Logo
Logo
×

বাতায়ন

শুদ্ধি অভিযান চালানোর আগে নিজেদের শুদ্ধ হতে হবে

Icon

এ কে এম শাহনাওয়াজ

প্রকাশ: ২০ জুলাই ২০২০, ০৬:০০ পিএম

প্রিন্ট সংস্করণ

শুদ্ধি অভিযান চালানোর আগে নিজেদের শুদ্ধ হতে হবে

অনেকটা এরকমই দুঃসময় দেখতে হয়েছিল এক-এগারোর কালে। তখন বিশেষ করে বিএনপির মন্ত্রী-এমপিদের দুর্নীতির সাতকাহন প্রকাশ্যে এসেছিল। আর এখন ক্ষমতাসীনদের আশ্রয়-প্রশ্রয়ে স্বাস্থ্য প্রশাসন থেকে শুরু করে আমলাতন্ত্রের নানা ক্ষেত্রে দুর্নীতিবাজদের অভয়ারণ্য বিস্তার লাভ করছে। শুধু তা-ই নয়, এখন অবলীলায় ক্যাসিনোকাণ্ড ঘটছে, উত্থান ঘটছে পাপুল ও পাপিয়াদের।

মহাপ্রতারক সাহেদ ১৩ বছর ধরে প্রভাবশালী রাজনীতিকদের আশ্রয়ে প্রকাণ্ড হয়েছে। সরকার ও এর প্রশাসনের আনুকূল্যে যতক্ষণ সম্ভব এরা নিজেদের অপতৎপরতা চালিয়েছে। সাধারণের সামনে যখন এদের মুখোশ উন্মোচিত হয়ে মিডিয়ার মাধ্যমে তোলপাড় সৃষ্টি করেছে; বরাবরের মতো তখন নড়েচড়ে বসেছে প্রশাসন।

আইনের আওতায় আনার চেষ্টা করেছে। তখনই আশ্রয়দাতা রাজনৈতিক দল বরাবরের মতো আর এদের চিনতে পারছে না। এসব তৎপরতাকে মানুষ গা বাঁচানোর অপতৎপরতা বলেই মনে করে।

পত্রিকার মাধ্যমে জানলাম, সরকার ও দল এমন অনুপ্রবেশকারী ও তাদের আশ্রয়দাতাদের বিরুদ্ধে শুদ্ধি অভিযান করবে। এটি চমকে যাওয়ার মতো কোনো কথা নয়। কারণ ছাত্রলীগের সন্ত্রাস আর টেন্ডারবাজি নিয়ে ব্যাপক ক্ষোভ তৈরি হলে শুদ্ধি অভিযানের কথা শুনতে হয়েছে অতীতে। ক্ষুব্ধ হয়ে আওয়ামী লীগ প্রধান ছাত্রলীগের সংশ্রব ত্যাগ করার ঘোষণাও দিয়েছিলেন।

ক্যাসিনোকাণ্ডের মতো দলীয় লোকজনের অন্যায় সামনে চলে এলেও দলকে শুদ্ধ করার কথা ওঠে। এসব অন্যায়কারীকে ‘অনুপ্রবেশকারী’ বলে চিহ্নিত করে আপাতত মুখ ঢাকতে চান নেতারা; কিন্তু মানুষ এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পায় না যে, এমন একটি ঐতিহ্যবাহী দলের নেতারা এমন অথর্ব হয়ে গেলেন কীভাবে যে, ভিন্ন পক্ষের সন্ত্রাসী প্রতারক দলে ঢুকে ধীরে ধীরে মগডালে উঠে পড়ল অথচ কেউ টের পেলেন না!

বরং দুধ-কলা দিয়ে ও নিয়ে পরিপুষ্ট করেছেন; সেই সঙ্গে নিজেরাও পরিপুষ্ট হয়েছেন। এসব বাস্তবতা যখন আর ঢাকা যায় না, তখন সরকার ও দলীয় নীতিনির্ধারণী ফোরাম শুদ্ধি অভিযান চালানোর কথা বলে। সাধারণ মানুষ অত বোকা নয় বলে এসবে আস্থা রাখা কঠিন হয়ে পড়ে। এটি খুব নিুমানের আইওয়াশ বলেই মনে হয়। আর এ সত্য জানা আছে বলেই ৬০-এর ওপর মামলার আসামি প্রতারক সাহেদ র‌্যাবের সামনে দম্ভ করে বলতে পারে, ছয় মাসের বেশি তাকে আটকে রাখা যাবে না।

দলের ভেতর থেকে এরা প্রশ্রয় পেয়েছে কোনো না কোনো সুবিধা দিয়েই; কিন্তু দলীয় নেতৃত্ব বরাবর উটপাখির মতো বালুতে মুখ গুঁজে সব চোখের আড়াল করতে চাইলেও সাধারণ মানুষের দৃষ্টি ও মূল্যায়ন থেকে তা মুছে ফেলা সহজ নয়। এভাবে আওয়ামী লীগের মতো ঐতিহ্যবাহী দলও যে ক্যান্সারে আক্রান্ত হতে পারে, সে দৃশ্য ব্যথিত করে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাস্নাত মানুষকে।

সাহেদের মতো প্রতারকদের রাজনৈতিক আশ্রয় আমাদের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অনেক ক্ষতি করে দিচ্ছে। এটি অবশ্যই জাতীয় ক্ষতি। এদেশের মানুষ দীর্ঘ অভিজ্ঞতায় দেখেছে, কীভাবে আমাদের ক্ষমতাসীন দলগুলো আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ওপর প্রভাববিস্তার করে। অনেক ক্ষেত্রে এসব গুরুত্বপূর্ণ বাহিনীকে সাজিয়েও দেয় নিজের মতো করে। ফলে এসব বাহিনীর স্বাধীনভাবে দক্ষতা প্রমাণের সুযোগ কমে যাচ্ছে। যদি ধরে নিই, রাজনৈতিক ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ সত্য নয়, তাহলে নানা ব্যর্থতার দায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও গোয়েন্দাদের ওপর বর্তায়।

পাপুলের কথাই ধরি। পাপুল আওয়ামী লীগের কেউ নয়; বরং তার পরিবার বিএনপি-জামায়াত সংশ্লিষ্ট। দীর্ঘদিন ধরে মানব পাচার ও অর্থ পাচার করে বিপুল অর্থশালী হয়েছে। স্থানীয় মানুষ তেমনটিই জেনে আসছে। আর কুয়েতে ধরা পড়ার পর স্থানীয় মানুষের জানা তো সত্যে পরিণত হয়েছে। এখন মানুষ বলবে, আমাদের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী অকর্মণ্য। এ লোকটিকে দীর্ঘদিনেও আইনের আওতায় আনতে পারেনি। এই যে জাতীয় পার্টিকে দেয়া আসন এমন একজন দুর্নীতিবাজকে ছেড়ে দেয়া হল, গোয়েন্দারা কি সে রিপোর্ট সরকারি উচ্চপর্যায়ে করতে পারেনি?

এখন তো সাধারণ হিসেবে মনে হয়, সঠিক রিপোর্ট নির্বাচন কমিশনকে দিলে এর মনোনয়নপত্র বাতিল হয়ে যেত। অথচ তিনি শুধু স্বতন্ত্র প্রার্থীই ছিলেন না, আওয়ামী লীগের সমর্থনও পেয়ে গেলেন। জাতীয় পার্টি আসনটি ছেড়ে দিলে সেখানে আওয়ামী লীগ নিজেদের প্রার্থী দিল না কেন- এ প্রশ্ন তো সামনে আসবেই। আমি এ কথাটি লক্ষ্মীপুরের একজন আওয়ামী লীগ-অন্তঃপ্রাণ সমর্থকের জবানি থেকেই বললাম।

সাধারণ মানুষ জানে, সংরক্ষিত মহিলা আসনে মনোনয়ন দেয়ার দায়িত্ব আওয়ামী লীগের উচ্চতম ফোরামের। মনোনয়ন পাওয়ার জন্য অনেক দলীয় নেতাকর্মীর চাপ থাকে। অথচ কী এমন অবদান ছিল যে, এ পাপুলের স্ত্রীকেই মনোনয়ন দিয়ে সংসদ সদস্য বানাতে হল! গোয়েন্দারা কি কোনো তথ্যই দিতে পারেনি? সাধারণ মানুষ কিন্তু সঠিক অঙ্কটি কষতে জানে।

‘ভিআইপি’ প্রতারক সাহেদ ১৩ বছর ধরে প্রায় প্রকাশ্যেই নানা ধরনের প্রতারণা ও দুর্নীতি করে যাচ্ছিল। মাঝে মাঝে তার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানাও জারি হয়েছে। অল্পদিনের জন্য আটকও হয়েছে; কিন্তু তার প্রতারণা থামেনি। অসংখ্য মানুষকে নিঃস্ব করেছে। নির্যাতনের শিকার হয়েছে অনেকে। তারপরও এ চিহ্নিত প্রতারক, সন্ত্রাসী ও দুর্নীতিবাজ সমাজে আরও বড় ভিআইপি হয়েছে। অথচ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী নিশ্চুপ থেকেছে। এতে এ বাহিনীর দক্ষতার প্রতি মানুষের কি সন্দেহ বাড়বে না? কেন তাদের নীরব থাকতে হয়েছে, তা হয়তো কেউ খুঁজে দেখবে না। এটিই স্বাভাবিক।

সংবাদমাধ্যম জানাল, ভুয়া কাগজপত্র ও কারণ দেখিয়ে সাহেদ বিভিন্ন ব্যাংক থেকে কোটি কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে। সে টাকা ফেরত দেয়নি। ব্যাংককে দিয়েছে ভুয়া চেক। মামলা হয়েছে; কিন্তু সাহেদের কিছু হয়নি। এমনই খুঁটির জোর তার। আবার যাচাই-বাছাই ছাড়া ব্যাংক যে যাকে খুশি তাকে ঋণ দিতে পারে, তা দেখেও অবাক হতে হয়। এখন তো টিভি চ্যানেলওয়ালাদের ব্যাপারে প্রশ্ন করবে মানুষ।

সাহেদের মতো এমন নামগোত্রহীন, একাডেমিক শিক্ষাবিহীন মানুষকে কীসের মোহে বারবার টকশোতে গেস্ট করা হতো? আবারও প্রশ্ন দাঁড়াতে পারে, অপরাধের দীর্ঘ রেকর্ডধারী ব্যক্তিটিকে যখন দেশ-বিদেশে সম্মানিত করছে টিভি চ্যানেল; তখনও কেন নিশ্চুপ ছিল আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী? শুনলাম, টকশোর সময় নামের শেষে নাকি আওয়ামী লীগের আন্তর্জাতিকবিষয়ক উপকমিটির সদস্য বলে তার পরিচয় দেয়া হতো।

আজ এ ভিআইপি আটক হওয়ার পর আওয়ামী লীগ নেতারা যখন প্রচার মাধ্যমে বলে বেড়াচ্ছেন, সাহেদ তাদের কেউ নন; তখন তো প্রশ্ন আসবেই- ‘তবে এতদিন কোথায় ছিলেন?’ দুদিন আগে এক টকশোতে আওয়ামী লীগের আন্তর্জাতিক সম্পর্কবিষয়ক কমিটির এক নেত্রী জাতির সামনে বলছিলেন- প্রতারক সাহেদ কখনও আওয়ামী লীগের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না। তখন চমকে উঠলাম। কিছুদিন আগে সাহেদ যখন পালিয়ে বেড়াচ্ছিল, তখন পত্রিকায় প্রকাশিত রিপোর্টে দেখলাম- উপকমিটির এ নেত্রী বলছেন, ‘সাহেদ তাদের সদস্য নন। মাঝে মাঝে এসে বসতেন। আগে সদস্য ছিলেন।’ এখন এসব সাধারণ মানুষ কেমন করে মেলাবে!

এ প্রতারক আওয়ামী লীগ নেতানেত্রী, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্তাব্যক্তি ও আমলাদের কাছে যদি গুরুত্বপূর্ণ না-ই হন, তবে অসংখ্য মামলার আসামি হয়েও তাদের সকাশে যেতে পারেন কীভাবে? এ সুযোগ কে করে দিল? ছবি দেখে মনে হবে, সাহেদকে পেয়ে সবাই আহ্লাদিত। এতকিছুর পরও এ প্রতারকের সনদ তামাদি হওয়া হাসপাতালের সঙ্গে কোটি টাকার চুক্তি করলে সাধারণ মানুষ সরকারি ইচ্ছে নিয়ে নানাভাবে ভাবতেই পারে।

দেশে উন্নয়নের গতিধারা সৃষ্টি করে দেশ-বিদেশে যখন নিজের সম্মানজনক অবস্থান তৈরি করেছেন, সম্মানিত হচ্ছেন বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা ও তার দল আওয়ামী লীগ; তখনই দলের কিছুসংখ্যক নেতানেত্রীর অশুদ্ধ চরিত্র ও ব্যক্তিগত লাভালাভের লালসা কালিমালেপন করে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর বিশ্ব ইতিহাসে উজ্জ্বল নেত্রী হওয়ার পথে বিছিয়ে দিচ্ছে কাঁটা; পিছিয়ে দিচ্ছে দেশের উন্নয়ন ও অগ্রগতির ধারা।

এ অবস্থা থেকে অবশ্যই আমরা বের হতে চাই। তাই শুদ্ধি অভিযানের এ পানসে খেলার চেয়ে এখন প্রয়োজন- যারা শুদ্ধ করার দায়িত্ব নেবেন, তারা শুদ্ধ কিনা, তা যাচাই করা। শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী লীগের ভেতর যে ক’জন শুদ্ধ নেতানেত্রী আছেন; দল, জনগণ ও দেশের কল্যাণে তাদের আরও দৃঢ় হতে হবে। এ সত্যটি মানতেই হবে- বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের জন্য ইতোমধ্যে দলটি জনগণের কাছ থেকে অনেকটাই দূরে সরে গেছে। বর্তমান বাস্তবতায় এটি বড় বিপর্যয়। গণতন্ত্রের প্রতি আস্থা রেখেই বলব- মুক্তিযুদ্ধস্নাত মানুষ কখনও চাইবে না, রাষ্ট্রক্ষমতায় পাকিস্তানপন্থী মুক্তিযুদ্ধবিরোধী দল ফিরে আসুক।

এ কারণে আমরা মনে করি, অন্যায় আর দুর্নীতিবাজদের ছেঁটে ফেলতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ওপর দলীয় তাপচাপের সংস্কৃতি যদি থেকেও থাকে, তবে তা উঠিয়ে এ বাহিনীকে স্বাধীন করে দিতে হবে। মানুষ বিশ্বাস করে, আমাদের এসব বাহিনী যথেষ্ট চৌকস। মুক্তভাবে তারা কর্তব্য পালন করতে পারলে দুর্নীতিবাজরা অবশ্যই আতঙ্কে থাকবে।

জনগণের চোখে আওয়ামী লীগ ও লীগ সরকার নেতিবাচকভাবে সমালোচিত হওয়া কাম্য নয়। বিশ্বাস করতে হবে, উন্নয়ন ও দুর্নীতি পাশাপাশি চলতে পারে না। এ সত্যও বিশ্বাস করতে হবে, সাহেদ-পাপুল, সাবরিনা-পাপিয়া কাণ্ড যেভাবে দুর্গন্ধ ছড়িয়েছে, কোনো আটপৌরে অভিযানের কথা শুনিয়ে জনগণকে প্রবোধ দেয়া যাবে না। অবশ্য গণশক্তিকে অস্বীকার করলে অন্য কথা। আসলে ক্ষমতাবানরা শুদ্ধ হলেই যে কোনো শুদ্ধি অভিযান এর লক্ষ্য অর্জন করতে পারবে।

ড. এ কে এম শাহনাওয়াজ : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

shahnawaz7b@gmail.com

ড. এ কে এম শাহনাওয়াজ শুদ্ধি অভিযান

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম