Logo
Logo
×

বাতায়ন

স্বদেশ ভাবনা

ঢাকা সিটি নির্বাচন সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক হোক

Icon

আবদুল লতিফ মন্ডল

প্রকাশ: ২৫ ডিসেম্বর ২০১৯, ০৬:০০ পিএম

প্রিন্ট সংস্করণ

ঢাকা সিটি নির্বাচন সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক হোক

ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন (ডিএনসিসি) ও ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনে (ডিএসসিসি) আগামী ৩০ জানুয়ারি ভোটগ্রহণের দিন নির্ধারণ করে তফসিল ঘোষণা করেছে নির্বাচন কমিশন। ২২ ডিসেম্বর প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কেএম নুরুল হুদা এ তফসিল ঘোষণা করেন।

ঘোষিত তফসিল অনুযায়ী, মনোনয়নপত্র দাখিলের শেষ সময় ৩১ ডিসেম্বর, মনোনয়নপত্র যাচাই-বাছাই ২ জানুয়ারি। প্রার্থিতা প্রত্যাহার ৯ জানুয়ারি। প্রতীক বরাদ্দ ১০ জানুয়ারি। ৩০ জানুয়ারি সকাল ৮টা থেকে বিকাল ৪টা পর্যন্ত ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হবে।

এ নির্বাচনে বিদ্যমান ভোটার তালিকাই ব্যবহার করা হবে। এ দুই সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে এবারই প্রথম ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) ব্যবহার করা হবে। প্রার্থী হতে হলে এ দুই সিটি কর্পোরেশনের বর্তমান মেয়রদের পদত্যাগ করতে হবে। সিইসি জানিয়েছেন, ডিএনসিসি ও ডিএসসিসির আসন্ন নির্বাচনে সেনাবাহিনী নিয়োগ করা হবে না।

ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের ২০০৯-২০১৩ মেয়াদের শাসনকালে জাতীয় সংসদে আইন পাসের মধ্য দিয়ে বিলুপ্তি ঘটে ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের এবং সৃষ্টি হয় ডিএনসিসি ও ডিএসসিসির। ২০১৫ সালের ২৮ এপ্রিল এই দুই ঢাকা সিটি কর্পোরেশনে প্রথম নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়।

ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের বিলুপ্তি এবং নবসৃষ্ট ডিএনসিসি ও ডিএসসিসি নির্বাচন অনুষ্ঠান-পূর্ব সময়কালে সরকার কর্তৃক প্রশাসক হিসেবে নিয়োজিত সরকারি কর্মকর্তারা এ দুটি সিটি কর্পোরেশন শাসন করেন।

২০১৫ সালের ২৮ এপ্রিলে অনুষ্ঠিত ডিএনসিসির নির্বাচনে নির্বাচিত মেয়র আনিসুল হকের মৃত্যুতে (২০১৭ সালের ৩০ নভেম্বর) চলতি বছরের (২০১৯) ২৮ ফেব্রুয়ারি মেয়র পদে উপনির্বাচন এবং ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশনে ৩৬টি নবগঠিত ওয়ার্ডে সাধারণ কাউন্সিলর এবং ১২টি সংরক্ষিত নারী কাউন্সিলর পদে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ডিএনসিসির উপনির্বাচনে মেয়র নির্বাচিত হন আতিকুল ইসলাম।

২০১৫ সালের ২৮ এপ্রিল ডিএনসিসি ও ডিএসসিসি নির্বাচন এবং চলতি বছরের ২৮ ফেব্রুয়ারি ডিএনসিসির মেয়র পদে উপনির্বাচন এবং ডিএনসিসি ও ডিএসসিসির ৩৬টি নবগঠিত ওয়ার্ডে সাধারণ কাউন্সিলর এবং ১২টি সংরক্ষিত নারী কাউন্সিলর পদে নির্বাচন সুষ্ঠু এবং অংশগ্রহণমূলক ছিল না।

২০১৫ সালের ২৮ এপ্রিলের নির্বাচন তৎকালীন আইন অনুযায়ী নির্দলীয়ভাবে অনুষ্ঠানের কথা থাকলেও ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সরাসরি হস্তক্ষেপে তা হতে পারেনি। প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা দলসমর্থিত প্রার্থীদের অনুকূলে কাজ করতে দলীয় কর্মীদের নির্দেশ প্রদান করেন।

নির্বাচনী প্রচার শেষ হওয়ার দিন ২৬ এপ্রিল প্রধানমন্ত্রী তার সরকারি বাসভবন গণভবনে এক সংবাদ সম্মেলনে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে সন্ত্রাসী আখ্যায়িত করে বিএনপি সমর্থিত প্রার্থীদের ভোট না দেয়ার জন্য জনগণের প্রতি আহ্বান জানান।

ওই সময় পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত খবর অনুযায়ী, সরকারের একজন সচিব তার অধীন একটি দফতরের কর্মকর্তাদের সঙ্গে মতবিনিময়কালে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের আচরণবিধি ভঙ্গ করে সিটি নির্বাচনে শাসক দল আওয়ামী লীগ সমর্থিত মেয়র ও কাউন্সিলরদের জন্য ভোট চান।

অন্যদিকে নির্বাচনী প্রচারের শেষদিকে খালেদা জিয়া বিএনপি সমর্থিত প্রার্থীদের অনুকূলে ভোট চাইতে মাঠে নামার চেষ্টা করে আওয়ামী লীগের অঙ্গসংগঠন যুবলীগ ও ছাত্রলীগ কর্মীদের বাধার কারণে তার সে কর্মসূচি সফল হতে পারেনি।

জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান এইচএম এরশাদ তার দল সমর্থিত প্রার্থীদের অনুকূলে ভোটারদের সমর্থন চাইতে প্রথম দিকে মাঠে নামলেও প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূতের দায়িত্বে থাকায় বিশেষ সুবিধাপ্রাপ্ত ব্যক্তি হিসেবে নির্বাচন কমিশনের অনুরোধক্রমে তাকে শেষ পর্যন্ত নির্বাচনী প্রচার থেকে বিরত থাকতে হয়।

প্রশাসনের সহায়তাপুষ্ট আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থীরা সুবিধাজনক অবস্থানে থেকে নির্বাচনী প্রচারণা চালালেও বিরোধী দলগুলো, বিশেষ করে বিএনপি সমর্থিত প্রার্থীদের ভাগ্যে সে সুবিধা জোটেনি।

এ নির্বাচনে ব্যাপক অনিয়ম হয়। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে ভোটকেন্দ্র দখল, বিএনপি ও বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোটসমর্থিত প্রার্থীর এজেন্টদের ভোটকেন্দ্র থেকে বের করে দেয়া ইত্যাদি কারণে বিএনপি ও তার শরিক দলগুলো নির্বাচন প্রত্যাখান ও বর্জন করে।

তারা ছাড়াও নির্বাচন বর্জন করেন জাতীয় সংসদে বিরোধী দল জাতীয় পার্টি সমর্থিত ডিএসসিসির মেয়র পদপ্রার্থী সাইফুদ্দিন মিলন, গণসংহতি আন্দোলনের মেয়র পদপ্রার্থী জোনায়েদ সাকি, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি ও বাংলাদেশ সমাজতান্ত্রিক দলের মেয়র পদপ্রার্থী যথাক্রমে আবদুল্লাহ আল কাফী ও বজলুর রশীদ ফিরোজ। তাছাড়া নির্বাচন বর্জন করেন ডিএসসিসির স্বতন্ত্র মেয়র পদপ্রার্থী গোলাম মওলা রনি।

নির্বাচন-পরবর্তী দু-তিন দিনের দৈনিকগুলোতে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সহায়তায় নির্বাচনে সংঘটিত অনিয়ম নিয়ে সচিত্র প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। মানবাধিকার সংস্থা অধিকার এ সিটি নির্বাচনকে প্রহসনের নির্বাচন আখ্যায়িত করে।

জাতিসংঘের তৎকালীন মহাসচিব বান কি মুন এ নির্বাচনে অনিয়মের অভিযোগ তদন্তের ব্যবস্থা নিতে প্রধানমন্ত্রীকে অনুরোধ জানান। একই অনুরোধ জানায় ইউরোপীয় ইউনিয়ন। বাংলাদেশে অবস্থানকারী বিদেশি কূটনীতিকরা এ সিটি নির্বাচনে অনিয়মে তীব্র অসন্তোষ প্রকাশ করেন এবং সংঘটিত অনিয়মের অভিযোগ তদন্তের আহ্বান জানান।

আওয়ামী লীগ সরকার কর্তৃক ২০১২ সালে গঠিত কাজী রকিবউদ্দিন আহমদের নেতৃত্বাধীন নির্বাচন কমিশন অভিযোগ তদন্তের পরিবর্তে হাতে সময় থাকা সত্ত্বেও নজিরবিহীন ক্ষিপ্রগতিতে এ সিটি নির্বাচনে জয়ী মেয়র ও কাউন্সিলরদের নাম সরকারি গেজেটে প্রকাশের ব্যবস্থা করে তদন্তের পথ বন্ধ করে দেয়। হেরে যায় গণতন্ত্র। ২৯ এপ্রিল ২০১৫ দেশের একটি দৈনিকের শিরোনাম ছিল, ‘জিতল আ’লীগ, হারল গণতন্ত্র।’

২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিভিন্ন অভিযোগের প্রতিবাদে সংসদের বাইরে প্রধান বিরোধী দল বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোট এবং বিএনপির ছায়ায় গঠিত জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট চলতি বছরের ২৮ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত ডিএনসিসি মেয়রের শূন্য পদে এবং ডিএনসিসি ও ডিএসসিসিতে নবগঠিত ৩৬টি ওয়ার্ডে সাধারণ কাউন্সিলর এবং ১২টি সংরক্ষিত নারী কাউন্সিলর পদে নির্বাচনে অংশগ্রহণে বিরত থাকে।

বহুদলীয় অংশগ্রহণমূলক না হওয়ায় এবং ভোটার উপস্থিতির হার খুব কম (৩১ দশমিক ৫ শতাংশ) হওয়ায় এ নির্বাচনকে ‘নাতিশীতোষ্ণ নির্বাচন’, ‘জনগণের আস্থা হারানোর নির্বাচন’, ‘নিরুত্তাপ নির্বাচন’ ইত্যাদি নামে অভিহিত করা হয়।

ডিএনসিসি ও ডিএসসিসির আসন্ন নির্বাচনে সেনাবাহিনী মোতায়েনের সম্ভাবনা নাকচ করে দিয়েছেন সিইসি। এ দুই সিটি কর্পোরেশনের ২০১৫ সালের নির্বাচনে প্রথমে স্ট্রাইকিং ও রিজার্ভ ফোর্স হিসেবে সেনাবাহিনী নিয়োগের সিদ্ধান্ত নিলেও পরে সে সিদ্ধান্ত থেকে সরে যায় নির্বাচন কমিশন।

পরিবর্তিত সিদ্ধান্ত অনুযায়ী নির্বাচনের দু’দিন আগ থেকে নির্বাচনের পরদিন পর্যন্ত সেনাসদস্যদের সেনানিবাসের অভ্যন্তরে রিজার্ভ ফোর্স হিসেবে রাখা হয়। বলা হয়, শুধু রিটার্নিং অফিসারের অনুরোধে তারা পরিস্থিতি মোকাবেলা করবে। সেনাবাহিনীকে স্ট্রাইকিং ফোর্স হিসেবে মাঠে না রাখায় ওই সিটি নির্বাচনে যে অনিয়ম হয়েছিল, সে সময়ের গণমাধ্যমের রিপোর্টের ভিত্তিতে তার সংক্ষিপ্ত বর্ণনা উপরে দেয়া হয়েছে।

ডিএনসিসি ও ডিএসসিসির আসন্ন নির্বাচনে সেনাবাহিনী নিয়োগ না করা হলে সে অবস্থার যে পুনরাবৃত্তি হবে না তার নিশ্চয়তা কোথায়? তাই অতীতের অভিজ্ঞতার আলোকে আসন্ন ঢাকা সিটি নির্বাচন সুষ্ঠু করতে নির্বাচনের অন্তত দু’দিন আগে থেকে নির্বাচনের একদিন পর পর্যন্ত সেনাবাহিনীকে স্ট্রাইকিং ও রিজার্ভ ফোর্স হিসেবে মাঠে রাখার বিষয়টি কমিশন পুনর্বিবেচনা করতে পারে।

গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা ও এর বিকাশে সুষ্ঠু, অবাধ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের বিকল্প নেই- সে নির্বাচন জাতীয় বা স্থানীয় যে পর্যায়েই অনুষ্ঠিত হোক। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, গত ছয় বছর ধরে জাতীয় ও স্থানীয় সরকার পর্যায়ে সুষ্ঠু নির্বাচন অধরা রয়ে গেছে।

বর্তমান নির্বাচন কমিশনের অধীনে নানা অনিয়মের মধ্য দিয়ে অনুষ্ঠিত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অতীতের সব নির্বাচনের রেকর্ড ভঙ্গ করেছে। এ নির্বাচনে যেসব অভিযোগ উঠেছে সেগুলোর মধ্যে রয়েছে- নির্বাচনের আগের রাত ব্যালট বাক্সে ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থীদের অনুকূলে সিল মেরে রাখা, বুথ দখল করে প্রকাশ্যে ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থীদের অনুকূলে ব্যালটে সিল মারা, সরকারবিরোধী জোটের পোলিং এজেন্টদের ভোটকেন্দ্রে প্রবেশ করতে না দেয়া, সরকারবিরোধী দল বা জোটের প্রার্থীর সমর্থক ও নেতাকর্মীদের ভয়-ভীতি প্রদর্শন, হামলা, নির্বাচনী ক্যাম্প ভাংচুর করা ও পুড়িয়ে দেয়া।

বর্তমান নির্বাচন কমিশনের আমলে একাদশ সংসদ নির্বাচনের আগে বা পরে যেসব স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে, সেসব নির্বাচনের অধিকাংশ হয় সুষ্ঠু হয়নি অথবা অংশগ্রহণমূলক ছিল না। আসন্ন ঢাকা সিটি নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে কমিশন কিছুটা হলেও তাদের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করতে পারে।

সবশেষে বলতে চাই, সরকারি দল আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি, জাতীয় পার্টিসহ সব বিরোধী দলের অংশগ্রহণে আসন্ন ঢাকা সিটি নির্বাচন সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক হোক- এটাই জনগণের প্রত্যাশা। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় দেশে নির্ভেজাল গণতন্ত্রের ভিত শক্তিশালী হোক। গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে বাংলাদেশ বিশ্বের দরবারে মাথা উঁচু করে দাঁড়াক।

আবদুল লতিফ মন্ডল : সাবেক সচিব, কলাম লেখক

latifm43@gmail.com

ঢাকা সিটি

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম