Logo
Logo
×

বাতায়ন

যে হারেনি, হারবে না

Icon

পবিত্র সরকার

প্রকাশ: ০৮ ডিসেম্বর ২০১৯, ০৬:০০ পিএম

প্রিন্ট সংস্করণ

যে হারেনি, হারবে না

ছবি: সংগৃহীত

নবনীতা চলে গেল ক’দিন আগে। নবনীতা মানে বাঙালির প্রিয় লেখিকা নবনীতা দেব সেন। আমার চেয়ে বয়সে অল্প ছোটই ছিল সে, সরল অঙ্কের হিসেবে আমার আগে তার যাওয়ার কথা নয়।

কিন্তু জীবন আমাদের বারবার ঘাড়ে ধরে বুঝিয়ে ছাড়ে যে সে সরল অঙ্ক মেনে চলে না, ওই অঙ্ককে আবর্জনার স্তূপে ছুড়ে ফেলতে বলে। নবনীতার ক্যান্সার হয়েছিল।

হাঁপানি ছিল, হাঁটুর জোর কমে এসেছিল বলে লাঠি নিয়ে চলত, সিঁড়িতে বিদ্যুৎচালিত চেয়ার লাগিয়ে নিয়েছিল ওঠানামার জন্য।

প্রশ্ন করে লাভ নেই নবনীতার কেন এসব হল। হল তো হল, এবং ক্যান্সার ও অন্যান্য উপসর্গ তক্কে তক্কে থেকে যথাসময়ে তাদের একটি মূল্যবান শিকার তুলে নিল মৃত্যুকে উপহার দেয়ার জন্য। তাতে মৃত্যুর তো দারুণ খুশি হওয়ার কথা।

না, নবনীতা ক্যান্সার বা মৃত্যুকে খুব বেশি খুশি হওয়ার সুযোগ দেয়নি। কারণ দুটোকেই সে অট্ট-উপহাসে উপেক্ষা করে এসেছে।

তার শেষ ছাপা লেখাতেও সে মৃত্যু, মরণব্যাধি এসব নিয়ে তুমুল ইয়ার্কি করেছে, আমি তার সেই দম টানতে টানতে প্রবল উচ্চহাসি শুনতে পাচ্ছি। যেদিন ওকে দেখতে গেলাম, ওর বসার ঘরে ফুলের শয্যায় ওকে শুইয়ে রাখা হয়েছে। মুখখানি শান্ত, জীবন্ত, উজ্জ্বল।

যেন এইমাত্র হাসি থামিয়েছে; কিন্তু হাসির আভা মুখ থেকে মুছে যায়নি। ওর ঠোঁটের গড়ন আমার আশ্চর্য লাগত, মনে হতো যেন কোনো ভাস্কর ছেনি দিয়ে কেটে নিখুঁত করে তৈরি করেছে ওই ঠোঁট, হাসি ওই ঠোঁটে খুব সহজে ভেঙে পড়ত আর উজ্জ্বল চোখ তার যোগ্য সংগত করত।

নিচে চলে এলাম ওর মাথায় একটুখানি হাত ছুঁইয়ে, আর তার একটু পরে ‘প্রাণ ভরিয়ে তৃষা হরিয়ে মোরে আরও আরও আরও দাও প্রাণ’ গানের সুরে ও শবশকটে চড়ে আমাদের সবার নাগাল এড়িয়ে চলে গেল।

আমি তার বন্ধুত্বের ভেতর-বৃত্তে ছিলাম না; কিন্তু বন্ধু তো ছিলাম। ১৯৫৯ থেকে তাকে জানি, তারপর যাদবপুরে একসঙ্গে প্রায় সাতাশ বছর চাকরি, ওর নিজের বিভাগ তুলনামূলক সাহিত্যে, আমি বাংলায়।

যখন চাকরিতে ছিলাম তখন প্রায় রোজই দেখা হতো, যাদবপুরে ফ্যাকাল্টি ক্লাবে বিকালে আড্ডায়, যে আড্ডায় থাকতেন শঙ্খ ঘোষ, সুবীর রায় চৌধুরী (প্রয়াত), মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, স্বপন মজুমদার, সৌরীন ভট্টাচার্য, বাংলার পিনাকেশ আর আমি।

তাতে নবনীতাও, দেশে বা পশ্চিম বাংলায় থাকলে, প্রায়ই আসত। নানা জ্ঞানগম্যির কথাবার্তার পাশাপাশি নানা হাসিঠাট্টা, গল্প-গুজব হতো, যাতে আমরা সবাই চা-টোস্ট-ওমলেট খেয়ে, দিনের ক্লান্তি তাড়িয়ে খানিকটা বাড়তি জীবন নিয়ে ফিরতাম।

কখনও আমরা নবনীতার পেছনেও লাগতাম। ওর কথায় কথায় টরেন্টো, নিউইয়র্ক, মেলবোর্ন, বেঙ্গালুরু, শিমলা যাওয়া নিয়ে হাসিঠাট্টা; তখন ও-ই ছিল আমাদের মধ্যে সবচেয়ে আন্তর্জাতিক ব্যক্তিত্ব।

আবার এসব নানা কারণে দলের মধ্যে একমাত্র ও-ই ছিল, যে যাদবপুরের ফিন্যান্স ডিপার্টমেন্টে নিজের মাইনের চেক মাসের পর মাস ফেলে রাখত।

আমরা বলতাম, ‘তোমার নিজের মাইনের দরকার নেই তো আমাদের মধ্যে টাকাটা বিলিয়ে দাও না কেন, আমাদের সংসারের কিছুটা সুরাহা হয় তা হলে!’ নবনীতা ছদ্মরাগ দেখাত।

মনে আছে, সাহিত্য একাডেমির হয়ে ওর ওপরে একটা ইংরেজি ডকুমেন্টারি যখন তোলা হল, তখন আমাকে কেন যেন তার জন্য নির্বাচন করেছিল, আমিই ওকে ওর জীবন সম্বন্ধে প্রশ্ন করব, ওর সঙ্গে ওর স্মৃতির জায়গাগুলোতে ঘুরে বেড়াব। সেই একটা দিন, প্রায় সকাল থেকে বিকাল, খুব মজায় কেটেছিল।

ওর সঙ্গে গেলাম ওর স্মৃতির মামাবাড়ি, ঠনঠনে কালীবাড়ির উল্টোদিকে। তারপর ওর স্কুল, গোখলে মেমোরিয়ালে, তারপর ওর ইন্টারমিডিয়েট পড়ার কলেজ, লেডি ব্রেবোর্নে, বিএ পড়ার কলেজ প্রেসিডেন্সিতে, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে। ব্রেবোর্নে দেখাল কোথায় ফুচকাওয়ালার কাছে থেকে ফুচকা কিনে খেত। সারাদিন একসঙ্গে হাসিতে গল্পে দারুণ কেটেছিল।

তারপর, আবার কী কারণে জানি না, ও একটা ভারতের নানা ভাষার ছোটগল্প অনুবাদ করেছিল, তার ভূমিকা আমাকে লিখতে বলে। খুব কৃতার্থ হয়ে সে ভূমিকাও লিখে দিই।

অনেকদিন লিখেওছি একসঙ্গে, একই কাগজে। প্রয়াত ঋতুপর্ণ ঘোষ আমাদের দু’জনকেই ডেকে নিয়েছিল ‘সংবাদ প্রতিদিনে’র রবিবাসরীয় সাপ্তাহিক ‘রোববারে’ লেখার জন্য। আর দেখে কী হিংসে হতো যে, লোকে, এমনকি আমার ঘরের লোকেও, ওর লেখাটাই সবার আগে পড়ত।

ইদানীংকালে এমন স্বাদু লেখা কি আর কেউ লিখতে পেরেছে, পুরুষ-নারী মিলিয়ে? কথার কোনো মারপ্যাঁচ নেই, অকারণে রসিকতার বেদম চেষ্টা নেই, হাসির সহজ বিচ্ছুরণ কথায় কথায়। এই হাসি দিয়ে ও কি কিছু লুকোতে চাইত?

ও কি আরেকটা নবনীতাকে আড়াল করতে চাইত? যদি তা চেয়ে থাকে সে কাজে ও চমৎকার সফল হয়েছিল, আপামর বাঙালি পাঠক নবনীতাকে একালের সবচেয়ে সরস গদ্যের লেখক হিসেবে জানে।

কোথায় চলে গেল কবি নবনীতা, কোথায় লুকোল ‘আমি অনুপম’ নামে একটি স্মরণীয় উপন্যাসের লেখিকা নবনীতা, আড়ালে পড়ে গেল মহাবিদ্যাবতী এক নারী, কবিতা আর গল্পের অনুবাদক, বিপুলভাবে সফল এক অধ্যাপিকা, ‘সই’-এর প্রাণ-উৎস, যে-কোনো মানবিক প্রশ্নে নিজের কণ্ঠস্বর প্রক্ষেপ করত যে নবনীতা।

