Logo
Logo
×

বাতায়ন

তৃতীয় মত

শক্তির উৎস বন্দুক নয় ঋণের জাল বিস্তার

Icon

আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী

প্রকাশ: ০২ এপ্রিল ২০১৯, ০৬:০০ পিএম

প্রিন্ট সংস্করণ

শক্তির উৎস বন্দুক নয় ঋণের জাল বিস্তার

মাওবাদ কী তা আজ আর বিশ্বের কোনো দেশের মানুষকে বোঝাতে হবে না। বাংলাদেশ ও ভারতের মানুষকে তো নয়ই। সূচনায় মাওবাদ ছিল একটি বিপ্লবী দর্শন। এশিয়ায় তার বিস্তার ঘটে রাজনৈতিক সন্ত্রাস হিসেবে। ভারতে এখনও এই সন্ত্রাস সক্রিয় ও অদমিত।

বাংলাদেশে পাকিস্তান আমলের শেষদিকে মাওবাদ চারু মজুমদার ও কানু সান্যালের নকশাল আন্দোলন নামেও শক্তিশালী সন্ত্রাস রূপে দেখা দিয়েছিল। এরও শাখা-প্রশাখা ছিল অনেক। তার মধ্যে শক্তিশালী ছিল সিরাজ সিকদারের সর্বহারা পার্টি।

চারু মজুমদারের নকশাল আন্দোলন পূর্ব ভারতে, বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা, আসাম রাজ্যে বিস্তার লাভ করেছিল। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর নকশাল আন্দোলনের অনুকরণে গঠিত সিরাজ সিকদারের সর্বহারা পার্টি এবং সমমনা অন্য বাম সন্ত্রাসী গ্রুপগুলো সারা দেশে, বিশেষ করে দক্ষিণ বাংলায় তৎপর হয়ে ওঠে। এদের জনসমর্থন ছিল; কিন্তু বাংলাদেশের স্বাধীন হওয়া এবং পশ্চিমবঙ্গে দীর্ঘকালের কংগ্রেস শাসনের অবসান হওয়ার পর সন্ত্রাসী বাম আন্দোলন দুর্বল হয়ে পড়ে।

বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গ সরকার কঠোর হাতে যথাক্রমে নকশাল ও সর্বহারা দলকে দমন করে। চারু মজুমদার পুলিশের হাতে ধরা পড়েন এবং জেলে তার মৃত্যু হয়। বাংলাদেশে সিরাজ সিকদার পুলিশের সঙ্গে এনকাউন্টারে নিহত হন। ভারতে ইন্দিরা গান্ধীর আমলে নকশাল আন্দোলন অত্যন্ত শক্তিশালী হয়ে উঠেছিল। কলকাতার রাজপথে নকশালি, টেরোরিস্ট ও ভারতের প্যারা মিলিটারির সম্মুখযুদ্ধ হয়েছে।

সিপিএম পশ্চিমবঙ্গ ও ত্রিপুরায় ক্ষমতায় আসার পরও নকশাল আন্দোলন শান্ত হয়নি। বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূল কংগ্রেস ক্ষমতায় আসার পরও মাওবাদী সন্ত্রাস অব্যাহত রয়েছে। ত্রিপুরা, বিহার, ছত্তিশগড় রাজ্যেও তারা তৎপর। কিন্তু চীনের মাও-পরবর্তী সরকারের আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক নীতি ও কৌশল পরিবর্তিত হওয়ার পর ভারতে তো বটেই, সারা বিশ্বেই মাওবাদী আন্দোলন দুর্বল হয়ে পড়েছে।

তার বদলে এখন বিশ্বের এক নম্বর সন্ত্রাসী আন্দোলন হিসেবে দেখা দিয়েছে তথাকথিত ইসলামী জিহাদিস্ট মুভমেন্ট। এদের অত্যাচার আরও ভয়াবহ। অনেকটা কম্বোডিয়া বা কম্পুচিয়ায় পলপটপন্থীদের নৃশংস হত্যাকাণ্ডের মতো।

বাংলাদেশে মাওবাদী সন্ত্রাস বন্ধ হওয়ার প্রধান কারণ দুটি। সাধারণ মানুষের মধ্যে সমর্থন হ্রাস এবং আওয়ামী লীগ সরকারের সঙ্গে মোকাবেলায় টিকতে না পারা। অন্যদিকে আফগানিস্তানে পাকিস্তান ও আমেরিকার মদদে তালেবান, মোজাহেদিন, আল-কায়েদাসহ বিভিন্ন জিহাদিস্ট গ্রুপ গড়ে ওঠার পর বাংলাদেশে বিএনপি ও জামায়াতের প্রশ্রয়ে এ গ্রুপগুলোর শক্তিশালী হয়ে ওঠা।

