Logo
Logo
×

বাতায়ন

মহীয়সী রোকেয়ার ‘বেগম মুক্তি’ ইতিহাসের দাবি

Icon

এ কে এম শাহনাওয়াজ

প্রকাশ: ২১ জানুয়ারি ২০১৯, ০৬:০০ পিএম

প্রিন্ট সংস্করণ

মহীয়সী রোকেয়ার ‘বেগম মুক্তি’ ইতিহাসের দাবি

মহীয়সী রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন।ফাইল ছবি

মহীয়সী রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন উনিশ শতকের শুরুতে শুধু নারীকে সমাজের অচলায়তনের বন্দিত্ব থেকে মুক্ত করার জন্য সংগ্রামে নামেননি, বরং তার কর্মতৎপরতায় ছিল এমন এক জ্যোতি যার চর্চা বর্তমান সময়েও যে কোনো সংকীর্ণতা থেকে বেরিয়ে আসার প্রেরণা জোগায়।

কিন্তু দুর্ভাগ্য, আমাদের সংস্কৃতিচর্চা, নারীবাদচর্চা ও রাজনীতিচর্চা এমন গণ্ডিবদ্ধতায় পড়ে আছে যে, তা আমাদের চিন্তার জগতে একটি বন্ধ্যত্ব তৈরি করে ফেলেছে। ইতিহাসবিচ্ছিন্নতা আমাদের দৃষ্টিভঙ্গিকেও অনেকটা আড়ষ্ট করেছে।

আমরা বস্তুগত লাভালাভের হিসাবে এতটাই আটকে পড়েছি যে বুঝতে চাই না ফল্গুধারার গোপন ও নীরব জলসিঞ্চন উর্বর আর সজীব রাখতে পারে ভূমি। এ যন্ত্রযুগে আমরা ধ্রুপদী জ্ঞানচর্চাকে উপেক্ষা করছি বেশি।

নীতিশিক্ষা বিষয়ক সাহিত্য, মহান মানুষদের জীবনধারা-জাতীয় লেখাগুলো শিশু শিক্ষার্থীদের পাঠ্যবই থেকে প্রায় উধাও হয়ে যাচ্ছে। আমাদের ছেলেবেলায় রোকেয়াকে জানার সুযোগ যতটা ছিল, এখন তেমনটা দেখি না।

দেশজুড়ে রোকেয়াচর্চা ছড়িয়ে দেয়ার জন্য তেমন সজীব রোকেয়াচর্চা কেন্দ্র এ দেশে কাজ করছে তেমনটিও আমার জানা নেই। অথচ রোকেয়া চর্চাকে প্রায় বিশ বছর ধরে জীবন্ত রেখেছে পশ্চিমবঙ্গভিত্তিক প্রতিষ্ঠান ‘রিভার’ (রোকেয়া ইন্সটিটিউট অব ভ্যালু এডুকেশন রিসার্চ), সংক্ষেপে বলা হয় ‘রোকেয়া গবেষণা কেন্দ্র’। রোকেয়া সম্পর্কে তথ্যসূত্র পাওয়া খুব সহজ নয়।

তবুও অক্লান্ত পরিশ্রম করে এ সংগঠন তাদের গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছে এবং রোকেয়া সম্পর্কে তথ্যভাণ্ডার সমৃদ্ধ করছে। সংগঠনটি স্কুলে স্কুলে রোকেয়া সম্পর্কে পাঠচক্র করছে। রোকেয়াচর্চার সঙ্গে যুক্ত করছে নতুন প্রজন্মকে। তাদের প্রধান উদ্দেশ্য এ চর্চার মধ্যদিয়ে নারী অগ্রগতির পথকে মসৃণ করা এবং অসাম্প্রদায়িক চেতনা ছড়িয়ে দেয়া।

গত ১৫ জানুয়ারি আমার জন্য ছিল একটি গুরুত্বপূর্ণ দিন। এদিন কলকাতায় রোকেয়া প্রতিষ্ঠিত সাখাওয়াত মেমোরিয়াল স্কুলে একটি ভিন্নরকম অনুষ্ঠানে যাওয়ার আমন্ত্রণ পেয়েছিলাম। রিভারের কেন্দ্র এখন এখানে প্রতিষ্ঠিত।

রোকেয়ার উত্তরসূরি তার ছোট বোনের ছেলে মানবতাবাদী আমির হোসেন চৌধুরী ১৯৬৪ সালের ১৫ জানুয়ারি ঢাকায় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় শহীদ হয়েছিলেন। তার স্মরণে সাখাওয়াত মেমোরিয়াল স্কুল চত্বরে দুটো বৃক্ষ রোপণ করা হয়।

একটি দেবদারু গাছ, ভাগলপুরে রোকেয়ার শ্বশুরবাড়ি থেকে আনা। এ চারাটি করা হয়েছে রোকেয়ার সময়ে রোপিত বৃক্ষ থেকে। আর অন্যটি একটি আম চারা, যে চারার উৎস ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের লাগানো গাছ।

এ অনুষ্ঠানের একপর্যায়ে রিভারের প্রাণপুরুষ প্রাণতোষ বন্দ্যোপাধ্যায় এবং স্কুলের প্রধান শিক্ষক পাপিয়া নাগ আমাকে অবাক করে দিয়ে জানালেন, জন্মলগ্নে ‘বেগম রোকেয়া গবেষণা কেন্দ্র’ হিসেবেই প্রতিষ্ঠানটি যাত্রা শুরু করেছিল। ‘বেগম’ যুক্ত রোকেয়া নামে বইও প্রকাশ করেছেন তারা।

বছর পনেরো আগে বাংলাদেশের একটি জাতীয় দৈনিকে ইতিহাসের বিচারে রোকেয়াকে ‘বেগম রোকেয়া’ লেখায় কী অন্যায় আর বিভ্রান্তি রয়েছে তা নিয়ে আমার একটি বিশ্লেষণধর্মী নিবন্ধ প্রকাশিত হয়েছিল। লেখাটির বক্তব্য তাদের কাছে যৌক্তিক মনে হয়।

এবং তারা সাংগঠনিকভাবে সিদ্ধান্তে আসেন এই প্রতিষ্ঠান রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের নামের আগে আর ‘বেগম’ ব্যবহার করবেন না। এ অনুষ্ঠানে আমাদের বিশিষ্ট লেখক মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি শ্রদ্ধেয় মফিদুল হকও উপস্থিত ছিলেন। তিনি জানালেন রোকেয়া নামের আগে বেগম ব্যবহার না করার আহ্বান জানিয়ে তিনিও কাগজে লিখেছিলেন।

আমি স্মৃতিচারণ করলাম। পত্রিকায় আমার লেখাটি প্রকাশিত হওয়ার পর অনেকে বিতর্ক করেছিলেন। আমার খুব নিকটজন এবং সুলেখিকা আমার কথা গ্রহণে দ্বিধা প্রকাশ করেছিলেন। গভীরভাবে না ভেবে বলেছিলেন ‘বেগম রোকেয়া’ নামটি প্রচলিত হয়ে গেছে।

তাহলে কেন আবার বিতর্ক তোলা। যাই হোক ঐতিহাসিক তাৎপর্য আর সংকট আমাদের দেশের সংশ্লিষ্টদের না বোঝাতে পারলেও রিভারের পরিচালকরা বুঝতে পারায় আমি আমার কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছি।

এ দেশের কাগজে কী লেখা হল আর অজ্ঞাতকুলশীল আমরা কী লিখলাম তা নিয়ে ভাবার অবকাশ গুণীজনদের থাকবে কেন! তাই এরপর রংপুরে মহীয়সী রোকেয়ার নামে বিশ্ববিদ্যালয় হয়ে গেল আর অবলীলায় এর নামকরণ হল ‘বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়’।

প্রধান শঙ্কা আমার ছিল এই যে, এত বছর পর নতুন প্রজন্মের কাছে ‘বেগম’ রোকেয়ার নামের অবিচ্ছেদ্য অংশ মনে হতে পারে। সে ক্ষেত্রে ইতিহাস বিকৃত হবে। আর তা না ভাবলে যে বিভ্রান্তি তৈরি হতে পারে তাতে রোকেয়ার মূল্যায়ন সংকীর্ণ হয়ে পড়বে। আমার এই আশঙ্কাটি অনেকটা সত্য হল।

সম্প্রতি সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত প্রগতিশীল আমার এক ছাত্রী এমন এক প্রশ্ন নিয়ে এলো। বলল, স্যার রোকেয়াকে আমরা নারীমুক্তির অগ্রদূত বলি; কিন্তু তিনি নিজেই তো রক্ষণশীলতা থেকে বেরোতে পারেননি। মুসলিম নারীর আভিজাত্যে নিজেকে জড়িয়ে রেখেছিলেন। তাই তিনি নামের সঙ্গে মুসলিম নারীর আভিজাত্য ও সম্মানের প্রতীক ‘বেগম’ শব্দটি যুক্ত রেখেছেন।

কিন্তু আমাদের দুর্বল শব্দ প্রয়োগের দায় স্বয়ং রোকেয়ার ওপর বর্তাতে পারে না। পাঠক, খোঁজ করলে জানবেন জীবদ্দশায় রোকেয়া তার নামের আগে ‘বেগম’ শব্দ যোগ করেননি। তার পারিবারিক ও ব্যক্তিগত পত্রে অবস্থাভেদে তিনি ‘রোকেয়া’ অথবা ‘রুকু’ লিখেছেন। স্কুল প্রতিষ্ঠার পর দাফতরিক চিঠিপত্রে আর. এস. হোসাইন (রোকেয়া সাখাওয়াত হোসাইন) স্বাক্ষর করেছেন। আর নিজের লেখা গ্রন্থে রোকেয়া সাখাওয়াত হোসাইন লিখেছেন।

আমি একজন নারীবাদী গবেষককে বলতে শুনেছি, মহিলারা নামের সঙ্গে স্বামীর নামের অংশ যুক্ত করে নিজেদের পুরুষ দাসত্ব মেনে নিচ্ছেন। এসবই উগ্রবাদী চিন্তা। রোকেয়া যে মহীয়সী রোকেয়া হয়ে উঠেছিলেন, এর জন্য তিনি নিজেই দু’জন পুরুষের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়েছিলেন।

একজন বড়ভাই ইব্রাহীম সাবের। যিনি সমাজের ভ্রুকুটি উপেক্ষা করে গভীর রাতে প্রদীপের আলোতে বোনকে ইংরেজি শিক্ষা চর্চা করাতেন। অন্যজন তার স্বামী সাখাওয়াত হোসেন। যিনি স্ত্রীর নারীশিক্ষার পক্ষে কাজ করাকে উৎসাহ দিয়েছিলেন এবং রোকেয়ার স্বপ্ন মেয়েদের স্কুল প্রতিষ্ঠার জন্য মৃত্যুর আগে দশ হাজার টাকা রেখে গিয়েছিলেন।

এটি বুঝতে অসুবিধা নেই যে, পরবর্তী সময় রোকেয়াকে সম্মানিত করতে ‘বেগম’ শব্দ যুক্ত হয়েছিল। যেমন পুরুষ হলে আমরা ‘জনাব’ ব্যবহার করি। কিন্তু বিপদ হচ্ছে যখন অতি ব্যবহারে তা নামের অংশ করে ফেলি। আমাদের সমাজে অনেক মেয়ে পাব যাদের নামই বেগম।

ফলে নতুন প্রজন্মের কাছে বেগম রোকেয়া একটি অবিভাজ্য নামে পরিণত হতে বাধ্য। যা ইতিহাসের সত্যকে খণ্ডিত করবে। আমরা যদি একদিন শাহবাগের মোড়ের সাইনবোর্ডটিতে লেখা দেখি ‘জনাব বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়’- তখন যেমন হোঁচট খেতে হবে, তেমনি বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় নামে একইভাবে অস্বস্তি তৈরি হওয়ার কথা।

আমি শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করতে চাই তাদের প্রতি, যারা অনেক কাল আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মেয়েদের হলের নাম রেখেছিলেন ‘রোকেয়া হল’। ইতিহাসবোধ ও সত্যের প্রতি তাদের নিষ্ঠা ছিল। তাই অপ্রয়োজনীয় ‘বেগম’ শব্দটি যুক্ত করেননি। সম্প্রতি আমার হাতে এসেছে একটি রোকেয়া স্মারক পত্রিকা।

এটি ২০১৮-এর ডিসেম্বরে প্রকাশ করেছে মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়। আমাদের অপূর্ণ ইতিহাসবোধের অগভীরতার প্রকাশ এখানে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। একটি প্রকাশনা সব সময়ই আর্কাইভাল রেকর্ড। একে যত্নে ও সতর্কতায় প্রকাশ করতে হয়। সরকারি এ প্রকাশনাটি একটি দালিলিক নথি হিসেবেই টিকে থাকবে।

পত্রিকাটির প্রচ্ছদ দেখে প্রথম হালকা হোঁচট খেলাম। দুই লাইনে লেখা আছে ‘শিক্ষাব্রতী রোকেয়া’। ‘রোকেয়ার’ অর্ধমাত্রাযুক্ত (ভুল) বানান খুব কষ্ট দিল। তবুও আনন্দ পেলাম বেগম যুক্ত না থাকায়। পাতা উল্টাতেই দেখি রোকেয়া জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে প্রকাশিত স্মারক ডাকটিকিটের ছবি।

সেখানে যথারীতি বেগম যুক্ত হয়ে আছে। এরপরে একে একে মুদ্রিত দেখলাম ‘বেগম রোকেয়া দিবস ২০১৭’, পদক প্রদান অনুষ্ঠানের মঞ্চশোভিত হয়ে আছে ‘বেগম রোকেয়া পদক ২০১৭’। এরপর মুদ্রিত সব বিশিষ্টজনের বাণীতেই বেগম রোকেয়া লিখতে কার্পণ্য করা হয়নি।

প্রকাশিত বেশিরভাগ লেখাতেই লেখকগণ বেগম ব্যবহার করেছেন। তবে এই ব্যতিক্রমও ছিল। কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেন, প্রাণতোষ বন্দ্যোপাধ্যায়, মোরশেদ শফিউল হাসান, ড. ফেরদৌসী বেগম, রাজিব সরকার, পিকসি নাজনীন, অসীম সাহা সতর্কভাবেই বেগম ব্যবহার করেননি।

আমি বিস্মিত হয়েছি সরকারের মন্ত্রণালয় থেকে প্রকাশিত এ গুরুত্বপূর্ণ দলিলটির সম্পাদনার দুর্বলতা দেখে। এই যে একই পত্রিকায় অবলীলায় বেগম যুক্ত ও বেগম মুক্তভাবে রোকেয়া উপস্থিত হলেন এই বিভ্রান্তি দূর করার দায় তো সম্পাদনা বিভাগেরই ছিল। দায়িত্বশীল জায়গা থেকে এমন অসতর্কতা প্রত্যাশিত নয়।

আমাদের দেশ যেহেতু নানা দিক থেকে এগিয়ে যাচ্ছে, তাই সরকার ও সরকারবহির্ভূত আমাদের সবারই ঐতিহ্য সংরক্ষণে সতর্ক হওয়া প্রয়োজন। হঠাৎ ধনী নানা চাকচিক্যে নিজেকে উজ্জ্বল করতে চাইলেও ঐতিহ্যহীনতায় বনেদি ভাব প্রকাশ পায় না।

ঐতিহাসিকভাবে বাঙালি জাতির যেমন অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি ছিল তেমনি সমৃদ্ধ ছিল এর ঐতিহ্যের ভাণ্ডার। আজ ঐতিহ্যের সত্য ও সৌন্দর্যকে ধারণ না করে যদি ভুঁইফোড় ধনীর আচরণ করি, তবে তা আমাদের শুধু বিষণ্ণই করবে না এক ধরনের মূর্খতারও প্রকাশ ঘটাবে।

আমাদের এগিয়ে চলার পথে রোকেয়াচর্চা এ সময়ে খুবই প্রাসঙ্গিক। এ কারণে সঠিক রোকেয়া সাখাওয়াতই উপস্থাপিত হওয়া উচিত বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের সামনে। ‘প্রচলিত হয়ে গেছে’ জাতীয় হালকা বিবেচনায় রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের সঙ্গে বেগম জুড়ে দেয়া সত্য এবং ইতিহাস বিকৃতির নামান্তর। রোকেয়া তো আমাদের মতো সামান্য কেউ নন। তাই এই অসামান্য মহীয়সীর নামের সামনে থেকে ‘বেগম’ মুক্ত করা এখন ইতিহাসেরই দাবি।

ড. এ কে এম শাহনাওয়াজ : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

shahnaway7b@gmail.com

মহীয়সী রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম