একজন রেদকিনের আত্মদান ও বন্দর উদ্ধারের গল্প
আসিফ রশীদ
প্রকাশ: ১৪ ডিসেম্বর ২০১৮, ০৬:০০ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ
বাংলাদেশ নেভাল একাডেমি। ছবি: সংগৃহীত
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
সাগরের বড় বড় ঢেউ আছড়ে পড়ছে সিমেন্টের ব্লকগুলোর ওপর আর পাড়ের প্রাচীরগাত্রে। দূরে চলাচল করছে কিছু লাইটার ভেসেল। আরও দূরে কয়েকটি কার্গো জাহাজ। হয়তো পণ্য নিয়ে আসছে, অথবা নিয়ে যাচ্ছে দূর কোনো দেশে। দুপুরের কড়া রোদে ঝিলিক দিচ্ছে রুপালি ঢেউ। আমরা দাঁড়িয়ে আছি চট্টগ্রাম নগরীর পতেঙ্গায়, বাংলাদেশ নেভাল একাডেমির রেদকিন প্রান্তে।
বঙ্গোপসাগরে কর্ণফুলী নদীর মোহনায় এ জায়গাটির একটা ইতিহাস আছে। চট্টগ্রাম বন্দরের প্রবেশমুখ এটি। ১৯৭১ সালে আমাদের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ও তাদের দোসররা পরাজয় নিশ্চিত জেনে এ দেশের বড় বড় অবকাঠামো ধ্বংস করে দিয়েছিল। বিশেষ করে তাদের লক্ষ্যবস্তু ছিল সেতু, বিমানবন্দর ও সমুদ্রবন্দরগুলো।
চট্টগ্রাম ও চালনা/মোংলা বন্দর প্রায় পুরোপুরি বিধ্বস্ত করে দিয়েছিল তারা। চট্টগ্রাম বন্দরের প্রবেশমুখে মাইন পুঁতে রেখেছিল বন্দর অচল করে দেয়ার উদ্দেশ্যে। এ ছাড়া বাংলাদেশের নৌ-কমান্ডো যোদ্ধাদের দ্বারা পরিচালিত অপারেশন জ্যাকপট নামে গেরিলা অভিযানে এবং ভারতীয় যুদ্ধবিমানের গোলার আঘাতে বন্দর ও বহির্নোঙর এলাকায় ছোট-বড় অন্তত ৪০টি নৌযান ডুবে গিয়েছিল।
এসব নৌযানের মধ্যে ছিল পাকিস্তানি বাহিনীর অস্ত্র ও গোলাবারুদবাহী জাহাজও। ফলে বন্দরে কোনো জাহাজ ভেড়ার উপায় ছিল না। অর্থনীতির ‘লাইফলাইন’ চট্টগ্রাম বন্দর হয়ে পড়েছিল পুরোপুরি অচল। আমদানি-রফতানি কার্যক্রম শুরু করা যাচ্ছিল না, যা ছিল সদ্য স্বাধীন দেশের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের অবস্থা ছিল খুবই খারাপ। বিপুল অর্থ ব্যয় করে বিশেষজ্ঞ দল আনিয়ে বন্দর দ্রুত সচল করার সামর্থ্য ছিল না আমাদের। এ পটভূমিতে বঙ্গবন্ধু সরকার জাতিসংঘ ও বাংলাদেশের মিত্ররাষ্ট্রগুলোর কাছে চট্টগ্রাম বন্দরের মাইন অপসারণে সহায়তা চায়।
জাতিসংঘ ও সোভিয়েত ইউনিয়ন ইতিবাচক সাড়া দেয়। তবে জাতিসংঘ জানায়, এ জন্য প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম পরিবহনে এবং দক্ষ প্রতিষ্ঠান নির্বাচনে কিছু সময় লাগবে। শেষে এগিয়ে আসে সোভিয়েত ইউনিয়ন। প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭২ সালের মার্চের প্রথম সপ্তাহে সোভিয়েত ইউনিয়ন সফরে গেলে মস্কো দ্রুততম সময়ে ও নিঃশর্তভাবে মাইন অপসারণে সহায়তার প্রস্তাব দেয়। এ নিয়ে আলোচনার জন্য সে বছরের ২১ মার্চ ৯ সদস্যের একটি সোভিয়েত প্রতিনিধি দল বাংলাদেশ সফরে আসে। পরদিনই উভয় পক্ষ এ বিষয়ে একটি চুক্তি স্বাক্ষর করে।
চুক্তি অনুযায়ী সোভিয়েত ইউনিয়ন সম্পূর্ণ বিনা পারিশ্রমিকে ও স্বল্পতম সময়ে চট্টগ্রাম ও চালনা/মোংলা বন্দরের মাইন অপসারণে সম্মত হয়। ওই বছরেরই ২ এপ্রিল রিয়ার এডমিরাল সের্গেই পাভলোভিচের নেতৃত্বে ১০০ নাবিকের সমন্বয়ে গঠিত একটি অগ্রবর্তী দল চট্টগ্রাম আসে। তারা দ্রুত তাদের সরঞ্জাম স্থাপন করে কাজ শুরু করে। মে মাসের ৪ তারিখের মধ্যে ভ্লাদিভস্তক থেকে সোভিয়েত ‘প্রশান্ত মহাসাগরীয় নৌবহরের’ ২২টি জাহাজ ও আরও ৭০০ নাবিক চট্টগ্রাম বন্দরে এসে পৌঁছে।
শুরু হয় দুঃসাহসী এক অভিযান। রিয়ার এডমিরাল জুয়েনকোর নেতৃত্বে মোট ৮০০ সদস্যের সোভিয়েত মাইন অপসারণ দল শুরুতেই খুব কঠিন ও ঝুঁকিপূর্ণ পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়। বন্দর ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল মারাত্মকভাবে। তাছাড়া মাইন অপসারণ অত্যন্ত জটিল ও বিপজ্জনক কাজ।
‘স্বাভাবিক’ পরিস্থিতিতেই ডুবে যাওয়া জাহাজ উদ্ধারের কাজটি বেশ কঠিন। আর চট্টগ্রাম বন্দরের ক্ষেত্রে তা ছিল আরও বেশি কঠিন ও বিপজ্জনক। কর্ণফুলী নদীর ময়লা ও কর্দমাক্ত পানির নিচে প্রায় কিছুই দেখা যাচ্ছিল না। তীব্র স্রোতের কারণে নাবিকরা দিনে চারবারের বেশি পানির নিচে যেতে পারছিল না। এবং তারা একটানা ৪০-৪৫ মিনিটের বেশি সেখানে থাকতে পারছিল না।
সোভিয়েত নাবিকদের মোকাবেলা করতে হচ্ছিল অত্যন্ত প্রতিকূল পরিস্থিতি। কর্ণফুলী নদী সরু হওয়ায় ডুবে থাকা জাহাজের ধ্বংসাবশেষ উদ্ধারে দক্ষ ও কার্যকর পদ্ধতি- যা পানির তলে বিস্ফোরণ ঘটিয়ে করা হয়- প্রয়োগ করা যাচ্ছিল না, কারণ তা আরও বিপজ্জনক হতে পারত।
তাছাড়া এর ফলে মাছসহ অনেক সামুদ্রিক সম্পদ ধ্বংস হওয়ার আশঙ্কা ছিল। তাই তাদেরকে সেকেলে ‘ডুবন্ত পন্টুন’ পদ্ধতি প্রয়োগ করতে হচ্ছিল। জাহাজের ধ্বংসাবশেষের সঙ্গে পন্টুনকে যুক্ত করে তা সংকুচিত বাতাসের চাপ দিয়ে উপরে ওঠানো হচ্ছিল। এ পদ্ধতি ছিল অত্যন্ত সময়সাপেক্ষ ও কঠিন।
মাইন অপসারণের কাজটি সম্পন্ন করতে সোভিয়েত মাইন অপসারণ দলের প্রায় দুই বছর সময় লাগে। দলের সদস্যরা চট্টগ্রাম বন্দরকে মাইনমুক্ত করার পাশাপাশি ডুবে যাওয়া জাহাজগুলোও উদ্ধার করেন। সেই দলের এক অসীম সাহসী তরুণ সদস্য ডুবে থাকা জাহাজের গায়ে আংটা বাঁধার সময় প্রবল বিপরীত স্রোতের তোড়ে প্রাণ হারান। নাম তার ইউরি ভিক্তরোভিচ রেদকিন।
বাংলাদেশ ও সোভিয়েত সরকারের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী রেদকিনকে বন্দরের মোহনার কাছেই সমাহিত করা হয়। পরে সেখানে নির্মাণ করা হয় একটি স্মৃতিস্তম্ভ। সমাধিস্থলটি তখন সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত থাকলেও ১৯৭৬ সালে এ স্থানে বাংলাদেশ নেভাল একাডেমি প্রতিষ্ঠার পর তা সংরক্ষিত এলাকায় পরিণত হয়।
নেভাল একাডেমির এ প্রান্তটি রেদকিন পয়েন্ট নামে পরিচিত হয়ে ওঠে। মাইনমুক্ত ও ব্যবহার উপযোগী হওয়ার ফলে চট্টগ্রাম বন্দর দ্রুত আগের অবস্থা ফিরে পায় এবং ১৯৭৩ সালে এর ধারণক্ষমতা যুদ্ধপূর্ব ধারণক্ষমতাকেও ছাড়িয়ে যায়।
আমরা জানি, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে তৎকালীন বিশ্বের অন্যতম পরাশক্তি সোভিয়েত ইউনিয়নের ভূমিকা ছিল অনন্য। তারা একদিকে মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় সৈন্যদের সামরিকভাবে সহায়তা করে, অন্যদিকে কূটনৈতিকভাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে সমর্থন জোগায়। যুদ্ধবিরতি প্রশ্নে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে সোভিয়েত ইউনিয়নের তিন-তিনবার ভেটো প্রয়োগ স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের জন্ম নিশ্চিত করে তোলে।
স্বাধীনতার পরও বাংলাদেশের পুনর্গঠনে এগিয়ে আসে সোভিয়েত ইউনিয়ন। তবে এ দেশের জন্য একজন সোভিয়েত নাবিকের, একজন বিদেশির আত্মত্যাগের কথা জানে খুব কম মানুষই। বিশেষ করে বর্তমান প্রজন্ম এ সম্পর্কে প্রায় কিছুই জানে না। কেননা মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক লেখাগুলোতে রেদকিন প্রসঙ্গের তেমন উল্লেখ নেই। অথচ এ আত্মত্যাগের ঘটনা শুধু ইতিহাস গ্রন্থে নয়, পাঠ্যবইয়েও স্থান পাওয়া উচিত বলে মনে করি।
২.
দেরিতে হলেও আমাদের মুক্তিযুদ্ধের বিদেশি বন্ধুদের স্মরণ করার জন্য তাদের সম্মাননা জানানোর প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে কয়েক বছর আগে। এ জন্য সরকারকে ধন্যবাদ জানাই। ২০১৬ সালে বিজয়ের ৪৫তম বার্ষিকী উদ্যাপন উৎসবে সরকারের আমন্ত্রণে চট্টগ্রাম বন্দরে মাইন অপসারণ কার্যক্রমে অংশ নেয়া সোভিয়েত উদ্ধারকারী দলের চার সদস্য সস্ত্রীক বাংলাদেশ সফরে এসেছিলেন। সরকারের পক্ষ থেকে তাদের সম্মাননা প্রদান করা হয়।
তারা স্মৃতিচারণ করেন জীবনের ঝুঁকি নিয়ে পানির নিচে মাইন অপসারণের সেই দুঃসাহসী ঘটনার। নেভাল একাডেমিতে গিয়ে রেদকিনের সমাধিতে শ্রদ্ধা নিবেদনও করেন তারা। ৮০০ সদস্যের উদ্ধারকারী দলটির অনেকেই আজ আর বেঁচে নেই। এ দলের প্রয়াত সদস্য ভ্লাদিমির মলচানভ এবং ভিক্তর কঝুরিন চট্টগ্রাম বন্দরের মাইন অপসারণ কার্যক্রমের ওপর ‘The Fairway is Clean Again’ নামে একটি বই লিখেছেন। বাংলাদেশ সফরকারী দলের সদস্যরা প্রধানমন্ত্রীকে এর কপি উপহার দেন এবং বইটি বাংলায় অনুবাদ করানোর অনুরোধ রাখেন।
৩.
ছাত্রজীবনে সোভিয়েত কূটনীতিকদের সঙ্গে যোগাযোগের সূত্রে চট্টগ্রাম বন্দরের মাইন অপসারণের ঘটনা এবং এ দেশের জন্য এক রুশ তরুণের আত্মত্যাগের কথা শুনেছিলাম বটে, তবে তার সমাধিটি কোথায় তা জানা ছিল না। সত্যি বলতে কী, তাকে যে এ দেশেই সমাহিত করা হয়েছে তাও ছিল অজানা। সম্প্রতি এক আত্মীয়ের বিয়ে উপলক্ষে চট্টগ্রাম গেলে সুযোগ হয় নেভাল একাডেমিতে যাওয়ার। সেখানে আকস্মিকভাবেই রেদকিনের সমাধিটি নজরে পড়ে, মোজাইক করা একটি স্মৃতিস্তম্ভসহ।
মনে পড়ে যায় এ দেশের জন্য তার সর্বোচ্চ ত্যাগের ঘটনাটি। তার সমাধির সামনে দাঁড়িয়ে কিছু সময় কাটাই। স্মৃতিস্তম্ভ ও সমাধির বেদিতে বাংলা ও ইংরেজিতে লেখা রয়েছে : ‘বাংলাদেশ সরকার এবং সোভিয়েত সরকারের মধ্যে ১৯৭২ সালের ২২ মার্চ তারিখের চুক্তি অনুযায়ী সোভিয়েত উদ্ধারকারী দল চট্টগ্রাম বন্দরে মাইন ও নিমজ্জিত জাহাজ অপসারণের কাজে লিপ্ত হন এবং বিপুল ত্যাগ ও নিঃস্বার্থভাবে উক্ত কাজ সম্পন্ন করেন।
সোভিয়েত নাবিক ইউ. ভি. রেদকিন উক্ত উদ্ধার কাজে নিয়োজিত থাকাকালীন মৃত্যুবরণ করেন।’ সমাধিগাত্রে রুশ ভাষায় রেদকিনের জন্ম ও মৃত্যু সাল উল্লেখ রয়েছে যথাক্রমে ১৯৫১ ও ১৯৭৩। অর্থাৎ তার যখন মৃত্যু হয় তখন তিনি মাত্র ২২ বছরের টগবগে তরুণ। বেঁচে থাকলে আজ তার বয়স হতো ৬৭।
পেছন ফিরে তাকাই। সামনে সুবিশাল বঙ্গোপসাগর। নৌবাহিনীর এক কর্মকর্তা জানালেন, এ স্থানেই চালানো হয়েছিল মাইন অপসারণ অভিযান। আশ্চর্য, তার পাশেই ঘুমিয়ে আছেন রেদকিন। কিছুক্ষণ পরপর পাড়ে বঙ্গোপসাগরের ঢেউ আছড়ে পড়ে ভিজিয়ে দিচ্ছে জায়গাটি।
সাগরের পানি ছুঁয়ে দিচ্ছে তার কবরটিও। যেন বুলিয়ে দিচ্ছে ভালোবাসার পরশ। শান্তিতে ঘুমাক মানুষটি! এ দেশের ‘লাইফলাইন’ বাঁচাতে নিজের লাইফটাই দিয়ে গেছেন তিনি। এই বিজয়ের মাসে, ১৮ ডিসেম্বর রেদকিনের ৪৫তম মৃত্যুবার্ষিকী। দেশের ৩০ লাখ শহীদের পাশাপাশি আমরা কি তাকেও স্মরণ করব না শ্রদ্ধার সঙ্গে?
আসিফ রশীদ : সাংবাদিক ও লেখক
arbangladesh@gmail.com
