Logo
Logo
×

দৃষ্টিপাত

আহ! মেট্রোরেল...

Icon

এস ডি সুব্রত

প্রকাশ: ২৭ ডিসেম্বর ২০২২, ০৬:০০ পিএম

প্রিন্ট সংস্করণ

যোগাযোগের ক্ষেত্রে আরেক ধাপ এগিয়ে মেট্রোরেলব্যবস্থার যুগে প্রবেশ করল বাংলাদেশ। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রাজধানীর গণপরিবহণের এই নতুন দিগন্তের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করবেন আজ। তবে সাধারণ যাত্রীদের মেট্রোরেলে উঠতে উদ্বোধনের পর আরও এক দিন অপেক্ষা করতে হবে; অর্থাৎ উদ্বোধনের পরদিন থেকে টিকিট কেটে যাত্রীরা মেট্রোরেলে চড়তে পারবেন। মেট্রোরেল উদ্বোধনের দিন দুই হাজার অতিথি নিয়ে অনুষ্ঠান হচ্ছে বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে। প্রধানমন্ত্রী প্রথম টিকিট কেটে স্বপ্নের মেট্রোরেলে চড়বেন।

জনবহুল ঢাকা শহরের সবচেয়ে বড় সমস্যা বোধহয় যানজট। এ যানজটের সমাধান করা যাচ্ছে না কোনোভাবেই। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাত ধরে নির্মিত স্বপ্নের এ মেট্রোরেল যোগাযোগ ব্যবস্থায় এক নতুন দিগন্তের উন্মোচন করবে এবং ঢাকার যানজট নিরসনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে বলে যোগাযোগ বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন। বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকায় মেট্রোরেল নির্মাণ ও পরিচালনার দায়িত্বে রয়েছে ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেড (ডিএমটিসিএল)। প্রথম দিকের পরিকল্পনা অনুযায়ী মেট্রোরেলে ১৬টি স্টেশন থাকবে; অর্থাৎ দুটি স্টেশনের মধ্যে গড় দূরত্ব হবে ১ দশমিক ৩৪ কিলোমিটার। বেশি স্টেশন রাখার ফলে বিপুলসংখ্যক যাত্রী এর সুফল ভোগ করবেন।

ঢাকা নগরী একটি অপরিকল্পিত শহর হিসাবেই গড়ে উঠেছে। এর ভেতরে চলাচলের জন্য যে যোগাযোগ অবকাঠামো, তা কোনোকালেই আন্তর্জাতিক মানের কাছাকাছিও ছিল না। এর পাশাপাশি আবাসিক ও বাণিজ্যিক অবকাঠমোগুলোকে অক্ষত রেখে একটি পরিকল্পিত সড়ক ব্যবস্থা গড়ে তোলা প্রায় অসম্ভব ছিল। তারপরও বিদ্যমান পরিবহণ অবকাঠামোকে বহাল রেখেই চলে বিড়ম্বনা লাঘবের প্রচেষ্টা। এ প্রচেষ্টার অংশ হিসাবে ২০১২ সালে বাংলাদেশ সরকার মেট্রোরেল প্রকল্প হাতে নেয়। জাপানের উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা জাইকার সঙ্গে ঋণচুক্তি হয় ২০১৩ সালে। মূল কাজ শুরু হয় ২০১৭ সালে। এ প্রকল্পের আওতায় উত্তরার দিয়াবাড়ি থেকে মতিঝিল পর্যন্ত প্রকল্পের কাজ চলছে। এখন পর্যন্ত সম্পন্ন হয়েছে দিয়াবাড়ি থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত প্রথম পর্বের কাজ, যা আজ উদ্বোধন হচ্ছে।

প্রথম পর্বে এ অংশের দূরত্ব ১১ দশমিক ৭৩ কিলোমিটার। এ অংশে ৯টি স্টেশন আছে; সেগুলো হলো-উত্তরা দিয়াবাড়ি, উত্তরা সেন্টার, উত্তরা দক্ষিণ, পল্লবী, মিরপুর-১১, মিরপুর-১০, কাজীপাড়া, শেওড়াপাড়া এবং আগারগাঁও। এর বাইরে নির্মাণাধীন আগারগাঁও থেকে মতিঝিল পর্যন্ত স্টেশন হবে ৭টি; যেগুলো হচ্ছে-বিজয় সরণি, ফার্মগেট, কাওরান বাজার, শাহবাগ, টিএসসি, প্রেস ক্লাব ও মতিঝিল। এ পর্বের কাজ আগামী বছরের শেষদিকে সম্পন্ন হওয়ার কথা রয়েছে এবং মতিঝিল থেকে কমলাপুর পর্যন্ত ১ দশমিক ১৬ কিলোমিটার মেট্রোরেলের কাজ সম্পন্ন হতে ২০২৫ সাল পর্যন্ত লেগে যেতে পারে।

ইতোমধ্যে বহুল কাক্সিক্ষত মেট্রোরেলের ভাড়া নির্ধারণ করা হয়েছে। প্রতি কিলোমিটার ৫ টাকা আর সর্বনিম্ন ভাড়া ২০ টাকা করা হয়েছে। এছাড়া রাজধানীর উত্তরা থেকে কমলাপুর পর্যন্ত ১০০ টাকা ভাড়া নির্ধারণ করা হয়েছে। যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধাদের ভাড়া মওকুফ থাকবে। সর্বনিম্ন ২০ টাকা ভাড়া দিয়ে সর্বোচ্চ দুই স্টেশন পর্যন্ত যাতায়াত করা যাবে। এক স্টেশন পর নেমে গেলেও ২০ টাকা ভাড়া দিতে হবে। মেট্রোরেলে ৩৫ মিনিটে উত্তরা থেকে মতিঝিল যাওয়া যাবে বলে প্রকল্প কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।

বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতোই প্রথমদিকে মেট্রোরেলের যাত্রী সংখ্যা ধারণক্ষমতার চেয়ে কম থাকবে। পর্যায়ক্রমে যাত্রীর সংখ্যা বাড়ানো হবে। উদ্বোধনের পর দুই থেকে তিন মাসের মধ্যে ট্রেনগুলো পূর্ণ যাত্রী নিয়ে চলবে। প্রাথমিক অবস্থায় সকালে কিছুক্ষণ, আবার বিকালে কিছুক্ষণ ট্রেন চলবে। তার মানে হলো ট্রেন চলাচলের সংখ্যা কম থাকবে; সূত্রমতে সে সংখ্যাটা হবে পাঁচ। যাত্রীদের ওঠানামা ও আসনে বসা-এসব বিষয়ে অভ্যস্ত ও পরিচিত করাতে স্টেশনে ট্রেন কিছুটা বাড়তি সময় দাঁড়াবে। কিন্তু পরে ট্রেনের সংখ্যা বাড়বে এবং স্টেশনে দাঁড়ানোর সময় কমে আসবে। ট্রেনটি চলবে সর্বোচ্চ ১০০ কিলোমিটার গতিতে। সে হিসাবে আগারগাঁও থেকে উত্তরার দিয়াবাড়ি পর্যন্ত যেতে সময় লাগবে মাত্র ২০ মিনিট। ধারণা করা হচ্ছে, পরে এ যাত্রার সময় ১৭ মিনিটে নেমে আসবে।

মেট্রোরেল চলাচলে আশপাশে তীব্র কম্পনের সৃষ্টি হবে কিনা, প্রশ্ন উঠেছে। এ বিষয়ে বুয়েটের অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ মিজানুর রহমান বলেন, মেট্রোরেল প্রকল্পটিতে কম্পন নিয়ন্ত্রণে বিশেষ ব্যবস্থা থাকবে। মেট্রোরেলের লাইনের নিচে এমএসএস (ম্যাস স্প্রিং সিস্টেম) থাকবে। ম্যাস স্প্রিং সিস্টেমে বিশেষ ধরনের বিয়ারিং থাকে, যার কাজ হলো রেললাইনে যে কম্পন তৈরি হয়, তা শোষণ করা। এর ফলে ট্রেন চলাচলের সময় আশপাশে তেমন একটা কম্পন অনুভূত হবে না। অধ্যাপক ড. মিজানুর রহমান আরও বলেন, মেট্রোরেল প্রকল্পটিতে শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণেরও বিশেষ ব্যবস্থা থাকবে। মেট্রোরেলের ক্ষেত্রে শব্দ তৈরির মাত্রা সাধারণ ট্রেনের চেয়েও কম, যা মানবদেহের জন্য সহনীয়। উল্লেখ্য, ৮৫ ডিবিএ মাত্রার শব্দ ৮ ঘণ্টা পর্যন্ত মানবদেহের জন্য সহনীয়। এ ছাড়াও মেট্রোরেলের চলাচল পথে কিছু এলাকায় শব্দ শোষণকারী দেয়াল থাকবে। এ দেয়ালের ফলে শব্দের মাত্রা আরও কমে আসবে।

মেট্রোরেল প্রকল্পটিতে বিদ্যুৎচালিত আধুনিক ট্রেনে যাত্রীরা চলাচল করবেন। ভিভিভিএফ (ভেরিয়েবল ভোল্টেজ ভেরিয়েবল ফ্রিকোয়েন্সি) ইনভার্টার সিস্টেমে চালিত ট্রেন চলার সময় অনেক কম শব্দ তৈরি করে, যা শব্দদূষণের পর্যায়ে পড়ে না। মেট্রোরেল প্রকল্পটি চালু হলে ব্যক্তিগত গাড়ি ও বাস ব্যবহারকারী অনেক যাত্রী মেট্রোরেলে যাতায়াত করবেন। এর ফলে বায়ুতে কার্বন ডাই-অক্সাইড নিঃসরণের পরিমাণ অনেক কমবে। বাসের ক্ষেত্রে বায়ুতে কার্বন ডাই-অক্সাইড নিঃসরণের পরিমাণ ৫১ গ্রাম বা যাত্রী-কি.মি; ব্যক্তিগত গাড়ির ক্ষেত্রে এর পরিমাণ ১৬৮ গ্রাম বা যাত্রী-কি.মি.। অন্যদিকে মেট্রোরেল যেহেতু বিদ্যুৎচালিত, তাই বায়ুতে কার্বন ডাই-অক্সাইড নিঃসরণের পরিমাণ নেই বললেই চলে। এসব বিবেচনায় মেট্রোরেল অনান্য পরিবহণ ব্যবস্থার চেয়ে অনেক বেশি পরিবেশবান্ধব, এতে কোনো সন্দেহ নেই।

রাজধানী ঢাকার যানজট সমস্যা এতটাই জটিল হয়ে উঠেছে যে, গণপরিবহণ হিসাবে সাধারণ বাস দিয়ে সমস্যার সমাধান করা সম্ভব নয়। এ অবস্থায় যানজট সমস্যা সমাধানের সবচেয়ে বড় বিকল্প হচ্ছে মেট্রোরেল। বিশ্বের সর্বাধুনিক সুবিধাসম্পন্ন দ্রুতগতির যোগাযোগ ব্যবস্থা এই মেট্রোরেল প্রকল্প রাজধানীর যানজট সমস্যা নিরসনের পাশাপাশি যোগাযোগ ব্যবস্থার ক্ষেত্রে বৈপ্লবিক পরিবর্তন বয়ে আনবে। নিত্যদিনের অসহনীয় যানজটের সীমাহীন দুর্ভোগ থেকে মুক্ত করে নগরবাসীর দৈনন্দিন জীবনের স্বস্তির সুবাতাস এনে দিবে মেট্রোরেল, ভাবতেই ভালো লাগছে।

কবি ও প্রাবন্ধিক, সুনামগঞ্জ

sdsubrata2022@gmail.com

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম