Logo
Logo
×

বাতায়ন

শিক্ষা, সংস্কৃতি ও সংবাদপত্র

Icon

সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম

প্রকাশ: ০৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৮, ০৬:০০ পিএম

প্রিন্ট সংস্করণ

যুগান্তর তার প্রতিষ্ঠার পর অনেকগুলো বছর পেরিয়ে এলো। পত্রিকাটি এখন সারা বাংলাদেশেই জনপ্রিয়, প্রধানত এর বস্তুনিষ্ঠ ও সত্যসন্ধ সাংবাদিকতার জন্য এবং দুর্নীতি, সামাজিক অবিচার ও শোষণ-বঞ্চনার বিরুদ্ধে এর সাহসী অবস্থানের জন্য। একই সঙ্গে পত্রিকাটি বাঙালি সংস্কৃতিকে এর অগ্রাধিকারের তালিকায় রেখেছে, শিক্ষার ক্ষেত্রেও এর রয়েছে দৃঢ় অঙ্গীকার। বাংলাদেশের শিক্ষাচিত্র বরাবরই যুগান্তর-এর মনোযোগের কেন্দ্রে রয়েছে। যখনই শিক্ষা নিয়ে কোনো সংবাদ হয়, যার প্রভাব দূরবিস্তারী, যুগান্তর তাকে প্রথম পৃষ্ঠায় স্থান দেয়। তাছাড়া এর সম্পাদকীয়, উপসম্পাদকীয় কলামে শিক্ষা ও সংস্কৃতি বরাবর একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে দাঁড়ায়।

সংস্কৃতি এবং শিক্ষার বিষয়টি নিয়ে হয়তো একটা প্রশ্ন উঠতে পারে- একটি সংবাদপত্র কতখানি সক্রিয়তা দেখাতে পারে এর প্রসারে? সংস্কৃতি না হয় বোঝা গেল, কিন্তু শিক্ষা? এর উত্তরে বলা যায়, সংস্কৃতি এবং শিক্ষা উভয় ক্ষেত্রে সংবাদপত্রের একটা ভূমিকা থাকে। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নয়, সাংস্কৃতিক শিক্ষা প্রসারে একটি সংবাদপত্রের পক্ষে অনেক কিছুই করা সম্ভব। তবে বিষয়টি আরও পরিষ্কার হবে যদি আমরা সংস্কৃতি ও শিক্ষার কিছু সূত্র তুলে ধরতে পারি।

শিক্ষা বিষয়টা পরিশ্রমের, চর্চার। শিক্ষাদানে পরিশ্রম আছে, শিক্ষা গ্রহণেও আছে- এই পরিশ্রমের কায়িক অংশটি গুরুতর নয়- ইটভাঙা অথবা লঞ্চঘাটে মাল টানা অনেক বেশি পরিশ্রমের। কিন্তু শিক্ষার শ্রম অংশটি আসে মেধা ও মননের অঞ্চল থেকে। অনেক পুরনো চিন্তা, মত, সংস্কার, অভ্যাস ও চর্চাকে বদলানোর মধ্যেই গুরুত্ব পায় শিক্ষার শ্রম। এই শ্রম দিতে যারা আগ্রহী, তারাই শিক্ষার সংস্কৃতিকে গ্রহণ করতে পারেন। সংস্কৃতি কোনো জড় পদার্থ নয়; এটি একবারে অর্জন করা অপরিবর্তনশীল কোনো সামাজিক চর্চা নয়। সংস্কৃতি সতত পরিবর্তনশীল, যদিও এই পরিবর্তনটি খুব সহজে বা সর্বৈব দৃশ্যমান উপায়ে ঘটে না। সংস্কৃতির ভেতরের সময়টি খুব দীর্ঘ এবং সংস্কৃতির পরিবর্তনশীলতার পেছনে কার্যকর থাকে শিক্ষা। বিষয়টা একটু ঘুরিয়ে নিলে এ রকম বলা যায় : সংস্কৃতির গতিশীলতার পেছনে আছে শিক্ষা, যেমন শিক্ষার প্রকৃত উদ্দেশ্য পূরণ করে সংস্কৃতি। এ দুয়ের মধ্যে স¤পর্কটি খুবই ঘনিষ্ঠ।

কিন্তু শিক্ষা বলতে যদি প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার কথাই শুধু উল্লেখ করা হয়, তাহলে আমরা একটি বড় ভুল করব। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ আমাদের জন্য- প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছাড়া জগতে আমরা অচল। জ্ঞান-বিজ্ঞানের রাজ্যে প্রবেশের অধিকার এ শিক্ষাই আমাদের দেয়; কিন্তু কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাই পূর্ণ হয় না, যদি তাতে যুক্ত না হয় সাংস্কৃতিক শিক্ষা। সাংস্কৃতিক শিক্ষা আমাদের প্রতিষ্ঠানগুলো সব সময় দিতে পারে না, বরং এর বিরুদ্ধ শিক্ষাই সেগুলো দেয় মাঝে মাঝে। সাংস্কৃতিক শিক্ষা দেয় পরিবার ও সমাজ- প্রধানত পরিবার। তবে এ ক্ষেত্রে মিডিয়ারও একটা ক্রমবর্ধমান ভূমিকা দেখা যাচ্ছে, বিশেষ করে নিন্মসংস্কৃতি ও অপসংস্কৃতির যে রকম আগ্রাসন নিয়ে আসছে পশ্চিমা এবং কিছু ভারতীয় টিভি চ্যানেল, তার বিপরীতে একটি সুস্থ সাংস্কৃতিক পরিবেশ গড়ে তোলা ও প্রতিপালন। পরিবার অথবা সমাজ থেকে তা না পেলে একজন শিক্ষার্থী কখনও স¤পূর্ণ মানুষ হতে পারে না। তথাকথিত অশিক্ষিত মানুষও পরিবার থেকে সাংস্কৃতিক শিক্ষা পেলে তথাকথিত অনেক শিক্ষিত মানুষ থেকে বেশি শিক্ষিত হতে পারে। যেহেতু শিক্ষার সংস্কৃতিকে সে গ্রহণ করে অনেক সহজে। দু-একটি উদাহরণ দিয়ে বিষয়টি বোঝানো যাক।

গত পনেরো-কুড়ি বছর থেকে দেশের পাবলিক পরীক্ষাগুলোতে নকলের মাত্রা কিছুটা কমেছে, যদিও এখন প্রশ্নপত্র ফাঁস হওয়াটা এক মরণ-ব্যাধির আকারে ছড়িয়ে পড়েছে। এক সময় নকলের মহোৎসব চলত। কাগজে ছবি এসেছে বিএ পরীক্ষার সময় পরিবারের লোকজন- বাবা, চাচা, মামা, ভগ্নিপতি পরীক্ষার্থীকে নকল সরবরাহ করছে। এখন দেখা যায়, বাবা হয়তো ফাঁস হওয়া প্রশ্নপত্র কিনে ছেলের হাতে দিচ্ছেন। এ রকম নকল করে অথবা ফাঁস হওয়া প্রশ্নে পরীক্ষা দিয়ে যে ছেলে পরীক্ষায় পাস করবে, সে হয়তো এক সময় চাকরি নেবে, হর্তাকর্তা হবে অথবা রাজনীতি করবে, দেশের নীতিনির্ধারক, সাংসদ ইত্যাদি হবে। যে নকল করে শিক্ষার স্তরগুলো পার হয়ে সনদ হাতে বেরিয়ে আসে, সে কাগজে-কলমে শিক্ষিত হলেও এ শিক্ষার প্রয়োগযোগ্যতা কী? গ্রহণযোগ্যতাই বা কী? সে কি শিক্ষিত? তার পরিবার কি শিক্ষিত? তার পরিবারে মূল্যবোধ এবং রুচির অবস্থা কী রকম, সে তো বোঝাই যায়। এই অশিক্ষিত-শিক্ষিতদের দৌরাত্ম্যে সমাজজীবনে পচন ধরেছে। এবং সমাজে পচন ধরেছে বলে আরও অশিক্ষিত তৈরি হচ্ছে। এক অনতিক্রান্ত বৃত্তের ভেতর আটকা পড়ে যাচ্ছি আমরা।

দ্বিতীয় আরেকটি উদাহরণ দেয়া যাক। বিজ্ঞানের একটি বিষয়ে প্রথম হয়ে এমএসসি পাস করেছে একটি ছেলে এবং দু’বছর বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতাও করল সে। তারপর বিদেশে গেল, পিএইচডি করল, তারপর দেশে ফিরে এসে আবার অধ্যাপনা শুরু করল। কিন্তু তার আচার-আচরণে শিষ্টতা অথবা সৌজন্য কিছুই নেই। পশ্চিমে সহকর্মীরা একে অন্যের, এমনকি ছাত্ররা শিক্ষকদের নাম ধরে ডাকে, সেটিই স্বাভাবিক আচার সেখানে। কিন্তু আমাদের দেশে তো তা নয়। আবার গুরুজনের সামনে সিগারেট খাওয়াটাও আমাদের দেশে ভালো চোখে দেখা হয় না, পশ্চিমে তা অনেকদিন স্বাভাবিক বলে ধরে নেয়া হতো, যদিও এখন প্রায় সর্বত্রই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ধূমপান নিষিদ্ধ। আমাদের তরুণ অধ্যাপক পশ্চিম থেকে এসব চর্চা শিখে আসল। তো একদিন শুনলাম, সে বাসার কাজের ছেলেকে এমন প্রহার করেছে যে, ছেলেটি প্রাণভয়ে বাড়ি থেকে পালিয়েছে। এই তরুণ অধ্যাপক উচ্চশিক্ষিত, কিন্তু তার সংস্কৃতির শিক্ষাটি অস¤পূর্ণ রয়ে গেছে। সে সারাজীবন অনেক সফল গবেষণা হয়তো করবে, হয়তো অনেক গবেষকও তৈরি করবে, কিন্তু মানুষ তৈরির কারিগর তাকে বলা যাবে না। যে কারিগর তার উৎপাদিত বস্তুর সব প্রয়োজনীয় উপাদান সম্পর্কে জ্ঞাত নয়, তাকে উন্নত কারিগর নিশ্চয় বলা যাবে না।

সাংস্কৃতিক শিক্ষা এবং শিক্ষার সংস্কৃতির মধ্যে যোগসূত্রটি এই যে, উভয় ক্ষেত্রে মানুষ তৈরির গুরুত্বপূর্ণ উপাদানগুলো প্রাধান্য পায়। এই উপাদানগুলোর মধ্যে অবশ্য প্রয়োজনীয় অর্থাৎ যার অভাবে মানুষ মানুষ হয় না, শিক্ষা শিক্ষা হয় না, তা হচ্ছে এই প্রসারতার বিপরীত। আমরা প্রতিদিনের দিনযাপনে সঙ্কীর্ণতাটাই বেশি দেখি- প্রসারতা, গভীরতা দেখি না। স্বার্থপরতা, আত্মার অহমিকা হচ্ছে এই সঙ্কীর্ণতা; আর একটি মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি, সহনশীল এবং প্রজ্ঞাবান দৃষ্টি, নিজের বাইরে অন্যের দিকে, সমাজের দিকে মনোযোগী হওয়া হচ্ছে প্রসারতার লক্ষণ। শিক্ষার উদ্দেশ্য মুখস্থবিদ্যায় পারদর্শী কিছু তোতাপাখি সৃষ্টি নয় বরং যুক্তি-তর্ক ও বিচার বোধসম্পন্ন মনন সৃষ্টি করা। বলা হয়ে থাকে, পশ্চিমে আধুনিক যুগ শুরু হয়েছে পঞ্চদশ শতাব্দীর রেনেসাঁসের সময় থেকে এবং এর পরিপূর্ণতা এসেছে অষ্টাদশ শতকের এনলাইটেনমেন্ট বা জ্ঞানালোকপ্রাপ্তি কালে। এই সময়ে মানুষ নিজের মধ্যে বিশ্বকে অবলোকন করেছে, প্রশ্ন করেছে, সংস্কার ও অন্ধ প্রচলনকে ভেঙেছে। বস্তুত যে মানুষ প্রশ্ন করতে জানে না, যুক্তি-বিচার ছাড়া অন্ধভাবে সবকিছু গ্রহণ করে, আবেগটাকেই সবচেয়ে বড় শক্তি হিসেবে দেখে, সে আধুনিক মানুষ নয়। শিক্ষার সংস্কৃতি হচ্ছে এই আধুনিক মনস্কতাকে গ্রহণ করা।

শিক্ষার সংস্কৃতি হচ্ছে ভালো-মন্দ, শুভ-অশুভের বিশ্লেষণ ও পার্থক্য করতে শেখা এবং নান্দনিক দৃষ্টির অধিকারী হওয়া। এই সংস্কৃতি আমাদের শিক্ষায় অনেকটা ঠোঁটসেবার মতো দেয়া হয় বটে; কিন্তু প্রকৃত পাঠটি গ্রহণ করা এবং পাঠ গ্রহণের মাধ্যমে হৃদয়ে তা ধারণ করা অনেক বড় ব্যাপার। আমাদের দেশে দুর্নীতিচিত্র নিয়ে অনেক প্রতিবেদন বেরিয়েছে বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা ও গবেষণা সংস্থার প্রকাশনায়। একটি চাঞ্চল্যকর, যদিও সবার জানা, সত্য বেরিয়ে এসেছে কোনো কোনো প্রতিবেদনে : দুর্নীতির প্রায় নব্বই ভাগের জন্য দায়ী তথাকথিত শিক্ষিত মানুষরা। অবস্থা এমন এক পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, ঘুষ নেয়া যে খারাপ কাজ, কাজে ফাঁকি দেয়া যে দুর্নীতি সে বিষয়টি নিয়েও এখন কেউ প্রশ্ন তোলে না। মানুষের সঙ্গে ক্ষমতার অপব্যবহার করা, খারাপ আচরণ করা, মানুষকে অকারণে বিপদে ফেলা- এসব অনৈতিকতাকেও আমরা সয়ে নিয়েছি। এ জন্য সকালে খবরের কাগজে ভয়ানক সব অন্যায়-অবিচারের খবর পড়েও আমরা নিশ্চিত ও প্রফুল্ল মনে অফিসে যাই, স্কুল-আদালতে যাই। আমরা শিক্ষা পেয়েছি, পেয়ে যাচ্ছি, কিন্তু শিক্ষার সংস্কৃতি রয়ে গেছে আমাদের নাগালের বাইরে।

শিক্ষার সংস্কৃতিই সভ্যতাকে নির্মাণ করে এবং ভিত্তিটি গেঁথে এর দরদালান তুলে দেয়। একা শিক্ষা মানুষের মধ্যে সৌন্দর্যবোধ সৃষ্টি করতে পারে না, এ জন্য একটি আবহের প্রয়োজন হয়, আবহটা আসবে সমাজ থেকে, জনগোষ্ঠী থেকে এবং এই সমাজ বা জনগোষ্ঠী দীর্ঘদিনের চর্চায় এবং একটি গ্রহণ ও বর্জন প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে সৌন্দর্যের উপাদানগুলো ছেঁকে আনবে অসুন্দরকে বিসর্জন দিয়ে। একটি জাতি যদি শিক্ষার সংস্কৃতিকে গুরুত্ব দেয়, দেখা যাবে সেই জাতির সব কাজেই সৌন্দর্য রয়েছে। সে জাতির দৈনন্দিন জীবনাচরণে, আহার গ্রহণে, ঘর সাজানোতে, শহর পরিকল্পনায়, শিশুদের লালন-পালনে- সব ক্ষেত্রে সৌন্দর্যের প্রকাশ ঘটে। আমাদের ক্ষেত্রে ঘটে এর বিপরীত। আমরা কি জোর দিয়ে বলতে পারব, সেই সৌন্দর্য আমাদের মধ্যে আছে? আমাদের রান্নাঘর আর বাথরুমের দিকে নজর দিলে বুঝতে পারব, কী অসম্ভব অসুন্দর আমাদের জীবনযাত্রা। যে ঘরে খাদ্য তৈরি হচ্ছে, সে ঘরটিই সবচেয়ে নোংরা আমাদের দেশে। শিশুদের আমরা অসম্ভব আদর-যত্নে লালন করি বটে, কিন্তু তাদের জন্য পরিবেশটা অসম্ভব নোংরা করে রাখি। যে মানুষ জঙ্গলের গাছ কেটে চোরাই বাজারে পাঠায়, যে অকাতরে বৃক্ষ নিধন করে, পাহাড় কাটে, জলাভূমি ভরাট করে জবরদখল করে, সে কি শিশুদের, এমনকি তার নিজের সন্তানদের, ভালোবাসে? না। তার ভালোবাসাটি ভয়ানক স্বার্থপর; কিন্তু অপ্রকৃত। সে ভালোবাসে কেবল নিজেকেই, অথচ সে বুঝতে পারে না এই অনাদরে কী সর্বনাশ করছে প্রকৃতির, সভ্যতার। সেটি যখন সে বুঝতে পারে, তখন অনেক দেরি হয়ে যায়।

একইভাবে, যারা সন্ত্রাস ও সহিংসতার পথ বেছে নেয় সমস্যা সমাধানের জন্য, যুক্তিতর্ককে আমলে আনে না তারাও সমাজ, প্রকৃতি ও সভ্যতার বিরুদ্ধে বড় অপরাধী। দুঃখজনক সত্য হচ্ছে, এই অপরাধীদের সংখ্যা বাড়ছে এবং এদের নিয়েই থাকতে হচ্ছে আমাদের। এদের কেউ কেউ শিক্ষা পেয়েছে; কিন্তু শিক্ষার সংস্কৃতি এদের নাগালের বাইরে রয়ে গেছে।

অন্য দুঃখজনক সত্য হচ্ছে এই যে, আমাদের মুখস্থবিদ্যানির্ভর শিক্ষাব্যবস্থায় সংস্কৃতি পুরোপুরি অবহেলিত। বর্তমানে শিক্ষাব্যবস্থা ও পরীক্ষা গ্রহণ পদ্ধতিটা আমার একেবারেই মনোপূত নয়। এই ব্যবস্থায় ছাত্রছাত্রীর সৃজনশীলতা মোটেই উৎসাহিত হয় না। হয় শুধু মুখস্থ করার মনোবৃত্তি। অন্যের লেখা জিনিস মুখস্থ করে জিপিএ-৫ ইত্যাদি পাওয়া কি গৌরব? আমাদের পরীক্ষা পদ্ধতিতে অন্যের সঙ্গে প্রতিযোগিতাটাই মুখ্য, অথচ আদর্শ হওয়া উচিত নিজের সঙ্গে প্রতিযোগিতা। নিজের ষোল আনা মেধা ও মনীষাকে কাজে লাগানোর প্রতিযোগিতা। পাঁচজন প্রাইভেট টিউটর রেখে আঠারো ঘণ্টা পাঠ মুখস্থ করে গোল্ডেন জিপিএ পেয়ে বাবা-মাকে সোফায় দু’দিকে বসিয়ে ছবি তুলে ছাপানোর কোনো বড় কৃতিত্ব নেই, যতটা আছে নিজের সৃজনশীল ক্ষমতাকে সর্বোচ্চ পর্যায়ে নিয়ে গিয়ে প্রকৃত জ্ঞান লাভ করায়।

যারা নিজেদের মেধার চর্চা করে, পাঠ্যবইয়ের অতিরিক্ত বই পাঠে সময় দেয়, লেখালেখির চেষ্টা করে, সমাজের মানুষের কথা ভাবে, যাদের আচরণে গরিব মানুষ ব্যথা পায় না, সন্তুষ্ট হয় বরং; যারা নিজেদের স্বার্থকে প্রধান করে না, যাদের মধ্যে সৌন্দর্যবোধ প্রবল, তারা প্রত্যেকে নিজস্ব পথে শিক্ষার সংস্কৃতিকে গ্রহণ করেছে অথবা গ্রহণ করার চেষ্টা করছে। একজন সত্যিকার শিক্ষার্থী- যে শিক্ষা এবং শিক্ষার সংস্কৃতি, উভয়ই গ্রহণ করে জগৎটাকে একটা খোলা বইয়ের মতো পড়তে পারে। কারণ জগৎটা বিশাল, অবারিত। দৃষ্টিস্বল্পতা বা মাইয়োপিয়া আক্রান্ত মানুষ সেই জগৎকে পড়তে পারবে না। যাদের দৃষ্টি প্রসারিত, তাদের মনটা সঙ্কীর্ণ নয়। শিক্ষার সংস্কৃতি, আমি আগেই বলেছি, দৃষ্টি ও মননের প্রসারতা ঘটায়।

২. আমাদের দেশে এক সময় স্কুল-কলেজগুলো যথেষ্ট স্বাবলম্বী ছিল। স্বাবলম্বী এই অর্থে যে, স্কুলের পড়াশোনা ও অন্যান্য অ্যাকাডেমিক চর্চাকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে স্কুল সময়ের ভেতরেই ছাত্রছাত্রীদের তা দেয়ার ব্যবস্থা করা হতো এবং শিক্ষকদের তা দেয়ার যোগ্যতা ছিল। সম্পদ এখনকার তুলনায় অনেক বেশি সীমিত ছিল; কিন্তু শিক্ষাদানে নিষ্ঠার কোনো কমতি ছিল না। শিক্ষকরা এখনকার শিক্ষকদের তুলনায় অনেক অসচ্ছল ছিলেন, কিন্তু গৃহশিক্ষকতার প্রচলন প্রায় ছিল না-ই বলা যায়। অনেক গ্রামের স্কুলের ছেলেমেয়েরা ম্যাট্রিক খুব ভালো ফল করত; তবে সাধারণ ছাত্ররা যে জ্ঞান পেত, তার মান অনেক উন্নত ছিল। এখন অনেক স্কুল অভিভাবকদের থেকে ডোনেশন নিয়ে তহবিল বাড়ায়; কিন্তু জ্ঞান উৎপাদনে তাদের ভূমিকা যথেষ্ট নয়। বাংলা এবং ইংরেজি শিক্ষাদানে আগের মান আর নেই অথচ শিক্ষা ব্যবস্থার ক্রমবিকাশে মান আরও বাড়ার কথা ছিল। আমার একটা কথা সব সময় মনে হয় যে, আমরা শিক্ষার পরিমাণগত বৃদ্ধি যতখানি অর্জন করেছি, মানগত উন্নতি ততটুকু করতে পারিনি। বরং দেখা যাচ্ছে পরিমাণ যত বাড়ছে, মান তত কমে যাচ্ছে। এর একটি কারণ শিক্ষাকে জাতীয় অগ্রাধিকারের তালিকায় প্রথম স্থানটি না দেয়া। আমাদের দেশে বাজেট বরাদ্দের সময় কাগজে-কলমে শিক্ষাকে এক নম্বর রাখা হয়; কিন্তু সবারই জানা, প্রয়োজনের তুলনায় তা নিতান্তই অকিঞ্চিৎকর। এ জন্য অবশ্য দায়ী একটি সু¯পষ্ট শিক্ষানীতির অভাব। যদি একটি সুস্পষ্ট শিক্ষানীতি থাকে আমাদের, যাতে দীর্ঘমেয়াদি একটি পরিকল্পনাও অন্তর্ভুক্ত করে, তাহলে সেই পরিকল্পনা অনুযায়ী অন্যান্য খাত, বিশেষ করে অনুৎপাদনশীল খাত থেকে পয়সা বাঁচিয়ে শিক্ষার ক্ষেত্রে বিনিয়োগ করা সম্ভব হয়।

শিক্ষায় বিনিয়োগ করলে কী উপকার হয়, তা বোঝার জন্য শ্রীলংকা, ইসরাইল এবং ভারতের কেরালা রাজ্যের দিকে তাকালেই যথেষ্ট। শ্রীলঙ্কায় দুই দশক ধরে গৃহযুদ্ধ চলেছে, তারপরও শিক্ষা সে দেশে প্রকৃত সর্বোচ্চ অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত ক্ষেত্র। এজন্য দেশটি জীবনের সব ক্ষেত্রে এতটা উন্নতি করেছে। কেরালার ক্ষেত্রে একই কথা। আর ইসরাইলের তুলনাটা এখন বিশ্বের অনেক স্থানেই শিক্ষাব্যবস্থা উন্নয়নে ব্যবহৃত হচ্ছে। একটি যুদ্ধবাজ দেশ হয়েও শুধু ১০০ ভাগ শিক্ষিত এবং উচ্চহারে উচ্চশিক্ষিত মানুষের কারণে দেশটি এক মজবুত অর্থনৈতিক অবস্থানে রয়েছে। প্যালেস্টাইনের নেতৃত্বও শিক্ষার গুরুত্ব উপলব্ধি করে গত দেড় দশক ধরে যে উন্নতি সাধন করেছেন প্রাথমিক থেকে বিশ্ববিদ্যালয়- সব পর্যায়ের শিক্ষায়, তাতে আর এক প্রজন্মের মধ্যে ইসরাইলের সঙ্গে এর বর্তমান বুদ্ধিবৃত্তিগত বৈষম্য সম্পূর্ণ দূর হয়ে যাবে। তখন প্যালেস্টাইনের প্রতি ইসরাইলের বর্বর আচরণের জবাব ভিন্নভাবে দিতে পারবে প্যালেস্টাইনের উচ্চ শিক্ষিত প্রজন্মটি।

আমাদের স্কুলগুলোতে শ্রেণীকক্ষ নেই, বেঞ্চ নেই, ব্ল্যাকবোর্ড নেই। কোনো গবেষণাগার নেই। সবচেয়ে বড় কথা কোনো লাইব্রেরি নেই।

এই অবস্থা ৯০% স্কুলের। সরকার একটি সুন্দর শিক্ষানীতি তৈরি করেছিল ২০১০ সালে, কিন্তু এর কোনো প্রয়োগ নেই। শিক্ষানীতিতে যা নেই যেমন পিএসসি, জেএসসি পরীক্ষা- এখন দেশের ওপর চাপিয়ে দেয়া হয়েছে। শিক্ষকদের আলাদা বেতন স্কেল দেয়া হয়নি, তারা এখন রাজপথে আন্দোলন করেন সামান্য কিছু দাবি আদায়ের জন্য। ইংরেজি ও বাংলা মাধ্যম এবং মাদ্রাসা- এই তিন প্রবাহে চলছে মুখস্থনির্ভর, নকল উৎসাহিত করা শিক্ষাব্যবস্থা। এই ভয়াবহ অবস্থা যে প্রজন্ম তৈরি করছে, তারা একটা নিচু পর্যায়ের শিক্ষিত মানুষ।

একটি স্বাধীন জাতিকে পরিচালনা করার জন্য যাদের প্রয়োজন তাদের এই নিন্মশিক্ষিত বাহিনী থেকে পাওয়া যাবে না। সংস্কৃতির ক্ষেত্রে শূন্যতাটা তো আরও প্রকট। সংস্কৃতি বলতে আমরা হরফ সংস্কৃতি এবং সহজাত সংস্কৃতি অর্থাৎ যাতে মানুষের আচার-আচরণ, কর্মকাণ্ড এবং সামাজিক ও ব্যক্তিক সম্পর্কসমূহে কোনো প্রাতিষ্ঠানিক প্রশিক্ষণ ছাড়াই প্রতিফলিত হয়- উভয়কেই গণ্য করি। হরফ সংস্কৃতি অর্থাৎ শিক্ষা থেকে যা আহরিত তার একটা সুবিধা আছে¡ বিশ্বের শ্রেষ্ঠ চিন্তা, চেতনা ও চর্চাগুলো শিক্ষার মাধ্যমে আমাদের জানা হয়ে যায়। তবে শিক্ষিত মানুষের সংস্কৃতি নিয়েই শুধু ব্যস্ত হয়ে পড়লে চলবে না।

একই সঙ্গে গ্রামের শিক্ষাবঞ্চিত মানুষের সহজাত সংস্কৃতিকেও আমাদের গুরুত্ব দিতে হবে এবং স্বস্থানে পুনরাধিষ্ঠিত করতে হবে। এই সংস্কৃতিই আমাদের সংস্কৃতির আদি এবং সমৃদ্ধ একটি রূপ। আমাদের সময় উভয় ক্ষেত্রেই একটা দৈন্য অথবা সংকট লক্ষ্য করা যায়। শিক্ষিত মানুষের আচরণ থেকে এখন বোঝা মুশকিল অনেক সময় সেখানে সংস্কৃতির কোনো স্থান আছে কিনা। আবার লোকজ সংস্কৃতিতেও ‘শিক্ষিত’ শহুরে সংস্কৃতির প্রভাবে একটা সংকট সৃষ্টি হয়েছে। আমার মনে হয়, সারা দেশে শিক্ষা- বিশেষ করে জ্ঞান-বিজ্ঞাননির্ভর, যুক্তিনিষ্ঠ, সংস্কৃতিভিত্তিক শিক্ষার প্রচার করা সম্ভব হলে এই সংকট কেটে যাবে। উন্নত সংস্কৃতি ঐতিহ্য এবং কৃষ্টিকে লালন করে তার থেকে প্রতিনিয়ত গ্রহণ করে। তবে সে রকম শিক্ষার প্রচারের জন্য জাতীয় ঐকমত্য, জাতীয় প্রচেষ্টা এবং অঙ্গীকার থাকতে হবে। আপাতত তা দেখা যাচ্ছে না।

শিক্ষার সংস্কৃতি অপূর্ণ থেকে যায় যদি বিশাল জনগোষ্ঠী তাদের জীবনে সুস্থ সংস্কৃতির প্রকাশ ঘটাতে না পারে। যদি তারা অপসংস্কৃতির শিকার হয় এবং সংস্কৃতির মূল সূত্রগুলোকে বিকৃত করার চেষ্টাকে রুখে না দাঁড়ায়। বাংলাদেশের বর্তমান বাস্তবতায় এই অনভিপ্রেত বিষয়গুলো আগের যে কোনো সময়ের তুলনায় এখন গুরুত্ববহ। শিক্ষা ও সংস্কৃতির বিকাশ সাধনে এখনই আমাদের ব্রতী হতে হবে।

৪. একটি সংবাদপত্র যদি নিরপেক্ষতা ও সততার সঙ্গে কাজ শুরু করে- দেশ ও জাতির স্বার্থকেই শিরোধার্য করে নামে তার পথে, তাহলে তার পক্ষে জনগণের আস্থা অর্জন সহজ হয়। আর জনগণ যদি একবার একটি সংবাদপত্রকে আস্থায় আনে, তাকে বিশ্বাস করে, তাহলে জনগণের শিক্ষা ও সংস্কৃতি বিকাশে ওই সংবাদপত্রের যে কোনো কার্যক্রম তাদের সমর্থন পায়। ওপরে যে সংস্কৃতির শিক্ষার কথা বলা হয়েছে, শিক্ষার জন্য দেশের দল-মত নির্বিশেষে সবার যে ঐকমত্যের কথা বলা হয়েছে, সে লক্ষ্যে এরকম একটি সংবাদপত্র কাজ করে দিতে পারে। শিক্ষাকে উৎসাহিত করতে পারে। যে শিক্ষা মানুষকে উন্নত করে, তার পক্ষে প্রচার চালাতে পারে। মুক্ত-বুদ্ধির প্রসার ঘটিয়ে সেই শিক্ষার চেতনাকে তার প্রতিদিনের পাতায় প্রতিফলিত করতে পারে। বস্তুত, একটি শিক্ষিত জাতি গড়ার জন্য একটি আন্দোলনও শুরু করতে পারে এরকম একটি সংবাদপত্র।

যুগান্তর শুরু থেকে সেই কাজটি করছে এবং আমাদের ধন্যবাদার্হ হয়েছে। আগামীতেও পত্রিকাটি শিক্ষা ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে তার ভূমিকা আরও দৃঢ় করবে, অব্যাহত রাখবে, আমরা তা আশা করি।

যুগান্তর ও যুগান্তর পরিবারের জন্য শুভেচ্ছা।

সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম : অধ্যাপক, লেখক

 

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম