Logo
Logo
×

দৃষ্টিপাত

অফুরান পিতৃস্নেহ

Icon

গোলাম ছারওয়ার চৌধুরী

প্রকাশ: ২১ জুন ২০২৩, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

বাবা প্রয়াত হয়েছেন অনেক বছর। মহাকালের পরিক্রমায় এ সময় নগণ্য হলেও ব্যক্তিজীবনের হিসাবে অনেক। বাবার কথা প্রতিনিয়তই মনে পড়ে। বাবার সঙ্গে আমাদের ভাইবোনদের সম্পর্কটা ঠিক বন্ধুত্বপূর্ণ ছিল না। ভীষণ ভয় করতাম আমরা। বাবার মৃত্যুর পর বুঝতে পারি, মানুষের জীবনে বাবা কী এবং কতটুকু?

কত টুকরো টুকরো স্মৃতি! মৃত্যুর আগে দীর্ঘদিন অসুস্থ ছিলেন বাবা। পক্ষাঘাতে শরীরের একদিক অবশ হয়ে গিয়েছিল। অসুস্থতার প্রাথমিক ধকল কাটিয়ে প্রথম দিকে লাঠি ভর দিয়ে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটতেন। কিন্তু শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা একেবারেই কমে গিয়েছিল। বাবা ছিলেন বেশ আড্ডাপ্রিয় মানুষ। সেই মানুষের এমন দুঃসহ অবস্থা, মনোবেদনা, একাকিত্বের কষ্ট-কাছ থেকে দেখেছি। জীবনে কমবেশি এ রকম কষ্টই কি মানুষের নিয়তি? এসব নিয়ে নয়, এমন এক স্মৃতি নিয়ে লিখব আজ, যা বাবা সম্পর্কে আমার ধারণাই পালটে দিয়েছিল।

অনেক বছর আগের কথা। আমার প্রাতিষ্ঠানিক লেখাপড়া শেষ। গ্রামের বাড়িতেই বসবাস। একের পর এক চাকরির ইন্টারভিউ দিই। আক্ষরিক অর্থেই চাকরি যেন অধরা এক সোনার হরিণ। দিনভর কাজকর্ম নেই। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্জিত আমার সার্টিফিকেটগুলো আমাকে কোনো কাজই করতে দিত না। দুপুরে খেয়ে ঘুম দিতাম এবং ঘুম থেকে উঠে স্থানীয় বাজারে চলে যেতাম। সেখানে আমার মতো আরও কয়েকজনের দেখা মিলত। কফি হাউজের মতো আড্ডাটা বেশ জমে উঠত। ফলে বাড়ি ফিরতে বেশ রাত হয়ে যেত। এ নিয়ে মা প্রায়ই বকতেন। রাতের খাবার নিয়ে বসে থাকতেন।

প্রায় প্রতিদিনই প্রতিজ্ঞা করতাম, আর এ রকম দেরি করব না। কোনোদিন সে প্রতিজ্ঞা রক্ষা করতে পারিনি। পরে মা রাতের খাবার রাখার একটা বিকল্প ব্যবস্থা করেছিলেন এবং সেটা বাবাকে লুকিয়ে। সে আরেক কাহিনি। মা যে বকাবকি করতেন সবটা তার নিজের ইচ্ছায় ছিল না। অনেকটাই বাবার ইচ্ছায়। তবে বাবা নিজে কোনোদিন কিছু বলতেন না। গম্ভীর হয়ে থাকতেন। এটা ছিল আরও ভয়ানক। বাবার সঙ্গে যাতে সাক্ষাৎ না হয়, তাই দেরি করে ফেরার মাত্রাটা আরও বাড়িয়ে দিলাম। এ ফর্মুলা বেশ কাজও দিচ্ছিল। সকালে অফিসে যাওয়ার তাড়া থাকায় বাবা একটু আগেই ঘুমিয়ে পড়তেন। আমার রাতের খাবারও মায়ের বিকল্প ব্যবস্থায় চলছিল। কিন্তু কদিন আর এভাবে চলা যায়।

একদিন রাতে বাড়ি ফিরে দেখি বাবা বসার ঘরে। আমি যেখানে ঘুমাই সেখানে বসে কী যেন পড়ছেন। আমার উপস্থিতি টের পেয়ে সেটা রেখে দিলেন। অন্ধকারে ভূত দেখার মতো চমকে উঠলাম আমি। মনে হচ্ছিল বাবা যে কোনো সময় চিৎকার করে উঠবেন। অজুহাত দেওয়ার মতো কিছুই আমার ঝুলিতে নেই। আমি দ্রুত পুকুর ঘাটে হাত-মুখ ধোয়ার জন্য বেরিয়ে গেলাম। বাবাও বোধহয় আমার অবস্থা বুঝতে পারছিলেন, তাই তৎক্ষণাৎ কিছু না বলে চুপ করে ছিলেন। তাড়াহুড়া করতে গিয়ে বাবার সামনে থেকে হারিকেনটা নেওয়া হয়নি। তবে রাতটা ছিল জ্যোৎস্না আলোকিত। ঘাটে গিয়ে দেখি বেশ বড় আকারের একটা সাপ ঘাটে বসে আছে। মাথাটা দেখতে পাচ্ছিলাম না, কিন্তু আমি পুরোপুরি সাপের নাগালের মধ্যে চলে গিয়েছিলাম। সঙ্গে সঙ্গে সরেও এলাম এবং সাপের গায়ে পা পড়লে আমার কী হতো এই ভেবে ভয়ে রীতিমতো কাঁপছিলাম।

দ্রুত ঘরে এসে বাবার সামনে থেকে হারিকেনটা নিয়ে বললাম, ‘ঘাটের ওপর বড় একটা সাপ বসে আছে।’ বাবার ভয় তখন মন থেকে চলে গেছে। বাবা এবার মুখ খুললেন, ‘থাক, তুই ঘরে বসে থাক। এখন আর ঘাটে যাওয়ার দরকার নেই। সাপটা চলে যাবে। কথা বললে তো শুনিস না। কখন যে কোন বিপদে পড়িস আল্লাহ জানেন!’

আমার মাথায় তখন অন্য চিন্তা। সাপটাকে মারতে হবে। আমি উঠানে বাঁশ বা লাঠি কিছু একটা খুঁজে পেলাম। তারপর ঘাটের কাছে গিয়ে দেখি সাপটা ওভাবেই আছে। বোধহয় ইঁদুরজাতীয় কিছু একটা খাচ্ছিল।

সজোরে সাপটাকে লাঠি দিয়ে আঘাত করলাম। সাপের গায়ে আঘাত লেগেছে সামান্যই। কিন্তু লাঠিটা ভেঙে গেল। নিরাপদ দূরত্বে থেকে পুনরায় আঘাত করার আর কোনো সুযোগ নেই। সাপটা লাঠির মৃদু আঘাতে লাফিয়ে ওপরে উঠে এলো এবং নিমিষেই আবার পানিতে নেমে গেল। এ এক ভয়ানক অভিজ্ঞতা। মাঝে মধ্যে মনে পড়ে, সাপটি যেভাবে লাফিয়ে উঠেছিল, যদি আমার গায়ে এসে পড়ত আমার অবস্থা কী হতো!

ঘরে এসে বাবাকে ঘটনা বললাম। ভয়ে আমার ক্ষুধা চলে গিয়েছিল। তবু বাবা খাবার জন্য বারবার তাগাদা দিতে লাগলেন। আমার না খাওয়ার পেছনে অবশ্য অন্য একটি কারণও ছিল। অবশেষে বাবার পীড়াপীড়িতে মায়ের লুকানো বাক্স থেকে খাবার বের করে খেলাম। বাবাও ব্যবস্থাটি নিজ চোখে দেখলেন।

এরপর মশারি টানিয়ে ভেতরে ঢুকে আমি খাটের ওপর বসে আছি। বাবাও বসে আছেন। বাবা বললেন ঘুমিয়ে পড়তে। কিন্তু আমার মনে অন্য ভয়। আমি শিশুর মতো বাবাকে বললাম, ‘আব্বা, শুনেছি সাপকে আঘাত করলে সাপ যদি না মরে তবে রাত্রে নাকি কামড়াতে আসে প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য?’

বাবা এতক্ষণে আমার মনের অবস্থাটা বুঝতে পারলেন। বললেন, ‘ধুর বোকা! এসব মিথ্যা গল্প। তুই ঘুমিয়ে পড়, আমি বসছি। হারিকেনটা জ্বালানোই থাক। ভয় করিস না, কিছু হবে না।’ কিন্তু আমি ঘুমাতে পারি না। বাবা বারবার অভয় দিলেন, বকাঝকা কিছু আর করলেন না।

বাবার কথা শুনতে শুনতে সাপ আসার মিথ্যে ভয় মাথায় নিয়ে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম টের পাইনি। বাবা কখন ঘুমাতে গেছেন-রাতে না সকালে জানি না। সকাল বেলা ঘুম থেকে জেগে বুঝতে পারি আমি বেঁচে আছি। রাতে সাপ আসেনি অথবা বাবা আসতে দেননি। হারিকেনটা তখনও মৃদু আলোয় আমার বিছানার পাশে টেবিলের ওপর জ্বলছিল।

আগ্রাবাদ, চট্টগ্রাম

 

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম