Logo
Logo
×

বাতায়ন

সমাজ বাস্তবতার বিষণ্ণ ছবি

Icon

এ কে এম শাহনাওয়াজ

প্রকাশ: ২০ জানুয়ারি ২০২০, ০৬:০০ পিএম

প্রিন্ট সংস্করণ

সমাজ বাস্তবতার বিষণ্ণ ছবি

আন্দোলনকারীদের হাত থেকে স্বামীকে বাঁচাচ্ছেন সন্তানসম্ভবা স্ত্রী। ছবি: যুগান্তর

গত ১৫ জানুয়ারি কয়েকটি জাতীয় দৈনিক পত্রিকার প্রিন্ট ও অনলাইন মাধ্যমে রিপোর্টটি প্রকাশিত হয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু ছাত্র সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের তারিখ পেছানোর দাবিতে শাহবাগ মোড়ে রাস্তা বন্ধ করে আন্দোলন করছিল।

আওয়ামী লীগের নেতাসহ অনেকেরই সমর্থন ছিল এ দাবিতে। সরস্বতী পূজার দিন নির্বাচনের তারিখ পড়ায় ছাত্রদের এ দাবির যৌক্তিকতা অনেকেই মেনে নিয়েছেন। আমাদের মতো অসাম্প্রদায়িক মনোভাবের দেশে এমন দাবির মধ্যে সৌন্দর্যও আছে।

গত কয়েকদিন বিভিন্ন মহলের প্রতিক্রিয়া দেখে ও শুনে বোঝা যাচ্ছিল নির্বাচন কমিশনকে তাদের সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসতে হবে। এমন এক বাস্তবতায় আন্দোলনকারীরা শাহবাগে রাস্তা বন্ধ করায় তীব্র জানজটের সৃষ্টি হয়। শাহবাগ রাজধানীর সড়ক ব্যবস্থাপনার একটি গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট।

এখানে বিনা নোটিশে রাস্তা বন্ধের পিকেটিং হলে নগরবাসীর অনেকেই চরম বিপাকে পড়ে। মানুষের দুর্ভোগ যাতে না হয় এমন এক নির্বিবাদী স্থানে অবস্থান নিয়ে দাবি উত্থাপন করে যাওয়া যথেষ্ট ছিল। সেখান থেকেই আলটিমেটাম দেয়া যেত।

কিন্তু মুশকিল হচ্ছে আন্দোলনকারীরা এমনটি দেখে অভ্যস্ত যে এ দেশে পিকেটিং এবং ভাংচুর করে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি না করা পর্যন্ত সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বিশেষত সরকার পক্ষের ঘুম ভাঙে না। আন্দোলনকারীরা এ সত্য জানে বলেই নিজেদের বিজয় অর্জনের জন্য জনদুর্ভোগ সৃষ্টি করাকে কৌশল বিবেচনা করে।

প্রকাশিত রিপোর্টে ঘটনাটি এমন, শাহবাগে যানজটে দীর্ঘক্ষণ আটকে আছেন অনেকের মতো এক দম্পত্তি। ব্যবসায়ী ভদ্রলোক প্রবাসী। এ দেশের নাগরিক হলেও দেশের রাজনৈতিক হাবভাবের সঙ্গে হয়তো তেমন পরিচিত নন। উল্লেখ্য, সঙ্গে তার লাইসেন্স করা পিস্তল ও শটগান ছিল।

সন্তানসম্ভবা স্ত্রীকে হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছিলেন। হতাশ ও বিরক্ত ব্যবসায়ী ভদ্রলোক এক পর্যায়ে নেমে ছাত্রদের সমস্যার কথা বলে তার গাড়ি ছেড়ে দিতে অনুরোধ করলেন। কিন্তু এতে নারাজ ছাত্ররা। তারা জড়িয়ে পড়ে উত্তপ্ত বাক্য বিনিময়ে।

একপর্যায়ে ব্যবসায়ী ধৈর্য হারিয়ে তার পিস্তল ঠেকান এক ছাত্রের বুকে। তাই স্বাভাবিকভাবে উত্তেজনা বড় হয়। গণপিটুনির মুখে পড়েন ব্যবসায়ী। অসহায় অসুস্থ স্ত্রী দৌড়ে আসেন স্বামীকে বাঁচাতে। জড়িয়ে ধরে ঢাল তৈরি করেন। এ মর্মস্পর্শী ছবি ছাপা হয়েছে অনেক পত্রিকায়।

এমন রিপোর্টের সূত্রে অনেক প্রশ্ন সামনে চলে এসেছে। এ সময়ের সমাজ বাস্তবতার বিষণ্ন ছবি যেন দেখতে পাচ্ছিলাম।

সব ঘটনার উৎস ঢাকা সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা নিয়ে নির্বাচন কমিশনের অদক্ষতা প্রদর্শন। তারিখ নির্ধারণের মতো এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় কম গুরুত্বে দেখা। সরস্বতী পূজা প্রধানত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অনুষ্ঠিত হয়। সেখানেই আবার পূজার দিনে ভোটের আয়োজন!

কমিশনের পক্ষ থেকে একটি হাস্যকর সাফাই শুনেছিলাম ক’দিন আগে। যে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পূজামণ্ডপ তৈরি হয়, তারা সেগুলো বাদ রেখেছেন। কমিশনের বিধায়করা হয়তো জানেন না এখন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে দিন দিন পূজার সংখ্যা বাড়ছে।

আগে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে দু-একটি নির্ধারিত স্পটে পূজামণ্ডপ তৈরি হতো। পরে প্রশাসন স্থায়ী মন্দির বানিয়ে দেয়। ধারণা করা হয়েছিল, পূজার আয়োজন সেখানেই কেন্দ্রীভূত থাকবে। অথচ এখন মন্দির ছাড়াও বিভিন্ন একাডেমিক বিভাগের শিক্ষার্থীরা আলাদা করে মণ্ডপ সাজায়।

তীব্র প্রতিক্রিয়ার পরও নির্বাচন কমিশনের অনড় থাকার পেছনের শক্তির কথা জানতে পারলাম। তারিখ পরিবর্তনের রিট আবেদন খারিজ করে দিয়েছেন মহামান্য উচ্চ আদালত। আদালতের ব্যাপারে আমরা নীরব থাকতে চাই। নির্বাচন কমিশন যুক্তি দেখাল এসএসসি পরীক্ষা ইত্যাদির কারণে তাদের হাতে আর সময় নেই।

সাংবিধানিক বাধ্যবাধ্যকতা রয়েছে। কিন্তু অধিকতর সময়ের প্রয়োজনে ও গুরুত্বে অনেক সময় সমন্বয় করা যে জরুরি হয়ে পড়ে তা মানতে চায়নি কমিশন। শেষে তো তারিখ পরিবর্তন করতেই হল। বিধায়করা নিশ্চয়ই সরকারি ছুটির তালিকা দেখে ২৯ জানুয়ারি পুজোর দিন ভেবেছিলেন।

খেয়াল করেননি পূজা পঞ্জিকা মেনে হয়। এতে ৩০ জানুয়ারি বেলা ১১টা পর্যন্ত পূজা চলবে। নির্বাচন শুরু যদি হতো দুপুর ২টা থেকে তাহলে একটি যুক্তি ছিল। পূজার মাঝপথে তো মণ্ডপ ভেঙে দেয়া যায় না। অবশ্য রক্ষা- ধর্মীয় মৌলবাদীরা কোনো দাবি করেননি। এসব দাবি সরকার সাধারণত মান্য করে।

এমন হলে হয়তো কোনো রক্ষাকবচ আইন-টাইন দেখিয়ে শরিয়ত বয়াতির গ্রেফতারের মতো ভোরে পূজারিদের বের করে দেয়া যেত। তবে এমনটি সম্ভব নয়। কারণ এ দেশের সাধারণ মানুষকে সাম্প্রদায়িক বানানোর চেষ্টা বৃথা হবে। ঐতিহাসিকভাবে এ দেশের মানুষ অসাম্প্রদায়িক চেতনার মধ্য দিয়ে বড় হয়েছে।

কিন্তু ক্ষত যেটি তা হচ্ছে আমাদের রাজনীতিকরা রাজনীতির শুভ্র-সুন্দর অবয়বকে অচেনা করে দিয়েছেন। তাই মাঠে নেমে তরুণরাও যুক্তি ও মানবিকতার ধার ধারছে না। বলপ্রয়োগের অভ্যাস ও উত্তেজনায় নিজেদের গণ্ডিবদ্ধ করে ফেলেছে।

না হলে ব্যবসায়ী যখন জানালেন স্ত্রীকে হাসপাতালে নিতে হবে, সঙ্গে সঙ্গে ছাত্ররা মানবঢাল তৈরি করে তার গাড়ি বেরোনোর ব্যবস্থা করতে পারত। আমরা শিশুদের সড়ক অবরোধের কথা মনে করতে পারি।

ওরা কী সুশৃঙ্খলভাবে অ্যাম্বুলেন্সগুলো বেরোনোর ব্যবস্থা করেছিল। শাহবাগে ছাত্ররা শুরুতে মানবিক আচরণ করলে পরবর্তী ঘটনাগুলো ঘটত না। আমাদের রাজনীতি নষ্ট করে দেয়া জাতীয় রাজনীতিকরা এসব সুন্দরের পাঠ দেন না। তাই নিজেদের গোষ্ঠীস্বার্থ রক্ষার জন্য শিশুদের রাস্তা থেকে সরাতে রাজনৈতিক লাঠিয়ালদের মাঠে নামিয়েছিলেন।

শাহবাগে অরাজনৈতিক আন্দোলন হলেও নিজেদের অভ্যাস ও পরিবেশগত দীক্ষা ও আচরণের কারণে তরুণ ছাত্ররা সেদিন মানবিক হতে পারেনি। ব্যবসায়ী ভদ্রলোককে প্রবাসী ধারণা বাদ দিয়ে পোড়খাওয়া এ দেশি হওয়া উচিত ছিল।

ছোট ভাই বয়সীদের হাত-পা ধরে অনুরোধ করা উচিত ছিল। এর বদলে উত্তেজিত হয়ে বন্দুক তাক করলেন! এটি নিশ্চয়ই অন্যায়। আন্দোলনকারীরা যদি শোভন আচরণের দীক্ষা পেত তাহলে ভদ্রলোককে পুলিশের হাতে সোপর্দ করা যেত।

এর বদলে গণধোলাই! বড় ভাই বয়সী তো কী হয়েছে- ওরা তো দেখে অভ্যস্ত রাজনৈতিক বন্ধুরা ক্যাম্পাসে শিক্ষকদেরও কীভাবে অপমান করে। বাম রাজনীতি এক সময় জনপ্রিয় ছিল এ দেশে।

তখন এ অঞ্চলের তরুণদের চলনে-বলনে, লেখায়, চর্চায় এক ধরনের মাধুর্য ছিল, যার কারণে তাদের অন্যদের থেকে আলাদা করা যেত। এখন হরে দরে এক হয়ে গেছে। হয়তো তরিকা আলাদা; কিন্তু গাড়ল আচরণ একই।

তবে আমি তরুণদের তেমন দোষ দিতে পারি না। ওরা উদাহরণ নেবে কোথা থেকে! তরুণরা ক্যাম্পাসে রাজনৈতিক বড়ভাইদের দেখে পেশিশক্তি প্রদর্শন করতে। ভাংচুর করতে। আন্দোলনরত শিক্ষকদের দেখে প্রতিপক্ষ শিক্ষক-প্রশাসককে লাগামহীন বকাঝকা করতে।

দেখে রাজনীতিক আইনজীবীদের আদালতের রায় নিজ দলের বিরুদ্ধে গেলে আদালতপাড়ায় মিছিল করতে- ভাংচুর বা আদালতের দরজায় লাথি মারতে। অন্য পেশাজীবীদেরও দেখে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষদের প্রতি পরস্পরের চড়াও হতে, তখন শোভন আচরণের দীক্ষা পাওয়ার সুযোগ থাকে না। এসবই যেন সমাজ বাস্তবতার এক বিষণ্ন ছবি।

এর পাশাপাশি আমার চেখে ভাসে ১৯৯২ সালের কথা। আমি গবেষণার কাজে তখন কলকাতায়। থাকি আলীপুরে ভারতীয় ন্যাশনাল লাইব্রেরির রিডার্স হোস্টেলে। ন্যাশনাল লাইব্রেরি ক্যাম্পাস ব্রিটিশ আমলে বড়লাটের বাড়ি ছিল। বিশাল ক্যাম্পাস। বেশ সাজানো-গোছানো।

ভেতরের রাস্তার ধারে, ভবনের সিঁড়ির ধাপে হাজার হাজার ফুলের টবে অসংখ্য রঙিন ফুল ঝলমল করত। একদিন দেখলাম ক্যাম্পাসে বেশ উত্তেজনা। ন্যাশনাল লাইব্রেরির সীমানার পরেই ভারতীয় কেন্দ্রীয় সরকারের অফিসারদের কোয়ার্টার। নিজেদের ক্লাব নেই বলে অফিসাররা সন্ধ্যায় আসতেন লাইব্রেরির অফিসারদের ক্লাবে।

এ দুই প্রতিষ্ঠানের অফিসারদের আনন্দ আয়োজন ছিল সেখানে। কিন্তু হঠাৎ ফুঁসে উঠলেন লাইব্রেরির তৃতীয়-চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীরা। অভিযোগ এলো রাতে ক্লাবে নাকি অনৈতিক কাজ হয়। তাই তারা সরকারি অফিসারদের ঢুকতে দেবেন না। এ ক্ষোভ স্তিমিত না হতেই আরেক সংকট দেখা দিল।

লাইব্রেরি ক্যাম্পাসের পেছনের গেটের কাছাকাছি একটি চমৎকার টেনিস কোর্ট আছে। শোনা গেল, কেন্দ্রীয় সরকারের কর্মকর্তারা একটি বড় টেনিস টুর্নামেন্টের আয়োজন করেছে। নানা দেশ থেকে বিভিন্ন টিম আসবে। ভাড়া নিয়েছে লাইব্রেরির এ টেনিস কোর্টকে। লাখ লাখ টাকা ব্যয়ে টেনিস কোর্টের নবরূপায়ণ করা হচ্ছে।

আমি প্রতিদিন এ পেছনের গেট দিয়ে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে যাই আর টেনিস কোর্টের পরিচর্যা দেখি। এরই মধ্যে ফের উত্তেজনা দেখা দিল। কর্মচারীরা এখানে অফিসারদের খেলা হতে দেবেন না। স্লোগান হল, লিফলেট ছাড়া হল। একদিকে ঘনিয়ে এলো খেলার তারিখ। এরই মধ্যে একদিন বিকালে যাদবপুর থেকে ফিরছি।

গেট দিয়ে ভেতরে ঢুকেই থমকে গেলাম। আমার অভ্যস্ত চোখ কী যেন খুঁজে পাচ্ছে না। শেষে সংবিৎ ফিরে পেলাম। আসলে গোটা টেনিস কোর্টটাই নেই। এর বদলে পুরো জায়গায় ঝলমল করছে একটি ফুলের বাগান। রকমারি ফুলে উজ্জ্বল হয়ে আছে।

একি ভোজবাজির কাণ্ড! একবেলার মধ্যে কীভাবে গায়েব হয়ে গেল টেনিস কোর্ট। কোনো ধ্বংসযজ্ঞের আলামতও নেই। আর এমন সুন্দর সুবিন্যস্ত বাগানই বা বেলাবেলি তৈরি হল কেমন করে! পরে জানলাম আন্দোলনের এ এক নান্দনিক প্রকাশ।

কর্মচারীরা ক্যাম্পাস থেকে ভ্যানগাড়ি করে হাজার হাজার ফুলের টব নিয়ে এসেছিলেন। সুন্দর করে সাজিয়ে ঢেকে ফেলেছেন টেনিস কোর্ট। কোনো কিছু ভাংচুর হয়নি- নষ্ট হয়নি। কিন্তু এ অভূতপূর্ব প্রতিবাদ-প্রতিরোধে বন্ধ হয়ে গিয়েছিল টেনিস টুর্নামেন্ট।

ন্যাশনাল লাইব্রেরির কর্মচারীরা কী মননশীলতা আর সৌন্দর্যে নিজেদের দাবি আদায় করেছিলেন। এ স্মৃতি আমার মনে স্থায়ী হয়ে রইল। কতটা অহিংসা আর সৌন্দর্য ছড়িয়ে আন্দোলনের দাবি আদায় করা যায়! কম শিক্ষিত নিুআয়ের কর্মচারীদের কাছ থেকে আমি অনেক কিছু শিখলাম।

ড. এ কে এম শাহনাওয়াজ : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

shahnawaz7b@gmail.com

ড. এ কে এম শাহনাওয়াজ ঢাবি শাহবাগ

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম