Logo
Logo
×

দৃষ্টিপাত

ফ্লোর প্রাইসই কি শেয়ারবাজার স্থিতিশীলতার একমাত্র অন্তরায়?

Icon

মোহাম্মদ মনিরুল ইসলাম

প্রকাশ: ০৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

আমরা এমন একসময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি, যেখানে দুঃসংবাদের কোনো শেষ নেই; বিশেষ করে করোনা থেকে শুরু করে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে তরতর করে এগিয়ে চলা বিশ্ব অনেকটা গতি হারিয়েছে। সদ্য প্রকাশিত গ্লোবাল ইকোনমিক প্রসপেক্টস বা বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সম্ভাবনা শীর্ষক এক প্রতিবেদনে বিশ্বব্যাংক বিশ্ব অর্থনীতির যে চিত্র তুলে ধরেছে, তা সত্যিই হতাশার। দুর্দশার এক কঠিন সময় আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে। বিশ্বব্যাংকের পূর্বাভাস অনুযায়ী, ২০২৩ সালে বিশ্ব অর্থনীতির প্রবৃদ্ধির হার দাঁড়াতে পারে ১ দশমিক ৭ শতাংশ। অথচ গত জুনে এই পূর্বাভাস ছিল ৩ শতাংশ; অর্থাৎ বিশ্ব অর্থনীতি খুবই ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থানে আছে এবং এটি যে কোনো সময় পা হড়কে মন্দায় পড়ে যাওয়ার আশঙ্কা আছে। ফলে বিশ্বজুড়ে জনমানসে তৈরি হয়েছে এক অনিশ্চয়তা; বিশেষ করে বাংলাদেশের মতো এত ঘনবসতিপূর্ণ উচ্চ বৈষম্যের অসচেতন দেশে জনমনে উদ্বেগের দানা বাধা খুব স্বাভাবিক। তাই তো আশা-নিরাশার এই কুয়াশাচ্ছন্ন গুমোট পরিবেশে গুজবের ডালপালা মেলে সহজেই। আর গুজব এমনই এক জিনিস, যা বাতাসের আগে ধায়।

কারও এ কথা অস্বীকার করার ধৃষ্টতা আছে বলে মনে হয় না যে-আমাদের রাষ্ট্র কাঠামোতে প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতা নেই; বিশেষ করে অর্থনীতির চালিকাশক্তি ব্যাংকিং খাতে প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতা বা অরাজকতা দিনদিন দৃশ্যমান হচ্ছে। ব্যাংকিং ব্যবস্থায় আস্থা কমে আসছে ক্রমাগত। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে দেউলিয়া হয়ে যাওয়ার গুজব। এতে শুরু হয় সংশ্লিষ্ট ব্যাংক থেকে টাকা উত্তোলনের হিড়িক। বেগতিক পরিস্থিতি সামাল দিতে সংশ্লিষ্ট মহলের বেশ বেগ পেতে হয়েছে। পরিস্থিতি এ যাত্রায় নিয়ন্ত্রণে এলেও যা রটে, তা যে ঘটে না বা ঘটবে না; সে বিষয়ে সর্বদা সতর্কতামূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করাই শ্রেয়। গুজবের সবচেয়ে উর্বর জায়গা হচ্ছে অর্থ সংস্থানের আরেক উৎস শেয়ারবাজার, যেখানে অতি সহজে বাম্পার ফলন পাওয়া যায়। মুহূর্তেই সব গতিশীলতাকে স্থবির করে দেয়। বিনিয়োগকারী দিদ্বিদিক, তটস্থ, হিতাহিত জ্ঞানশূন্য-বিবেচনার ঝুলি শিকেয় তুলে, সচেতন মনে গুজবকে কাঁধে নিয়ে মনের সুখে ঘুরে বেড়ায়। আর অবচেতন মনে এই ভার অন্যকে দিয়ে বেড়ায়। ফলে বাজার হয়ে ওঠে গুজবময়, অস্থিতিশীল।

এ গুজবই একসময় শেয়ারবাজারে গজবে পরিণত হয়। হামেশাই এমনই পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছে আমাদের শেয়ারবাজার। যখনই বাজার ঘুরে দাঁড়ানোর কোনো পথ খুঁজে পায়, তখনই মূর্তিমান আতঙ্ক হয়ে দাঁড়ায় কোনো না কোনো গুজব। সাম্প্রতিক সময়ে শেয়ারবাজারে এমনই এক গুজবের বিষয়বস্তু হচ্ছে-ফ্লোর প্রাইস। ফ্লোর প্রাইস তুলে ফেলা হবে কী হবে না, এটা বিনিয়োগকারীদের চিন্তার বড় বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রথমে ভেবে দেখা দরকার, ফ্লোর প্রাইস কেন আরোপ করা হয়েছে এবং কাদের জন্য? বিভিন্ন প্রতিকূল পরিবেশে শেয়ারদর যখন একেবারে তলানিতে এবং শেয়ারবাজারের সূত্রমতে, বাজারের নিজস্ব শক্তিতে ঘুরে না দাঁড়িয়ে উলটো আচরণ করে অর্থাৎ সূচক যখন বারবার সূচনালগ্নের অবস্থানে ফিরে যায়, তখন নিয়ন্ত্রক সংস্থা নিরুপায় হয়ে ফ্লোর প্রাইস আরোপ করে। এ যাবৎকালে শেয়ারবাজারের ইতিহাসে এবার নিয়ে দুবার ফ্লোর প্রাইস বেঁধে দেওয়া হয়। যদিও এটি একটি সাময়িক সমাধান।

ফ্লোর প্রাইস বেঁধে দেওয়ার মাধ্যমে নিয়ন্ত্রক সংস্থা-আস্থা হারিয়ে ফেলা হতাশ বিনিয়োগকারীদের মাঝে আস্থা ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করে। তারা নিশ্চয়তা দেয়, শেয়ারদর এর নিচে আর নামবে না। এটি দৃশ্যত বিনিয়োগকারীদের সুরক্ষা দেওয়ার জন্য। ফলে সূচকও একটি নির্দিষ্ট জায়গায় আটকে যায়। ধারণা করা হয়, যারা সূচক দেখে বিনিয়োগ করে, এর ফলে তারা আবার বিনিয়োগে ফিরে আসবে। বাজার চাঙা হবে। কিন্তু প্রকৃত চিত্র বলছে অন্য কথা-বছরজুড়েই অস্থিরতায় কেটেছে শেয়ারবাজার। ২০২২ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি ডিএসইএক্স সূচক ছিল ৭ হাজার ২৪ পয়েন্ট। লেনদেন হয় ১ হাজার ২৬১ কোটি টাকা। সেই অবস্থান থেকে সূচকের টানা ক্রমাবনতি হয়ে ২৯ ডিসেম্বর সূচক দাঁড়ায় ৬ হাজার ২০৬ পয়েন্টে। লেনদেনেরও একই হাল ৩৪৫ কোটি টাকা। অথচ গত বছরের ৪ সেপ্টেম্বর লেনদেন হয়েছে ২ হাজার ২৯৬ কোটি টাকা। আবার নতুন বছরের ২ জানুয়ারি লেনদেন হয় ১৪৫ কোটি টাকা। এভাবেই চলছে আমাদের শেয়ারবাজার। এটি নতুন কিছু নয়। নতুন বছরেও দরপতন অব্যাহত আছে। হাজার কোটি টাকার লেনদেন নেমেছে ২০০ কোটি টাকার আশপাশে। বাজারে চরম তারল্য সংকট চলছে। কারণ বিনিয়োগকারীরা লেনদেনে অংশ নিচ্ছেন না। আরও দরপতনের অপেক্ষা করছেন।

বাজারে প্রায় ৪০০ কোম্পানি ও মিউচুয়াল ফান্ড তালিকাভুক্ত। এর মধ্যে অনেক কোম্পানি ভালো মৌলভিত্তির, যেখানে যে কোনো বিবেচনায় বিনিয়োগ করা যায়। ডিভিডেন্ড ইল্ড অত্যন্ত আকর্ষণীয়। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে-এসব কোম্পানিও ফ্লোর প্রাইসে পড়ে রয়েছে। আর লেনদেন হচ্ছে হাতেগোনা নির্দিষ্ট ২৫ থেকে ৩০টি কোম্পানির। বিনিয়োগকারীদের মধ্যে অনিশ্চয়তা কাজ করছে। ফলে মোটের ওপর বাজারে এক ধরনের অচলাবস্থা চলছে। এ থেকে নিষ্কৃতির উপায় খুঁজে পাচ্ছে না সংশ্লিষ্টরা। কেউ কেউ বলছেন, ফ্লোর প্রাইসের কারণে বাজারে লেনদেন হচ্ছে না। বড় কোম্পানির শেয়ারে কোনো মুভমেন্ট নেই। ছোট কোম্পানির শেয়ার দিয়ে একটি কৃত্রিম সূচক দেখানো হচ্ছে। এভাবে ফ্লোর প্রাইস দিয়ে দিনের পর দিন বাজার অকার্যকর করে রাখার কোনো মানে হয় না। তাই তো অনেকের মতে, ফ্লোর প্রাইস তুলে নেওয়া ১৬৯টি কোম্পানির নিচের দিকে যে ১ শতাংশ ছাড় দেওয়া হয়েছে তা ২ থেকে ৩ শতাংশ করে পর্যবেক্ষণ করা যায় কি না। পাশাপাশি ব্লক মার্কেটে শেয়ার কেনাবেচার পরিমাণ ৫ লাখ টাকার পরিবর্তে ২ লাখ নির্ধারণ করা। কারণ, যাদের পুঁজি কম তারাও যেন লেনদেন করতে পারে। ফলে লেনদেন বাড়বে।

অনেকের যুক্তি-সারা বিশ্বই তো যুদ্ধের উত্তাপে পুড়ছে। কিন্তু কোথাও তো ফ্লোর প্রাইস দেওয়া হয়নি অথবা এ জাতীয় ঠেকনা দিয়ে শেয়ারবাজার ঠেকিয়ে রাখার কোনো একাডেমিক ভিত্তি নেই। শেয়ারবাজারে চাহিদা ও সরবরাহ মুক্তভাবে ওঠানামা করতে দেওয়া উচিত। ধরে নিলাম, কথাগুলো সবই যৌক্তিক। এ নজিরবিহীন ফ্লোর প্রাইসই যত সমস্যার মূল। তবে যারা যুদ্ধ করছে, সেই রাশিয়ার শেয়ারবাজার এখন ঘুরে দাঁড়িয়েছে অথবা দেউলিয়া হওয়া শ্রীলংকার বাজারও স্বাভাবিকের পথে। সমস্যা যত বাংলাদেশে। আমাদের শেয়ারবাজারে অস্থিতিশীলতা একটি রেওয়াজে পরিণত হয়েছে। আজ ফ্লোর প্রাইস তুলে নেওয়া হলে, সূচক যে আবার ৩ হাজারের ঘরে আসবে না, সেই নিশ্চয়তা কে দেবে? আমরা কি প্রতিবছর নতুন করে শুরু করব? শেয়ারবাজারের এ ন্যক্কারজনক ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি আর কত?

পুঁজিবাজার বিশ্লেষক

monirulislammi888@gmail.com

 

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম