|
ফলো করুন |
|
|---|---|
এ সময়ের আলোচিত বিষয় হল দুর্নীতিবিরোধী অভিযান। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দেশে-বিদেশে অনেকটা উচ্চৈঃস্বরে এবং স্পষ্ট ভাষায় দুর্নীতির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার কথা বলেছেন। তার ফল হিসেবে ঢাকায় ‘ক্যাসিনো অভিযান’ পরিচালিত হচ্ছে। এখন পর্যন্ত যারা অভিযানের জালে আটকা পড়েছেন, তারা সরকারি দলের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। এ বিষয়ে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদকের বক্তব্য হল, ‘দুর্নীতিবিরোধী অভিযান আমরা ঘর থেকেই শুরু করতে চাই।’
আমি এ বক্তব্যকে সাধুবাদ জানাতে চাইলেও ‘নিন্দুকরা’ বলছেন, গত ১০ বছরে বাইরের কেউ তো দুর্নীতি করার সুযোগই পায়নি, তাই সরকারের ঘরেই সব দুর্নীতিবাজ আসর জমিয়েছে। কথাটা শুনতে একপেশে হলেও আমলে না নিয়ে উপায় নেই। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী গেল সপ্তাহে আমেরিকায় সংবাদ সম্মেলনে যা বললেন, তার সঙ্গে যদি আন্তরিকতা ও দৃঢ়তার সমন্বয় ঘটে, তাহলে আমরা নতুন কিছু আশা করতেই পারি।
ব্যক্তিগত জীবনে আমি নিজেকে একজন ‘আশাবাদী’ মানুষ বলতে পছন্দ করি। কিন্তু আজ একটি সত্য স্বীকার করতেই হবে, আমি মুখে আশার কথা বললেও আমার ‘অন্তর’ কিন্তু নিরাশার দোলাচাল খায়। অনেক ক্ষেত্রেই মুখের কথার সঙ্গে মনকে বশে আনতে পারি না। আজ প্রধানমন্ত্রীর কথায় আশান্বিত হলেও বাস্তব অবস্থা বিবেচনায় মন আমার নিরাশার জলে নিমজ্জিত। কারণ আজকের যে অভিযান, যেখান থেকে অভিযান, যে মাত্রায় অভিযান, যে ক’জনার বিরুদ্ধে অভিযান; শুধু সেখানেই অভিযান সীমাবদ্ধ থাকবে কি না? যদি তা হয় তাহলে তেমন কিছু আশা করা যায় না। সার্বিক অর্থনীতিতে দুর্নীতির যে কালোছোঁয়া লেগেছে তার শেকড় উপড়ে ফেলার প্রত্যয় ও শপথ থাকলেই আমরা ভালো কিছু প্রত্যাশা করতে পারি। সে জন্য জানা দরকার আমাদের দুর্নীতির পরিধি কত, দুর্নীতির আয়তন কত, আর যাদের দ্বারা ও সহযোগিতায় এ দুর্নীতি সম্পাদিত হয়েছে, তাদের শক্তি কতখানি। তারপর হিসাব করতে হবে, ওই অপশক্তি মোকাবেলা করার মতো শুভশক্তি আমাদের আছে কি না; শক্তি থাকলেও তা প্রয়োগের সদিচ্ছা আছে কি না; সদিচ্ছা থাকলেও দুর্বৃত্তের বলয় থেকে বেরিয়ে এসে সেই সদিচ্ছা পূরণের ক্ষমতা আছে কি না।
দুর্নীতির আকার-আয়তনের ধারণা দিতে গিয়ে সাবেক ইউজিসি প্রফেসর ড. মইনুল ইসলাম স্পষ্টত ও যথার্থই বলেছেন, ‘বাংলাদেশে দ্রুত কোটিপতি হওয়ার আরেকটি ন্যক্কারজনক পন্থা হল দুর্নীতিতে নিমজ্জিত হওয়া। দেশের প্রতিরক্ষা বাহিনীগুলো, পুলিশ, র্যাব, বিজিবি, আয়কর-ভ্যাট-কাস্টমসসহ সরকারি-আধা সরকারি-স্বায়ত্তশাসিত-আধা স্বায়ত্তশাসিত সব বিভাগ, বিচার বিভাগ ও আদালতগুলো, শিক্ষা বিভাগ ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো, স্বাস্থ্য বিভাগ ও সরকারি হাসপাতালগুলো- এমন একটি সরকারি প্রতিষ্ঠানের নাম করা যাবে না যেটা খানিকটা দুর্নীতিমুক্ত। দুর্নীতিলব্ধ অনর্জিত আয় দুর্নীতিবাজদের পরিবারের সদস্যদের অতিদ্রুত মধ্যবিত্ত ও উচ্চ মধ্যবিত্ত অবস্থানে নিয়ে যাচ্ছে নিঃসন্দেহে।’ সুতরাং দুর্নীতির পরিধি কতখানি তা সহজেই অনুমেয়। পুরো বাংলাদেশেরই খোলনলচে পাল্টে ফেলার প্রয়োজন দেখা দিয়েছে, যা আমাদের মাঝে শত আশঙ্কার জন্ম দিয়েছে।
আজ ক্যাসিনোবিরোধী যে অভিযান চলছে আর তার যে ভয়াবহ চিত্র ফুটে উঠেছে, তাতেই আমাদের চক্ষু চড়কগাছ! কিন্তু আপনাদের জ্ঞাতার্থে বলতে চাই, এই চিত্র প্রকৃত চিত্রের তুলনায় বড় পুকুরের এক বালতি পানির চেয়ে বেশি কিছু নয়। ওয়াশিংটনভিত্তিক ‘ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেগ্রিটি’র তথ্যমতে, গত ১০ বছরে বাংলাদেশ থেকে অর্থ পাচার হয়েছে ৭০ হাজার কোটি ডলার। আমরা যদি ১ ডলার সমান ৮৪ টাকা ধরি, তাহলে তা বাংলাদেশের অর্থমানে দাঁড়ায় ৫ লাখ ৮৮ হাজার কোটি টাকা। এ পরিমাণ টাকা আমাদের ২০১৯-২০ অর্থবছরের জাতীয় বাজেটের চেয়েও ৫০ হাজার কোটি টাকার বেশি। টাকার ছড়াছড়ির আরও খবর দেয়া যাবে। সুইজারল্যান্ডের ব্যাংকগুলোতে, যাকে আমরা ‘সুইস ব্যাংক’ বলি, ২০১৮ সালে বাংলাদেশিদের সঞ্চয় বেড়ে ৬১ কোটি ৭৭ লাখ ফ্রাংকে দাঁড়িয়েছে। আপনি যদি এক ফ্রাংক সমান ৮৭ বাংলাদেশি টাকা ধরেন, তবে এ অর্থের পরিমাণ হবে ৫ হাজার ৩৭৩ কোটি টাকা। ২০১৭ সালের তুলনায় প্রায় ১ হাজার ২৩৪ কোটি টাকা বেশি। ২০১৮ সালের এ টাকা দেশের বেসরকারি ১২টি ব্যাংকের পরিশোধিত মূলধনের (Paid-Up Capital) সমান! অথচ ১০ বছর আগে ২০০৯ সালে এই আমানতের পরিমাণ ছিল মাত্র ১৪.৯০ কোটি ফ্রাংক বা ১ হাজার ৩০৫ কোটি টাকা। গত ১০ বছরে সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশিদের সঞ্চয়ের পরিমাণ বেড়েছে ৪ গুণেরও বেশি। অর্থনীতি বিশ্লেষকরা বলছেন, এখনও প্রতিবছর টাকা পাচারের পরিমাণ ৭০-৭৬ হাজার কোটি টাকা। অতএব সার্বিক পরিস্থিতি যতটা আমরা অনুমান করছি তার চেয়ে ভয়ানকভাবে বেশি! ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুর সরকার অনেক সাধ্য-সাধনা করে বাংলাদেশকে জাতিসংঘের ‘স্বল্পোন্নত দেশের’ ক্যাটাগরিতে অন্তর্ভুক্ত করাতে সক্ষম হয়েছিল, যাতে বাংলাদেশ বৈদেশিক অনুদান, খাদ্য সহায়তা এবং ‘সফট লোন’ পাওয়ার ব্যাপারে বিশেষ বিবেচনা পায়। এ মর্যাদাহীন তকমা বঙ্গবন্ধু নিরুপায় হয়ে গায়ে মেখেছিলেন, যে কারণে ১০ বছরের মধ্যে সেখান থেকে বেরিয়ে আসার সংকল্প করেছিলেন; কিন্তু ১৫ আগস্টের রাজনৈতিক প্রতিহিংসা তাকে সে সুযোগ দেয়নি। এ জন্য ১০ বছরের স্থলে ‘স্বল্পোন্নত দেশের’ গ্লানি থেকে বের হতে আমাদের সময় লেগে গেছে ৪৩ বছরেরও বেশি। আর এর মূল কারণটাই ছিল ‘আর্থিক দুর্বৃত্তায়ন’।
আমরা বিগত দশক ধরেই আর্থিক অনিয়ম ও দুর্নীতির দিকটি তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। কিন্তু প্রতিটি ক্ষেত্রেই সরকারি মহল থেকে তা অবজ্ঞা করা হয়েছে, নয়তো বিএনপি-জামায়াতের তকমা আমাদের গায়ে লাগানোর চেষ্টা করা হয়েছে। প্রকৃত সমস্যার সমাধান দূরে থাক, তা অনুধাবনেরই চেষ্টা করা হয়নি। দিনের আবর্জনা দিনে পরিষ্কার করলে আজ তা বিশাল স্তূপে পরিণত হতো না; বই-বালিশ-পর্দা-চেয়ারের মতো কলঙ্কের জন্ম হতো না। আজ যে দু-চারজনকে হাতকড়া পরানো হয়েছে, অতীতে কোনোদিন আমরা তাদের নামই শুনিনি, একবারেই চুনোপুঁটি। তাদেরই যদি টাকার এরকম বাহার হয়, তাহলে রাঘববোয়ালদের অবস্থা কত বিশাল হতে পারে! ক্যাসিনোর মতো একটি অবৈধ জুয়ার রমরমা ব্যবসা একদিনে গড়ে উঠেছে কিংবা একজনের দ্বারা গড়ে উঠেছে- এ কথা একটি শিশুও বিশ্বাস করবে না। এগুলো বছরের পর বছর গড়ে উঠেছে এবং তা আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও রাজনৈতিক দলের আশীর্বাদেই। তাদের সবাইকে আইনের আওতায় আনা যাবে কি?
২ অক্টোবর চ্যানেল আই আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আবারও দৃঢ়ভাবে উচ্চারণ করলেন দুর্নীতি প্রতিরোধের কথা। কথার মধ্যে বলিষ্ঠতা ছিল সন্দেহ নেই; কিন্তু পদক্ষেপের গতি ও প্রকৃতি নিয়ে সংশয় আছে। ২১ আগস্টের মর্মান্তিক ও ঘৃণ্য বোমা হামলার পর বিএনপির ‘জজ মিয়া’ নাটকের কথা মনে রেখে অনেকেই এটাকে আওয়ামী লীগ আমলের আরেকটি ‘জজ মিয়া’ নাটক বলে বিবেচনা করতে চাইছেন। আমরা সেরকম ভাবতে চাই না, আবার পরিস্থিতিকেও অস্বীকার করতে পারছি না। কেননা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত দুর্নীতির দিক থেকে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল শীর্ষে। তখন বিএনপি সরকার ক্ষমতায় ছিল। আওয়ামী লীগ টিআইবিকে সম্পূর্ণ আস্থায় এনে বিএনপির বিরুদ্ধে জনমত সৃষ্টিতে পিছপা হয়নি। সেই টিআইবি যখন বলল, ২০১১ সালের তুলনায় ২০১২ সালে দেশে দুর্নীতির মাত্রা বেড়েছে, আওয়ামী লীগের নেতৃস্থানীয়রা টিআইবিকে কটূক্তি-নিন্দা করতে বাকি রাখেনি। এ ধরনের ‘বিচার মানি, তালগাছ আমার’ মানসিকতা কোনোভাবেই শুভবুদ্ধির পরিচায়ক নয়। উল্লিখিত অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী সংবাদমাধ্যমকে সরকারের সমালোচনার পাশাপাশি ভালো কাজের প্রচার এবং জনগণে আস্থা তৈরি করার জন্য অনুরোধ করেন।
ভালো কাজের কথা মুখে আনলে আমাদের জিহ্বা কোনো সময়েই সংকুচিত হয় না, জড়তায় আড়ষ্ট হয় না, এটুকু দায়বোধ আমাদের নিশ্চয়ই আছে। গত ১০ বছরে উল্লেখ করার মতো অনেক কিছুই ঘটেছে। বিদ্যুৎ উৎপাদন চাহিদার সমান না হলেও কয়েকগুণ বেড়েছে, ‘লোডশেডিং’ রয়েছে সহনীয় মাত্রায়; জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৮ শতাংশ পেরিয়েছে; আমাদের মাথাপিছু আয়, মানব উন্নয়ন সূচক এবং নারীর ক্ষমতায়ন সন্তোষজনকভাবে বেড়ে চলেছে। আমার মতো নগণ্য মানুষের মূল্যায়নের কথা আমলে নাইবা নিলেন। বিশ্বখ্যাত অর্থনীতিবিদদের মূল্যায়ন হল- ‘দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশ ভারতের চেয়ে অনেক বেশি দরিদ্র হওয়া সত্ত্বেও গড় আয়ু, শিশুদের টিকা দেয়ার হার, শিশুমৃত্যু, শিশুদের অপুষ্টি, মেয়েদের স্কুলে যাওয়ার হার ইত্যাদি সামাজিক মাপকাঠিতে তাকে ধরে ফেলেছে, এমনকি ছাড়িয়েও গেছে’ (জঁ দ্রেজ ও অমর্ত্য সেন, ‘ভারত : উন্নয়ন ও বঞ্চনা’; পৃষ্ঠা : ৮)। এতসব অর্জনের পরও বলব, সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে গণতন্ত্র চর্চা আর অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের ক্ষেত্রে।
আস্থার কথা যদি বলেন, দুদক, নির্বাচন কমিশন, প্রশাসন ইত্যাদি কোনো প্রতিষ্ঠানের ওপরই মানুষের আজ আর কোনো আস্থা নেই। আমরা বসার জায়গা চষে ফেলেছি। এ থেকে বেরিয়ে আসা খুব সহজ হবে না। গত ৪৮ বছর ঠকতে ঠকতে আমরা কাঠ হয়ে গেছি। তাই প্রধানমন্ত্রীর সাহসী উচ্চারণ- ‘দুর্নীতিবাজ দলীয় কিংবা আত্মীয় হলেও ছাড় পাবে না’- শুনে আমাদের মনে আশা জাগে। কিন্তু এর সঙ্গে একটি শঙ্কা থেকেই যায়। যতটা গর্জন শুনি ততটা বর্ষণ হবে তো?
মুঈদ রহমান : অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়