আমরা অনেকে তাকে এত সবকিছুর জন্য শ্রদ্ধা আর অনুরাগ দিয়ে মনে রাখব; কিন্তু বাঙালি পাঠকের কাছে সে অনাবিল সরসতা উৎস, মুহূর্তে মন ভালো করে দেয়ার ওস্তাদ কারিগর।

বাজে লাগছে তোমার, পৃথিবীর চাপে তুমি একটু বসে পড়ছ, তাহলে নবনীতার একটা বই নামিয়ে নাও তাক থেকে, পড়তে থাকো, বিষাদ উত্তীর্ণ হও। দেখো কীভাবে নিজেকে নিয়ে, নিজের দুঃখকে নিয়ে নিষ্ঠুর হাসিঠাট্টা করে এই মহিলা, সে কেমন সবকিছু ছাড়িয়ে ওঠে। যেমন চিরনির্ভর হয়ে আছেন ত্রৈলোক্যনাথ, পরশুরাম, শিবরাম, শরদিন্দু, সুকুমার, লীলা মজুমদার- তেমনই নবনীতাও এ স্মরণীয়দের দলে কেমন সহজে পৌঁছে গেছে।

আবার বলি, সরল অঙ্কের হিসেবে এ রকম হওয়ার কথা ছিল না। আমার মনে আছে, শিকাগো থেকে এসেছিল রুডলফ দম্পতি, শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের দুই অধ্যাপক ড্যানিয়েল আর সুজান।

নবনীতা তাদের কেন জানি না, সে সন্ধ্যায় আমাকে ‘ভালো-বাসা’তে নিমন্ত্রণ করেছিল, সম্ভবত শিকাগোর সংযোগে। সন্ধ্যা থেকে কথাবার্তা ডিনার পর্যন্ত গড়াল, ডিনারের পরও অনেকটা রাত পর্যন্ত। ব্যক্তিগত কথা বলতে বলতে নবনীতাকে সেদিন ভেঙে পড়তে দেখেছিলাম। ওই একবার।

জানি না, আমাদের মতো মানুষেরা, পুরুষ বা নারী যেই হোক, দুটি সন্তান নিয়ে, ভালোবাসার সংসার থেকে প্রত্যাখ্যাত হওয়ার অপমান আর গভীর যন্ত্রণাকে কখনও বুঝে উঠতে পারব কিনা।

আমি কাউকে দোষ দিতে চাই না, জানি জীবন প্রায়ই এ রকম নিষ্করুণ হয়, দুটি মানুষের সম্পর্কের রসায়ন কখন কীভাবে বদলে যায়, আমরা তো পারিই না, তারা নিজেরাও বুঝতে পারে না।

নবনীতা যে হারেনি, হারবে না বলে দুর্জয় ইচ্ছায় তিলে তিলে নিজেকে নতুন করে নির্মাণ করেছে, সারা পৃথিবী সেটা লক্ষ করেছে। সন্তানদের যোগ্য করে তুলেছে, নাতনির সুখ উপার্জন করেছে। কিন্তু তার সবচেয়ে সফল নির্মাণ সে নিজে।

অধ্যাপনায় ছাত্রছাত্রী আর বন্ধু সহকর্মীদের গভীর শ্রদ্ধা আর ভালোবাসা সে পেয়েছে, দেশ-বিদেশে তার বিশেষজ্ঞতার সুনাম ছড়িয়েছে, সর্বত্র নানা বিদ্বৎসভায় তার মুহুর্মুহু আমন্ত্রণ আসত।

কিন্তু তার লেখা তার যে উজ্জ্বল, সহাস্য প্রতিমা তৈরি করেছে, সে প্রতিমা বিজয়িনীর। সে জীবনের কাছে হারেনি। বোধহয় সেই সংকল্প নিয়েই সে নতুন করে যাত্রা শুরু করেছিল, নিজেকে ভেঙেচুরে নতুন করে গড়ার, তাতে সে সম্পূর্ণ সার্থক। আমি এই বিজয়িনী নবনীতার কাছে মাথানত করি।

পবিত্র সরকার : সাবেক উপাচার্য, রবীন্দ্র ভারতী বিশ্ববিদ্যালয়, কলকাতা

নবনীতা

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম