Logo
Logo
×

দৃষ্টিপাত

খাবারে ভারী ধাতু বাড়াচ্ছে স্বাস্থ্যঝুঁকি

Icon

মো. এমদাদুর রহমান উদয়

প্রকাশ: ০১ নভেম্বর ২০২৩, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

জীবের বেঁচে থাকার জন্য খাদ্যের প্রয়োজন। তবে সুস্থ ও রোগমুক্ত জীবনধারণের জন্য প্রয়োজন সুষম ও নিরাপদ খাদ্য উপাদান। খাদ্য উপাদানে ভারি ধাতুর উপস্থিতি মানবজীবনকে হুমকির মুখে ফেলেছে। খাদ্যে মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর রাসায়নিকের ব্যবহার দিনদিন বেড়েই চলেছে। খাবারে ভারী ধাতু যেমন ক্যাডমিয়াম, নিকেল, কোবাল্ট ও ক্রোমিয়ামসহ নানা রাসায়নিকের উপস্থিতি উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এসব উপাদান দেহের ভেতরে নানা রোগ সৃষ্টির পাশাপাশি রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকেও কমিয়ে দিচ্ছে।

খাবারে ভারী ধাতুর উপস্থিতির অন্যতম প্রধান কারণ হিসাবে প্রাকৃতিক উপাদানগুলোর দূষণকে চিহ্নিত করা যায়। বর্তমানে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় অস্বাভাবিক হারে বেড়েছে বায়ুদূষণের মাত্রা। মাত্রাতিরিক্ত দূষণের কারণে অন্যান্য জটিলতার মতো খাদ্য নিরাপত্তার ক্ষেত্রেও নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। বাতাসে ভাসমান নানা পদার্থ সহজেই আমাদের প্রাত্যহিক খাদ্যে মিশে যাচ্ছে। এছাড়া খাদ্য উৎপাদনে ব্যবহৃত বিভিন্ন রাসায়নিক ও কীটনাশক মাটির উর্বরা শক্তি কমিয়ে মাটিকে দূষিত করছে। মাটি খাদ্য উৎপাদনের অযোগ্য হয়ে পড়ছে। ফলে খাদ্যের গুণগত মান নষ্ট হচ্ছে।

আমাদের দেশে বিপুল জনগোষ্ঠীর আমিষের চাহিদা মেটানোর জন্য বাণিজ্যিকভাবে মুরগির উৎপাদন লক্ষ করা যায়। তবে এক গবেষণায় উৎপাদিত মুরগির মাংসে আর্সেনিক, ক্রোমিয়াম, পারদ, নিকেল ও সিসার মতো ভারী ধাতু পাওয়া গেছে। এসব ক্ষতিকর পদার্থ মানবদেহে প্রবেশ করে দীর্ঘমেয়াদি শারীরিক জটিলতার সৃষ্টি করে। মানবদেহে ক্যানসারের ঝুঁকি এক-চতুর্থাংশ পর্যন্ত বাড়িয়ে দিতে পারে। এছাড়াও অন্যান্য জটিলতা সৃষ্টিও করতে পারে। ব্যবসায়ীরা প্রায়ই অতি মুনাফার আশায় মুরগির খাদ্যে ক্ষতিকর পদার্থ ও নানা ধরনের দ্রুতবর্ধনশীল ওষুধ ব্যবহার করেন; যা মানবদেহে মারাত্মক বিরূপ প্রভাব ফেলে। চিকিৎসকের মতে, উৎপাদিত মুরগিতে যে কোনো ধরনের ওষুধ ব্যবহারের ৭২ ঘণ্টার মধ্যে ওই মাংস খেলে বিষক্রিয়াসহ মৃত্যু পর্যন্ত ঘটতে পারে।

আমাদের উৎপাদিত মৎস্যশিল্পেও একই অবস্থা বিদ্যমান। বর্তমানে আমাদের দেশে প্রাকৃতিকভাবে মৎস্য আহরণের পাশাপাশি খামারে মাছ চাষের পদ্ধতি চালু রয়েছে। কিন্তু মাছের খাদ্যে ভেজালসহ নানা কারণে উৎপাদিত মৎস্যেও সম্প্রতি ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়া ও ভারী ধাতুর অস্তিত্বের প্রমাণ মিলেছে। সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল গবেষক এ বিষয়টি প্রমাণ করতে সমর্থ হন। তারা হাকালুকি হাওড়ের কার্পজাতীয় মাছ অর্থাৎ রুই, মৃগেল ও কালিবাউশ মাছের ব্যাকটেরিয়াল ও রাসায়নিক পরীক্ষা করে ক্ষতিকারক ব্যাকটেরিয়া ই কোলাই, সালমোনেলা এবং ভিব্রিও প্রজাতির উপস্থিতির পাশাপাশি ভারী ধাতু সিসার মাত্রাতিরিক্ত উপস্থিতি লক্ষ করেন, যা নিরাপদ খাদ্য ব্যবস্থাপনার জন্য হুমকি।

এছাড়াও দেশের জামালপুর এলাকায় ক্ষেতে উৎপাদিত ফসলে ভারী ধাতু পাওয়া গেছে। সেখানে উৎপাদিত বেগুনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে গবেষকরা বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। এছাড়া অন্যান্য ফসলেও উল্লেখযোগ্য পরিমাণে ক্ষতিকর পদার্থ পাওয়া গেছে। মূলত মাটিদূষণ ও ফসলি জমিতে যথেচ্ছ কীটনাশকের ব্যবহারের ফলেই এমনটা ঘটছে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। তবে খাদ্যে ভেজালের সবচেয়ে ভুক্তভোগী হচ্ছে সদ্যজাত শিশুরা। প্যাকেট ও কৌটাজাত দুধে সিসার উপস্থিতি শিশুর দেহে মারাত্মক নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করছে। শিশুদের খাদ্যপণ্যে ক্ষতিকর রং, কৃত্রিম ফ্লেভার, কেমিক্যাল, হাইড্রোজ, স্যাকারিন ইত্যাদি মিশিয়ে তৈরি হচ্ছে বিভিন্ন ধরনের পানীয় এবং জেলিসহ ভেজাল খাবার। চিকিৎসকদের মতে, নিম্নমানের এসব মুখরোচক ভেজাল খাবার খেয়ে শিশুরা মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়ছে। এসব দ্রব্য শিশুর পেটে গেলে কিডনি ও লিভার ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

স্বাস্থ্য সংস্থার দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, প্রকৃতিতে অতি অল্প পরিমাণে ক্যাডমিয়ামের উপস্থিতি থাকা স্বাভাবিক। কিন্তু দূষণের কারণে সম্প্রতি প্রকৃতিতে এটি ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। আমাদের দেশে নিরাপদ খাদ্য আইন ও ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইনের আওতায় ভেজালবিরোধী কর্মসূচি পরিচালনা করা হচ্ছে। আইন অনুযায়ী, ভেজাল খাদ্য উৎপাদন, বাজারজাতকরণ ও বিক্রয়ের শাস্তি হিসাবে ন্যূনতম ৬ মাস থেকে সর্বোচ্চ পাঁচ বছরের কারাদণ্ড এবং এক লাখ থেকে সর্বোচ্চ দশ লাখ টাকা নগদ অর্থদণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে। তবে মানুষের মধ্যে সার্বিক সচেতনতা ও নৈতিক মূল্যবোধের প্রসারই পারে এ ভয়াবহ সমস্যা থেকে দেশ ও জাতিকে মুক্তি দিতে।

শিক্ষার্থী, স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

 

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম