পরীক্ষা দিতে হচ্ছে! আর এ কারণেই হতাশ হতে হচ্ছে ব্যাংক কর্মকর্তাদের। উল্লেখ্য, ডিপ্লোমা পরীক্ষার দুই পার্টে পাশ করা না থাকলে প্রমোশন হচ্ছে না অনেক দক্ষ ব্যাংকারদের। অথচ সবাই তাদের উচ্চশিক্ষা শেষ করে মেধার স্বাক্ষর রেখে প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার মধ্য দিয়ে ব্যাংকের চাকরিতে যোগদান করে থাকে।
বিগত বছরগুলোয় ডিপ্লোমা পরীক্ষা দিতে গিয়ে বেশ ভোগান্তিতে পড়তে হয়েছে ব্যাংক কর্মকর্তাদের। পরীক্ষার হলে ম্যাজিস্ট্রেট কর্তৃক ব্যাংক কর্মকর্তাদের সঙ্গে অসদাচরণ নিয়ে অনেকেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ক্ষোভ জানিয়েছেন। ডিপ্লোমা পরীক্ষা দিতে গিয়ে হল পরিদর্শক কর্তৃক পুলিশ প্রশাসনের ভয় দেখানো হয় ব্যাংকারদের! একজন ৫ম/৬ষ্ঠ গ্রেডের ব্যাংক কর্মকর্তাকে (এসপিও/পিও) ৯ম গ্রেডের একজন কর্মকর্তা কর্তৃক অপমানিত হতে হয়, যা ব্যাংকারদের জন্য বেশ হতাশার। এমনকি পরীক্ষার হলে ‘সার্চ’ করার নামে যে হয়রানি করা হয়, এতে কাউকে কাউকে অন্য সব কর্মকর্তাদের সামনে বেশ লজ্জার মধ্যে পড়তে হয়। ব্যাংকারদের কাজের প্রসারের কথা সবাই অবগত। বিশেষ করে করোনা মহামারির সময়ে যখন সব সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যায়, তখনও দেশের অর্থনীতিকে সচল রাখতে ঢাল হয়ে দাঁড়ান একেকজন ব্যাংকার। করোনার মধ্যে সেবা দিতে গিয়ে অনেক ব্যাংক কর্মকর্তাই প্রাণ হারিয়েছেন। তারপরও ব্যাংকিং সেবা দেওয়া বন্ধ হয়নি। অথচ একটা ডিপ্লোমা পরীক্ষা দিতে গিয়ে যদি ব্যাংকারদের লাঞ্ছিত হতে হয়, তবে তা বেশ হতাশাজনক।
ব্যাংকিং ডিপ্লোমার যৌক্তিকতা নিয়েও অনেকদিন ধরেই আলোচনা চলে আসছে। বেশকিছু সাবজেক্টের পরীক্ষা দিতে হয়, যা কিনা ব্যাংকিং ব্যবস্থা সম্পর্কিত নয়। এতে দক্ষ ব্যাংকাররা পিছিয়ে পড়ছেন। সারা দিন ব্যাংকিং কাজ শেষ করে পরিবারকে সময় দেওয়ার মতো সময় থাকে না অনেক ব্যাংকারের। অফিস সময়ের বাইরেও কাজ করতে হয়, অনেক সময় বন্ধের দিনও কাজ করতে হয়। এমন পরিস্থিতিতে তাত্ত্বিক পরীক্ষার প্রস্তুতি নেওয়ার মতো সময় যে থাকে না, তা নিশ্চিত। এরপর আবার যদি হয়রানি কিংবা লাঞ্ছিত হওয়ার ঘটনা ঘটে, তবে তা সত্যিই দুংখজনক। দীর্ঘদিন থেকেই তাই একটা চাপা ক্ষোভ নিয়ে ব্যাংকিং ডিপ্লোমা পরীক্ষা দিতে হচ্ছে ব্যাংকারদের। ৯৫তম ব্যাংকিং ডিপ্লোমার আবেদন গ্রহণ শুরু হচ্ছে সামনের সপ্তাহ থেকে। এর পরীক্ষার সময়সূচিও প্রকাশ করা হয়েছে। তবে হঠাৎ করেই পরীক্ষার রেজিস্ট্রেশন ফি বাড়িয়ে ১৮০০ টাকা করা হয়েছে! আইবিবি-এর এমন সিদ্ধান্তও সবাইকে হতাশ করেছে। বিশেষ করে একই সাবজেক্টে বারবার পরীক্ষা দেওয়ার পরও যখন ফেল করানো হচ্ছে, তখন একটি সাবজেক্টের জন্য বারবার সমপরিমাণ টাকা দিয়ে রেজিস্ট্রেশন করানো কতটা যৌক্তিক?
ব্যাংক কর্মকর্তাদের চাকরির ক্ষেত্রে বেশ চ্যালেঞ্জ নিতে হয়। অফিস সময়ের বাইরে গিয়েও কাজ করতে হয়। অর্থনিতীর যে কোনো চাপ মোকাবিলায় সব সময়ই প্রস্তুত ব্যাংকাররা। করোনার সময়ে অর্থনীতির চাকা সচল রাখতেও ব্যাংকারদের ছিল সম্মুখযোদ্ধার ভূমিকা। তাই ব্যাংকারদের অধিকার নিয়েও ভাবতে হবে নীতি-নির্ধারকদের। ব্যাংকিং ডিপ্লোমার আধুনিকায়নে হতে পারে যুগান্তকারী পরিবর্তন। বিশেষ করে তাত্ত্বিক বিষয়ে লিখিত পরীক্ষা কমিয়ে দক্ষ ব্যাংকারদের মূল্যায়নে প্রাকটিক্যাল কোর্সের আয়োজন করা যেতে পারে। ডিপ্লোমা পরীক্ষাতে শুধু ব্যাংকিং রিলেটেড সাবজেক্ট অন্তর্ভুক্তিকরণ কিংবা অসংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো বাদ দেওয়া, পরীক্ষার হলে ব্যাংকারদের হয়রানি না করাসহ বহির্বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে নতুন নতুন বিষয়ের ওপর প্রশিক্ষণ হতে পারে সমাধান। এ প্রেক্ষাপটে ব্যাংকিং ডিপ্লোমার আধুনিকায়নের উদ্যোগ হবে সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত-এটা সব ব্যাংকার বিশ্বাস করেন।
ব্যাংকার ও কলামিস্ট, দুমকি, পটুয়াখালী
