Logo
Logo
×

দৃষ্টিপাত

নবাবদের দিলকুশার বাগানবাড়ি থেকে বঙ্গভবন

Icon

সোহেল সানি

প্রকাশ: ১৫ মার্চ ২০২৩, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

১৯০৫-২০২৩। ব্রিটিশ-ভারত শাসনামলে ঢাকার দিলকুশার বাগানবাড়ি থেকে লাটভবন। পাকিস্তান শাসনামলে লাটভবন থেকে গর্ভনর হাউজ। স্বাধীন বাংলাদেশে গভর্নর হাউজ থেকে বঙ্গভবন। অর্থাৎ ছোটলাট লেফটেন্যান্ট গভর্নরের বাসভবন থেকে মহামান্য রাষ্ট্রপতির বাসভবন। এ বাসভবনের বাসিন্দা হিসাবে নাম লিখিয়েছেন ছোটলাট লেফটেন্যান্ট গভর্নর স্যার ব্যামফিল্ড ফুলার থেকে মহামান্য রাষ্ট্রপতি মো. আব্দুল হামিদ। আর কদিন পরেই বঙ্গভবন বরণ করে নিতে যাচ্ছে নবনির্বাচিত রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনকে।

বঙ্গভবন কখনো হয়েছে ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু; আবার কখনো আলংকারিক মর্যাদার প্রতীক। ১৯০৫ সালের ২০ জুলাই ব্রিটিশ পার্লামেন্ট ‘বঙ্গভঙ্গ’ আইন পাসের মাধ্যমে বাংলাকে ভাগ করে সৃষ্টি করেছিল পূর্ববঙ্গ ও আসাম নামে একটি প্রদেশ, যার আয়তন হয় ১ লাখ ১১ হাজার ৫৬৯ বর্গমাইল। ১৯০৫ সালের ১৬ অক্টোবর প্রদেশটির কার্যক্রম শুরু হয়। তখন শাসনকর্তা লেফটেন্যান্ট গভর্নর ও তার কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য প্রয়োজন হয় সুরক্ষিত অফিস ও বাসা-বাড়ির। এর পরিপ্রেক্ষিতে ভারত ভাইসরয় লর্ড কার্জন ঢাকার নবাব স্যার সলিমুল্লাহর দিলকুশা বাগানবাড়িটি পছন্দ করেন এবং বার্ষিক ১১ হাজার টাকায় স্থায়ীভাবে তা লিজ নেন। আর এখানেই নির্মাণ করা হয় লেফটেন্যান্ট গভর্নরের জন্য বাসভবন। তাকে ছোটলাট বলে অভিহিত করা হতো বলে অচিরেই এর নাম হয়ে ওঠে ‘লাটভবন’। পরে ‘গভর্নর হাউজ’। পাকিস্তানের আত্মসমর্পণের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পর ১৯৭২ সালের ১২ জানুয়ারি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান গভর্নর হাউজের নামকরণ করেন ‘বঙ্গভবন’।

ছোটলাটের বসবাসের জন্য সে সময় ইস্পাতের ফ্রেমের ওপর সেগুনকাঠ দিয়ে বাড়িটি নির্মাণ করা হয়েছিল। ১৯৬১ সালে ঝড়ে ক্ষতিগ্রস্ত হলে পুরো কাঠের বাড়ির আদলে ‘মঈনউদ্দীন চিশতী অ্যান্ড ব্রাদার্স’ নামের একটি স্থাপত্য প্রতিষ্ঠান বর্তমান ভবনটির নকশা প্রণয়ন করে তা নির্মাণ করে। মূল ভবনের সঙ্গে প্রস্তরখণ্ড সংযুক্ত করা হয়, যাতে বাংলা, ইংরেজি ও আরবি হরফে পবিত্র কুরআনের দুটো আয়াত খোদাই করা হয়; এক-‘প্রতিপালক প্রভু আমার, ইহাকে নিরাপদ শহরে পরিণত কর’ এবং অপর আয়াতটিতে লেখা রয়েছে- ‘শান্তি হউক তোমাদের উপর, তোমরা পবিত্র জীবনযাপন করিয়াছ; সুতরাং চিরকালের জন্য (জান্নাতে) প্রবেশ কর।’

স্বাধীন সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ অভ্যুদয়ের পর থেকে বঙ্গভবনের সুউচ্চ গোলাকার চূড়ার সামনে প্রতিদিন সূর্য উদয়ের সঙ্গে সঙ্গে দুটো পতাকা উত্তোলিত হয় এবং সূর্য অস্তমিত হওয়ার আগেই আনুষ্ঠানিকভাবে তা নামিয়ে ফেলা হয়; একটি বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা এবং অন্যটি মহামান্য রাষ্ট্রপতির পতাকা। বঙ্গভবনে রয়েছে দৃষ্টিনন্দিত এক একটি দরবার হল, যে হলে মন্ত্রিসভার সদস্যদের শপথবাক্য পাঠ করান মহামান্য রাষ্ট্রপতি। এর পূর্বপাশে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের জন্য রয়েছে একটি মঞ্চ।

বঙ্গভবনের পশ্চিমাংশ ঢাকা সিটি করপোরেশনের কাছে ছেড়ে দেয়া হয়। তারপরও জমির পরিমাণ ৫৪ একর ৫০ শতাংশ। ১৮৬৬ সালে ইংরেজ ইএফ স্মিথের কাছ থেকে নবাব আবদুল গণি এ জমি কিনেন এবং বড় পুত্র খাজা আহসানউল্লাহর ব্যবহারের জন্য একটি বাগানবাড়ি তৈরি করেন, যার নামকরণ করা হয় ‘দিলখুশা বাগানবাড়ি’। ১৮৭৩ সালে আহসানউল্লাহ বড় একটা দিঘি খনন করেন এবং দিঘিতে শান বাঁধানো ঘাটের ওপর একটা ‘হাওয়াখানা’ তৈরি করেন, এখনো দানা দিঘি নামে যেটা পরিচিত। বর্তমানে বঙ্গভবনের মূল গেটে দাঁড়িয়ে সোজা পূর্বদিকে তাকালে দেখা যাবে-মূল ভবনের গেট, ক্রেডিনসিয়াল হল গেট, রাষ্ট্রপতির বাসভবন গেট এবং বাসভবন থেকে পূর্বদিকে বেরিয়ে যাওয়ার গেট একই সমান্তরালে নির্মিত। বঙ্গভবন কমপ্লেক্সে আছে পঁয়ষট্টিটি বিল্ডিংয়ের মেঝে, যেগুলোর আয়তন বিয়াল্লিশ হাজার তিনশত পঁচাত্তর বর্গমিটার। মূল ভবনের মেঝের আয়তন নয় হাজার ছয়শ ছেষট্টি বর্গমিটার। বঙ্গভবন কমপ্লেক্সের অভ্যন্তরে চব্বিশ হাজার বর্গমিটার সুন্দর রাস্তা রয়েছে। সবুজ উন্মুক্ত এলাকা আছে প্রায় আটচল্লিশ একর। বঙ্গভবনের উত্তর পাশের সবুজ চত্বরে বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় অনুষঙ্গ; যেমন-স্বাধীনতা ও বিজয় দিবসের সংবর্ধনার আয়োজন করা হয়। সবুজ চত্বরের পশ্চিম পাশে নবনিযুক্ত রাষ্ট্রদূতকে গার্ড অব অনার প্রদান করা হয়। প্রাচীন ‘মানুক হাউজ’ এখন তোষাখানা হিসাবে ব্যবহৃত হয়। এ তোষাখানায় অনেক মূল্যবান সামগ্রী আছে। এসব সামগ্রী বিভিন্ন দেশের সরকার ও রাষ্ট্রপ্রধানের কাছ থেকে প্রাপ্ত। বঙ্গভবন কমপ্লেক্সের মধ্যে রয়েছে কিচেন বিল্ডিং, মেশিন রুম, স্কোয়াশ কোর্ট বিল্ডিং, বিমান আক্রমণ থেকে নিরাপদে থাকার বিল্ডিং, টেনিসকোর্ট, পিজিআর ও পুলিশ ব্যারাক, ব্যাংক, পোস্ট অফিস, মসজিদ, অভ্যর্থনা কক্ষ, ইলেকট্রিক সাব স্টেশন, গ্যারেজ, পেট্রোল পাম্প, গণপূর্ত অফিস, নার্সারি ও আরবারি কালচার অফিস, টেলিফোন অফিস ইত্যাদি। মূল বঙ্গভবন কমপ্লেক্সের বাইরে কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের জন্য তিনটি পৃথক আবাসিক এলাকাও আছে।

তিন তলাবিশিষ্ট বঙ্গভবনের মূল ভবনটি দেখতে খুবই সুন্দর ও জাঁকালো। গাড়ি থামানোর জায়গায় সব সময় ডিউটিরত থাকেন রাষ্ট্রপতির গার্ড রেজিমেন্টের সদস্যরা। মূল গেটেও তারা ডিউটিরত থাকেন। গাড়ি থেকে নেমেই বারান্দা, দুপাশে দুটো গ্রান্ডফাদার ঘড়ি। এ দুটো ঘড়ির মালিক ছিলেন নাটোরের জমিদার। এখনো ঘড়ি দুটি সচল। মূল ভবনটি তিন ভাগে বিভক্ত। প্রথমে রাষ্ট্রপতির অফিস, কর্মকর্তাদের অফিস এবং রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সাক্ষাৎ প্রার্থীদের জন্য দুটি সজ্জিত কামরা। এছাড়া মন্ত্রিসভা কক্ষ ও বিশিষ্ট অতিথিদের বসার স্থান। মধ্যম অংশে দরবার হল, অভ্যর্থনা হল, গ্যালারি কক্ষ, স্টেট ডাইনিং হল ও ক্রেডিনসিয়াল হল। তৃতীয় অংশে রাষ্ট্রপতির বাসভবন। দোতালায় কর্মকর্তাদের বসার স্থান এবং তিন তলায় রাষ্ট্রীয় অতিথিদের খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা। ব্রিটিশ আমলের কিছু রুপার কাটলারি এখনো আছে, যা দিয়ে একসঙ্গে সত্তরজনের ডিনারের ব্যবস্থা করা যায়। এসব কাটলারি ও ক্রোকারিজের মধ্যে আছে ক্যান্ডেল স্ট্যান্ড, ছুরি, ককটেল, স্পুন, ফিশ নাইফ, বাটার নাইফ, পিপার পট, ট্রে, ফ্রুট নাইফ ইত্যাদি। হাতির দাঁতের বাঁটসহ কাঁটাচামচ ও বতরদানি এখনো আছে। গভর্নরের মনোগ্রাম সংবলিত টি ও কফি সেটও রয়েছে। রুপার তলোয়ার অব্যবহৃত অবস্থায় রয়েছে। কাটলারি ও ক্রোকারিজগুলো পলিশ করে রাখেন ‘সিলভারম্যান’ পদে থাকা একজন।

রাষ্ট্রপতির অফিসে আসা-যাওয়ার সময় অধিক আওয়াজ ও শক্তিসম্পন্ন একটা কলিং বেল বাজানো হয়। কার্পেটের পরিবর্তে এখন মেঝেতে টাইলস বসানো। নতুন করে অত্যাধুনিক বাথটাব নির্মাণ করা হয়েছে। মূলগেটে রয়েছে দর্শনার্থীদের বসার ব্যবস্থা। শাহজালাল দখিনী, চন্দন শাহ ও নওগাজী মাজারের (শহিদ গম্বুজ) সংস্কার করা হয়েছে। বঙ্গভবনের ইতিহাসে চোখ রাখলে বিস্ময়কর নানারকম ঘটনারও সাক্ষাৎ মেলে। বঙ্গভবনে নিম্নপদস্থ কতগুলো পদ রয়েছে এবং এক্ষেত্রে মোগল, ইংরেজ ও পাকিস্তানি আমলের রীতিনীতিগুলো এখনো পালন করা হয়। লশকর, খালাশি, মশালচি, চাপরাশি, চোপদার জমাদার ও খেদমতগার-পদগুলো মোগল আমলের জমিদারি ঐতিহ্যেরই সারথি। ব্রিটিশ বা ইংরেজ আমলে সৃষ্টি করা হয় বাটলার, প্যান্ট্রিম্যান, কুক, কুকমেট, মার্কেট ম্যান, টেনিস মার্কার, টেনিস স্পিকার ও স্টুয়ার্ট ইত্যাদি। পাকিস্তান আমলে ‘আবদার’ নামে একটি পদ সৃষ্টি করা হয়। এ পদে নিয়োজিত ব্যক্তির কাজ হলো পানীয় সরবরাহ করা। এখনো উপরোক্ত পদগুলোর অস্তিত্ব রয়েছে।

বঙ্গভবনের সীমানা আগে আরও বড় ছিল। এর সীমা ছিল বর্তমান গুলিস্তান ভবনের পূর্বপাশের রাস্তা পর্যন্ত বিস্তৃত। বর্তমান বঙ্গভবনের পশ্চিমাংশের বিরাট এলাকায় গড়ে তোলা হয়েছিল ‘আইউব শিশু পার্ক।’ উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থানের সময় ঢাকার নবকুমার ইনস্টিটিউশনের ছাত্র মতিউর রহমান ও ছাত্রনেতা আসাদুর রহমান আসাদ পুলিশের গুলিতে শহিদ হলে বিক্ষুব্ধ ছাত্রজনতা ‘আইউব গেট’-এর নাম ‘আসাদ গেট’ এবং ‘আইউব শিশুপার্ক’-এর নাম ‘মতিউর শিশু পার্ক’ রাখে। ২০০০ সালে ওখানে গড়ে ওঠে ‘মহানগর নাট্যমঞ্চ। ওখানে একটা প্রাচীন পুকুরের অস্তিত্ব রয়েছে। মীর মুকিমের বাড়ি ছিল ওখানে। ওই পুকুরের পূর্বপাশে দুটো রাস্তা উত্তর-দক্ষিণ যাতায়াতের জন্য। ওই রাস্তা দুটির পূর্ব পাশে বেশকিছু এলাকাজুড়ে মূল্যবান গাছ এবং তারপরই সীমানা প্রাচীর।

বর্তমান বঙ্গভবনের মূল গেটের উত্তর বরাবর আগে ছিল পাঁচটি কাঠের বাড়ি, উত্তর-দক্ষিণ লম্বা। এখানে উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা বাস করতেন। গভর্নরের সচিব, সামরিক সচিব, এডিসি এখানেই বাস করতেন। দানা দিঘির পশ্চিম পাশে সচিব ও সামরিক সচিবের জন্য দুটি বাড়ি তৈরি করা হয়েছিল। উত্তর-পশ্চিম কোণে নির্মাণ করা হয়েছিল এডিসি ও অন্যান্য কর্মকতার জন্য বাড়ি। ওই কাঠের বাড়িগুলোর অস্তিত্ব এখন নেই। গভর্নর মালিক ফিরোজ খান নূনের স্ত্রী লেডি ভিকারুননিসা নূন রমনায় ভিকারুননিসা নুন স্কুলই শুধু নয়, বর্তমান বঙ্গভবনের উত্তর-পশ্চিম কোণে ভেতরে একটি প্রাইমারি স্কুল প্রতিষ্ঠা করেছিলেন মালি, খালাসি, দর্জি, ক্ষৌরকার, বাটলার ইত্যাদি নিম্নপদস্থদের ছেলেমেয়ের লেখাপড়ার জন্য। বঙ্গভবনের পূর্ব পাশে রয়েছে চন্দন শাহর মাজার।

বঙ্গভবন কখনো ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু আবার কখনো আলংকারিক মর্যাদার কেন্দ্র হলেও নিঃসন্দেহে এটি বাঙালির ইতিহাস, ঐতিহ্য ও আভিজাত্যের প্রতীক।

সিনিয়র সাংবাদিক, কলামিস্ট ও ইতিহাস গবেষক

 

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম