জনগণ সব ক্ষমতার মালিক
মেজর (অব.) মো. ইকবাল হায়দার
প্রকাশ: ২২ নভেম্বর ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
আমাদের গ্রামের বীর মুক্তিযোদ্ধা কালু সর্দারের বয়স ৭০ বছর। তিনি মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে সম্মুখযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন। তিনি পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়েন, নিয়মিত মসজিদে যান। কালু সর্দার লেখাপড়া তেমন করেননি। এ বীর মুক্তিযোদ্ধা একজন স্পষ্টভাষী এবং সত্য কথা বলতে কোনো দ্বিধা করেন না। তিনি দেশবিদেশের রাজনীতি সম্পর্কেও খোঁজখবর রাখেন। তার সঙ্গে আমার যেভাবে তার আঞ্চলিক ও শুদ্ধ ভাষার মিশ্রণে কথা হয়েছে তার বর্ণনা এমন-
‘চাচা আপনি লেখাপড়া জানেন না, তবে কীভাবে দেশবিদেশের এত তাজা খবর রাখেন?’ তার জবাব, ‘ভাতিজা, আমার পাশের বাড়ির তোতা মিয়ার বড়ো পোলা দুলাল মাস্টার স্থানীয় সরকারি প্রাইমারি স্কুলে মাস্টারি করে। তার বাড়িতে টেলিভিশন আছে, পত্রিকাও রাখে। আমি প্রতিদিন সকালে ও সন্ধ্যার পর দুলাল মাস্টারের বাড়ি গিয়া টেলিভিশন দেখি এবং পত্রিকার বড়ো বড়ো শিরোনামে কী কী আছে তা দুলাল মাস্টারের কাছ থেকে শুনি।’
আমি কালু সর্দারকে বলি, ‘চাচা, দেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি কেমন?’ প্রথমেই তিনি সব রাজনৈতিক নেতার প্রতি ঘৃণা প্রকাশ করে বললেন, ‘আমাদের দেশের রাজনীতির সংজ্ঞা হলো, যার নাই কোনো নীতি, তার নাম রাজনীতি।’ আমি বলি, ‘চাচা, এভাবে আপনি রাজনীতিকদের অসম্মান করলেন! কথাটা কিন্তু ঠিক বলেননি।’
তিনি জবাবে বলেন, ‘আমি একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা, আমি আল্লাহ ছাড়া কাউকে পরোয়া করি না। আমি সব সময় উচিত কথা বলি।’ তিনি আরও বলেন, ‘বর্তমানে আমাদের দেশে শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ এবং খালেদা জিয়ার বিএনপি একে অপর দলকে সেয়ানে সেয়ান মনে করে। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ দেশের সবচেয়ে পুরোনো একটি রাজনৈতিক দল। যার ইউনিয়ন পর্যন্ত শক্ত কমিটি রয়েছে। এদিকে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর প্রায়ই বলে থাকেন, বিএনপি বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ রাজনৈতিক দল।’
আমি বীর মুক্তিযোদ্ধা কালু সর্দারকে প্রশ্ন করি, ‘চাচা, নির্বাচনে আপনি কোন দলকে ভোট দেবেন?’ জবাবে কালু সর্দার বলেন, ‘ভাতিজা, এটা তো আমার নিজস্ব ব্যাপার। তবে মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণকালে ভারতে সব মুক্তিযোদ্ধা অস্ত্র হাতে প্রতিদিনই স্লোগান দিতাম-আমার নেতা তোমার নেতা শেখ মুজিব, শেখ মুজিব। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্ম না হলে আমাদের দেশ স্বাধীন হতো কিনা সন্দেহ রয়েছে। এখন আপনি নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন, আমি কোন দলকে ভোট দেব।’
স্বাধীন হওয়ার পর মাত্র তিন বছর আওয়ামী লীগ সরকার যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ পরিচালনার সুযোগ পায়। ১৫ আগস্ট, ১৯৭৫ সালে বিপথগামী একদল সেনা কর্মকর্তার হাতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ পরিবারের সব সদস্য নিহত হন। ভাগ্যক্রমে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং তার ছোট বোন শেখ রেহানা বিদেশে অবস্থান করায় প্রাণে বেঁচে যান।
বিগত দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন ৫ জানুয়ারি ২০১৪ সালে অনুষ্ঠিত হয়। ওই নির্বাচন সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণভাবে অনুষ্ঠিত হয়নি। বিএনপি ওই নির্বাচনে অংশ নেয়নি। ওই নির্বাচনে ১৫৪ জন সংসদ সদস্য বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন। এছাড়া ভোটার উপস্থিতি ছিল মাত্র ৪২ শতাংশ। তারপরও বিদেশি রাষ্ট্রগুলো বর্তমান সরকারের সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রাখছে। বিএনপি বর্তমান সরকারকে অবৈধ সরকার বলে আখ্যায়িত করছে। অথচ দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে দেশের পাঁচ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে বিএনপি আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে অংশ নেয় এবং তাদের প্রার্থীরা বিপুল ভোটে জয়লাভ করে। ৫ জানুয়ারি ২০১৪ তারিখের নির্বাচনে বিএনপিসহ দেশের সব রাজনৈতিক দল যাতে অংশগ্রহণ করে, সেজন্য আওয়ামী লীগ সরকার আপ্রাণ চেষ্টা করেছিল। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে আলোচনায় বসার জন্য টেলিফোনের মাধ্যমে গণভবনে ডিনারের আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এটাও বলেছিলেন, ‘আসুন সর্বদলীয় সরকার গঠন করি। আপনি (খালেদা জিয়া) স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়সহ যে যে মন্ত্রণালয় চাইবেন আমি তা দিতে রাজি আছি। তবুও নির্বাচনে অংশগ্রহণ করুন।’
বিএনপি ৫ জানুয়ারি ২০১৪ সালের নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করে নির্বাচনের পর তিন মাসের বেশি দেশে হরতাল, অবরোধ দিয়ে দেশবাসীকে জিম্মি করে রেখেছিল। এছাড়াও বাস, ট্রেন ও অন্যান্য যানবাহনে আগুন দিয়ে অনেক মানুষকে পুড়িয়ে মারা হয়। এমনকি মুমূর্ষু রোগী বহনকারী অ্যাম্বুলেন্স পর্যন্ত ভাঙচুর ও পুড়িয়ে দেওয়া হয়। এসব দেশবাসী ও বিদেশিরাও প্রত্যক্ষ করেছেন।
বীর মুক্তিযোদ্ধা কালু সর্দারকে আমি বলি, ‘চাচা, ২০২৩ সালের দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে যদি বিএনপি অংশ না নেয়, তাহলে কী হবে?’ জবাবে কালু সর্দার জানান, আওয়ামী লীগ সংবিধান অনুযায়ী অবশ্যই নির্বাচন অনুষ্ঠান করবে। তিনি বলেন, ‘ভাতিজা, আওয়ামী লীগ ও বিএনপি সব সময়ই কাদা ছোড়াছুড়ি করছে। যদি দেশের বেবাক (সব) পাবলিক একাট্টা হয়ে একটি আওয়াজ তোলে-ভোটকেন্দ্রে যাব না, কাউকে ভোট দিব না, তখন দুই বৃহত্তর রাজনৈতিক দলসহ অন্য সব দলের খবর আছে। কারণ জনগণই প্রজাতন্ত্রের মালিক ও সব ক্ষমতার উৎস।’
প্রাবন্ধিক
