বৈশ্বিক মহামারী ও উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা প্রসঙ্গ
এম এ জলিল আনসারী ও আলী হাসান
প্রকাশ: ১২ জুলাই ২০২০, ০৬:০০ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ
ছবি: সংগৃহীত
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
করোনা বৈশ্বিক মহামারীর শেষ কোথায়- তা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাও নিশ্চিত করে বলতে পারছে না। করোনাকে ঠেকাতে তাই সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা এখন সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় বিধান। এজন্য আমাদের নতুন নতুন নিয়মের সঙ্গে খাপ খাইয়ে চলতে হচ্ছে। এটি নিঃসন্দেহে জীবনধারণের একটি প্রয়োজনীয় দক্ষতা।
এ দক্ষতা কাজে লাগিয়ে করোনাযুদ্ধে জয়লাভ করতে হবে। করোনা মহামারীর কয়েক মাসে দেশে এবং বিদেশে হাজার হাজার সম্মেলন, ধর্মীয় ও সামাজিক অনুষ্ঠানসহ অসংখ্য কার্যকলাপ হয় স্থগিত করা হয়েছে, না হয় কাটছাঁট করে প্রযুক্তির সহায়তায় অনলাইনে অনুষ্ঠিত হচ্ছে।
প্রথমদিকে বিষয়টি অসম্ভব মনে হলেও অবস্থা অনেকটাই কাটিয়ে ওঠা গেছে, এতে অনলাইনের সুষ্ঠু ব্যবহার ও উদ্দেশ্য অর্জন করা যাচ্ছে। ভালো-মন্দ যাই হোক, প্রযুক্তিকে ব্যবহার করে জনজীবন নতুনভাবে চলতে শুরু করেছে- এটিই জীবজগতের নতুন পরিস্থিতিতে খাপ খাইয়ে চলার সক্ষমতা।
আমাদের দেশে তেরো লক্ষাধিক উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার্থী শিক্ষা বোর্ডের নির্ধারিত শ্রেণিকক্ষের কার্যক্রম শেষ করে শুধু পরীক্ষায় বসার জন্য প্রস্তুত হয়ে করোনার কারণে চরম অনিশ্চয়তার মধ্যে বাড়িতে বসে দিন গুনছে- বিষয়টি সবারই জানা।
একদিকে করোনা মহামারী, অন্যদিকে শিক্ষাজীবনের এমন অনিশ্চয়তা; তাদের মানসিক অবস্থা শেষ পর্যন্ত কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে, তা নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না।
যে কোনো শিক্ষাবিদই বলবেন- শিক্ষা কার্যক্রমে পরীক্ষা গ্রহণ, প্রশিক্ষণের মূল্যায়ন বৈ কিছু নয়। শিক্ষার্থী-মূল্যায়নের মাধ্যমে শিক্ষাব্যবস্থা ও প্রতিষ্ঠানের ত্রুটিবিচ্যুতি নির্ধারণ সহজ হয়।
পরবর্তী সময়ে ওই ত্রুটিবিচ্যুতি দূর করে শিক্ষা ও পাঠদান পদ্ধতি আরও উন্নত করে তোলা যায় যদি সদিচ্ছার ঘাটতি না থাকে। কিন্তু আমাদের দেশে পাবলিক পরীক্ষার ব্যাপারে এ ধারণা অনেকেই পোষণ করতে ভরসা পান না। পরীক্ষাকে নিছক প্রতিযোগিতা হিসেবে দেখতেই আমরা অভ্যস্ত।
বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত পৌঁছতে শিক্ষার্থীকে অন্তত চারটি পাবলিক পরীক্ষার মতো প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করতে হয় এবং এর অপরিহার্যতা সবার মনোজগতে মিশে গেছে। কাজেই বর্তমান করোনাকালে যেসব শিক্ষার্থী ইতঃপূর্বে তিনটি পাবলিক পরীক্ষা দিয়ে ফেলেছে তাদের জন্য এইচএসসির চতুর্থ পরীক্ষাটি না দিলেও শিক্ষার কোনো ক্ষতি হবে না- এমন মন্তব্য ঝুঁকিপূর্ণ মনে হতে পারে।
আমাদের শিক্ষাপদ্ধতিতে যেমন উন্নয়নের অবকাশ আছে, ঠিক তেমনই মেধা-মূল্যায়নেও রয়েছে নানাবিধ প্রশ্ন। আদর্শ মূল্যায়ন প্রক্রিয়া এমন হওয়া উচিত, যাতে কোনো প্রশিক্ষণার্থীকে বারবার মূল্যায়ন করা হলেও যেন একই ফলাফল আসে। তবে এমন মূল্যায়ন পদ্ধতি বাস্তবে মেলা ভার, আমাদের দেশে তো অনেক দূর।
এখানে পাবলিক পরীক্ষার মান নিয়ে ভেতরে ভেতরে সন্দেহ থাকে বলেই এত পরীক্ষার পরও আবার প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে অযৌক্তিক হয়রানিমূলক অসংখ্য ভর্তি পরীক্ষা নেয়া হয়।
প্রতিটি শিক্ষার্থী ডজন খানেক প্রতিষ্ঠানে পরীক্ষা দেয়, হয়তো নির্বাচিত হয় একাধিকটিতে, ভর্তি হয় কয়েক স্থানে আর পড়া শুরু করে পছন্দসই একটি প্রতিষ্ঠানে। এদের সিংহভাগ আবার হয়তো কোথাও নির্বাচিত হতে পারে না অথচ ভর্তি কার্যক্রম শেষে দেখা যায় প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়েই বেশকিছু সিট ফাঁকা রয়ে যায়- এ এক নির্মম পরিহাস, এ এক নিদারুণ অনিশ্চয়তা।
উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তির সময় মাধ্যমিক স্তর অবধি পূর্ববর্তী বোর্ড কর্তৃক আয়োজিত পাবলিক পরীক্ষাগুলো, শিক্ষক ও স্কুল-কলেজের নিজস্ব মূল্যায়ন ইত্যাদির ওপর নির্ভরযোগ্যতা না থাকার কারণেই বারবার জাতীয়ভাবে পাবলিক ও ভর্তি পরীক্ষা নেয়া হয়ে থাকে।
একই শিক্ষার্থীদের বারবার পরীক্ষা নেয়ায় শিক্ষা ক্ষেত্রে সামগ্রিক কী লাভ হয় বা এর প্রয়োজনীয়তাই কী- তা ভেবে দেখা প্রয়োজন। মূল্যায়ন যদি প্রশ্নবিদ্ধ না হতো এবং সবার গ্রহণযোগ্যতা পেত তাহলে একের পর এক পরীক্ষা গ্রহণের ধকল থেকে শিক্ষার্থীদের কিছুটা মুক্তি মিলত।
প্রাথমিক শিক্ষাস্তর পেরিয়ে যেসব শিক্ষার্থী মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক স্তরে শিক্ষাগ্রহণ করে থাকে, তাদের উদ্দেশ্য ও পরিণতি কার না জানা। দেশের আর্থসামাজিক কারণে উচ্চমাধ্যমিকের ফলাফল উচ্চশিক্ষায় ভর্তির যোগ্যতা হিসেবেই বেশি গ্রহণযোগ্যতা পায়, জ্ঞানার্জনের উদ্দেশ্যে নয়।
উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান পূর্বফলাফলে পুরোপুরি ভরসা না পেয়েই হোক কিংবা অন্য কোনো সুবিধা লাভের জন্যই হোক একের পর এক ভর্তি পরীক্ষা নিয়ে থাকে। পরীক্ষা, পরীক্ষা আর পরীক্ষা! পরীক্ষা কি বিষয়বস্তু শেখায়?
নিশ্চয়ই না, পরীক্ষা কেবলই পরীক্ষা দেয়া শেখায়। বারবার পাবলিক পরীক্ষার এত প্রয়োজন আছে কি না, ভেবে দেখা দরকার। ইতোমধ্যে পরীক্ষার চাপে শিক্ষার্থী-অভিভাবক বিভিন্নভাবে বিপর্যস্ত।
আমাদের দেশে পাবলিক পরীক্ষাগুলো মেধা মূল্যায়নের চেয়ে পরবর্তী ধাপের শিক্ষা সুবিধা লাভের বাছাই প্রক্রিয়া হিসেবেই ব্যবহৃত হয়ে আসছে দীর্ঘকাল ধরে। চলমান ধারাটি নিয়মে পরিণত হয়েছে। কাজেই উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার মতো পাবলিক পরীক্ষার কোনো বিকল্প চিন্তা করতে কে না ইতস্তত বোধ করবে?
কিন্তু খুব সহজে বলা যায়, এ পরীক্ষায় শিক্ষার্থীদের জ্ঞান বাড়ার কোনো সম্ভাবনা নেই, জ্ঞান-দক্ষতা বাড়ে শিক্ষাকার্যক্রমে অংশগ্রহণের মাধ্যমে।
করোনা আসার আগেই উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষার্থীদের ক্লাস শেষ হয়েছে। এখন পরীক্ষার মাধ্যমে মূলত বাছাই প্রক্রিয়াটি বাকি। এটা পাবলিক পরীক্ষার মাধ্যমেই হতে হবে- এমনটি না ভাবা খুব দোষের কিছু নয়।
করোনাকালে শিক্ষাবিদরা নিশ্চয়ই একটি বিকল্প কিছু বের করতে পারেন। এ শিক্ষার্থীদের বিগত তিনটি পাবলিক পরীক্ষার রেকর্ড, ক্লাসটেস্ট, বার্ষিক, প্রাক-নির্বাচনী ও সর্বোপরি নির্বাচনী পরীক্ষার রেকর্ড তো রয়েছে। এগুলো হতে পারে উচ্চশিক্ষার জন্য বাছাই প্রক্রিয়ার চমৎকার মাপকাঠি।
মাধ্যমিক পরীক্ষায় যারা আশানুরূপ ফল লাভ করতে পারেনি, তাদের বিষয়টি বিবেচনায় রেখে দেশের শিক্ষাবিদরা সময়োপযোগী একটি বাছাই প্রক্রিয়া উদ্ভাবন করতে পারবেন না, এমনটি তো নয়। মুক্তিযুদ্ধের সময় প্রায় এক বছর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ছিল, তথ্যপ্রযুক্তি ছিল না বললেই চলে। তখনও কিন্তু সরকার বাস্তবসম্মত ব্যবস্থা গ্রহণ করে শিক্ষা কার্যক্রমের ধারাবাহিকতা বজায় রেখেছিল।
দেশে বিদগ্ধ শিক্ষাবিদ রয়েছেন। বৈশ্বিক এ আপদের সময় তারা চিরাচরিত নিয়মের একটা প্রয়োগযোগ্য বিকল্প বাছাই পদ্ধতি তৈরি করতে এখনই কাজ শুরু করতে পারেন। দেশের এ ক্রান্তিকালে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের প্রায় তেরো লাখ শিক্ষার্থীকে করোনা ঝুঁকি এড়াতে পাবলিক পরীক্ষায় না বসিয়ে উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি প্রক্রিয়া শুরু করা প্রয়োজন।
সরকারের একটি বিশ্বস্ত কমিটি সম্পূর্ণ প্রক্রিয়াটির একক নিয়ন্ত্রণ ও দায়িত্ব গ্রহণ করলে করোনাকালের একটি সংকটও কাটবে এবং অর্থনৈতিকভাবেও দেশ লাভবান হবে। এ কাজে উচ্চমানের প্রযুক্তির ব্যবহারের মাধ্যমে উচ্চশিক্ষার আসন বণ্টন ব্যবস্থা দেশের জন্য একটি দৃষ্টান্তমূলক ও গর্বের বিষয় হতে পারে।
অনলাইন শিক্ষাপদ্ধতি ইতোমধ্যে অনেক প্রতিষ্ঠানে চালু হয়েছে এবং তার সফলতা কতটুকু, তা-ও চিহ্নিত হচ্ছে। শিক্ষার্থীদের বসিয়ে না রেখে শিক্ষা কার্যক্রমে অনলাইন ব্যবস্থা জোরেসোরে শুরু করা প্রয়োজন। সফলতা শুরুর দিকে আশানুরূপ না হলেও ধীরে ধীরে ফলপ্রসূ হবে।
কাজেই বাস্তবতা হল- আমাদের অনলাইনভিত্তিক কার্যক্রমের দিকেই অগ্রসর হতে হবে। করোনাপূর্ব সময়েও অনলাইন কার্যক্রম যে চলেনি, তা কিন্তু নয়। এখন প্রয়োজনের তাগিদেই এটিকে ত্বরান্বিত করতে হবে। করোনা-যুদ্ধে জয়ী হতে হলে সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখেই আমাদের চলতে শিখতে হবে। এজন্য আন্তরিকতার সঙ্গে নতুন ও বিকল্প পদ্ধতিতে অভ্যস্ত হওয়ার গন্তব্য নেই।
অধ্যাপক এমএ জলিল আনসারী : বিভাগীয় প্রধান, মেডিসিন, এন্ডোক্রাইনোলজি, শাহাবুদ্দীন মেডিকেল কলেজ ও
মো. আলী হাসান : প্রভাষক, পদার্থবিজ্ঞান
