Logo
Logo
×

বাতায়ন

উপমহাদেশে শান্তি-স্বস্তির বাতাবরণই কাম্য

Icon

বিমল সরকার

প্রকাশ: ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০২০, ০৬:০০ পিএম

প্রিন্ট সংস্করণ

উপমহাদেশে শান্তি-স্বস্তির বাতাবরণই কাম্য

ফাইল ছবি

দুনিয়ায় কেউই শতভাগ পারফেক্ট নয়। ভুল যে কারোরই হতে পারে। ব্যক্তি, সংস্থা, প্রতিষ্ঠান, এমনকি আরও বড় কারও। এ ছাড়া ‘সময়ের প্রয়োজনে’ বলেও একটি কথা আছে। সর্বোপরি ‘অসতর্কতা’র ব্যাপারটি তো রয়েছেই।

ভুল সংশোধন করতে সাহস আর স্বীকার করতে সৎসাহসের দরকার। আর ভুলে গেলে চলবে না সেই আপ্তবাক্যটি, ‘জনগণের চেয়ে উৎকৃষ্টতর মানুষের কথা কখনও কল্পনা করা যায় না।’ এ জন্য শাসককুলের সবার আগে জনগণের ভাষা বুঝতে হয়, প্রকৃতপক্ষে জনগণ কী চায়।

ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বাধীন বিজেপি সরকার প্রণীত নতুন আইন এনআরসি ও সিএএ এখন কেবল ভারত নয়, গোটা উপমহাদেশেই বিশেষ ভাবনার বিষয়।

২০১৯ সালের ডিসেম্বর থেকে বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও ভারতের শান্তিকামী জনগণের জন্য তা দুঃসহ উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা ও বিড়ম্বনার কারণ হয়ে দেখা দিয়েছে।

সে দেশে একের পর এক নিজেদের বিধানসভায় সিএএবিরোধী আইন পাস করে চলেছে একেকটি রাজ্য সরকার। কেরালা, পাঞ্জাব, রাজস্থান, পশ্চিমবঙ্গ, মধ্যপ্রদেশ প্রভৃতির পর এবার সক্রিয় হয়েছে তেলেঙ্গনা রাজ্য। বোঝা দায় এ প্রতিবাদের ক্রমধারা শেষ পর্যন্ত কোথায় গিয়ে ঠেকে আর এর নিরসনই বা কীভাবে, কোন পথে।

ভারতবর্ষে মুঘল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা জহিরুদ্দীন মুহম্মদ বাবর মারা যাওয়ার আগে উত্তরাধিকারীদের উদ্দেশে এমন একটি উপদেশবাণী রেখে যান- “ভারতবর্ষ এক বিচিত্র জায়গা। বহু ধর্মের অনুসারী ও বহু ভাষাভাষী লোক এখানে বসবাস করে।

ধর্ম-বর্ণ-গোত্র ও সামাজিক শাসন-অনুশাসন এবং রীতিনীতি পালনের দিক দিয়ে পৃথিবীর আর কোথাও এমন আর একটি দেশ খুঁজে পাওয়া যাবে না। ‘বিবিধের মাঝে ঐক্য, বৈচিত্র্যের মাঝে মিলন’ এই হল ভারত, ভারতবর্ষ।

আর কিছু তোমরা যাই কর, এখানকার মানুষের ধর্মবিশ্বাস, রীতিনীতি ও প্রচলিত সামাজিক প্রথা-অনুশাসনগুলোর ওপর কখনও হস্তক্ষেপ করবে না।” বিচিত্র ভারতবর্ষ সম্পর্কে তার আগাগোড়া অনেকটা স্পষ্ট ধারণা ছিল বলেই বোধ করি ‘মুঘল-এ-আযম’ বাবরের পক্ষে এমন একটি মন্তব্য করা সম্ভব হয়েছিল।

মূলত এ নীতি অনুসরণ করেই বাবরের উত্তরাধিকারীরা তিনশ’ বছরের বেশিকাল প্রধানত হিন্দু জন-অধ্যুষিত উপমহাদেশে তাদের শাসন-আধিপত্য বহাল রাখতে সক্ষম হয়েছিলেন।

আধুনিক ভারতের রূপকার পণ্ডিত জওহরলাল নেহেরু সেই কবে মুঘল বাদশাহ আকবরকে ‘ভারতীয় জাতীয়তাবাদের জনক’ বলে অভিহিত করেছিলেন।

কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের ভাষায়-

‘হেথায় আর্য, হেথা অনার্য, হেথায় দ্রাবিড়, চীন-

শক-হুন-দল, পাঠান মোগল এক দেহে হল লীন।

পশ্চিম আজি খুলিয়াছে দ্বার সেথা হতে সবে আনে উপহার,

দিবে আর নিবে, মিলাবে মিলিবে- যাবে না ফিরে,

এই ভারতের মহামানবের সাগরতীরে।’

পৃথিবীতে সাগর-মহাসাগর, দেশ-মহাদেশ, দ্বীপ-উপদ্বীপ, বন-উপবন এমন অনেককিছু রয়েছে; কিন্তু সাতটি মহাদেশের মধ্যে উপমহাদেশ (sub-continent) একটিই আছে এবং তা হল ভারতীয় উপমহাদেশ (Indian sub-continent)| এ ক্ষেত্রে সে একক, অনন্য; ভারতীয় উপমহাদেশ ছাড়া পৃথিবীর আর কোথাও কোনো উপমহাদেশ নেই।

ভারতীয় উপমহাদেশের ইতিহাস-ঐতিহ্য অনেক সমৃদ্ধ, গৌরবমণ্ডিত ও নানা বৈচিত্র্যে ভরপুর। প্রায় দু’শ বছর শাসন করার পর ১৯৪৭ সালে ইংরেজরা দ্বি-জাতি তত্ত্বের (হিন্দু ও মুসলমান) ভিত্তিতে উপমহাদেশকে ভাগ করে ভারত ও পাকিস্তান নামে দুটি আলাদা স্বাধীন রাষ্ট্র রেখে চিরবিদায় গ্রহণ করে।

ইংরেজরা ১৯৪৭ সালে ভারতীয় উপমহাদেশকে দুই ভাগ করার ফলে তা হয় পাক-ভারত উপমহাদেশ। একইভাবে ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সঙ্গে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের ফলে নতুন রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পর থেকে নতুন পরিচয় হয় ‘বাংলাদেশ ও পাক-ভারত উপমহাদেশ’ (Bangladesh and Indo-Pak sub-continent)।

এ উপমহাদেশেই সুদূর প্রাচীনকালে গড়ে ওঠে বিখ্যাত সিন্ধু সভ্যতা ও আর্য সভ্যতা। হিন্দুদের গৌরব-গরিমা এবং ঐতিহ্যমণ্ডিত রামায়ণ ও মহাভারতের মতো মহাকাব্য রচিত হয় এখানকার পরিস্থিতি-পরিবেশ ও পটভূমিতেই।

বেদ, পুরাণ-উপনিষদ আরও কত গ্রন্থ-সংস্কৃতি এবং বিশ্বাসের উৎসভূমি ‘এই মহামানবের সাগরতীর’। হিন্দু শাসন, বৌদ্ধ শাসন-মৌর্য-গুপ্ত-শক-কুষান। যুগের পর যুগ, শতাব্দীর পর শতাব্দী বংশানুক্রমিক শাসন চলেছে এক একটি রাজবংশের। মুসলিম শাসন- তুর্কি-খিলজি-পাঠান-মুঘল।

বাণিজ্যব্যপদেশ তথা ভাগ্যান্বেষণে এলো ইউরোপীয়রা- পর্তুগিজ, ওলন্দাজ, দিনেমার, ফরাসি, ইংরেজ। পারস্পরিক প্রতিযোগিতায় টিকে যায় খ্রিস্টান ইংরেজরা।

ছল-বল-কৌশল খাটিয়ে সমগোত্রীয় ব্যবসায়ী প্রতিদ্বন্দ্বীদের, এমনকি পরাক্রমশালী মুঘল শাসকদেরও পরাস্ত করে সুবিশাল এ ভূখণ্ড ও কোটি কোটি মানুষের রাজনৈতিক ভাগ্যবিধাতার ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়।– ‘পোহাইলে শর্বরী, বণিকের মানদণ্ড দেখা দিল রাজদণ্ডরূপে।’ ইউরোপীয় প্রতিদ্বন্দ্বীদের সঙ্গে সমান বা অসম-প্রতিযোগিতায় শেষ পর্যন্ত টিকে যায় ইংরেজরা।

এনআরসি (ন্যাশনাল রেজিস্টার অব সিটিজেনস)- রাষ্ট্রীয় নাগরিকপঞ্জি বা নাগরিকদের রাষ্ট্রীয় পঞ্জি। তার মানে ভারতের নাগরিক হওয়ার জন্য দলিল-প্রমাণে যে কাউকে সরকারকে এ কথা বোঝাতে হবে যে সে ভারতের নাগরিক, যা একজন সাধারণ নাগরিকের জন্য অত্যন্ত কষ্টকর ও ঝামেলাপূর্ণ।

ভারতের মতো বিশাল একটি দেশে কৃষক, শ্রমিক, দিনমজুর; শিক্ষিত, অশিক্ষিত, নানা বর্ণ ও পেশায় নিয়োজিত বিচিত্রসব পেশার নাগরিক বসবাস করে। নতুন আইনে কাগজপত্রে নাগরিক বলে তাদের প্রমাণ দিতে হবে।

কাজটা খুবই কঠিন হলেও হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান সবার জন্যই সমানভাবে প্রযোজ্য ছিল। কিন্তু কট্টর হিন্দুত্ববাদী বিজেপি নেতারা যেখানে ‘রামরাজত্ব’ স্থাপন করার স্বপ্নে বিভোর, সেখানে তাদের ‘এনআরসি’ নীতি কার্যকর হচ্ছে না দেখে ভিন্নদিকে মনোযোগ দেয়।

কারণ এনআরসি কার্যকর করলে অনেক হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টানের নাগরিকত্ব হারানোর আশঙ্কা রয়েছে। এতে হতাশ হয়ে ধর্মান্ধরা নতুন কৌশল অবলম্বন করে।

অন্যদের নয়, মুসলিমদের নাগরিকত্ব হরণের দুরভিসন্ধি নিয়ে তারা দ্বিতীয় আইন জারি করে। পেশ করার সময় প্রথমে ছিল ‘সিএবি’ (সিটিজেনশিপ অ্যামেন্ডমেন্ডমেন্ট বিল) অর্থাৎ ‘সংশোধিত নাগরিকত্ব বিল’।

পরে লোকসভা ও রাজ্যসভার মাধ্যমে আইনে পরিণত হয়েছে ‘সিএএ’ (সিটিজেনশিপ অ্যামেন্ডমেন্ট অ্যাক্ট) নামে। এ আইনের সহজ কথা হল ২০১৪ সালের ৩১ ডিসেম্বরের আগে যেসব অমুসলিম ভারতে প্রবেশ করেছে, কাগজপত্রে ভারতের নাগরিকত্ব প্রমাণ করতে না পারলেও তাদের ভারতের নাগরিকত্ব দেয়া হবে।

দেয়া হবে না কেবল মুসলিমদের। তার কারণ হিসেবে ভারত দাবি করছে- পার্শ্ববর্তী দেশগুলোয় (বাংলাদেশ, পাকিস্তান, আফগানিস্তান) অমুসলিমরা সংখ্যালঘু হওয়ায় নির্যাতিত।

এটা প্রতীয়মান যে, উল্লিখিত দুই আইনের মাধ্যমে হিন্দুত্ববাদ প্রতিষ্ঠায় ভারতে একদিকে কেবল অমুসলিম হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টানদের নাগরিকত্ব দেয়া হবে, অন্যদিকে মুসলমানদের ভারত থেকে তাড়িয়ে দেয়ার সূক্ষ্ম পাঁয়তারা করা হচ্ছে।

এটি গোটা উপমহাদেশেই অস্থিরতা তৈরি করবে। উপমহাদেশ বিভক্ত হয়েছে এটা ঐতিহাসিক সত্য। তবে খেয়াল রাখতে হবে, পৃথক হলেও বাংলাদেশ, পাকিস্তান, ভারত ইত্যাদি দেশের সাধারণ মানুষ বরাবরই শান্তি ও স্বস্তিকামী।

এ অবস্থায় উপমহাদেশে শান্তি-স্বস্তির বাতাবরণই কাম্য। শাসককুলের কোনো অদূরদর্শী সিদ্ধান্ত কোনোক্রমেই যাতে বিরাজমান শান্তি ব্যাহত করতে না পারে, জনগণকে সে বিষয়ে সজাগ থাকতে হবে।

বিমল সরকার : অবসরপ্রাপ্ত কলেজ শিক্ষক

উপমহাদেশ শান্তি

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম