চট্টগ্রামে জলাবদ্ধতার স্থায়ী সমাধান জরুরি
মাহমুদুল হক আনসারী
প্রকাশ: ০৯ আগস্ট ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
কদিন আগেও কৃষক ভাইয়েরা চাষযোগ্য ফসল বুনতে বৃষ্টির অপেক্ষায় ছিলেন। সারা দেশের মানুষের মতো চট্টগ্রামের মানুষ গরমে কাহিল হয়ে পড়েছিল। প্রখর রোদে চৌচির কৃষি জমি দেখে কৃষকের কপালে চিন্তার রেখা দেখা দিয়েছিল। জমির জন্য বৃষ্টির পানির দরকার। এমন সময়ে বৃষ্টির দেখা মিলল। কৃষকের মুখে হাসি দেখেছি। গ্রামের হাজার হাজার একর জমিতে এখন বর্ষাকালীন ফসলের জন্য কৃষক পানির সন্ধান পেয়েছে। তারা এখন লাঙল আর গরু নিয়ে জমি তৈরিতে ব্যস্ত। অবশ্য গ্রামে বৃষ্টির পানি আশীর্বাদ হলেও শহরের অবস্থা ব্যতিক্রম।
মাত্র কয়েকদিনের বৃষ্টিতে চট্টগ্রাম শহরের অলিগলিতে পানি থইথই করছে। চট্টগ্রাম শহর এলাকার মার্কেট, বাজার, পানিতে ভাসছে। চকবাজার, বহদ্দারহাট, বাকলিয়া, খাজারোড, জিইসি, আগ্রাবাদ বাণিজ্যিক এলাকায় বৃষ্টির পানিতে জনভোগান্তি পৌঁছেছে চরম পর্যায়ে। বৃষ্টির পানিতে রিয়াজউদ্দীন বাজারের অনেক ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের লাখ লাখ টাকার মালামাল নষ্ট হয়েছে। খাতুনগঞ্জের পাইকারি দোকানে পানি ঢুকে পড়েছে। নিত্যপণ্যের অনেক কাঁচামাল পানির কারণে নষ্ট হয়েছে। হাঁটুসমান পানি এখন চট্টগ্রাম শহরের অলিগলিতে। স্কুল-কলেজ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ডুবে গেছে। চট্টগ্রামের মেয়রের বাসার গলি, বহদ্দারহাট ডুবে গেছে।
নগরীর যেসব ড্রেন-নালা-খাল রয়েছে তার প্রায় সবই অপরিষ্কার। শহর এলাকার ৪১টি ওয়ার্ডের যত নালা-ড্রেন আছে তার প্রায় সবই ময়লার উচ্ছিষ্টে জমাটবেঁধে স্তূপ হয়ে আছে। ২নং গেট থেকে বহদ্দারহাট পর্যন্ত দুই পাড়ে যে ড্রেন আছে, তা ময়লার স্তূপে ভরপুর। চকবাজার, কাপাসগোলা, কাঁচাবাজার, চট্টগ্রাম কলেজ এলাকা, সিরাজউদ্দৌলা রোডসংলগ্ন ড্রেনগুলো ময়লার জমাটবাঁধা স্তূপে পানি নিষ্কাশনে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করেছে।
আগ্রাবাদ এক্সেস রোড, অলংকার মোড়, এ কে খান মোড়, বড়পুলের পশ্চিম দিকের হালিশহর রোডসংলগ্ন ড্রেনসহ চট্টগ্রামের কোনো নালাই বর্ষার আগে পরিষ্কার করা হয়নি। পুরো সিটি এলাকার প্রায় সব নালা-ড্রেন, ছোট খাল ময়লার পাহাড়ে পরিণত হয়েছে। প্রশ্ন হলো পানি নিষ্কাশনের জন্য এগুলো পরিষ্কারের দায়িত্ব তাহলে কার? নিশ্চয়ই সিটি করপোরেশন বা স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলের। তারা তো জানে বর্ষার সময় বৃষ্টি হবে। আর বৃষ্টি হলে নগরীতে যে পরিমাণ পানি জমবে তা কীভাবে নদী সাগরে পৌঁছাবে?
বর্ষার আগে থেকেই শহরের সব নালা-ড্রেন পরিষ্কার করে বৃষ্টির পানি যথানিয়মে খাল-বিল, নদী পর্যন্ত পৌঁছানোর জন্য সিটি করপোরেশনকে সময়মতো কাজ করতে হবে। আমার বিশ্বাস সিটি করপোরেশনের সংশ্লিষ্ট বিভাগ ঠিকমতো এসব কাজ করছে না। ৩ মাস আগে আমি বহদ্দারহাট পুলিশ বক্সের পশ্চিম পাশের দুদিকের বড় নালায় ময়লার স্তূপ এবং স্থানীয় কাঠ ব্যবসায়ীদের নালা দখল করে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার অবৈধ কর্মকাণ্ডের ওপর একটি লেখা পত্রিকায় পাঠিয়েছিলাম। সেটি জাতীয় পত্রিকায় প্রচারও হয়েছে। সিটি করপোরেশনের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের গোচরেও আনা হয়েছে; কিন্তু আজ পর্যন্ত ওই এলাকার সমস্যার কোনো সমাধান হয়নি।
নগরীর জলাবদ্ধতার কারণ ও প্রতিকার নিয়ে বহু প্রতিবেদন স্থানীয় ও জাতীয় পত্রিকায় লেখালেখি হয়। তবে বাস্তবে কোনো প্রতিকার নগরবাসী পায় না। নালার ওপর অবৈধ দোকান বসিয়ে চাঁদার বিনিময়ে ব্যবসার সুযোগ তৈরি করা হলেও পানি নিষ্কাশনের পথ বন্ধ করা হয়েছে। প্রশ্ন হচ্ছে, অস্থায়ী এসব দোকান থেকে দিনে কিংবা মাসে বিপুল অঙ্কের চাঁদা নেয় কারা? সারা শহরে এসব অবৈধ দোকান থেকে সংগ্রহ হওয়া কোটি কোটি টাকার ভাগ বসায় কারা? নগরীর দোকান মার্কেট ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান থেকে সিটি করপোরেশনের ট্যাক্সের টাকা যায় কোথায়? সিটি করপোরেশনের কাজটাই বা কী? শুধু পত্রিকা আর মাইকিং করে জনগণকে আহ্বান করেই তাদের দায়িত্ব শেষ। আদতে সিটি করপোরেশন নগরীর জলাবদ্ধতা, ডেঙ্গু প্রতিরোধ, মশার উপদ্রব দমন, নগরীর পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার ব্যাপারে উদাসীন বলেই নগরবাসী মনে করে। জনগণ আঙুল দিয়ে সিটি করপোরেশনকে দেখিয়ে দিলেও তা করার জন্য কর্তৃপক্ষ এগিয়ে আসে না। তাহলে চট্টগ্রাম নগরীর ৮০ লাখ মানুষের শহর কীভাবে তার ঐতিহ্য ধরে রাখবে? এখানে শত শত বাসা, বহুতল ভবন, বাণিজ্যিক মার্কেট রয়েছে। গড়ে উঠছে নতুন নতুন ভবন। এসব অবকাঠামো যথাযথ নিয়ম মেনে হচ্ছে কি না তা খতিয়ে দেখে অনুমোদন দেওয়া উচিত। কিন্তু তদারকির অভাবে আজকের চট্টগ্রাম শহর অপরিষ্কার নগরীতে পরিণত হয়েছে। পানি নিষ্কাশনব্যবস্থা বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছে। সঠিকভাবে আইনের প্রয়োগ হচ্ছে না। রাজনৈতিক বিবেচনায় অনেকেই অপরাধ করে পার পাচ্ছে।
নগরবাসীর দাবি, যে কোনো মূল্যে বাণিজ্যিক রাজধানী চট্টগ্রামকে পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে। পানি নিষ্কাশনব্যবস্থা ঠিক রাখতে নালার ওপর গড়ে ওঠা দোকানপাট উচ্ছেদ করতে হবে। পানি নিষ্কাশনের জন্য পর্যাপ্ত জায়গা রেখে ভবন তৈরি করতে হবে। বন্দরনগরী চট্টগ্রাম বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রাণ। সারা দুনিয়ার নানা পেশার মানুষ চট্টগ্রামে ব্যবসার জন্য আসছে। চট্টগ্রাম হয়ে কক্সবাজার সমুদ্রসৈকত দেখতে যাচ্ছে। জাতীয় অর্থনীতির সিংহভাগ জোগানদাতা এ চট্টগ্রামকে সব সময় গোছাল, পরিচ্ছন্ন ও পরিবেশবান্ধব রাখতে কর্তৃপক্ষকে উদ্যোগী হতে হবে।
গবেষক ও কলামিস্ট