বাংলাদেশে মাওবাদী সন্ত্রাসেরই স্থলাভিষিক্ত হয়েছিল জিহাদিস্ট সন্ত্রাস। তারা আদর্শে ভিন্ন হলেও একটি লক্ষ্যের ক্ষেত্রে ছিল অভিন্ন। সেটি হল বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক সরকারকে উৎখাত। জিহাদিস্টরা এ ব্যাপারে বিএনপি ও জামায়াতের সহায়তায় সাময়িকভাবে সফল হলেও শেষ পর্যন্ত পরাজিত হয়েছে। বাংলাদেশে জিহাদিস্টদের ‘নরমুন্ডের খেলা’ বন্ধ হয়েছে এবং গণতান্ত্রিক সরকার ক্ষমতায় টিকে গেছে।

সম্প্রতি ইউরোপে জুলিয়া লভেল নামে এক গবেষকের ‘মাওইজম : এ গ্লোবাল হিস্ট্রি’ নামে একটি বই বেরিয়েছে। তার মতে, কমিউনিস্ট চীনের প্রতিষ্ঠাতা মাও জে দুংয়ের তত্ত্ব ছিল, ‘শক্তির উৎস বন্দুকের নল’ (power comes from the barrel of a gun)। এ তত্ত্বের ওপরই কমিউনিস্ট চীনের আন্তর্জাতিক রাজনীতির নীতি ও কৌশল তৈরি হয়েছিল। এ কৌশল অনুযায়ী চীন বিশ্বব্যাপী মাওবাদী তৈরি করেছে এবং তাদের সশস্ত্র শ্রেণীযুদ্ধে (যা আসলে ছিল সন্ত্রাস) সব ধরনের সাহায্য দিয়েছে।

কিন্তু এ কৌশল দ্বারা বিশ্ব কমিউনিস্ট শিবিরে বিভক্তি সৃষ্টি, সাবেক তৃতীয় বিশ্বের গণতান্ত্রিক সরকারগুলোর সঙ্গে বিবাদ তৈরি এবং কমিউনিজমকে ‘টেরোরিজম’ হিসেবে পশ্চিমা প্রচারণাকে সাহায্য করা ছাড়া আর কোনো সাফল্য অর্জিত হয়নি; তখন মাও-পরবর্তী চীন বন্দুকের নল ক্ষমতার উৎস- এ নীতি ত্যাগ করে এবং রাষ্ট্রের কমিউনিস্ট কাঠামো অব্যাহত রেখে পুঁজিবাদী অর্থনীতি গ্রহণ দ্বারা আমেরিকার ট্রেড পার্টনার হয়ে দ্রুত ইকোনমিক পাওয়ারে পরিণত হয়।

এখন চীন উন্নয়নশীল দেশগুলোকে বিরাটভাবে আর্থিক ঋণ দিয়ে তাদের ঋণের জালে বেঁধে ফেলছে। সেইসঙ্গে চলছে অস্ত্রের ব্যবসাও। এখন বিশ্ব^বাজারে আমেরিকার এবং এশিয়ার বাজারে ভারতের সবচেয়ে বড় প্রতিদ্বন্দ্বী চীন।

জুলিয়া লভেলের এ বইটির প্রতিপাদ্য বিষয় নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে ব্রিটিশ কলামিস্ট মাইকেল বারলে তার সাম্প্রতিক এক কলামে মন্তব্য করেছেন, ‘চীনের মাওবাদী আন্দোলন বিশ্বব্যাপী যতটা বিশালতা অর্জন করেছে, ততটা বিশালতা ফ্রান্সের জ্যাকোভিন এবং রাশিয়ার বলশেভিক আন্দোলনও অর্জন করতে পারেনি।’ আমার মতে কথাটা বিতর্কমূলক। জ্যাকোভিন এবং বলশেভিক দুটিই সন্ত্রাসী আন্দোলন ছিল না, ছিল রাজনৈতিক দর্শন। তার সাফল্য মাওবাদের চেয়ে অনেক বেশি। অনেক স্থায়ী। মাওবাদ কিছুকালের জন্য বিশ্বব্যাপী বিশাল প্রসারতা অর্জন করেছিল; কিন্তু রাজনৈতিক দর্শন নয়, সন্ত্রাসবাদ হিসেবে আবির্ভূত ও পরিচিত হয়ে জনমনে তার আবেদনকে ধরে রাখতে পারেনি।

মাওবাদ মার্কসবাদের সম্প্রসারণ হিসেবে যতই আকর্ষণীয়, রাজনৈতিক দর্শনরূপে একসময় পপুলার হয়ে থাকুক, কিন্তু সন্ত্রাস দ্বারা কোনো আদর্শ যে প্রতিষ্ঠা করা যায় না, মাওবাদী আন্দোলনের বর্তমান অবস্থা তার প্রমাণ। নেপালে মাওবাদী কমিউনিস্টদের সন্ত্রাস ত্যাগ করে সংসদীয় গণতান্ত্রিক পন্থায় ক্ষমতায় যেতে হয়েছিল। আয়ারল্যান্ডে শান্তি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে আইআরএ সন্ত্রাসীদের অস্ত্র ত্যাগের পর। উদাহরণ আরও আছে।

মাওবাদী সন্ত্রাসী আন্দোলনের অনুরূপ শক্তিশালী এবং আন্তর্জাতিকভাবে প্রসারিত ‘ইসলামী খিলাফত আন্দোলন’ সারা বিশ্বে বিভীষিকা সৃষ্টি এবং ইরাক ও সিরিয়ায় কিছু ভূখণ্ড দখল করে একটি তথাকথিত রাষ্ট্র (খিলাফত) প্রতিষ্ঠার পরও আজ পরাজিত এবং তাদের তথাকথিত খিলাফত থেকে বিতাড়িত।

মাও সন্ত্রাস চাননি, চেয়েছিলেন শ্রেণীযুদ্ধ এবং তার ধারাবাহিকতা। তার কালচারাল বিপ্লবের লক্ষ্য ছিল তাই। নিজের অসুস্থতা এবং দলের ভেতরে পুঁজিবাদী অর্থনীতির প্রতি আকৃষ্ট সংস্কারপন্থীদের উত্থানের ফলে তার স্বপ্ন বাস্তবায়িত হয়নি।

তার অনুসারী গ্যাঙ অব ফোরকে ক্ষমতা থেকে উচ্ছেদ করে জেলে ঢোকানো হয়। এশিয়া-আফ্রিকার অন্যত্র মাওয়ের অনুসারীরা শ্রেণী-সংগ্রামের তত্ত্ব না বুঝে গরিব কনস্টেবল হত্যা, একটু সচ্ছল কৃষক হত্যা দ্বারা মাওবাদকে সন্ত্রাস হিসেবে খাড়া করেন এবং পরাজিত হন। বর্তমানের জিহাদিস্টরা আসল ইসলামকে না বুঝে অথবা বুঝতে না চেয়ে পশ্চিমাদের দ্বারা সৃষ্ট পলিটিক্যাল ইসলামের বা ‘জিহাদিজমের’ যে সন্ত্রাস ছড়াচ্ছে তা-ও এখন চূড়ান্ত পরাজয়ের মুখে।

চীনের বর্তমান নেতা শি জিনপিংকে বলা হয় প্রাগমেটিভ নেতা। তিনি মাও ভক্ত। কিন্তু মাওয়ের বন্দুকের নলের তত্ত্ব বিসর্জন দিয়ে দু’হাতে উন্নয়নশীল দেশগুলোতে কম সুদে ঋণ ঢেলে এবং কম দামে অস্ত্র বেচে সারা বিশ্বেই এক বিরাট চীনা প্রভাব বলয় তৈরি এবং তা ক্রমশ সম্প্রসারণের নীতি গ্রহণ করেছেন। তার এ নীতির ফলে আমেরিকা পর্যন্ত বিপাকে পড়েছে এবং চীন ইকোনমিক সুপার পাওয়ারের পর্যায়ে উঠে এসেছে। চীনের নীতি এখন উন্নয়শীল দেশে বিপ্লব রফতানি নয়, তার নীতি কম সুদে ঋণদান এবং কম দামে অস্ত্র বিক্রি এবং এভাবে সারা বিশ্বকে ঋণ জালে বেঁধে ফেলে ‘চায়নিজ হেজিমনি’ প্রতিষ্ঠা করা। এর ফলে বিশ্বে একটি ট্রেড ওয়ার শুরু হতে চলেছে। সতর্ক না থাকলে সশস্ত্র যুদ্ধও শুরু হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

এখন দেখার রইল সন্ত্রাসকে সাহায্য না দিয়ে আর্থিক সাহায্যের বিশাল দুয়ার খুলে বিশ্ব রাজনীতিতে চীন কতটা সফল হয়!

লন্ডন, ৩১ মার্চ, ২০১৯, রবিবার

ঋণের জাল বিস্তার

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম