সড়ক দুর্ঘটনা রোধে দ্রুত বিধিমালা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন জরুরি
তরিকুল ইসলাম
প্রকাশ: ০৮ নভেম্বর ২০২২, ০৬:০০ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
প্রতিবছর ২২ অক্টোবর ‘জাতীয় নিরাপদ সড়ক দিবস’ পালিত হয়। সড়ক নিরাপদ করার আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় ২০১৭ সাল থেকে প্রতিবছর ২২ অক্টোবর জাতীয় নিরাপদ সড়ক দিবস পালিত হয়। দিবসটির এবারের প্রতিপাদ্য ছিল ‘আইন মেনে সড়কে চলি, নিরাপদে ঘরে ফিরি’। প্রতিবছর এ দিবস পালনের মধ্য দিয়ে দেশের সড়ক-মহাসড়কগুলোকে নিরাপদ করার জনদাবি জোরেশোরে উচ্চারিত হলেও প্রশ্ন হলো-এর কোনো সুফল জনগণ পাচ্ছে কি না?
সড়ক দুর্ঘটনা মানবঘাতক হিসাবে পরিচিতি পেয়েছে। আন্তর্জাতিক বিশ্বে বাংলাদেশ বর্তমান সময়ে বিভিন্ন বিষয়ে এগিয়ে আছে। বিশ্বে আমাদের দেশের সুনাম ও সুখ্যাতি ব্যাপকভাবে অগ্রগামী। তবে এই সুনাম আর সুখ্যাতিকে মলিন করে দিচ্ছে দেশের সড়ক দুর্ঘটনা। এমন কোনোদিন নেই, এমন কোনো সময় নেই-যে দিনে বা সময়ে আমাদের সড়ক ও মহাসড়কগুলোতে সড়ক দুর্ঘটনা ঘটছে না। সড়ক ও মহাসড়কে আহতদের আর্তনাদ আর নিহতদের পরিবার-পরিজনের কান্না মানুষের হৃদয়ে নাড়া দিচ্ছে। সড়ক দুর্ঘটনার কারণগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো, নিয়ন্ত্রণহীন গতিতে অর্থাৎ অতিরিক্ত গতিতে যানবাহন চালনা। সড়কে সড়কে আর কোনো দুর্ঘটনা কিংবা লাশ নয়-আমরা চাই শতভাগ নিরাপদ সড়ক।
রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের হিসাবে, ২০২০ সালে করোনা সংক্রমণে বছরব্যাপী লকডাউনে পরিবহণ বন্ধ থাকা অবস্থায় ৪ হাজার ৮৯১টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৬ হাজার ৬৮৬ জন নিহত ও ৮ হাজার ৬০০ জন আহত হয়েছে। বিগত ৬ বছরে ৩১ হাজার ৭৯৩টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৪৩ হাজার ৮৫৬ জন নিহত, ৯১ হাজার ৩৫৮ জন আহত হয়েছে। ২০২১ সালে সারা দেশে সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে ৫ হাজার ৩৭১টি। এসব দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন ৬ হাজার ২৮৪ জন এবং আহত হয়েছেন ৭ হাজার ৪৬৮ জন। নিহতদের মধ্যে ৮০৩ জন বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী। আর চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুলাই পর্যন্ত ৪ হাজার ১৬৬ জন নিহত হয়েছেন। আগস্ট মাসে সারা দেশে ৪৫৮টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৫১৯ জন নিহত ও ৯৬১ জন আহত হয়েছেন। সেপ্টেম্বরে দেশে ৪০৭টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৪৭৬ জন নিহত হয়েছেন। অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহে সারা দেশে ৩২২টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৬৩ জন নিহত ও ২৪৪ জন আহত হয়েছেন।
সংখ্যা যাই হোক; সড়কে মৃত্যুর মিছিল থামানো যাচ্ছে না-এটাই ভাবার বিষয়। দেশে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণহানির শিকার হন প্রায় ৪৭ শতাংশ পথচারী। আমাদের সড়ক-মহাসড়কে যানবাহনের গতি নিয়ন্ত্রণ, সিটবেল্ট ব্যবহার, ড্রিংক ড্রাইভ, মানসম্মত হেলমেট ও শিশু আসন ব্যবহার নিশ্চত করা গেলে প্রাণহানি অর্ধেকে নামিয়ে আনা সম্ভব। জনগণের দীর্ঘদিনের দাবি ছিল-দুর্ঘটনা রোধে একটি সময়োপযোগী সড়ক পরিবহণ আইন করা। আইন হয়েছে; কিন্তু বিধিমালা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন না হওয়ায় এর সঠিক প্রয়োগ হচ্ছে না।
সরকারি তথ্য বিশ্লেষণ করে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা প্রতিষ্ঠান এআরআই বলছে, দেশে ৫৩ শতাংশ সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে অতিরিক্ত গতিতে গাড়ি চালানোর কারণে। আর চালকদের বেপরোয়া মনোভাবের কারণে দুর্ঘটনা ঘটে ৩৭ শতাংশ। একইসঙ্গে সড়ক নির্মাণে প্রকৌশলগত ত্রুটি ও পথচারীদের অসচেতনতাও দায়ী। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ২০১৮ সালের সড়ক দুর্ঘটনাসংক্রান্ত সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুসারে, সড়ক দুর্ঘটনায় সারা বিশ্বে বছরে সাড়ে ১৩ লাখ মানুষ মারা যায়। এর মধ্যে ৩০ শতাংশের বয়স ২৫ বছরের কম। বিশ্বে তরুণরা যেসব কারণে বেশি হতাহত হন, তার মধ্যে সড়ক দুর্ঘটনা সবার শীর্ষে। এ প্রতিবেদন অনুসারে, বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রতি বছর প্রাণহানি হয় ২৫ হাজার মানুষের।
সড়ক দুর্ঘটনা কমে না, মৃত্যুর হার কমে না। বাড়ে, বাড়তেই থাকে। প্রায় প্রতিদিনই পত্রিকার পাতায়, টিভি চ্যানেলে সড়ক দুর্ঘটনায় মর্মান্তিক মৃত্যুর খবর পাওয়া যাচ্ছে। দেশের প্রতিটি অঞ্চলের সড়ক, মহাসড়কে এমন মর্মান্তিক মৃত্যুর তাণ্ডব অহরহ। সড়ক দুর্ঘটনা হ্রাসে আমাদের প্রত্যাশিত লক্ষ্যে এখনো পর্যন্ত পৌঁছাতে না পারার কারণ আইনের দুর্বল দিক, আইনের যথাযথ বাস্তবায়ন না হওয়া, উপযুক্ত আইন প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে বিভিন্ন ধরনের বাঁধা, সরকারের সদিচ্ছা ও আমাদের সচেতনতার অভাব। সড়ক পরিবহণ আইন ২০১৮ প্রণয়নে গণমাধ্যম যেভাবে এগিয়ে এসেছিল, ঠিক একইভাবে গণমাধ্যম এগিয়ে এলে বিধিমালা দ্রুত প্রণয়ন হবে।
সড়ক দুর্ঘটনার বিভীষিকা থেকে উত্তরণের উপায় খুঁজতে হবে এবং দুর্ঘটনা রোধে কার্যকর পদক্ষেপ নিশ্চিত করতে হবে। সরকারি হিসাবেই গত এক বছরে দেশে সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যু বেড়েছে প্রায় ৩০ শতাংশ। তবে সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে সড়ক দুর্ঘটনার হার ও মৃত্যু বহুলাংশে কমিয়ে আনা সম্ভব। যার মধ্যে অন্যতম হলো দ্রুত বিধিমালা প্রণয়ন। দেশে সড়ক দুর্ঘটনার প্রধান কারণগুলো বিবেচনায় নিয়ে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণের বিকল্প নেই। সড়ক দুর্ঘটনা রোধে দুর্ঘটনার কারণগুলো আমলে নিয়ে সেই মোতাবেক কঠোর পদক্ষেপ নিশ্চিত করতে হবে এবং দ্রুত বিধিমালা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করতে হবে।
অ্যাডভোকেসি অফিসার, কমিউনিকেশন রোড সেফটি প্রকল্প, ঢাকা আহ্ছানিয়া মিশন
tarikul@amic.org.bd
