Logo
Logo
×

বাতায়ন

আমাদের চিকিৎসাব্যবস্থা ও ডাক্তারের দায়

Icon

মঈদুল ইসলাম

প্রকাশ: ১৯ জুলাই ২০২০, ০৬:০০ পিএম

প্রিন্ট সংস্করণ

আমাদের চিকিৎসাব্যবস্থা ও ডাক্তারের দায়

ডাক্তারদের নিয়ে নানা কথা আছে একালে, ছিল সেকালেও। খারাপ কিছু শুনলে খারাপ লাগে। বাবা (আমরা ডাকতাম ‘আব্বা’) ডাক্তার ছিলেন। ইংরেজিতে 'Doctor'। গবেষণা করে সন্দর্ভ রচনা করে বিদ্যার্জন-বিতরণের সর্বোচ্চ সনদ যারা পান তারাই আদি ‘Doctor’। গবেষণা না করে কপি-পেস্ট করা সন্দর্ভ দিয়েও ‘Doctor’ হওয়া যায় বলে আজকাল শোনা যায়। দু’চারজনকে জানি যাদের দেশি দু-একটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ‘Doctor’ হয়ে নাকি নামের আগে জোড়া ছাড়া আর কোনো কাজে লাগেনি। ‘Doctor’ শব্দটি এসেছে ল্যাটিন ক্রিয়াবাচক ‘Docere’ থেকে, অর্থ গুরুগিরি (অধ্যাপনা) করা। ‘ডকেরেকারদের’ বলা হতো ‘Doctor’। সেখান থেকে খ্রিস্টীয় ত্রয়োদশ শতাব্দে ইউরোপে বিদ্যায় সর্বোচ্চ পাণ্ডিত্য অর্জনের উপাধি হিসেবে এর ব্যবহার শুরু। ক্যাথলিক পাদরিরা তাদের ধর্মতত্ত্বের গুরুত্বপূর্ণ গবেষণার জন্য চার্চ থেকে ‘Doctor of the Church’ উপাধি পান। গবেষণা-সন্দর্ভ না থাকলেও গণ্যমান্য ব্যক্তিবিশেষরা মান হিসেবে ‘Doctor’ খেতাব পান। অপার্থিব মঙ্গল সাধকদের পরে এবার যারা পার্থিব জীবনের মঙ্গলেও কাজ করেন সেই চিকিৎসকদেরও ১৮শ’ (অষ্টাদশ) শতাব্দের মাঝামাঝি থেকে ইউরোপে ‘Doctor’ বলা শুরু। বাংলায় এখন ডাক্তারি আর ডাক্তারখানা নিয়ে আছেন কেবল চিকিৎসকরা। অন্য সবার বেলায় বাংলায় ‘ডক্টর’, সংক্ষেপে ‘ড.’ চলে, কেবল চিকিৎসকের বেলায় বাড়তি আকার!

ঝাড়ফুঁক দেয়া লোকজ চিকিৎসার ওঝারা আছে বরাবর। ভারতে প্রাচীন শাস্ত্রীয় চিকিৎসক ছিলেন আয়ুর্বেদ পদ্ধতির বৈদ্য বা কবিরাজ (সাপুড়ে বেদে বা স্বপ্নাদিষ্ট কবিরাজ নয়)। এর সঙ্গে মুসলিম আমলে যুক্ত হয় আরবীয় চিকিৎসা পদ্ধতি ইউনানির হেকিম। ব্রিটিশরা শুরুর দিকে কোম্পানির কর্মচারী ও সেনাদের চিকিৎসার জন্য পশ্চিমা অ্যালোপ্যাথ ইংরেজ ডাক্তারদের আনত। শাসন পরিধি সম্প্রসারণের সঙ্গে সঙ্গে ভারতের প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলোয় কোম্পানির কুঠি, কাচারিরও বিস্তৃতি ঘটে। বিশাল এলাকার জন্য বিপুলসংখ্যক বিলাতি ডাক্তার আনা ও রাখা ব্যয়সাপেক্ষ। কোম্পানির ভারতীয় কর্মচারী ও সেনারা আবার জাত-পাতের ভয়ে ফিরিঙ্গিদের হাতে চিকিৎসা নিতে বিমুখ। অভিজ্ঞ কর্মচারী ও সেনাদের মৃত্যুর হাতে ছেড়ে দিলে কোম্পানির লোকসান। নিজের লোকদের সুচিকিৎসার জন্যই পশ্চিমা অ্যালোপ্যাথ জানা ‘নেটিভ’ ডাক্তার প্রয়োজন হয়ে পড়ে কোম্পানির।

ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ১৮২২ সালে (খ্রিস্টীয়, পরবর্তী সালগুলোও) রাজধানী কলকাতায় ‘নেটিভ মেডিকেল ইন্সটিউট’ প্রতিষ্ঠা করে উর্দু, ফারসি ভারতীয় ভাষায় (ইংরেজি শিক্ষিত ও শিক্ষার্থীর অভাবে) ৪-৫ বছরের ভার্নাকুলার এলএমএফ কোর্স দিয়ে পশ্চিমা মেডিকেল শিক্ষা চালু করে। মান নিয়ে সমালোচনায় সেটা বন্ধ করে ইংরেজি মাধ্যমে মেডিকেল শিক্ষার জন্য ভারতে প্রথম ১৮৩৫ সালে রাজধানী কলকাতায় মেডিকেল কলেজ প্রতিষ্ঠা করে। এরপর ১৮৩৫ সালেই মাদ্রাজ ও ১৮৩৮ সালে বোম্বে (এখনকার মুম্বাই) প্রেসিডেন্সি শহরে মেডিকেল কলেজ করে। তিনটি কলেজই লন্ডনের ‘রয়্যাল কলেজ অব সার্জনস’ স্বীকৃত ছিল। পাশাপাশি কলকাতাসহ বিভিন্ন শহরে ইংরেজি মাধ্যমের এলএমএফ কোর্সের আলাদা মেডিকেল স্কুলও করেছিল ব্রিটিশরা।

পূর্ববঙ্গে আমাদের বাংলাদেশে প্রথম ১৮৭৫ সালে ঢাকায় প্রতিষ্ঠিত হয় মিটফোর্ড হাসপাতাল ও সঙ্গে ঢাকা মেডিকেল স্কুল, যেটা এখন স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ। ঢাকার এক সময়ের কালেক্টর ও পরে প্রাদেশিক আপিল আদালতের জজ রবার্ট মিটফোর্ডের উইল করে যাওয়া অর্থ (মারা যান ইউরোপে ১৮৩৬ সালে, তার ওয়ারিশদের করা মামলা মিটতে সময়ের সঙ্গে টাকার ভাগও কিছু কমে যায়) দিয়ে হয়েছিল এ স্কুল ও হাসপাতাল, যা ছিল সেকালের আসাম ও গোটা পূর্ববঙ্গে একমাত্র মেডিকেল প্রতিষ্ঠান। এ স্কুল ও হাসপাতাল উন্নয়নের কাজ হয়েছিল স্যার সলিমুল্লাহসহ ঢাকার ১৬ নবাবের দানের অর্থে। সেকালে ধনীরা (দেখছি ফিরিঙ্গি আমলাও) নিজের অর্থে পরার্থের কাজ করার মতো কিছুটা উদারও ছিলেন, প্রতিষ্ঠান খুলে আত্মস্বার্থে সরকারের কাছে প্রণোদনার প্রার্থনা না করার মতো আত্মসম্মানও রাখতেন।

মিটফোর্ডে ঢাকা মেডিকেল স্কুলে চালু হয় ৪ বছরের এলএমএফ কোর্স। ভর্তির যোগ্যতা ছিল ম্যাট্রিক পাস। ব্রিটিশ আমলেই ঢাকার বাইরে এরকম এলএমএফ কোর্সের মেডিকেল স্কুল হয়েছিল ১৯২৪ সালে ময়মনসিংহে (লিটন মেডিকেল স্কুল) ও ১৯২৭ সালে চট্টগ্রামে। ১৯৪৬ সালেই ভোরে (Sir Joseph William Bhore) কমিটি এলএমএফ কোর্স তুলে দেয়ার সুপারিশ করেছিল। ১৯৪৭-এর ভারত ভাগের পর তখনকার পূর্ববঙ্গে এমবিবিএস কোর্সের মেডিকেল কলেজ ছিল কেবল ঢাকা মেডিকেল কলেজ, মাত্র এক বছর আগে ১৯৪৬ সালে ১০ জুলাই যার প্রতিষ্ঠা। বোধহয় এমবিবিএস কোর্স চালানোর মতো যোগ্য ও যথেষ্ট শিক্ষক না থাকায় বন্ধ করার বদলে এলএমএফ কোর্সের আরও দুটি মেডিকেল স্কুল করা হয়। একটি সিলেটে ১৯৪৮ সালে, অপরটি রাজশাহীতে ১৯৪৯ সালে। রাজশাহী মেডিকেল স্কুলটি হয়েছিল সেখানকার সমাজসেবী গণ্যমান্য কিছু নাগরিকের উদ্যোগে সম্পূর্ণ বেসরকারি প্রতিষ্ঠান হিসেবে, ছিল স্টেট মেডিকেল ফ্যাকাল্টি ঢাকার অধীন। আব্বা এ স্কুল থেকে এলএমএফ কোর্স করেন।

১৯৫৪ সালে স্কুলটি কলেজে উন্নীত হয়, ১৯৫৮ সালে ১ জুলাই থেকে পুরোপুরিভাবে চালু হয় রাজশাহী মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল। ১৯৫৮ সালেই সারা দেশ থেকে এলএমএফ কোর্স একেবারেই তুলে দেয়া হয়। ঢাকা মেডিকেল স্কুল ১৯৬২ সালে ‘স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ’ হয়ে যায় (হাসপাতালটি এখনও মহামতি মিটফোর্ডের নামেই আছে)। ১৯৬৩ সালে কলেজের কার্যক্রম শুরু হয় এলএমএফ ডাক্তারদের ২ বছরের কনডেন্সড এমবিবিএস কোর্স দিয়ে। এখান থেকে ১৯৭৪-এর সর্বশেষ ব্যাচে আব্বা কনডেন্সড এমবিবিএস করেন।

টানা ৪ বছরে ইংরেজি মাধ্যমে চিকিৎসা শাস্ত্রের মোটামুটি সব বিদ্যাই পড়ানো হতো এলএমএফ ডাক্তারদের। ব্রিটিশ আমল থেকে এরাই ছিলেন বড় ধরনের অপারেশন ছাড়া প্রায় সব রোগের অ্যালোপ্যাথ চিকিৎসার জেনারেল প্র্যাকটিশনার বা জিপি ডাক্তার। তাদের দু-একজনের চাকরি হতো শহরে জেলখানার ডাক্তার হিসেবে, বাকিদের গ্রামাঞ্চলে ‘চ্যারিটেবল ডিসপেনসারিগুলোতে’ (১৯৭২ সালের পর ‘দাতব্য চিকিৎসালয়’ নামে কিছুদিন চলে সরকারি হয়)। পাকিস্তান আমলে প্রতি থানায় একটি, কদাচিৎ দুটি ‘চ্যারিটেবল ডিসপেনসারি’ ছিল। থাকত একজন এলএমএফ ডাক্তার, একজন কম্পাউন্ডার ও একজন পিয়ন। এগুলো জেলা বোর্ড পরিচালনা করত। বোর্ডই মাইনাপাতি, ওষুধপত্র জোগাত। পিয়ন সেই গ্রামেরই, বদলি নেই। কম্পাউন্ডারও সেখানকার বা পাশের গ্রামের, বদলি হতো কালেভদ্রে। এলএমএফ ডাক্তারদের বদলি ২-৩ বছর পরপর জেলার এক থানা থেকে আরেক থানার চ্যারিটেবল ডিসপেনসারিতে। ডাক্তাররা সপরিবারেই বাস করতেন যেখানে যখন বদলি হতেন। আমার ক্লাস নাইন পর্যন্ত গ্রামেই কেটেছে আব্বার সঙ্গে ডিসপেনসারির সঙ্গে একই কম্পাউন্ডে, কখনও বা বাইরে কয়েক বাড়ি পরে নির্ধারিত কোয়ার্টার থাকত তাদের। মাটির বাড়ি, তালপাখার বাতাস। মাটির রাস্তা, গরুগাড়ি, নৌকা আর দু-চারখানা বাইসাইকেল। এ ছিল গ্রামের রোগীর ও চাকুরে ডাক্তারের অবস্থা।

১৯৭১ সালে স্বাধীনতা পর্যন্ত বাংলাদেশে ৪ বিভাগে মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ছিল ঢাকা, স্যার সলিমুল্লাহ-মিটফোর্ড, ময়মনসিংহ, চট্টগ্রাম, সিলেট, রাজশাহী, বরিশাল ও রংপুর-এ মাত্র ৮টি। থানা পর্যায়ে সরকারি-বেসরকারি কোনো হাসপাতাল ছিল না, কুমুদিনী হাসপাতালের মতো বিরল দু-একটি দাতব্য প্রতিষ্ঠান ছাড়া। উন্নত ছিল না সেকাল কোনো দিকেই। গাঁ-গ্রামের রোগী, চাকুরে ডাক্তার থাকত গ্রামেই। ছুটত না তারা শহরে সব সময়। যাতায়াতে উভয়েরই ধুলোকাদার দুরতিক্রম্য বেকায়দা ছিল বটে। রোগীর আস্থা-ভরসাও কিছু ছিল গ্রামের চাকুরে ডাক্তারের চিকিৎসায়। ডাক্তারও নিজেকে, রোগীকে মানুষজ্ঞানে সত্যিকারের মানবিক চেষ্টাও করতেন সারিয়ে তোলার। ব্যতিক্রম যে ছিলই না তেমন বেহেশতখানা তো ছিল না। তবে, তা ব্যতিক্রমেই সীমাবদ্ধ। সে কুকীর্তি দ্রুত রাষ্ট্র (একালে ভাইরাল) হওয়ার আর তার বিশদ বিবরণ থেকে পাঠ নিয়ে আরও অভিনব টেকনিক বের করা দুষ্কৃতিতে সয়লাবের ব্যবস্থা ছিল না। কর্তব্যনিষ্ঠ সজ্জনরাই ছিলেন দৃশ্যমান, দুর্জনরা থাকত তলানিতে।

সাড়ে সাত কোটি বাঙালির সেই দেশ এখন ১৬ কোটির। ৪ বিভাগ এখন ৮টি, ১৯ জেলা এখন ৬৪। থানা এখন উপজেলা ৪৯২টি, উপজেলায় স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, ১৩১২টি ইউনিয়ন স্বাস্থ্য সাব-সেন্টার। সেখানে আর এলএমএফ নেই, চাকরি করেন এমবিবিএস ডাক্তার। পাকা দালান, পাকা কোয়ার্টার, পাকা রাস্তা, চলে মোটরযান। জেলা শহর, ঢাকা শহর, অনেকের কাছে সিঙ্গাপুর-ব্যাংককও সুগম্য। জেলা ও বিশেষায়িত হাসপাতাল ১২৫টি। হাজার তিনেকের মতো বেসরকারি হাসপাতাল। বেসরকারি ডায়াগনস্টিক সেন্টার সাড়ে পাঁচ হাজারের মতো। যেদিন থেকে বেসরকারিতে ক্লিনিক আর ডায়াগনস্টিক সেন্টারের শুরু, সেদিন থেকে সরকারি হাসপাতালে সাঁটানো হল ‘রোগী ধরা দালাল হতে সাবধান’ বিজ্ঞপ্তি। দালাল ধরা পড়ে না কখনও। স্বাস্থ্য মৌলিক অধিকার নয় এখানে। আছে সংবিধানের ১৮ অনুচ্ছেদে রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতির ভাগে, নিশ্চিত না হলে রাষ্ট্রের কোনো দায় নেই। এখনকার বুলি তাই ‘আপনার সুরক্ষা (স্বাস্থ্য) আপনার হাতে’।

জেলায় জেলায় সরকারি-বেসরকারি, সামরিক মেডিকেল কলেজ, মোট সংখ্যা শতাধিক। আছে মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ও, হতে যাচ্ছে আরও। বিশেষজ্ঞ ও সাধারণ মিলিয়ে বিএমডিসির রেজিস্টার্ড এমবিবিএস ডাক্তার প্রায় ৮০ হাজারের কাছাকাছি, লক্ষপূরণের আর দেরি নেই। বছরে হাজার পাঁচেক এমবিবিএস ডাক্তার তৈরি হয়। টেকনিশিয়ান, নার্স, প্যারামেডিক সবই বেড়েছে, বাড়ছে। জনসংখ্যার অনুপাতে বাড়া দরকার আরও বটে। সংখ্যায় যত বাড়ছে ততই বাড়ছে প্রশ্ন মান নিয়ে। মেডিকেল কলেজের মান, মেডিকেল শিক্ষার মান, শিক্ষকের মান, হাসপাতালের মান, যন্ত্রপাতি-সরঞ্জামের মান, বিল্ডিংয়ের মান (পিলার-ছাদের রড লোহার নাকি বাঁশের!), চিকিৎসার মান, চিকিৎসকের মান, প্রশ্ন সবটায়। দায়িত্ব যাদের তারা নিয়ন্ত্রণ নাকি নিমন্ত্রণ করেন সে প্রশ্নও ওঠে। এক স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে দুই বিভাগ, দুই সচিব। ১০-১২টি অধিদফতর। মহা, অতিরিক্ত, যুগ্ম, উপ, সহকারী কত পরিচালক। ফার্মাকোলজি, অ্যানাটমি ছাড়িয়ে পাবলিক হেলথের কারবারে এখন হেলথ ইকোনমিক্স, হেলথ কেয়ার ম্যানেজমেন্ট, হসপিটাল ম্যানেজমেন্ট আরও কত কেতাবি বিদ্যা! এসব ডিগ্রি নিয়ে নামেন হেলথ কেয়ার আর হাসপাতাল পরিচালনায়। প্রশ্ন সেই পরিচালনার মান নিয়ে। আজকাল আবার যার মান তার রাখার দায় নেই, সে দায় অন্যের। মানে একটুখানি টান পড়লে মানহানির মামলা। সেটাও করে অন্যে। মানহানি একজনের, মামলা করে জনে জনে যত থানা যত আদালত সবখানে। আসছে আবার ভার্চুয়াল, নিজ ঘরে বসে অন্য একজনে এক ছোঁয়াতেই ঠুকে দিতে পারে মামলা যত খুশি তত, আসল উকিলে ছোঁয়াছুঁয়ির ট্রেনিং পেতে পেতে।

সরকারি ডাক্তার, বিশেষত বিশেষজ্ঞ ডাক্তার (সাধারণ তেমন নেই-ই, প্রায় সবারই এখন বাড়তি দু-একটা ডিপ্লোমা থাকেই) মানেই ডাবল প্র্যাকটিশনার। টানটা স্বভাবত প্রাইভেটেই বেশি। মূলটা তো বিনিয়োগ, মুনাফাটাই লভ্য। সকাল থেকে গভীর রাত শরীর নিয়ে ছুটছেন হাসপাতালে, ক্লিনিকে। চাকুরে, হাতুড়ে, ভুয়া, সবারই টান প্রাইভেটে। প্রাইভেট যার জমেনি তারও মন থাকছে না সরকারি হাসপাতালে। ভোগবাদের একালে ভোগের সামগ্রীর সুড়সুড়ি কাটিয়ে নিরাসক্ত থাকাও তো শক্ত! স্বল্পমূল্যে সুচিকিৎসা সরকারি হাসপাতালেই জুটলে উচ্চমূল্যের বেসরকারি ব্যবসাদারিগুলো চলবে! হেলথ ইকোনমিক্স তো আছে! করোনা টেস্ট সরকারিতে দু’শ-পাঁচশ টাকা, বেসরকারিতে সরকারি রেট সাড়ে তিন-সাড়ে চার হাজার টাকা! রোগীর কেন, ডাক্তারেরও মাথা ঠিক রাখা দায়!

বছর কয়েক আগে ব্রিটিশ মেডিকেল জার্নাল এক সমীক্ষায় জানায়: আমাদের এখানে নাকি একজন রোগী একজন ডাক্তারের কাছে সময় পায় মাত্র ৪৮ সেকেন্ড। গেলাম শরীর খারাপ নিয়ে, ফিরলাম মন খারাপটাও সঙ্গে করে! রোগীর চাপ আছে সত্য, সেই হেলথ কেয়ার ম্যানেজমেন্ট, হসপিটাল ম্যানেজমেন্টের মাপ ঠিক আছে! চাপটা যায় ডাক্তারের ওপর দিয়েই। মারধরও শুরু হয়েছে। কর্তব্যনিষ্ঠ এক ডাক্তারকে তো মেরেই ফেলা হল কিছুদিন আগে। পাবলিকও সেয়ানা! ছেলেধরা সন্দেহে পিটিয়ে মারে নিরীহ আসল মাকে, আর প্রতিষ্ঠিত মানব পাচারীর কদমবুসি করতে হুটোপুটি খায়। স্বর্ণমূল্যে পর্দা কেনা, যন্ত্র ছেড়ে খালি বাক্স কেনা, নকল পিপিই, নকল মাস্কের ভুল ধরলে পাবলিক অথরিটি ছাড়ে না। ভুল খোঁজারু ডাক্তারকে বদলি করে দেয় আরেক জায়গায় ভুল খুঁজতে। পিপিই সংকটের অজুহাত তোলা ডাক্তারদের ঘাড়েই চাপছে নিজেদের মৃত্যুর দায় পিপিই পরতেই জানে না বলে।

পাবলিক হেলথের অন্ত্রে-তন্ত্রে এখন ব্যবসাদারি ভাইরাস ঢুকেছে। সংক্রমিত করছে ডাক্তারদেরও। ব্যবসায়ও তো পেশাদারিত্ব থাকে। ব্যবসার মধ্যে ব্যবসাদারি ঢুকে হচ্ছে মুশকিল। পেশাদারিত্বটা থাকলে নিজ নিজ ক্ষেত্রে সবারই উৎকর্ষ আসে, সৃষ্টি হয় মহান কীর্তি। দস্যুবৃত্তি, তস্করবৃত্তির মতো টাকা কামানোটাই লক্ষ্য হলে সব পেশাতেই ঘটবে যত সব নিকৃষ্ট কুকীর্তি। শতকরার ভাগে তিন চল্লিশ বা সাতান্ন যাই হোক, কর্তব্যনিষ্ঠ ভালো তো আছেনই কিছু সবখানে। তথ্য-প্রযুক্তির প্রচারে দুষ্কৃতদের কুকীর্তি এমন বাজার পায় আর তার থেকে পাঠ নেয়া অভিনব টেকনিকের নতুন নতুন দুষ্কৃতিতে এমন ছয়লাব হয় যে, কর্তব্যনিষ্ঠ সজ্জনরা বিরল ব্যতিক্রম হয়ে তলিয়ে পড়ে অদৃশ্যে। প্রতিবিধান নেই, শুধুই প্রচার, প্রযুক্তি আর কুযুক্তিতে হচ্ছে দুষ্কৃতদের প্রশিক্ষণ লাভ।

চিকিৎসা মানে জীবন-মরণ ব্যাপার। যার চূড়ান্ত নির্ধারক স্বয়ং বিধাতা বলে মনে করা হয় প্রাচীনকাল থেকে। বিধাতার সেই অনুগ্রহটুকু পেতে রোগগ্রস্তকে যন্ত্রণার যে যুদ্ধটা করতে হয়, তাতে তার জয়ের শক্তি জোগানটা চিকিৎসকের কাজ। যেমনি মহৎ তেমনি বিপজ্জনক। যার তার হাতে পড়ে যেন বিপজ্জনক না হয়, সে চিন্তা করেছিল গ্রিকরা প্রায় আড়াই হাজার বছর আগে। রোগ ও আরোগ্যের দেবতা অ্যাপোলোকে সাক্ষী রেখে হিপোক্রেটিক ওথ (Hippocratic Oath) নিয়ে ডাক্তারিতে নামার নিয়ম করেছিল। সেই থেকে এ ডাক্তারি বিদ্যা যেখানে যেখানে গেছে সেখানে সেখানে এ শপথও গেছে। ওয়ার্ল্ড মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের ১৯৪৮ সালের সম্মেলন থেকে এখন তা চলছে জেনেভা ডিক্লারেশন নামে। ডাক্তারকে যে প্রতিজ্ঞায় আবদ্ধ হতে হয় তার প্রথম দফাটিই হল: ‘I solemnlypledge to dedicate my life to the service of humanity.’ (মানবতার উপকারে আমার জীবন সমর্পণের দৃঢ় অঙ্গীকার করলাম) ‘মানুষ’ নয়, ‘মানবতা’-মানবতা শব্দে যত ব্যাপক অর্থ ধারণ করে ততদূরব্যাপী উপকারে জীবন সমর্পণ। এ ব্যাপকতা মর্মে ধারণ করতে না পারলে ডাক্তারিতে ঘটবে অনর্থ। ধারণপাত্র উপযুক্ত না হলে উপচে পড়ে হবে ব্যবসাদারি।

জীবনটা সঁপে দিলেও ডাক্তারের জীবনের দায় তো তার নিজেরই, তারও তো কিছু চাওয়া-পাওয়া আছে। সেটা যেন তার অঙ্গীকারের মূল ছাড়িয়ে প্রধান হয়ে না দাঁড়ায়, সে জন্য ২০১৭ সালের অক্টোবরে ওই জেনেভা ডিক্লারেশনে যুক্ত হয়েছে আরেকটি দফা: ‘I will attend to my own health, well-being, and abilities in order to provide care of the highest standard.’ (নিজের স্বাস্থ্য, সুখ ও সামর্থ্যরে দিকে খেয়াল রাখব সর্বোচ্চ মানের সেবা দিতে পারার উদ্দেশ্যে) এ মূলমন্ত্রটা মর্মে ধারণ করে পেশাদারিত্বটুকু ধরে রাখুন। নিজেকে ও রোগীকে মানুষজ্ঞানে একটু সময় ধরে একটু মমতায় সঠিক শুশ্রূষা দিয়ে তার সেরে ওঠার শক্তিটা জোগান। বিধাতার অনুগ্রহ আসবে তবে দু’জনেরই।

মঈদুল ইসলাম : প্রবন্ধকার ও আইনগ্রন্থকার, সাবেক সিনিয়র জেলা জজ ও দুদকের সাবেক মহাপরিচালক

moyeedislam@yahoo.com

চিকিৎসা ডাক্তার

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম