পুঁজিবাজার
স্বল্পতম সময়ে অর্থনীতির চাকা ঘুরতে পারে
ফজলুল বারী
প্রকাশ: ০৯ সেপ্টেম্বর ২০২০, ০৬:০০ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
স্বল্পতম সময়ে অর্থনীতির চাকা ঘোরানোর সহজতম সড়কের নাম পুঁজিবাজার। এ বাজার দিয়ে অগ্রসর হলে সারা দেশের অর্থনীতির মন্দাবস্থা খুব দ্রুতই কেটে যাওয়ার সম্ভাবনা বেশি। একইসঙ্গে শুরু হবে ব্যাপক কর্মযজ্ঞও। এটি কোনো দিবাস্বপ্ন নয়। ভার্চুয়ালও নয়। একেবারেই শারীরিক বাস্তবতা।
উল্লিখিত বাস্তবতা, বাস্তবায়ন বা দৃশ্যমান করার জন্য সরকারের কোনো আর্থিক প্রণোদনা বা সহায়তার প্রয়োজন নেই। অব্যাহত নীতিগত সহায়তাই যথেষ্ট। সরকারের বর্তমান নীতিগত সহায়তার সঙ্গে আরও কয়েকটি বিষয় যোগ করা জরুরি। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি জরুরি বাজার ব্যবস্থাপনার আরও উন্নয়ন ও দর্শনগত পরিবর্তন। বর্তমানে বাজার পরিচালনার দর্শন হচ্ছে নিয়ন্ত্রণ ও হস্তক্ষেপমূলক। এটি পরিবর্তন করে পুঁজিবাজারের সার্বভৌমত্বকেই প্রতিষ্ঠা করার ওপর জোর দিতে হবে। এজন্য সূচক নিয়ন্ত্রণ ও লেনদেন কর্মকাণ্ডে বাজার-ব্যবস্থাপকদের হস্তক্ষেপ ও নির্দেশনা পুরোপুরি বন্ধ করা জরুরি।
পুঁজিবাজারে সূচক বৃদ্ধি বাজার নিয়ন্ত্রণের একক নির্দেশক নয়। এটি অনেকটাই মানুষের রক্তের ইএসআর রিপোর্টের মতোই। সূচকের চেয়ে পৃথক পৃথক শেয়ারের দিকেই বেশি নজর দিতে হবে। সূচক ও লেনদেন বৃদ্ধি শেয়ারের চাহিদা নির্দেশ করে। চাহিদা অনুযায়ী সরবরাহ বাড়ালেই বাজারমূল্য স্থিতিশীল পর্যায়ে নেমে আসবে। এতে করে বাজারের গভীরতা বাড়বে এবং বাজার-ব্যবস্থাপনা কিছুটা হলেও সহজ হয়ে আসবে। ভালো শেয়ারের মাধ্যমে পুঁজিবাজারের গভীরতা বাড়ানো হলে কারসাজির লেনদেন কঠিন হয়ে যাবে।
বাজারে টেকনিক্যাল প্রোডাক্ট অর্থাৎ ডেরিভেটিভস, হেজিং, ইনডেক্স ট্রেডিং ইত্যাদি চালু করা সম্ভব হবে। এভাবে বাজার নিয়ন্ত্রণ করার জন্য বাজারের ভেতরের-বাইরের প্রভাবশালীদের ধৈর্য ও পেশাদারিত্বের সঙ্গে বাজার পরিচালনায় মনোযোগী হতে হবে।
এবার আসি মূল প্রসঙ্গে। পুঁজিবাজারের সঙ্গে এখনও সারা দেশের কম-বেশি ৩০ লাখ লোক জড়িত রয়েছে। সাম্প্রতিক বাজারের স্থিতাবস্থা ধরে রেখে অগ্রসর হতে থাকলে দ্রুততম সময়ের মধ্যেই ৩০ লাখ বিনিয়োগ অ্যাকাউন্ট সচল হয়ে যাবে। উপরন্তু, মন্দা বাজারজনিত কারণে বন্ধ হয়ে যাওয়া আরও কয়েক লাখ বিনিয়োগ অ্যাকাউন্ট আবারও সচল হওয়ার পরিপ্রেক্ষিত তৈরি হয়ে যাবে। এ প্রক্রিয়ায় কম-বেশি অর্ধকোটি মানুষের কর্মযজ্ঞ শুরু হয়ে যাবে সারা দেশে।
এর মাধ্যমে অর্থ ও পুঁজির পুনঃবিনিয়োগ চক্র ঘুরতে শুরু করবে। স্বল্পতম সময়ের মধ্যেই অর্থপ্রবাহও বেড়ে যাবে সারা দেশে। এতে করে স্বাভাবিকভাবেই মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বাড়বে; বাড়বে চাহিদা। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যসামগ্রী ছাড়াও পরিবহন, সেবা, স্বাস্থ্য, আবাসন খাতের উৎপাদন ও বিনিয়োগ বাড়বে। এতে করে এসব খাতের সঙ্গে জড়িত ছোট, মাঝারি ও বড় শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোর উৎপাদন ও বিনিয়োগ বন্ধ্যত্ব দূর হয়ে যাবে। যোগ হবে নতুন গতিবেগ। সবকিছু ঠিকমতো এগোলে এসব বিষয় দৃশ্যমান হতে সর্বোচ্চ দুই থেকে তিন মাস সময় লাগবে। এর বেশি নয়।
মাত্র দুই থেকে তিন মাসের মধ্যে অন্য কোনো খাতে আর্থিক প্রণোদনা যুক্ত করেও এ সুফল পাওয়া খুবই দুরূহ ব্যাপার। বরং আর্থিক প্রণোদনার বিষয়টি নানা ধরনের জটিলতা আহ্বান করতে পারে। দৃশ্যমান অভিজ্ঞতা এ সাক্ষ্যই দেয়। বরং পুঁজিবাজারের মাধ্যমে সারা দেশে পণ্য চাহিদা বৃদ্ধিসহ অর্থপ্রবাহ বেড়ে গেলে বাণিজ্য ও শিল্প খাতে এর দ্রুত ইতিবাচক প্রভাব পড়ার সম্ভাবনাই বেশি। কৃষি ও শিল্প উৎপাদন বৃদ্ধিতে এ উদ্যোগ সরাসরি ভূমিকা রাখবে।
১৯৩০-এর দশকের শুরুতে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রসহ গোটা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়া মন্দা অর্থনীতি কাটাতে ব্রিটিশ অর্থনীতিবিদ জন মেনার্ড কেনজ অভিমত দিয়েছিলেন, ‘সরকারকেই মাঠে নামতে হবে বিরাট অর্থ ভাণ্ডার নিয়ে- কিছু না হোক পিরামিড বানাও।’ অতঃপর পিরামিডের ঠিকাদার সংস্থা সেই টাকার এক অংশ নিয়ে মালামাল কিনবে বা ক্রেন ভাড়া করবে। আর এক অংশ হয়তো ব্যয় করবে স্ত্রীর গয়না কিনতে। যে সংস্থা ক্রেন ভাড়া দেয় তার মালিকও রোজগারের কিছুটা অংশ নিয়োজিত করবে সামগ্রী সংগ্রহে এবং বাকিটা হবে তার সঞ্চয়। এর থেকেই কেনজ-এর ‘মাল্টিপ্লায়ার’ তত্ত্বের উদ্ভব ঘটে। এ তত্ত্বের মূল কথা হল, অর্থনীতিতে এক টাকা প্রবিষ্ট করলে তা সেখানে থেমে থাকে না, বাড়তে থাকে মাল্টিপ্লায়ারের গুণিতক হিসাবে। ফল দেয় চার বা পাঁচ টাকার।
এ লেখায় কেনজের মাল্টিপ্লায়ার তত্ত্বটাকেই বেশি গুরুত্ব দেব। পিরামিড তৈরিকে নয়। এক টাকা বিনিয়োগে চার বা পাঁচ টাকার ফল। শেয়ারবাজারে এক টাকা বিনিয়োগ মানে মাল্টিপ্লায়ার এফেক্ট+একইসঙ্গে সারা দেশে অর্থপ্রবাহ ধরা দেয়া+বিনিয়োগ পুঁজি বৃদ্ধি+কর্মসংস্থান বৃদ্ধি+কৃষি, শিল্প উৎপাদন বৃদ্ধি। পুঁজিবাজার স্থিতিশীলতার ধাপ অতিক্রম করে আরও সামনের দিকে অগ্রসর হলে পুঁজিবাজারের সঙ্গে বিনিয়োগকারীদের সংশ্লিষ্টতা আরও বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। পুঁজিবাজারের স্থিতিশীলতা, শক্তিমত্তা বৃদ্ধি এবং একে আরও অগ্রসর করার জন্য প্রয়োজন পুঁজিবাজার-ব্যবস্থাপনার আরও উন্নয়ন, সুশাসন প্রতিষ্ঠা ও বিনিয়োগকারীসহ সংশ্লিষ্ট সব সুবিধাভোগীর প্রগাঢ় আস্থা অর্জন।
বাজার-ব্যবস্থাপকদের মধ্যে পুঁজিবাজারের শীর্ষ সংস্থা বিএসইসির নতুন কমিশন এরই মধ্যে বাজারে কিছু ইতিবাচক বার্তা প্রদানসহ দৃশ্যমান কয়েকটি পদক্ষেপ নিয়েছে। এতে করে এ বাজারে আস্থার ঘাটতি কিছুটা কমেছে। এর ইতিবাচক প্রভাবে সক্রিয় ও নিষ্ক্রিয় বিনিয়োগকারীসহ প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োকারীদের মধ্যেও বিনিয়োগ স্পৃহা জেগেছে। প্রমাণ, ফ্লোর প্রাইসের দেয়াল ধসিয়ে দিয়ে পুঁজিবাজারের মূল্যসূচক ও লেনদেন কর্মকাণ্ড সামনের দিকে ধাবমান হওয়া।
এরই মধ্যে পুঁজিবাজার এক দশকের ধস পরিস্থিতি কাটিয়ে ঘুরে দাঁড়ানোর সংকেত প্রদান করেছে। প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, গত ২১ জুন ডিএসই’র লেনদেন মাত্র ২৮ কোটি ৬২ লাখ টাকায় নেমে এসেছিল। সেখান থেকে গত ১০ আগস্ট ডিএসই’র লেনদেনের অঙ্ক ১ হাজার কোটি টাকার নিকটতম মাইলফলকটি অতিক্রম করে আরও সামনে এগিয়ে যায়। একইসঙ্গে শেয়ারের হারানো মূল্য ফিরে পাওয়াও শুরু হয়। হারানো মূল্য ফেরত আসার সময়টুকুকে মূল্যবৃদ্ধি বা মূল্য উল্লম্ফন বলা হলে তা হবে খুবই নির্দয় উচ্চারণ। অশুদ্ধ অথবা তথ্য বিকৃতি। আমার মতে, ২০১০ সালের সূচক, শেয়ারমূল্য ও লেনদেন অতিক্রম করলেই বৃদ্ধি শব্দটি যোগ করা যুক্তিযুক্ত হবে। তবে এক্ষেত্রে ভিন্নমত থাকতেই পারে।
বিরাজমান সার্বিক পরিপ্রেক্ষিত বিবেচনায় ভিন্নমতগুলোকে একপাশে রেখে ঐকমত্যের জায়গাগুলোতেই সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে দেখা উচিত বলে আমি মনে করি। এটিও একটি আপেক্ষিক বিষয়; তারপরও ঐকমত্যের জায়গাগুলোই আগে মেরামত করা জরুরি। আরও জরুরি হল, দেশের প্রাচীন ও বৃহত্তম পুঁজিবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) ব্যবস্থাপনার ব্যাপক উন্নয়নের মাধ্যমে এ প্রতিষ্ঠানের সুবিধাভোগী সব প্রতিষ্ঠানসহ বিনিয়োগকারীদের কাছে আস্থাশীল প্রতিষ্ঠানে পরিণত করা। এ প্রতিষ্ঠানের প্রশাসন মাথাভারি। গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানগুলোতে গুরুত্বহীন জনবল নিয়োগ দেয়া হয়েছে। অতি প্রয়োজনীয় বিভাগগুলোতে প্রয়োজনীয় ও দক্ষ জনবল নেই। অতি দ্রুত ডিএসই’র ব্যবস্থাপনার দুর্বলতা দূর করা প্রয়োজন। প্রাথমিক পদক্ষেপ হিসেবে ডিএসই’র ম্যানেজমেন্ট ও কস্ট অডিট সম্পন্ন করাও জরুরি।
বাজার-ব্যবস্থাপনার উন্নয়ন ছাড়া বাজার শৃঙ্খলা রক্ষা করা অসম্ভব। বাজার শৃঙ্খলা রক্ষাসহ শক্তিশালী ও স্থিতিশীল পুঁজিবাজার নির্মাণের জন্য এ বাজারের লেনদেন কর্মকাণ্ডে সার্বভৌম সত্তা প্রতিষ্ঠিত করার বিষয়টিও খুবই জরুরি। এর আগে নির্মূল করা জরুরি সিন্ডিকেট ও সার্কুলার ট্রেডিংসহ কারসাজি সহায়ক সব ধরনের ‘টুলস’।
বাজার-ব্যবস্থাপকসহ সংশ্লিষ্ট সবাইকে উপলব্ধি করতে হবে- পুঁজিবাজার হল টেক ও লাগসই পুঁজি উত্তোলনের উত্তম উৎস। এ বাজারে একইসঙ্গে ক্ষুদ্র, মাঝারি ও বড় পুঁজির মহামিলন ঘটে। এ বাজারের মাধ্যমে সুদবিহীন বিনিয়োগ ও পুঁজি সংগ্রহ করা সম্ভব। সরকারের উন্নয়ন প্রকল্পগুলোতেও পুঁজিবাজার সুদবিহীন অর্থের জোগান দিতে সক্ষম। অর্থ মন্ত্রণালয়ের উচিত হবে এ সক্ষমতাকে কাজে লাগানো।
ফজলুল বারী : সিনিয়র সাংবাদিক, পুঁজিবাজার বিশ্লেষক
