পর্যটন খাতের সম্ভাবনা কাজে লাগাতে হবে
এটিএম মোসলেহ উদ্দিন জাবেদ
প্রকাশ: ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
প্রতিবছর এই দিনে বিশ্ব পর্যটন দিবস পালিত হয়ে আসছে। জাতিসংঘের অধীনস্থ বিশ্ব পর্যটন সংস্থার (ইউএনডব্লিউটিও) প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে ১৯৮০ সাল থেকে সব সদস্য দেশে দিবসটি পালিত হয়ে আসছে। দিবসটির প্রধান উদ্দেশ্য হচ্ছে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ও পর্যটনকেন্দ্রের সঙ্গে সেতুবন্ধ গড়ে তোলা। এছাড়া পর্যটনের ভ‚মিকা সম্পর্কে জনসচেতনতা বৃদ্ধিসহ সামাজিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক উপযোগিতাকে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দেওয়া এ দিবসের অন্যতম লক্ষ্য। বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো এবারও বাংলাদেশে দিবসটি নানা আয়োজনে পালিত হচ্ছে।
পর্যটন বলতে অবসর অথবা ব্যবসার উদ্দেশ্যে একস্থান থেকে অন্যস্থানে কিংবা এক দেশ থেকে অন্য দেশে ভ্রমণ করাকে বোঝায়। বর্তমানে সারা বিশ্বে পর্যটন ‘শিল্প’ হিসাবে পরিণত হয়েছে। এছাড়া বিশ্বব্যাপী অবসরকালীন কর্মকাণ্ডের অন্যতম মাধ্যম হিসাবেও জনপ্রিয়তা পেয়েছে। আর যিনি ভ্রমণ করেন তিনি পর্যটক নামে পরিচিত। ট্যুরিস্ট গাইড, পর্যটন সংস্থার মতো সেবা খাতগুলো এর সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত। অর্থাৎ সংস্কৃতির পরিচিতি তো রয়েছেই, অর্থনৈতিক উন্নয়নেও বিশ্বের অনেক দেশে পর্যটন খাত অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভ‚মিকা পালন করছে। ফ্রান্স, মিসর, গ্রিস, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, স্পেন, ইতালি, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর এর অন্যতম। এছাড়া দ্বীপরাষ্ট্র হিসাবে মৌরিশাস, বাহামা, ফিজি, মালদ্বীপ, ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপাইন, সিসিলি, ক্যারাবীয় অঞ্চলেও পর্যটনশিল্প ব্যাপক বিকাশ লাভ করেছে।
অপরূপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, সমৃদ্ধ ইতিহাস, বৈচিত্র্যপূর্ণ সংস্কৃতি আমাদের দেশকে রূপের রানিতে পরিণত করেছে। এদেশে রয়েছে বিশ্বের দীর্ঘতম নিরবচ্ছিন্ন প্রাকৃতিক সমুদ্রসৈকত কক্সবাজার, ১৯৯৭ সালে ইউনেস্কোর ঘোষিত বিশ্ব ঐতিহ্যের স্থান পৃথিবীর একক বৃহত্তম জীববৈচিত্র্য ভরপুর ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল সুন্দরবন, একই সৈকত থেকে সূর্যোদয় ও সূর্যাস্ত দেখার স্থান কুয়াকাটা, ‘দুটি পাতা-একটি কুঁড়ি’র সিলেট, স্বচ্ছ জলরাশির লালাখাল, পাথর জলের নয়নাভিরাম জাফলং ও বিছনাকান্দি, পাংথুমাই ঝরনা, রাতারগুল সোয়াম্প ফরেস্ট, হাকালুকি, কানাইঘাটের লোভাছড়া, পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চল, সমৃদ্ধ অতীতের সাক্ষী উত্তরাঞ্চলের প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনের মতো নানা দর্শনীয় স্থান। ফলে স্বাভাবিকভাবে বাংলাদেশের পর্যটনশিল্পে উন্নয়নের সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে। তুলনামূলকভাবে বাংলাদেশ স্বল্প আয়তনের দেশ হলেও প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের যে বৈচিত্র্য রয়েছে, তা সহজেই পর্যটকদের আকর্ষণ করতে পারে।
বাংলাদেশে পর্যটনশিল্প বিকাশের সমূহ সম্ভাবনা থাকা সত্তে¡ও আমরা খুব একটা সামনে এগিয়ে যেতে পারিনি। এ খাত থেকে সরকারের বিপুল অর্থ আয়ের সম্ভাবনা থাকলেও বরাবরই তা উপেক্ষিত থেকেছে। পর্যটনশিল্প বিকাশের পথে আমাদের পর্বতসম সমস্যা নিয়ে এগিয়ে যেতে হচ্ছে। অনুন্নত যোগাযোগব্যবস্থা এক্ষেত্রে প্রধান অন্তরায়। আমাদের দেশের যোগাযোগব্যবস্থা যেমন খুব একটা সুবিধাজনক হয়ে ওঠেনি, তেমনি যাতায়াত খরচও তুলনামূলক বেশি হওয়ায় আমরা পর্যটক আকর্ষণে ব্যর্থ হচ্ছি। এখানকার হোটেল, মোটেল, রিসোর্টের খরচ বিশ্বের অন্যান্য পর্যটনবান্ধব দেশের তুলনায় অনেক বেশি হওয়ায় পর্যটকরা আগ্রহ হারায়। দেশের পর্যটক আকর্ষণকারী স্থানগুলোতে নিরাপত্তার যথেষ্ট ঘাটতি রয়েছে। দিনেদুপুরে চুরি, ছিনতাইয়ের মতো ঘটনা ঘটে থাকে। ফলে বিদেশি পর্যটকরা নিরাপত্তার অভাবে আসতে চান না। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের এদিকে দৃষ্টি দেওয়া উচিত। স ষ্টা আমাদের অপরূপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দান করলেও আমরা তার যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছি। আমরা সুন্দরবনের গাছ কেটে উজাড় করেছি। নিজেদের সামান্য স্বার্থের আশায় ধ্বংস করে দিয়েছি এর জীববৈচিত্র্যকে। এদেশের পর্যটনশিল্পের বিকাশে রাজনৈতিক অস্থিরতাও নেতিবাচক প্রভাব ফেলে থাকে।
বর্তমানে বিশ্বব্যাপী পর্যটকের সংখ্যা প্রায় ৯০ কোটি। ধরা হচ্ছে ২০২০ সাল নাগাদ এ সংখ্যা দাঁড়াবে ১৬০ কোটিতে। পর্যটন বিশেষজ্ঞদের মতে, এ বিপুলসংখ্যক পর্যটকের প্রায় ৭৩ শতাংশ ভ্রমণ করবেন এশিয়ার দেশগুলোতে। এছাড়া বিশ্ব পর্যটন সংস্থার তথ্যমতে ওই সময়ের মধ্যে এ শিল্পে ২৯ কোটি ৭০ লাখ লোকের কর্মসংস্থান হবে, যা বিশ্ব অর্থনীতিতে অবদান রাখবে ১০.৫ ভাগ। বাংলাদেশ যদি এ বিশাল বাজার ধরতে পারে, তাহলে পর্যটনের হাত ধরেই বদলে যেতে পারে এদেশের অর্থনীতি। বর্তমানে কক্সবাজারকে কেন্দ্র করে নেওয়া হচ্ছে নানা পরিকল্পনা। কক্সবাজার থেকে টেকনাফ পর্যন্ত সাগর পাড়ে বিশ্বের দীর্ঘতম ৮০ কিলোমিটার মেরিন ড্রাইভ সড়ক নতুন করে পর্যটকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করছে। পাশাপাশি কক্সবাজারে বেড়াতে আসা বিদেশি পর্যটকদের জন্য পৃথক ট্যুরিস্ট জোন করা হচ্ছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে পর্যটক আকর্ষণে কক্সবাজারে তিনটি পর্যটন পার্ক তৈরির পরিকল্পনা করা হয়েছে।
পর্যটন খাতকে এগিয়ে নিতে বর্তমানে তথ্যপ্রযুক্তি সহায়ক ভ‚মিকা পালন করছে। তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার করে পর্যটকরা সহজেই তাদের গন্তব্য নির্ধারণ করতে পারছেন। ভ্রমণপিপাসুদের জন্য বাণিজ্যিক ট্রাভেল এজেন্সির বাইরেও গড়ে উঠেছে অনলাইনভিত্তিক বিভিন্ন প্লাটফর্ম। ফেসবুকভিত্তিক বিভিন্ন গ্র“প রূপ নিয়েছে ট্রাভেল এজেন্সিতে। বোঝা যায় ভ্রমণের প্রতি মানুষের আগ্রহ দিনদিন বাড়ছে। সাম্প্রতিক সময়ে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির প্রসার পর্যটন খাতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে। কিছু অনলাইন পোর্টাল আবার ভ্রমণবিষয়ক লেখার প্রতিযোগিতার আয়োজন করে, যেখানে পুরস্কারের ব্যবস্থাও থাকে। এভাবে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির ব্যবহার পর্যটন খাতের প্রচার ও প্রসারে অসামান্য অবদান রাখছে। সরকারের সহযোগিতা ও পৃষ্ঠপোষকতা পেলে এ ধরনের অনলাইনভিত্তিক ট্রাভেল গ্র“পগুলোর গতিশীলতা আরও বাড়বে।
সম্প্রতি পর্যটনবান্ধব দেশের তালিকায় পাঁচ ধাপ এগিয়েছে বাংলাদেশ। বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামের চলতি বছরের ট্রাভেল অ্যান্ড ট্যুরিজম কম্পিটিটিভ প্রতিবেদনে ভ্রমণ ও পর্যটনে সেরা দেশগুলোর তালিকায় পাঁচ ধাপ এগিয়ে বাংলাদেশের অবস্থান এখন ১২০ নম্বরে। তালিকার শীর্ষে রয়েছে ইউরোপের দেশ স্পেন। এরপরই রয়েছে ফ্রান্স, জার্মানি, জাপান, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়া, ইতালি, কানাডা ও সুইজারল্যান্ডের মতো দেশ। সার্কভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে ৩৪ নম্বরে রয়েছে পার্শ্ববর্তী ভারত, শ্রীলংকার অবস্থান ৭৭, নেপাল ১০২ ও পাকিস্তান ১২১। এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে নিরাপত্তা ও সুরক্ষায় বাংলাদেশ সবচেয়ে বেশি উন্নতি করেছে বলে প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। বাংলাদেশের জন্য আশার কথা হলো, প্রাকৃতিক সম্পদ ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের কারণে এখানকার পর্যটনশিল্পে উলেখযোগ্য উন্নতি হবে। পাশাপাশি পর্যটকদের সংখ্যাও দ্রুত বাড়বে। বন্যপ্রাণীর অভয়ারণ্য বৃদ্ধি, প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণ দেশে পর্যটনের বিকাশে গতি আনতে পারে। সেই সঙ্গে দেশের পর্যটনশিল্পের প্রচার ও উন্নয়নে সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি ট্যুর অপারেটর, হোটেল ও এভিয়েশনসংশ্লিষ্ট সবাইকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে।
চাকরিজীবী
