Logo
Logo
×

দৃষ্টিপাত

ছোট ছোট অভ্যাসের পরিবর্তন মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সহায়ক হবে

Icon

মো. শাহাদাত হোসেন

প্রকাশ: ১৫ নভেম্বর ২০২২, ০৬:০০ পিএম

প্রিন্ট সংস্করণ

বিশ্বে পর পর দুটি অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা কোভিড-১৯ ও রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে বিশ্ব অর্থনীতি রীতিমতো টালমাটাল। বাংলাদেশও তার ব্যতিক্রম নয়। ফলে মূল্যস্ফীতির হার শুধু ওপরের দিকে উঠছে। এছাড়া আমাদের ব্যবসায়ীদের চিরায়ত সুযোগসন্ধানী স্বভাব একে নিয়ন্ত্রণহীন বানিয়ে ফেলেছে। এ কারণে সাধারণ আমজনতার স্বাভাবিক জীবনযাত্রায় ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। মূল্যস্ফীতি মোকাবিলায় সবার সদিচ্ছার পাশাপাশি ঐকান্তিক প্রচেষ্টাও প্রয়োজন। শুধু সরকারের আন্তরিকতা দিয়ে এ সমস্যার সমাধান করা অসম্ভব। তাই সবাইকে নিজ নিজ অবস্থান থেকে এগিয়ে আসতে হবে। এ লক্ষ্যে আমাদের ছোট-খাটো অভ্যাস গঠনের পাশাপাশি কিছু অভ্যাস পরিত্যাগ করা বাঞ্ছনীয়-

১. আমাদের প্রধান খাদ্যশস্য হলো চাল। দেশের শতকরা ৯৫ ভাগ পরিবার ভাত রান্না করে ভাতের মাড় ফেলে দেয়। মাড় ফেলে দেওয়ার ভেতর দিয়ে মনের অজান্তেই আমরা ভাতের মধ্যে নিহিত শরীরের জন্য প্রয়োজনীয় উপাদানের সিংহভাগই ফেলে দেই। গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে, ভাতের মাড় ফেলে দেওয়ায় চালে বিদ্যমান ক্যালরির প্রায় ২০-২৫ ভাগ নষ্ট হয় এবং পুষ্টিগুণের প্রায় ৭০-৭৫ ভাগ নষ্ট হয়। আমাদের ধানের বার্ষিক চাহিদা প্রায় ২ কোটি ৬০ লাখ টন। সর্বনিু ২০ ভাগ ক্যালরির অপচয় রোধ করা গেলে প্রায় ৩৫ লাখ মেট্রিক টন চাল বাঁচানো যেত। তাই সবাইকে মাড় না গলিয়ে ভাত রান্নার চর্চা শুরু করতে হবে। এ প্রক্রিয়ায় রান্না করে ভাত খেলে মোটা হওয়ার কোনো ভয় থাকে না। উপরন্তু রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধির পাশাপাশি শারীরিক ও মানসিক সতেজতা বৃদ্ধি পায়। এর ফলে চিকিৎসা খরচও কমে আসবে।

২. আমাদের হোটেলগুলোতে ভাজা খাবারের বিকল্প খুব একটা দেখা যায় না। দেশের শতকরা ২৫ ভাগ মানুষ ভাজা খাবার খায় ধরে নিলেও দৈনিক ((১৭,০০,০০,০০০*২৬০)/ ৪)/১০০০ বা ১,১০,৫০,০০০ কেজি আমিষ জাতীয় খাবার অযথা নষ্ট হচ্ছে। ভাজাপোড়া খাবার খাওয়া বন্ধ করতে পারলে বার্ষিক ৪০৩ কোটি ৩২ লাখ ৫০ হাজার কেজি আমিষ জাতীয় খাবারের চাহিদা কমানো সম্ভব হতো। উন্নত দেশের জনগণ স্বাস্থ্য সচেতন হওয়ায় তারা সবকিছু হালকা সিদ্ধ ও ঝোল করে খেতে ভালোবাসে। ফলে পুষ্টিগুণ সমুন্নত থাকে। এ জন্য তাদের থেকে আমাদের দেশের মানুষ অধিক দুর্বল প্রকৃতির হয়ে থাকে। একজন পুরুষের জন্য দৈনিক ৫৫ গ্রাম আমিষ ও নারীর জন্য ৪৫ গ্রাম আমিষ দরকার অর্থাৎ গড়ে একজন ব্যক্তির প্রায় ৫০ গ্রাম আমিষ প্রয়োজন। গবেষণায় দেখা গেছে, দেশের স্বাদু পানির প্রতি ১০০ গ্রাম মাছে ১৮ গ্রাম আমিষ বা প্রোটিন বিদ্যমান আর ১০০ গ্রাম মুরগির মাংসে ২০ গ্রাম আমিষ বা প্রোটিন থাকে। অর্থাৎ ৫০ গ্রাম আমিষের চাহিদা পূরণের জন্য আমাদের দৈনিক গড়ে ২৬০ গ্রাম মাছ বা মুরগির মাংস খাওয়া প্রয়োজন। অথচ অভ্যাসগত কারণে আমাদের সর্বনিু ৫০০ গ্রাম বা আধা কেজি আমিষজাতীয় খাবার খেতে হয়।

৩. শরীরের বিভিন্ন প্রয়োজনীয় ভিটামিন ও মিনারেলের ঘাটতির জন্য প্রতিদিন শাকসবিজ খাওয়া বাঞ্ছনীয়। শাকসবজি ধোয়ার আগে কাটলে এর পুষ্টিগুণ পানির সঙ্গে চলে যায়; ফলে একই পরিমাণ পুষ্টির জন্য অধিক পরিমাণ শাকসবজি খেতে হয়। এ ছাড়া আমরা শাকসবজির দুর্গন্ধ দূর করার জন্য সবজি সিদ্ধ করে সেই পানি ফেলে দেই, যা আরও মারাত্মকভাবে পুষ্টির অপচয়। তা ছাড়া অল্প আঁচে ও অল্প তেলে রান্না করা হলে এর পুষ্টিগুণ সমুন্নত থাকে। অভ্যাসগত কারণে আমরা অতিরিক্ত হারে বিষাক্ত রাসায়নিকযুক্ত শাকসবজি খেয়ে প্রাণবন্ত হওয়ার পরিবর্তে অসুস্থ হয়ে যাচ্ছি। আমাদের কৃষি জমি অত্যন্ত কম বিধায় বাড়তি ফসলের চাহিদা মিটানোর জন্য কৃষকরা রাসায়নিক সার ব্যবহারের পাশাপাশি বিভিন্ন ধরনের কীটনাশক ব্যবহার করে। এসব খাওয়ায় ক্যানসারসহ বিভিন্ন জটিল রোগ সৃষ্টি হচ্ছে। আমাদের অভ্যাস পরিবর্তন করতে পারলে শাকসবজির ওপর চাপ কমত এবং এতে রাসায়নিক সার ও কীটনাশকের ব্যবহার হ্রাস পেত। রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি পাওয়ায় চিকিৎসা খাতে আমাদের ব্যয়ের পরিমাণও কমে আসত।

৪. আমদানিকৃত চাল ও গমের উৎকৃষ্ট বিকল্প হতে পারে সারা বিশ্বে জনপ্রিয় গোল আলু। আফ্রিকার অনেক দেশের প্রধান খাবার গোল আলু; বিশেষ করে কাসোভা। গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে, একজন মানুষের জীবন ধারণের জন্য যে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান দরকার, তার সবকিছুই আলুর ভেতর আছে। অর্থাৎ শুধু আলু খেয়েই একজন মানুষ বেঁচে থাকতে পারবে। যারা কায়িক পরিশ্রম করে না, শুধু তাদের আলু খেয়ে মোটা হওয়ার ভয় থাকে, অন্যদের নয়। বর্তমানে চাল ও গমের তুলনায় আলুর দাম অনেক কম। তা ছাড়া আলু খাওয়া বাড়িয়ে দিলে এটি আমাদের আমদানি করতে হবে না। কারণ, আমাদের দেশের আবহাওয়া আলু উৎপাদনের অত্যন্ত উপযোগী। উৎপাদন বেড়ে গেলে দাম পাওয়া যায় না বিধায় কৃষকরা আলুর উৎপাদন কম করে। উল্লেখ্য, একই পরিমাণ জমি থেকে ধান বা গমের তুলনায় আলুর উৎপাদন প্রায় দ্বিগুণের মতো এবং উৎপাদন খরচও কম।

৫. অপচয় বাঙালির জীবনযাত্রার নিত্যদিনের প্রতিচ্ছবি। বাসাবাড়ি থেকে শুরু করে বিয়ের দাওয়াত পর্যন্ত সব জায়গায় অপচয়ের ছড়াছড়ি। এ কঠিন সময়েও অপচয়ের ব্যাপারে কারও কোনো মাথাব্যথা নেই। আমাদের সামাজিক পরিবেশও এর জন্য দায়ী। যেমন-এখানে চাইলেও কেউ বড় মাছ পিস হিসাবে কিনতে পারে না এবং ফল এক কেজির কম কিনতে পারে না। হোটেলগুলোতে একসঙ্গে বেশি বেশি করে অর্ডার দিতে হয়। বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠানে অপচয়ের দৃশ্য ভীষণ বেদনার। আমাদের মানসিকতা এখনো অনেক নিুমানের। অনুষ্ঠানে খাবার কম পরিবেশন বা খাবারের ঘাটতি দেখা দিলে আমরা আপ্যায়নকারীকে কঞ্জুস বলতে এতটুকু দ্বিধা করি না। কখনো কখনো এটি মারামারি পর্যন্ত পৌঁছায়। এগুলো থেকে আমাদের সরে আসতে হবে।

যে কোনো পণ্যের মূল্য নির্ভর করে বাজারে এর চাহিদা ও সরবরাহের ওপর। বাজারে সরবরাহ বাড়লে বা চাহিদা কমে গেলে পণ্যের মূল্য স্বয়ংক্রিয়ভাবে হ্রাস পায়। ওপরের অভ্যাসগুলো গঠনের মাধ্যমে আমরা দুর্ভিক্ষ মোকাবিলার সঙ্গে সঙ্গে পণ্যের চাহিদা হ্রাস করতে সক্ষম হব। আর পণ্যের চাহিদা হ্রাস পেলে অবশ্যই দাম কমে আসবে। এতে সরকারি কোনো হস্তক্ষেপের প্রয়োজন হবে না; অর্থাৎ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে। ফলে পণ্যের অতিরিক্ত চাহিদা পূরণে আমদানি বাবদ বৈদেশিক মুদ্রা অপচয় করতে হবে না।

শিক্ষক ও কলামিস্ট

hossainshahadat1985@gmail.com

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম